এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সময় ও কয়েকজন

    Pradip Ray লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ নভেম্বর ২০২০ | ৮২৯ বার পঠিত
  • একটা লেখা। অনেকে মিলে। নাম গুলো জানাব সময় মত। এখনও যোগ বিয়োগ করা যায়। বাংলায়। আমাদের বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া, বুড়ো হওয়ার এন্থোলজি। আমি এখানে আস্তে আস্তে পরিবেশন করলাম। পড় ও মতামত জানা। প্লীজ। কিছু যোগ করতে চাইলে পোস্ট করিস। এডিট করে জুড়ে নেব। ৪২ জনই কেন ধ্রুবক !! ৪৩ হল আজ। আমি সবাইকে অনুরোধ করছি। সকলেরই বয়স হয়েছে। এখন আর এসব ভাল লাগে না। আমার কাজ শেষ। দিলীপ, বীরেশ, বিশু, উদয়ন, মানস, উজ্জ্বল, কল্যান ও আরও কয়েকজনের লেখা এতে আছে। মন্তব্য পেলে সবাই খুশী হবে।

    সময় ও কয়েকজন।

    আজ আমার মনটা খুব খারাপ। গত তিন বছর আমি এই দিনে দশ কিলোমিটার পথ হেঁটেছি। সাথে হাজার হাজার লোক। কিন্ত আজ আর সম্ভব হল না। হাঁটুতে বেশ ব্যাথা। সময়ের কোপ। একটু চোখ বুজে থাকলে দেখতে পাচ্ছি সেই চলা। একসাথে সবাই ছুটছে, কেউ হাঁটছে সমাজকে কিছু দেবার জন্য, ক্যানসার রিসার্চ ফান্ডে। আমি আজ বাতিলের দলে। বুঝতে পারছি খেলা ভাঙ্গার খেলার দিন এসে গেছে।

    আমার বাড়ির পিছন দিকে একটা বেশ বড় লেক আছে। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে ওখানে ছিপ নিয়ে বসি। কোন দিন ধরা দেয়, আবার কোনদিন দেয় না। মাছেরাও আমার সাথে খেলা করে। ওদের ওই খেলা দেখলে আমার জিদ চেপে যায়। তখন মাছেরাও ধরা দেয়। মাঝে মধ্যে ছেড়ে দেই, বলি যা বেটা, বেঁচে গেলি।

    যম বাবু কি আমাদের এই রকম ধরছে আর ছাড়ছে?

    ৭৫-৮৫ এসে গেল। দেখতে দেখতে বয়স মাঝ গগনের দিকে এগোচ্ছে, দ্রুত, অতি দ্রুত। উপার্জন, প্রমোশন, বিদেশ যাত্রা, বিবাহ, সন্তান, স্কুটার বাইক গাড়ি, দায়িত্ব, নিকটাত্মীয় বিয়োগ -- জীবনের গতি ঊর্ধশ্বাস। মধ্যবয়সে এ আর এক নতুন ছুট। আড়ালে আবডালে, কখনও বা অলজ্জ্ব সমূখে। এ ছোটায় সমষ্টিগত ঘৃণা নেই; প্রতিহিংসা নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির এই দৌড়ে কখনও ভয়ে, কখনও আতঙ্কে আমরা সবাই সামিল। হোঁচট খাই।

    টলমল পায়ে উঠে আবার দৌড়াই। স্হিতু হওয়ার সময়। অহঙ্কারী হওয়ারও। আমি সামনে ও পেছনে ভাবার কাল। উল্টোটাও। সামান্য জাবর কাঁটা শুরু হোল বলে। পানসি এগোচ্ছে।

    খুব মন খারাপ হয় যখন চেনা মুখেরা অচেনা হয়ে যায়। দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টাতেই পারে। পৃথিবীর কিছুই স্থির নয়। কিন্তু অকারণে, অদরকারে, বিনা প্ররোচনায় যখন চেনা মানুষ টা অচেনার মতো ব্যবহার করে, তখন মনে হয় "না, এবার গোটাবার সময় হলো।" যা বিশ্বাস করতাম, তার অনেকটাই ভাঁওতা, মেকি। জীবনে সার শুধু আখের গোছানো। নিয়ে যাব বোধহয়। কোথায়? অন্তরীক্ষে। আর একটা ব্যর্থতা।শেষ। পানসী আমার চোরাবালিতে ঠেকে গেছে। জোয়ার এলে কি হবে জানি না। স্হাবর। জঙ্গম তোমরা করো। আমি দুর থেকে দেখবো। তবে মুখোশ হতে সাবধান।

    সম সাময়িক সময়। অনেক কষ্ট, নৈরাশ্য, আশাভঙ্গ। জীবন যে রকম। মেনে নিতে নিতে মেনিমুখো। নাকি আমরা অনেকে মুখোসের আড়ালে বীর। একা কুম্ভ কি রক্ষা করতে পারবে? শহীদ হতে আপত্তি কোথায়? মনে আছে এই তো সেদিন ডালহাউসির রাস্তায় আমাদের কাউকে উদোম কেলাল। পথচারীরা বলে মিটিয়ে নিন। কিসের মেটান তাই তো পরিষ্কার নয়। একা একা প্রতিবাদের সময় আছে আর !

    অমোঘ কিছু চাপ। প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে। স্ব-স্পৃহাও উপেক্ষনীয় নয়। সময় বড় কম। যেটুকু বা পাওয়া যায় তাতে সবকিছু গোছান অনেক জরুরী। স্বপ্ন দেখি; এখনও দেখি। তবে ফেডেড। মাঝখানে অনেক চিত্র বিচিত্র, ছিদ্র, অনর্থক, অসম্পূর্ণ। অতীতমুখী।

    -২-

    স্মৃতির অনেকগুলো থাক। পাশাপাশি, ওপরনিচে। যা চোখে পড়েছে, ঘটেছে, কানে এসেছে সব জমে গেছে। একটার সাথে আর একটার যোগ কখনও স্পষ্ট, কখনো ক্ষীণ, আবার কখনও মনেই পড়ে না। মাঝে মধ্যে ঝালিয়ে নিলে তাকগুলোর ধূলো ঝাড়া হয়ে যায়। কিছু কিছু তাকে জং ; কিছু পুরোপুরি হারিয়েও।

    মস্তিষ্ক বড় জটিল ব্যপার। কেন কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য হারিয়ে যায়, কেন কিছু মনে বাসা করে তা আর জানা হোল না। সাধারন মানুষ থেকে তাবড় বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যে ভরা মগজের কান্ড কারখানা। স্মৃতি আনন্দ দেয়, মেদুর করে, যন্ত্রনা আনে; চরম চেষ্টা করেও অনেক সময় কিছু মনে পড়ে না; পর মুহূর্তে হুড়মুড় করে সব মনে পড়ে যায়। ঘটনা পরম্পরা মানে না। এর মধ্যে ওটা, ওটার মধ্যে সেটা হামেশাই ঘটে। রামকে ভাবলে শ্যাম, আলিপুরদুয়ারে আলিপুর। স্বপ্ন থাকে, বাস্তবও। মিলে মিশে, এর ঘাড়ে ও; সত্য মিথ্যা বহাল তবিয়তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

    রাত দশটায় আলো নিভিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। গ্রাম্য মফঃস্বল বা বলা যায় মফঃস্বলীয় জায়গা। চারিদিক সুনসান। বাইরে গাছের পাতার সর সর শব্দ। সদ্য সদ্য তুমুল ঝড় বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ঝড় থামলেও টুপটাপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। গাছে জমা জল টুপটুপ করে নিচে ঝরছে। কিছু চলায় জমা পাতার ওপর সর সর শব্দ। সাপ নাকি ? ব্যাঙের ডাক, পাতার আওয়াজ, লোড শেডিং, নিকষ কালো অন্ধকার মনে কেমন উদাস উদাস ভাব আনে। কালহীন। পরিচিত শব্দহীন; আগামী নেই, গত নেই, কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ বিহীন চরাচরে এমন স্থির হওয়া সময়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা রহিত এক অদ্ভূত অনুভূতি। জীবন মৃত্যুর আলাদা অস্তিত্ব বিলীন। একা একা এই বসে থাকা বিষাদগ্রস্ত করে।

    ছোট একটা নাইটক্যাপ চলবে। সময় কাটে; রাতে ভাল ঘুম হয়। সকালের কাজকম্ম ও ঠিকঠাক হয়। ওকে। এবার আবার একা। আর একটা মেমরির তাক।

    -৩-

    স্মৃতির এই ভাঁড়ার অনেকটা মর্গের মত। সেরকম বিরাট বড় একটা ঠাণ্ডা ঘর, পাশাপাশি ঠাসাঠাসি উচু উচু র‍্যাক; নিচু ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ। ট্রেতে করে স্মৃতি সাজিয়ে ঢুকিয়ে রাখা। সব মৃত। ভাবলেশহীন উলঙ্গ শবদেহ। খুব ঠান্ডা; বেশীক্ষণ এখানে থাকা যায় না। একটা ডালা খুলে দেখে পরম্পরা মেনে পাশে রেখে দি। জায়গাটা ফাঁকা দেখে আর একটা তাক আপনা থেকেই সে জায়গায় চলে আসে। কিছু কিছু স্মৃতির আবার নট নড়ন চড়ন। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে আপনাপন জায়গায়। কখনো নতুন স্মৃতির অভাবে কোন জায়গাঁ ফাঁকা পড়ে। অনেক টানাটানিতেও কোন কোন তাক খোলে না। জং ধরে আটকে গেছে।

    এ সবই আমার,আমাদের মনে হয়। মরবিড, ধূসর স্মৃতির ক্ষেত্রফল। আলপথে আপনমনে পায়চারী। এটা টানি, ওটা খুলি, ওটার ধূলো একটু ঝাড়ি। দু একটা অদল বদল ও হয়ে যায়। ঠান্ডা ভ্যাপসা গন্ধে অল্পেই হাঁপ ধরে। তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় একটু দাঁড়াই। পরক্ষণেই অমোঘ টানে আবার ঢুকে যাই ঐ শবাগারে।

    এখনো রক্ত ফুটে উঠে। হয়তো এটাই নিয়তি। প্রেক্ষাপট ভিন্ন, বয়স ভিন্ন, কিন্তু মানসিকতা টা সাংঘাতিক ভাবে একই। ভয় আর পাইনা। স্বার্থপর হয়ে গেছি। সব পার্থিব দায়িত্ব শেষ। এবার তোর মরা গাঙে যদি জোয়ার নাও আসে, তাও ভাসা পানসী। তুমি হারো কিম্বা আমি হারি। নো ছাড়াছাড়ি।

    -৪-

    যুক্ত হোক স্মৃতি। ভান্ডার বাড়ুক। '৫৯ এ একবার বিচ্ছিরি ভাবে পা টা কেটে গিয়েছিল না ! দেখিতো কতটা কি মনে আছে। সেই রিক্সায় চাপিয়ে ডিসপেনসারি, বাগবাজার স্ট্রীট; সেলাই, বেনজিনের গন্ধ। ধরাধরি করে বাড়িতে ফেরত। ব্যস ! জ্বর হয়নি? স্কুল কামাই? কিবার ছিল সেদিন? আর কিছু লেখা নেই, মনে পড়ছে না। গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। একটু ভাবি কোন সময়টা বেশী মনে আছে।

    ১৯৬৪-৬৬ সময়টার ডালা খুলি। বড্ড ক্রুশিয়াল পিরিয়ড। স্বপ্ন ও কল্পনা দিয়ে তৈরি। আস্তে আস্তে গোছাতে হবে। ১৯৬৪র তাক টা টানি, জমা খরচের হিসেব একটু দেখি। জায়গামত গুছিয়ে রাখি। সবে শরীর বুঝতে শিখেছি। নাইট ইয়ে হচ্ছে। লজ্জ্বা পাচ্ছি। যে মেয়েদের সাথে ছোট থেকে বড় হয়েছি তাদের মুখের দিকে তাকাতে লজ্জ্বা হচ্ছে। আবার লুকিয়ে তাদের দেখছিও। অসহ কিছু ব্যথা, না বলা কিছু দুখ্যু। কিন্তু ইতিহাস কোথায় ? পাড়ার কূয়োর জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি স্কুলে।

    প্রায় সব নিম্নবিত্ত পাড়ায় মারামারি তখন দৈনিক অনুসঙ্গ। কারণের অভাব থাকলেও কারনের অভাব হত না। ক'লকাতায় স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন গন্ডগোল ও মনোমালিন্য আরম্ভ হয়ে গেছে।পরিবার ভিত্তিক বা পারিবারিক অন্তরকলহ নয়। বিভিন্ন অঞ্চলে গুন্ডাশ্রেণীর এক ধরনের যুবকের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। স্কুল ড্রপ আউট, অভব্য, রুক্ষ, কলহ প্রবন, বুক চিতিয়ে কলার তুলে এঁকে তাকে অসম্মান করার প্রবণতা এদের প্রায় নেশা কাম পেশায় পরিণত। রাজনীতি এরা এড়িয়ে চলে। রাজনীতিও এদের। রংবাজ মস্তান এ বিশেষন গুলো এদের জন্য।

    শহরের আকাশে বাতাসে এক ধরনের অশান্তির বীজ বোনা হলেও মধ্যবিত্ত ভদ্র সমাজের গায়ে তার আঁচ তেমন করে লাগেনি। (এর অনেক পরে লুম্পেন বলে সম্বোধন করে এদের মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণ্ণী। কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ।) চোরা গোপ্তা রিফিউজিদের আগমন, ফ্রেট ইকোয়ালাইসেশনর সুফলে অন্য রাজ্যে হেভী ইন্ডাস্ট্রি খুলছে। বেকারি বাড়ছে আমাদের রাজ্যে। লেখাপড়ার মান পড়ছে (আজ বাংলা মাধ্যম স্কুলে কারা পড়ে? আমাদের সময় এ জিনিস দেখিনি।) ভয় দেখিয়ে ছিনতাই, ছোট খাট চুরি, রেল স্টেশনে চোলাই এর ব্লাডার পাচার, খেপে খেলে দুটো পয়সা রোজগার ক্রমশ গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। অশান্তির বীজ কিন্তু জমা হচ্ছিল।

    -৫-

    ১৯৭৮, ব্রুকলীন, ম্যানহাটনের অলি গলি ঘুরে সমস্ত দিনের ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসি। গাড়ীর ইন্জিন বন্ধ করে বসে থাকি গাড়ীর ভেতরেই।বাড়ীটা র দিকে তাকাই, চিনতে পারিনা। এ আমি কোথায় ? কার বাড়ী ? এ বাড়ী তে থাকেই বা কে!

    শীতের পড়ন্ত বিকেল, সন্ধে ছুঁই ছুই। অবেলায় দুপুরের ভাত খেয়ে গভীর ঘুম থেকে ওঠা বালকটি চোখ কচলাচ্ছে। সমস্ত বাড়ী শুনশান, মফঃশ্বল শহরের রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। ঠাম্মি বেলতলায় প্রদীপ দেখিয়ে প্রনাম করছেন; মা সদ্য বাড়ীতে আসা বিজলী বাতির নীচে সোয়েটার বুনছেন। হঠাৎ এক ঝলক হাসি, হৈ হৈ করতে করতে পাখিদি ঢুকল। ধবধবে ফরসা আমার পাখিদি; ছিপ ছিপে লম্বা শরীরের গঠন। ঘন নীল আর হলুদ ফুলের ছাপা শাড়ীতে ওকে দারুন ঝকমকে দেখতে লাগে। ছোট্ট নাক ছাবির হীরেটা জ্বল জ্বল করছে। মার কাছে শিখতে এসেছে ব্লাউজ কাটার পদ্ধতি।রাংতায় মোড়া টফিটি খুলে আমার মুখে পুরে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে গাল দুটি টিপে আমায় আদর করল "জানিস, এ পাড়ায় শুধু আমার আর তোর গালে টোল পরে" আবার আদর।

    আমি গাড়ীতে মাতালের মত বুঁদ হয়ে বসে আছি, বিগত চল্লিশ বছরের দাঁড়ি কাটা খর খরে গালে হাত বুলিয়ে টোলটা খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি !

    -৬-

    ১৯৭০ এর কোন এক সময়। লোকালে তখন অল্পবয়সীরা কমই থাকে।আমি তো এমনিতেই থাকি না। কি একটা কারনে সেদিন এসেছি। একটু রাত্রের দিকে শুনলাম কুম্বিং হবে। তখন গোটা পশ্চিমবংগে এটা নিত্যকার ঘটনা। সময় মত খবর পেলে অন্যত্র চলে যাই। পরিভাষায় যেগুলোকে শেলটার বলে। রাতে মাথা গোঁজার জন্য এপাশ ওপাশ ছড়ান কিছু আস্তানা। তেমন অসুবিধে হয় না। রাতটা কাটিয়ে ভোর ভোর আলো ফোটার আগে বেরিয়ে পড়লেই হোল। কিন্তু সেদিন খবর টা পেলাম দেরীতে। গাড়ী বন্ধ। সাইকেলও যে যার তুলে দিয়েছে। অগত্যা বড়রাস্তার ধারে একটা বন্ধ দোকানের মধ্যে আমরা কয়েকজন জুটে গেলাম। দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে বাইরে বুটের আওয়াজে তারা এসে গেছে বুঝে গেছি। দুতিনজন এসে দোকানের সিঁড়িতে বসে বেশ জোরেই গপ্প জুড়ে দিল। বাকরুদ্ধ ও শ্বাসরুদ্ধ অবস্থাতেও নিজেদের নাম শুনতে মন্দ লাগল না। হিসি চেপে আছি; বায়ুত্যাগ করারও উপায় নেই। ফুটোফাটা দিয়ে বেরোলেই....। কিভাবে দুঃস্বপ্নের মত রাতটা কাটল!

    ঐদিন বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে মারা হয় আমার এক স্থানীয় বন্ধুর বোনের প্রেমিককে। তার বাবা তখন সর্বভারতীয় মার্কেন্টাইল ফেডারেশনের সভাপতি। বর্তমানে এমপির তূল্যমূল্য। বাইরের আর্তনাদ ও চীতকারে বাইরে বেরোলে বুটের লাথি জোটে। তার বোনের অবশ্যম্ভভাবী মানসিক বৈকল্য হয়। কিন্তু সে অন্য গল্প। মনে পড়ছে না সে রাতটা পূর্ণিমা ছিল কিনা। ঝলসানো রুটির অনেক গুরুত্ন তখন। প্রসঙ্গত প্রায় ৫০ বছর বাদে সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম। স্মৃতি কী বিশ্বাসঘাতক! কোন কিছুই চেনা লাগল না। ভাগ্যিস রাস্তায় একজন পুরোনো পরিচিতর সাথে দেখা হয়ে গেল!

    -৭-

    একাত্তর। বরাহনগর। প্রচন্ড ত্রাস। নিঃস্ব বিশ্বাস। বেলেঘাটা। মনে ওড়ে। সর্বানী। এখনো তোকে ভুলিনি। রজত পরিতোষ। শেষমেষ গায়ে আমার বরুয়া গলা; পায়ে আমারই কোলাপুরী। কি আপশোষ। একদম নতুন কেনা ! আর কদিন ওটা পরা যেত না সুদীপ! কায়দা মেরে থানার সামনে দিয়ে কে তোকে যেতে বলেছিল ? আর কত নাম করব? এদিকে সত্তর একাত্তরেই প্রথম টাই; ক্যাম্পাসিং।

    সত্তরের কলকাতা। রবীন্দ্র-বিদ্যাসাগরের স্ট্যাচুর গলা কাটা কলকাতা। ভাই ভাইকে খুন করার কলকাতা। রাইফেল ছিনিয়ে হত্যা করার কলকাতা, আমার চেয়ারম্যানের কলকাতা। পুলিশ বলে, যা দৌড়ে বাড়ী যা - পেছন থেকে গুলি করার কলকাতা। কিশোরেরা সবে যৌবনে পা দিয়েছে, টগবগে রক্ত, চন মনে ভাবনা। পৃথিবী কে অন্যায় মুক্ত করার স্বপ্ন। দাদারা নেতা্রা তাত্বিক আলোচনা করেন, সে মিটিংএ যায়, মন দিয়ে শোনে; কিছুই বোঝে না।

    দাস ক্যাপিটাল কি ? মেনিফেস্টো। রেড বুক। লিন পিয়াও। আ্যকশন আর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। বিভ্রান্ত ! চারিপাশে শ্রেণীশত্রু। নীতি গত ভাবে সব বর্জন, লারে লাপ্পা হিন্দি সিনেমা, প্রেম পূজারী, কফি হাউসে গিয়ে মেয়ে বন্ধু দের সাথে দাঁত ক্যালানো, বীয়ার খাওয়া। বিভ্রান্ত যুবক একা একা ফাঁকা মাঠে হাঁটে, আরও হাঁটে .... দৌঁড়য়,দৌঁড়য়। এ কিসের দৌঁড় ? কার কাছ থেকে পালান ? কোথায় গন্তব্য। সেই বাক্যবাগীশ দাদা, লেডিস হষ্টেলের লেকের পাশে রাতের অন্ধকারে ঘন হয়ে এক শালের নীচে বান্ধবীর সাথে। শীত করে। আরও জোরে দৌঁড়য় !

    পরীক্ষা শেষ, রাতের শো তে সিনেমা দেখে ঘরে ফেরা। চারদিক শুন শান, নিস্তব্ধ। শুধু কয়েক টা সি আর পি ট্রাকের আনোয়ার শা রোড দাপিয়ে যাওয়া, আসা। পরিচি্ত দোকানে এক বোতল কোকাকোলা খেয়ে, চারমিনারের প্যকেট নিয়ে হস্টেলের ঘরে ঢোকা। জানে ডাইনিং হলে খাবার নেই, নবীনা সিনেমায় ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রী করা বাইরের সব মস্তানদের মুক্তাঞ্চল এখন মেইন হষ্টেলে। শংকরের "বোধোদয়" বইটা খুলে পড়ার চেষ্টা করে, বাইরে বিকট শব্দে কোথাও পেটো ফাটে .......

    তখনই বোধহয় শীর্ষেন্দুর ঘুণপোঁকায় শ্যাম ঘুরপাক খায়; সুনীল নীরা ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করে ৷ গোগ্রাসে পড়ি ৷ সেই সময়ে সুনীলের আরেকটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো৷ তার একটা লাইন এখনও মনে আছে ... আইস খুকি আমারা স্বর্গের উদ্যানে ছোটাছুটি করি ৷ উপন্যাস টা সরল সত্য ৷আমাদের জীবনের ভালো মন্দ সবকিছু ৭০ এর দশকে জড়িয়ে আছে ৷ মুক্ত অঙ্গনে নাটক হবে পরশুরামের চিকিৎসা সংকট,তারিণী খুঁড়ো ৷ স্টেজে হুঁকো নিতে ভুলে গেছি। আলোকসম্পাতে দেবনাথ ৷ওপর থেকে উদোম খিস্তি ৷ কালো লম্বা রোগা হাঁটু পর্যন্ত্ কাপড় সামলে দৌড় দৌড় ! হুঁকো আনতে ৷ দর্শকের কি হাসি৷

    এ সময়ই তো দেখো রে নয়ন মেলের সময়। এত কিছু একসাথে দেখার! কোনটা ছাড়ি, কোনটা ধরি। চুনী বলরাম গোল দেয়, কানহাই মধ্যাহ্ণ ভোজনের আগে ১০০ করে। ভিয়েতনামে নাপাম পড়ে। সাত্র এসে কড়া নাড়ে। নীরা চুলোয় যায়। যমুনা রুমাল ওড়ায়। শ্যাম ঘুরপাক খায়। বৃত্তের কী সুররিয়ালিসটিক ব্যঞ্জনা। রাস্তায় নতুন রাজাকে বামপন্থী লাল রঙে স্বাগত জানাই।

    ভাইস চ্যন্সেলার খুন, পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় বার। ভারত বর্ষ কেঁপে গেছে। আ্যকশনের গন্ধ কদিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল ! মৃত দেহ আনা হয়েছে, টীচার্স কোয়টার্র এর আঙিনায়। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গেছি, স্ত্রীর আর্তনাদ ... ও গো তোমার ছেলেরা এসেছে তোমাকে শেষ দেখা দেখতে !! লাইব্রেরি র কোনায় এসে বমি করলাম। আজ ও ঐ আর্তনাদে মাঝে মাঝে রাতের ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘামে ভেজা নরম বিছানায়।

    -৮-

    কে জানে কীভাবে শুরু হতো দিন কী ভাবে রাত। বারুদের গন্ধ রাজপথে লাস। পটাপট নিভে যাওয়া বাতি। যেন কার্ফু লেগে থাকে সুন সান অলিগলি এবং বড় রাস্তায়। ভারী বুটের শব্দ বোমা গুলির আওয়াজ মিলিয়ে গিয়েও মিলিয়ে যায় না। মুখে কুলুপ। পুলিশের ব্যাটন। থানার ভিতরে আর্তনাদ। এনকাউন্টার। জলভাতের মত। মূর্তী ভাঙ্গা গননিধন যজ্ঞ। কলকাতা একাত্তর। এখন শান্তি; শান্তি। কত যুগ হল? রাত কত প্রহর? এই তো হরষে বিলাসে অবসর জীবন যাপন। এখন স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন কিছুই দেখি না। রাজনীতির চেহারা বদলাচ্ছে। সবই দেখি সবই বুঝি। কে মাথা ঘামায় ? মল কালচারে গা ভাসিয়ে লাটক সিনেমা দেখে চিল্ড বিয়ার বা বরফে চোবানো হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে আর মেলাতে চাই না। একা থাকি, একা চলি; একা একা কথা বলি। অকিঞ্চিৎকর,মৌনমুখর। অবাঙমনসাগোচর। ভিন্ন ভিন্ন সুরে, ভিন্ন কন্ঠস্বর। কে যায়? পরিচিত পদশব্দ। সময় সাঁতরায়।। স্মৃতিভ্রম? কোন বার্তা এনেছে কি? উড়ন্ত পারাবত পাখি? এখানে ওখানে বিপদ অতি সন্তর্পণে গুঁড়ি মেরে আসে। এবার এসেছে সময়। খুলে দাও সমস্ত অর্গল। বাঁধ ভেঙে আসুক জোয়ার।

    বড় বেশি নিম্নচাপ লাগছে না ! রক্তের লাল, বিষের সবুজ, ভয়ের হলুদ। হতাশার রামধনু। একটু মুক্ত হাওয়া বয়ে যাক না। স্মরগরল তো আমাদের চিরসাথী। কখনো কি অমৃত ওঠেনি সবার জীবনে?

    গ্রামের নাম টা সুভাষগ্রাম। যাদবপূরের অনেক পরে। বঙগবাসী মরনিং। ছিপছিপে তন্বী। একবেনী মোটা অলকগুচ্ছ। নাম ? মালতী কি মাধবী, ভুলে গেছি। থাকনা নামটা আমার কাছেই। কলেজ শেষ হতো, আমাদের শুরু হতো। শেয়ালদহে রোজ এক বিশেষ কামরা। আধ ঘন্টা কখন শেষ। যাদবপুর এসে গেছে। নামার পালা। আবার কালের আশ্বাস। আগামীকাল।।

    একদিন সেই নিয়মানুবরতিতা এক ঝটকায় উড়ে গেল। কলেজ সাইনে ডাই। আমিও আত্মগোপন। ঘর ছাড়া। খবর দিতে পারিনি। আমার বনলতা।।এখনও মাঝে মাঝে বারুইপুর যাবার পথে বাঁদিকে তাকিয়ে থাকি। পুকুরের আল ধরে যাতায়াত ছিলো। পুকুরটা এখনও আছে। যদি আর একবার.........।

    বাকিটা সাইনে ডাই।

    -৯-

    ১৯৬৭র ডালাটা খোলা দরকার। আরম্ভ করেছিলাম। মাঝে মনে হোল নিম্ন চাপ লাগছে। ঠিকই। তবে ব্যপ্তিটা অনেকটা বেশী বলে সময়ে অন্য রঙ্ ও আসবে। সবারি জীবনে রামধনু আছে, আসে। কোন রঙ বেশী; কোনটা কম। প্রতিটা প্রত্যয়ের পেছনে একটা উপসর্গ থাকে। জীবন ভাঙা গড়ায় যার অবদান অনস্বীকার্য। ৬৭ সেই ঘৃতাহুতি। দেশে বিদেশে তখন শুরু হয়েছে নতুনের গান। প্রথম ভোট। বয়স না হলেও লিস্টে নাম ছিল। এছাড়া ফলস দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলাম। দেশলাই কাঠির পোড়া দিক দিয়ে দাগ তুলে। ব্যপারটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় নি। যুক্তফ্রন্ট জেতার পরে রাস্তার মোড়ে লাল আবীর নিয়ে ব্যপক নাচানাচি। পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় একটা রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের সূচনা পরিষ্কার। বহুদিনের কংগ্রেসী শাসন পরিবর্তন হয়ে বামপন্থী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারনে পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থী আন্দোলনের ধাতৃভূমি হয়ে উঠেছিল। বাস্তুহারা দের আগমন,ক্রমশঃ তাদের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পেয়ে এবং শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার পাশা পাশি মূলতঃ বামপন্থী পথে এবার তারা আস্তে আস্তে বৃহত্তর শাসন ব্যবস্থায় ভাগ নেওয়ায় উৎসাহিত হয়ে উঠল।

    শিক্ষাক্ষেত্রও আস্তে আস্তে তৈরী হচ্ছিল। এই যে্রকম সচরাচর হয়। উনিয়নে নতুন মেধাবীদের যোগ দেওয়া, শিক্ষার কিছু নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনা, নতুন নতুন গান, কবিতা অভিনয়, স্থানীয় স্তরে কিছু এগিয়ে থাকা মানুষের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদির মাধ্যমে চেতনার সমৃদ্ধ হওয়া শুরু। বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারা যাচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এক নতুন আদর্শ, নতুন বিশ্বাস ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, কিউবা, আলবেনিয়া, সবর্ণ, চে, কাস্ত্রো, হো ইত্যাদি সম্বন্ধে কফি হাউস ক্যান্টিন ও বুদ্ধিজীবি সমাজে উত্তেজিত তুফান উঠছে। নতুন নতুন দর্শণে তখন পৃথিবীকে প্রায় আড়াআড়ি ভাগ।

    এবং মাও ৎসে তুং। একটা অঘোষিত ঝড়ের মত এই নাম ও আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ সত্য অসত্য কল্পনা মিলিয়ে মিশিয়ে সর্বত্র আশার, নতুন সূর্যের হদিশ দিচ্ছে। অনেকের কাছে সেই সব কাহিনী এসে পৌঁচ্ছছিল।মানুষ চিরকালই বীরের পূজারী। সে বীরত্ব নিঃস্বার্থ হলে তো আর এক কাঠি। চেতনায় বিদ্রোহ বিপ্লবের বীজ রোপন হয়েছিল সেই চার অধ্যায়, ঘরে বাইরে,বিদ্যাসাগর, রামমোহন,যুগান্তর অনুশীলনের হাত ধরে। কিছুটা পড়ে। অনেকটা শুনে্। ঐ অন্য ধরনের তাত্বিক বইও তখন ছাত্ররা গোগ্রাসে গিলছে। মার্ক্স,এঙ্গেলস,লেনিনের সাথে সাথে সেই সময়ের সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতির খবর ও নিচ্ছে। একই সাথে নিজের দেশের ইতিহাস,দেশ বিভাগ,র‍্যাডক্লিফ লাইন, কাশ্মীর তেলেঙ্গানা তেভাগা ইত্যাদিও কেমন যেন নতুন শিহরন পাঠান শুরু করে দিয়েছে।

    সেই সময় ৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন। মূলতঃ শ্রমিক, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠিত করার দিকে নজর ছোট বড় বামপন্থী দল গুলির। কার সংগঠন কতো বড়, সেই লড়াই থেকে আত্মঘাতী সংগ্রামের সূচনা হলো। পোষাকী নাম শরিকী সংঘর্ষ। প্রাণহানি অনেক হলো। চারদিকে কিছু হলে চলো যাই ঘেরাও করি। ইংরেজী অভিধান নতুন শব্দ পেল...। ঘেরাও।

    শরিকী সংঘর্ষ ঠেকাতে গিয়ে এক পুলিশ কনষ্টেবলের মৃত্যু হলো সুন্দরবনের বাসন্তীর গ্রামে। ক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মীরা মৃতদেহ নিয়ে চলে এলেন মহাকরণ।

    সেই ঘেরাও।। এর অনেক পরে ৭০ এর শেষ। সেটা ছিল বুধবার।ফ্যাক্ট্রিতে ইনসেন্টিভ ডিক্লেয়ার হবে।সকাল থেকে ঘরের সামনে স্লোগান চলছে।আর রীতিমত গালাগাল।

    ঘরের ভেতরে দুতিন জন। উত্তেজিত গলায় বাদানুবাদ। ক্রমশ চড়া স্বর খাদে নামে। খাতাকলম বেরোয়। টাকা পয়সার হিসাব। অনেক রকম। লাভ লোকসান। শ্রমিকের ভবিষ্যৎ খাটনির খতিয়ান। নেতাদের না বুঝেও কত বুঝেছি মুখ। এভাবে দু তিন ঘণ্টা চলে যায়। এবার সই সাবুদের পালা। সব মিটতে মিটতে ৩টে।

    তার বিবাহ সেদিন। জানান হয়নি এদের। অনুমতি চাওয়া হোল এবার বিবাহ করতে যাওয়ার।

    শ্রমিক কুল সামান্য অপ্রতিভ। গঞ্জনা কেন আগে জানান হয়নি বলে।

    হাসতে হাসতে মনে করিয়ে দিতে হয় তাদের মালিকের ছেলেরও আজই বিয়ে। গত সাত দিন ধরে সে কারনেই ওরা কেউ কারখানায় আসছেন না।

    একটু কান্নাও কি কোথাও ছিল ? সত্যিকারের মালিককে চিনতেই পারল না।হাতের সামনে তাদের প্রতিনিধির ওপরেই সমস্ত রাগ।

    যেমন রাস্তার ট্রাফিক পুলিস বা নিরীহ পথচারী নিধনে কয়েক বছর আগে দেখা গেছে !!

    -১০-

    আবার একটু কলেজ জীবন যৌবন। প্রথম চুমু। আহা,কি আনন্দ; বিচমে নাক আসে নি, কিন্তু কাটলেট ওয়ালা এসে গেছে গন্ধে গন্ধে। গচ্চা গেল। চুমুটাও পানসে হোল। আরও কি কি সব ভেবেছিলাম, সব ভোগে। এর চাইতে ক্যাম্পাসের গলতা বেটার ছিল। এর পর কত দিন কেটে গেছে। জীবনে মোট কতগুলো চুমু খেয়েছি কাউন্ট রাখিনি,কিন্তু ঐ ফার্স্ট কিসিটা একেবারে সেঁটে আছে।আচ্ছা, তখনো তো বল্লমে কনডোম পরাতে হতো। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তো মৌলবাদী থেকে আসেনি, এসেছে বামপ্রবাদ পুরুষদের থেকে। আমরা শুনেছি : "পুলিসের গুলিতে নিরোধ পরানো থাকে।"

    অত্যাচারের ভাষা সব সময়ই এক। সয়ম পাল্টায়, ভিত অপরিবর্তিত থাকে। তখন বুঝিনি। আসলে আমাদের মুভমেন্ট ওয়াস ওয়ে এহেড অফ ইট্স্ টাইম। মনে পড়ে মহীন গৌতমকে। সেও সময়ের আগে ছিল।

    ৬৯ এ রবিগানে বুঁদ। যা শুনি সব মুখস্থ করি। এমন সময় একজন বলল এ গান গাওয়া মানা। মানে? বুরজোয়া কবি। পরে আবার ইংরাজি তুলে দিয়ে বললো মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের ন্যায়। যতই বলি এসকেপিজম ভাল না, কিন্তু পালাতে পারি কই?

    -১১-

    ১৯৬৯ একটু আলাদা করে মনে পড়ে। যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের দি্নে প্রবল উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা মানুষে রাস্তাঘাট ছয়লাপ।মা্র্কস এংগলেস লেনিন চে প্যারী কমুউন, কামু কাফকা ফ্রয়ড সাত্র সমরেশ বসু বীরেন চট্যোপাধ্যায় হেমাংগ দেবব্রত শম্ভুতৃপ্তি উৎপল কল্লোল গন্ডার অয়দিপাউস হাংরী জেনারেশন অণু পত্রিকা মুক্তমঞ্চ ফিল্ম ক্লাব ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃ্নাল উত্তম সুচিত্রা হেমন্ত মানবেন্দ্র শ্যামল দের মধ্য গগন। পিকে চুনী বলরাম সুরজিত জংলা জার্নাল ছাত্র আন্দোলন সবর্ণে্ ভিয়েতনাম কিউবা মাও-- সব মিলিয়ে কলকাতা তথা সারা দুনিয়া তখন রোমাঞ্চিত। সে আসছে। এবং সে এলো। এখানে অশান্তির হাত ধরে। ২২শে এপ্রিল এতদিন লেনিনের জন্মদিন হিসেবে মনে ছিল। এখন তাতে নতুন নাম যোগ হোল।’৬৯-এর ৯-ই এপ্রিল জেল থেকে বেরিয়ে আসেন কানু সান্যাল। কোনও রকম সময় ব্যয় না করে তিনি কলকাতায় চলে আসেন ও চারু মজুমদারের সাথে দেখা করেন। সিদ্ধান্ত হয় নতুন পার্টি গঠনের। ’৬৯-এর ১-লা মে এক বিরাট জনসভায় কানু সান্যাল ঘোষণা করেন সিপিআই (এম-এল) গঠনের কথা।

    -১২-

    ৬৯-৭০-৭১। বেশ মাখো মাখো প্রেম পায় তখন। রবি ঠাকুর বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। শেষের কবিতা লাইন বাই লাইন ঠোটস্থ। সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দি। ৬৯-৭০ এ বিপ্লবের পথেও অনেক দূর। কিন্তু সে কথা পরে। এটুকু বলি যে যুক্তফ্রন্ট এসে গেছে এবং পিকিং রেডিও আমাদের রাত ৯টার স্টেপল ফুড। যাইহোক বিপ্লব যখন দোরগোড়ায় অনেকের মধ্যেই কিছু কিছু তাড়াহুড়ো। রাজনৈতিক বাতাবরন বেশ কনফিউসিং। লেখাপড়া ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার ডাক এসে গেছে। অনেকেই এটাকে বালখিল্য বলে তাচ্ছিল্য করছেন।সরোজ দত্ত কি মারা গেছেন ? পুলিসের খাতায় আজও পুলিশের খাতায় বা সরকারি নথিতে তিনি এখনও নিখোঁজ এত বছর পরেও। তবে ময়দানের ঘাসে তাঁর কবন্ধ লাশ ১৯৭১-এর অগস্টে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন কেউ-কেউ। সম্ভবত পত্রপাঠ তা লোপাট করে দেওয়া হয়। বহুস্বর ভারতীয় গণতন্ত্রে তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বর শাসকদের কাছে বড় বিপন্নতা সৃষ্টি করে থাকবে। তাই কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক সরোজ দত্ত ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান।

    আমাদের অনেকের ঐ সময় কাটে বড় বিপন্নতার মধ্যে। প্রেম করা বয়স ধর্ম। কিন্তু তা টেনে নেয় প্রচুর জীবন। তক্কে তক্কে থাকা খুনীদের হাতে বড় নিষ্ঠুর ভাবে শেষ হয় অনেক জীবন। রাজনীতি চুলোয় গেছে। শুধু একশন। প্রশ্ন করা বারন, ভালবাসা বারন।শ্রদ্ধা বারন। মহাপুরুষ মহিষী দের নতুন নির্মাণ। করছে কারা ? কতটুকু তাদের যোগ্যতা ? পজিটিভ কে যে নেগেটিভ কেমন করে আড়াল করতে পারে তার উদাহরণ প্রতি পদে পদে। কে যে বন্ধু, কে যে শত্রু সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। আমার মনের অবস্থা প্রায় সবার মনের মতন রাজনীতি নির্বিশেষে। অসহায়, দিকভ্রান্ত, মনে হাজারো প্রশ্ন।

    -১৩-

    ৭১। নয়ছয়। ভঙুর, ভাঙ্গছে তাসের মতো। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। মানুদা আর জ্যোতি দা সিঙ্গল মলটে মাখোমাখো। বিপ্লব দীর্ঘজিবী। হাবড়া লাইন। একটা স্টেশন। মাঝরাত। শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতাদের মদতপুষ্ট পুলিসের যমদুত। দরজাটা নেহাত শক্ত তাই ভাঙ্গেনি। ভদ্রলোক খুললেন। ছেলে কই? নেই। সার্চ করবো। ওয়ারেনট কই? পঁয়ত্রিশ বছবের যমদুত। বিরাশী শিক্কার চপেটাঘাত পঁচোষার্রধর গালে। শ্রেনী শত্রু বটে। এটাই ওয়ারেন্ট। আর চাই? মা সরালেন। বাড়ির আব্রু কোন কনডোমেই ঢাকলোনা।

    আজ যাচ্ছি। আবার আসবো। পেলে গুলি খর্চা করবোনা। মাথায় টিপে মারবো। ফিরে দাঁড়িয়ে মাকে, আপনি কি প্রেগনান্ট? না !? পেট ফোলা কেন? শাড়ি খুলুন। বলা যায়না ছেলেকে ------

    ফ্যাসিবাদী চেহারা সব সময়ই, সব জায়গাতেই এক। তা সে যেই হোক। লাল বা নীল সাদা বা গেরুয়া।

    বাদুর বলে ওরে ও ভাই সজারু
    আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু।
    জুটবে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা
    আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।

    আমরা সব সময় ইঁদুর। খুব কাটতে ইচ্ছে করে।দাঁতে জোর নেই। জিভে আছে।

    -১৪-

    আজ এখন
    আমার স্বদেশ এখন জেগে ওঠে ট্রামের ঘন্টায়,
    কুয়াশার আস্তরন, অ্যাম্বুলেন্সের হুটার,
    ট্রাফিক পুলিশের ওয়াকি টকি
    হত্যা, রেপ, রাহাজানি, যৌন নির্যাতনে শিশুর আর্তনাদে।
    জেগে থাকে
    ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা শপিং মলে
    পদ্মাবত আর এক থা টাইগারে।
    সারা রাত জেগে থাকে পার্ক স্ট্রীট হুল্লোড়।
    বিপ্লবের ঘোড়া চলে গেছে অজানা গন্তব্যের পথে
    চারিদিকে এখন শুধু
    সেফ ড্রাইভ; সেভ লাইফ।
    বিপ্লব এসেছিল টগ বগ ঘোড়ায়
    জিন দিয়ে;
    বিপ্লব এসেছিল ঘোড়ার খুড়ে
    আাগুনের ফুলকি নিয়ে।
    আমার মাতৃভুমি!
    বিপ্লবের গন গনে আগুনে পুড়তে পুড়তে
    এক সময়
    উঠে দাঁড়িয়েছিল গা ঝাড়া দিয়ে
    গায়ে ছিল আগুনের আঁচ।

    তারপর---

    অজস্র বুলেটের ক্ষতে
    বোমার আঘাতে
    ছিন্ন ভিন্ন দেহ;
    কেউ হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেল
    আরও আগুনের গহ্বরে
    কেউ আবার উঠে দাঁড়িয়ে
    চিৎকার করে বলে ওঠে -
    'সব ঝুট হায়';
    বেইমান, বেইমান সব বেইমান!

    আমি বেঁচে আছি। আমরা বেঁচে আছি। মরা মানুষের মৃত্যু নেই। হাজার বছর ধরে তারা পথ হাঁটে। ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই; ক্লান্তি নেই। শুধু পথ চলা। কাব্যিক ছন্দায়নে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন