আমাদের জীবনের অনেককিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা, এরকমটা আগে মনে হতো। এখন বুঝি যে আমাদের জীবনের কোনওকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। মাঝে মাঝে এই সারসত্য ভুলে গেলে মহাজগৎ মনে করিয়ে দেয়। নিজেই সংকেত পাঠায় আবার যে, আসলে ঠিক এখানেই থাকার কথা ছিল এই মুহূর্তে। আগেরদিন একটা লেখায় ব্যান্ডেলের বাড়ি ছাড়ার সময়ের কথা লিখেছিলাম; কীভাবে পন্ডিচেরির অরোভিল নিকটবর্তী অঞ্চলে পৌঁছতে গিয়ে কলকাতার অরবিন্দ নগরে এসে আবিষ্কার করলাম পাড়ায় একটা অ্যাপার্টমেন্টের নাম অরোভিল। সেই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে হয়েছিল ২০১৬ সালের ৩১শে অক্টোবর। বেরোনোর কথা ছিল না, বেরোতে হয়েছিল। সেখান থেকে পাটুলি কিউ ব্লকের এই বাড়িতে এসে আবিষ্কার করলাম উল্টোদিকের জংলা জমিতে বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে গিয়ে মাথার ওপর থেকে একটা বই মেঝেতে পড়ে হাট হয়ে খুলে গেলো। বইয়ের পাতায় লেখা, "সমীর সাহা, পাটুলি"! মা-বাবার বিয়েতে উপহার পাওয়া বই; ভদ্রলোক সম্ভবত হুগলি জেলার জিরাট অঞ্চলের পাটুলিতে থাকতেন। এদিকে আবার একটা ৩১শে অক্টোবর আসছে। পাটুলি থেকে সার্ভে পার্ক চলে যাচ্ছি এবার। এবং আবারও, যাওয়ার কথা ছিল না, যেতে হচ্ছে অসময়ে। সতেরো-আঠেরো-উনিশ, তিনটে অক্টোবর মাস কেটেছে মাঝখানে; সামনের জমিতে ওই বেগুনি ফুলগুলো আর আসেনি। দিনদশেক হলো ওরা ফিরে এসেছে আবার। যেন মাথা তুলে বলতে এসেছে, চলে যাওয়ার সময় হয়েছে তাই ফিরে এসেছি। আসার সময় আমরাই হাত ধরে নিয়ে এসেছিলাম, চলে যাওয়ার সময় শেষবার বিদায়টুকুও আমরাই জানাবো।
এছাড়া আরও কিছু মজার ব্যাপার আছে এখানে। যেটুকু না বললে বোঝানো যাবে না সেটুকুই লিখছি। বাকিটা কোনওদিনই লিখবো না, জানতে চেয়েও লাভ নেই। যে দু'একজন খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ এসব ব্যাপারে সামান্য একটু কিছুও জানেন তাঁদেরও অনুরোধ করবো মুখে তালা ঝুলিয়ে রাখতে কারণ এখানে অন্যান্য মানুষেরা ইনভল্ভড। তাদের অনুমতি ছাড়া তাদের বিষয়ে আলোচনা করাটা ঠিক হবে না একেবারেই।
এইবার মহাজাগতিক চক্রান্তটার কথা বলি। গতবার কাজুর একবছরের জন্মদিন পেরিয়ে পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাসে ঘটেছিল ঘটনাটা। এবার সুফির একবছর বয়স পেরিয়ে আরেক সেপ্টেম্বর। দুটো ক্ষেত্রেই বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার কারণ যে মূল ঘটনা সেখানে একটি অন্য চরিত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং দুক্ষেত্রেই সেই ব্যক্তিরা আমাদের খুব পুরনো এবং খুব কাছের কোনও বন্ধু। মানে, বন্ধুর চেয়ে পরিবার বলা ভালো, এতটাই কাছের। লোকদুটো অবশ্যই আলাদা, কিন্তু একজনের নাম রূপেশ হলে আরেকজন রূপঙ্কর। এছাড়াও, দুক্ষেত্রেই একজন মহিলা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যিনি কোথাও না থেকে গোটা ঘটনাটাতেই ছিলেন। মানে বলা যেতে পারে, তাঁরা হয়তো তখন নিজেদের বাসায় নিদ্রারত এবং দীর্ঘদিন মূল ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনও চরিত্রের সাথে কোনওভাবেই তাঁদের বিন্দুমাত্র যোগাযোগও নেই, অথচ ঘটনার প্রাথমিক কারণ তাঁরাই। আলাদা ব্যক্তি, কিন্তু এক্ষেত্রেও একজনের নাম সুচেতনা হলে আরেকজন সুরঞ্জনা। মাঝখান থেকে প্রত্যেকবারই আমি একা জীবনানন্দ-র মতো মহাজাগতিক ট্রামের তলায়! এসব ক্ষেত্রে বলতে হয় 'দোষ কারও নয় গো মা / আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা' অথবা 'আমি দোষ দিব না কাউরে / দোষ দিয়া কি হবে রে'... ইত্যাদি। এই পোস্টটিও একটি মহাজাগতিক পোস্ট। একথা দ্বিতীয় গানটি যাঁরা জানেন তাঁরা বুঝবেন। কারণ, এই গানের উল্লেখ এখানে নাই ঘটতে পারতো, অথচ আমার আগের বাড়িওয়ালার নাম সুবল!
যাই হোক, মহাজগতের কাছে এপ্রিল ফুল হইয়া কোনও এক পয়লা এপ্রিলের প্রাকলগ্নে কোনও এক সার্ভে ভিউ পার্ক ছেড়েছিলাম, আর এবার পয়লা নভেম্বর থেকে ঠিকানা হতে চলেছে ১৩৫৫, সার্ভে পার্ক। এইটুকুই কাজের কথা, বাকিটা ভাট। সেই বাড়িতেও কলকাতা শহরের মধ্যেই আশ্চৰ্যভাবে ব্যালকনির উল্টোদিকে বিশাল ফাঁকা জমি। কে জানে, হয়তো পৌঁছে দেখবো সেখানেও বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। না থাকলেও হয়তো অন্য কোনও সংকেত আসবে অন্য কোনওভাবে যে আসলে ঠিক এরকমই হওয়ার ছিল, আর অন্য কোনওকিছুই হতে পারতো না কোনওভাবেই। এক জীবনে এইটুকু শান্তিই যথেষ্ট!