এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • যখন ধোঁকা খেতে ভালোলাগে

    সুকি
    অন্যান্য | ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ | ৬৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকি | 212.16.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ ২০:০৭582344
  • ওয়াইন নিয়ে আঁতলামো
    -----------------------------------------------

    খোকা দেখি নতুন কি শিখেছ তুমি? বলো তো অ্যাকোলন, ব্লাটিনা, কলোরিনো, ডর্ণফেল্ডার, এস্পাডিয়েরো, ফ্রাপাটো কারে কয়? রিয়োজা, মোসেল, কিয়ান্তি এই সবই বা কি জিনিস! জানো না ঠিক আছে – কিন্তু নতুন কিছু শিখতে ইচ্ছে করে না তোমার? এই কাদা, গোবর, আউশ, আমন, আলুর বণ্ড এই সব নিয়েই থেকে যাবে?

    যত বয়স বাড়ছে আমার ধারণা ক্রমশঃই বদ্ধমূল হচ্ছে। এটা একটা স্ট্যাণ্ডার্ড স্টেটমেন্ট দিলাম – যাদের তর্ক করার প্রবণতা আছে তাঁরা জানতে চান কি বিষয়ের ধারণা? তখন আমাকে বাধ্য হয়েই সেই ফাটা রেকর্ড বাজাতে হয় – আমার ভিতর এই মৌলবাদ ধীরে ধীরে গেড়ে বসেছে যে আদপেই নতুন জিনিস বলে কিছু হয় না। অর্থাৎ নতুন আসলে নতুন নয়! তাহলে ‘নতুন’ কাকে বলব আমরা? নতুন এক ভ্রম মাত্র। মনে রাখবেন আমি এখানে ইনোভেশন আর ডিসকভারী এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আরো একবার প্রমাণ করার জন্য এই লেখা ফাঁদে বসি নি। আমার এখনকার মতামত প্রায় ফ্লোটিং, অনেকটা বদ্ধমূল, কিছুটা প্রমাণিত, বেশ তথ্যভিত্তিক মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র।

    অর্থাৎ এখানেও আমি নতুন কিছু বলতে পারব না। তবে যেটা অন্য অনেক লেখকের মত পারব সেটা হল এখান ওখান থেকে খাবলে খুবলে খিচুড়ী পাকাতে। সমস্ত স্বতস্ফূর্ত, স্বেচ্ছেচারী, আকাঙ্খিত ও ফালতু লেখকদের মোটো একটাই – ইফ ইউ কান্ট কনভিন্স, দেন কনফিউজ। এই ধরুণ কেউ কেউ এখনও বলে উড়োপ্লেন নাকি রাইট ভাইদের আমদানী করা বাজারে নতুন জিনিস – অথচ আপনি আমি সেই কবে থেকে জানি আমাদের দেশে সেই কত্ত আগে থেকে পুষ্পক রথ ব্যবহার করা হত! টেলিভিশন? ছোঃ – সঞ্জয় সেই কবে ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের লাইভ টেলিকাষ্ট রিলে করে শোনাত। এমন অনেক উদাহরণ আছে – মনে হয় বাজারে এই নিয়ে বইও পাওয়া যায় আজকাল। তবলে এই সব আজেবাজে প্রশ্ন তুলবেন না যে পুষ্পক রথ তা হলে কোন সময় নতুন ছিল কিনা ইত্যাদি।

    আমরা আজকাল নতুন বলে যা দাবী করি তা সবই আসলে নতুন বোতলে পুরানো ওয়াইন মাত্র। এই ওয়াইন বিষয়টি আমাকে বহুদিন ধরে ধ্বন্দে রেখেছে। রেড ও হোয়াইট দুই ধরণের ওয়াইন নিয়ে দুনিয়ায় এত্যো আঁতলামো চলে যে তা মাঝে মাজে মানসিক সহ্য সীমানার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় লেভেল হেডেড পাবলিকদের। আমি নিশ্চিত যে আমার মত আপনাদেরও এটা মনে হয়েছে কোন কোন সময় যে এ্যাতো আদিখ্যেতা করার আসলেই কোন কারণ আছে কি ওয়াইন নিয়ে? সত্যিই কি শুধুমাত্র একটু চুমুক দিয়ে কুলকুচি করে গিলে নিয়ে বলে দেওয়া সম্ভব ওয়াইনের ঠিকুজি কুষ্টি! না, আমি শুধুমাত্র ওয়াইন-এর ব্র্যাণ্ড শনাক্ত করার কথা বলছি না – কত সালের মাল, কার জমিতে তৈরী, সেই জমিতে কৃত্রিম সার নাকি মুরগীর হ্যাগস দেওয়া হয়েছিল কিনা, বৃষ্টি কেমন পেয়েছিল আঙুর গাছটা, সেই আঙুরের পৈত্রিক পরিচয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আমরা হয়ত বাড়িতে পরীক্ষা চালিয়েছি নিজেদের মত করে। চোখ বন্ধ করে খেলে রসগোল্লা আর ল্যাংচার পার্থক্য করা যাবে (আমাদের পাশের বাড়ির মাণিককা পারবে না অবশ্য)। কিন্তু কার তৈরী রসগোল্লা? কে সি দাশ, নবীন ময়রা, নাকি পাড়ার গঙ্গা ময়রার দোকানের? ল্যাঙচা শক্তিগড়ের? সীতাভোগ বর্ধমানের – এগুলি কি খেয়ে শনাক্ত করা যায় নাকি! আপনারা ব্লাইণ্ড টেষ্ট করে থাকলে হয়ত এতদিনে প্রমাণ পেয়েই গেছেন যে পার্থক্য করা সম্ভব নয় – তাহলে ওয়াইনের বেলায়?

    যেমনটা আগে বলেছি আমার এই দ্বিধাও নতুন কিছু নয় – আরো অনেকেই আগে ওয়াইনের আঁতলামো যে বেশীটাই বেসলেস সেটা নেড়েঘেঁটে দেখেছেন। খুঁজলেই রিসার্চ পেপার পাওয়া যাবে – আমিও খুঁজতে বসলুম।

    এককালে আমাকে প্রায়ই ফ্রান্স যেত হত কাজে বা অকাজে। ঘটনাচক্রে যেখানে যেতাম সেটা আবার হোয়াইট ওয়াইনের স্বর্গরাজ্য বলেই পরিচিত – বুরুগ্যাণ্ডি প্রদেশ। ডিজন শহরে থেকে বন্‌ পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিমি রাস্তার একটা স্ট্রেচ আছে যার দুধারে শুধুই আঙুরের ক্ষেত ও অসংখ্য ওয়াইন প্রস্তুতকারী গ্রাম। বেশীর ভাগই ফ্যামিলি বিজনেস – সেই রাস্তা দিয়ে সাইকেল নিয়ে ট্যুরে বেরুনো এক অনবদ্য অভিজ্ঞতাই বটে। তবে সেই গল্প ডিটেলেস-এ অন্য কোন খানে অন্য কোন সময়। দুই-একখান কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম বার খেয়ে – সেই আঙুর রাজ্যে ঘোরা নিয়ে – তখন বয়স ছিল –

    “ঘাম হইয়ে যাওয়া জলকণাগুলি কিছুটা শর্করা জাতীয়
    অথবা আঙুরের রস মজে মিষ্টি সাদা আর লাল
    তাদের লবণত্ব হারিয়ে সবুজ হতে ভালোবাসে
    আমি হলুদ তাপের মাঝে জলকণা
    শুষে নিই ভেণ্ডিং মেশিন থেকে
    আঙুরলতা জড়িয়ে গেছে হলুদে
    খালি পায়ে আঙুরবালা
    তুমি কাঠের উপর ঘষে নাও ক্লান্তি
    আর লেগে থাকা যৌবন”।

    আমি যখন নিজেই ঘুরে দেখি একটা কষ্ট পেয়ে বসে। আদি অকৃত্রিম কাদা মাখা, মোরামবিহীন, বাঙলা মিডিয়াম, ঝাপান, তুসু সম্বলিত আমার ছোটবেলা – আর আমি কবিতা লিখছি আঙুর – ওয়াইন নিয়ে! বাবা জানতে পারলে বেধরক রাগারাগি করত – কেন আমাদের রাস্তার ধারে খেজুরগাছগুলো কি দোষ করল? যেগুলো রামাশীষ গাছ দিত – শীতের ভোরে কলসি করে রস পৌঁছে দিত বাড়িতে? কি দোষ করল গরাঙ্গের পাড়ের তালগাছগুলো যেখান থেকে তাড়ি খেয়ে শীতের দিনে ক্রিকেট আর গরম-গ্রীষ্মে ফুটবল খেলতে নামতাম মনসা, পলু, ডাবা, আলমদের সাথে? খেজুর রস আর তালরস কি খুবই অচ্ছুৎ আঙুরের থেকে? মানছি তালরস খেয়ে ঘাম হলে বেজায় গন্ধ বেরোয় গা দিয়ে – সে তো ওয়াইন খেলেও জিব লাল হয় – তাই ও সব ফালতু কথা বল না – লিখেছ একটাও লাইন খেজুর তাল নিয়ে? কেবলই ভাঙিয়ে খাচ্ছ “তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে”।

    খেয়েছো তো ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা খেজুর রস মাটির কলসী থেকে – কেমন খেতে? ভাবতে গিয়ে পেত্যয় দিই – সত্যিই সে রস তো খারাপ ছিল না! তোমরা নিতে পার না – কারন তোমাদের আধার নেই। মহুয়া রস নিয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না – কারণ প্রথমত আমাদের দিকে মহুয়া হত না এবং দ্বিতীয়ত মহুয়া নিয়েও হাওড়া-কলকাতা বাসী বাঙালী বেশ যথেষ্ট পরিমাণে আঁতলেমো করে গেছে। যারা মহুয়া প্রকৃত পান করে তারা নিশ্চুপ – যারা চাখে তারা ফাটিয়ে দেয় ঢেকুর তুলে। তাবলে তুই ওয়াইন-আঙুর নিয়ে কবিতা লিখবি? গ্রামের জন্য তো হানিকারক জিনিস ছাড়া কিছুই করলি না – অন্ততঃ আমাদের দিকে ভাটিখানা আছে এটাও যদি লিখতিস, হয়ত কিছু বিজনেস পাওয়া যেত!

    ওয়াইন খাওয়া আর তাড়ি খাওয়ার প্রকার এক নয়। অবশ্য ওয়াইন যে তাড়ির মত খাওয়া যাবে না এমন কথাও হলপ করে কেউ বলে নি। তবে কিনা এটিকেট বলে একটা ব্যাপার আছে – “ভজহরি মান্না” তে ভাত-পাঁঠার মাংস হাত দিয়ে সাঁটিয়ে লিমিট পুস করা গেলেও “ওঃ ক্যালকাটা”য় সেই কাঁটা চামচ!
    এক ওয়াইন বিশারদ ওয়াইন গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢালল – আলোয় গ্লাস্টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে জানান দিল গাঢ মেহগীনি রঙ – হালকা মোচড় এবার গ্লাসটাকে ১৫ ডিগ্রিতে – তরল গ্লাসের গায়ে লহর তুলে নিল একটু – এবার তিনি শুঁকলেন – বুক ভরে বাতাসের সাথে সেই গন্ধ গেল তাঁর ভিতর – এবার তিনি বললেন – হালকা গুঁড়ো কফির ছোঁয়া, মশলা, লেদার এবং ব্ল্যাক কারেণ্ট! তারপর তিনি চুমুক দিলেন – জিহ্বার টোকায় খেলা করতে লাগল বিন্দু বিন্দু লাল জলীয় কণা মুখের ভিতর। আরও খানিকক্ষণ রোয়ান অ্যাটকিনসন এবং জিম ক্যারীর সংমিশ্রণ জাত মুখভঙ্গি করে তিনি ফ্যাইন্যালি মাল গলধগরণ করলেন। এরপর ঠক করে গ্লাস টেবিলে নামিয়ে তাঁর ভারডিক্ট – “ভালো আঙুর – ভালো ফল – লবঙ্গ তার সাথে সুইট টফির সুগন্ধ যুক্ত – ভিণ্টেজ ওয়াইন – স্যাতোন্যাফ – ১৯৮৯”।

    এতো পুরো জাদুগর – নহে কি ইহা বিলকুল ধোঁকা? এতো আমাদের গ্রামের দয়াল খুড়োর বাটি চালা! সাধন এর ছেলে বাপন কিছুদিন নিরুদ্দেশ – দয়াল খুড়ো বাপনের ছেড়ে যাওয়া গামছা শুঁকে ও বাটি চেলে বলে দিল যে এখন বোম্বে পাড়ি দিয়েছে সিনেমায় নায়ক হব বলে – এতক্ষণ নাগপুর পেরুল!
    মাঝে মাজে এই ওয়াইন ওয়াইন খেলা এতই অসহ্য হয়ে যায় যে এমনকি একজন ফ্রেঞ্চও সন্দেহ প্রকাশ করে ফেলে – ফ্রেডরিক ব্রোচে তেমনই একজন কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স-এর গবেষক বোর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৮ সালে ব্রোচে আটান্ন জন ওয়াইন বিশারদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলে তাঁদের মতামত জানার জন্য। প্রথমে ব্রোচে রেড ও হোয়াইট পরিবেশন করেন। বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মতামত লিপিবদ্ধে করেন – তারপর আবার অন্য রেড ও হোয়াইট ওয়াইন পরিবেশন। বিশেষজ্ঞরা এবারও মতামত লেখেন। দুই রেড ওয়াইনকে ব্রডলি এইভাবে বর্ণনা করা হয় – প্লাম্প, ডিপ, ডার্ক, ব্ল্যাক কারেণ্ট, চেরী, ফ্রুট, রাসপবেরী এবং স্পাইসি। দুই হোয়াইট ওয়াইন এই ভাবে বর্ণিত হয় – গোল্ডেন, ফ্লোরাল, পেল্‌, ড্রাই, অ্যাপ্রিকট, লেমন, হনি, স্ট্র ইত্যাদি। মোটামুটি যেমন ভাবে ভেগলি জিনিসপত্র বর্ণানা করা যায় আর কি!

    তবে ওয়াইন বিশারদরা থোড়াই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁরা এক পরীক্ষার স্বীকার – তাও কিনা আবার রেড ও হোয়াইট ওয়াইনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন কিনা! এ যেন মারাদোনাকে ফুটবল আর অমেরিকান ফুটবল সনাক্ত করতে দেবার মতন। তাঁরা ভেবেছিলেন নরম্যাল ওয়াইন চাখতে এসেছেন তাঁরা। আঙুরের টাইপ নয়, সাল নয়, কোথাকার ওয়াইন তাও নয় – স্রেফ রেড ও হোয়াইট ওয়াইনের মধ্যে পার্থক্য করতে বলা! সোজা ব্যাপার, তাই নয় কি?
    এটা কিন্তু চোখ বন্ধ করে কোন টেষ্ট নয় – দ্বিতীয় সেটে যে রেড ও হোয়াইট ওয়াইন পরিবেশন করা হয়েছিল, তা আসলে একই! হোয়াইট ওয়াইনটায় খালি খাবার রঙ মিশিয়ে লাল করে ব্রোচে চালিয়েছিলেন রেড ওয়াইন বলে। আমি এবং সম্ভবত আপনিও ভাববেন যে এক ওয়াইন বিশারদ অন্ততঃ রেড/হোয়াইটের পার্থক্য করতে পারবেন!

    কিন্তু না, ৫৮ জনের একজনও লেখেননি যে রেড ওয়াইনটা হোয়াইট-টার মত খেতে ছিল!। তাঁরা রেড ওয়াইন যেমন হয় তেমনই বর্ণনা করেছিলেন রং মেশানো লাল সাদা ওয়াইনকে!

    ব্রোচে এখানেই থামেননি – পরের পরীক্ষা ছিল সাধারণ ওয়াইন ও ভিণ্টেজ ওয়াইন পার্থক্য করা নিয়ে। ব্রোচে বলেন যে তিনি সাধারণ ও ভিণ্টেজ দুই ধরণের ওয়াইন পরবেশন করবেন। প্রথমে গ্লাসে ঢালেন সাধারণ ওয়াইন – ব্রোচে নিজেও এক চুমুক দেন। সবাইকে দেখিয়ে সেই ওয়াইন মুখ থেকে ফেলেও দেন এমনভাবে যে সাধারণ ওয়াইনটি আসলেই বাজে টাইপের। বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মতামতে লেখেন – সিম্পল, আন-ব্যালেন্সড, লাইট, ফ্লুইড এবং ভোলাটাইল।

    তারপর ব্রোচে ভিণ্টেজ ওয়াইন পরিবেশন করেন। এবার ব্রোচে নিজে চুমুক দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে অনুমদন সুচক ঘাড় নাড়েন। বিশারদেরা লেখেন – ফ্লেভারসম, স্মোকি, ফ্রেস, উডি এবং এক্সেলেণ্ট। আপনারা এতক্ষণ নিশ্চই পাঞ্চ লাইনটা বুঝতে পারছেন – ব্রোচে পরিবেশিত দুই ওয়াইনই ছিল এক – সাধারন বোর্দো ওয়াইন!

    তাহলে এই পরীক্ষার ফলাফল কি দাঁড়ালো? এটাই তো পাতি উপসংহার যে ওয়াইন বিশারদেরা আসলেই অতি সিউডো আঁতেল – স্রেফ সাধারণ পার্থক্যও ধরতে পারেন না! অন্ততঃ আমার কাছে সেটাই মূল সারবত্তা!

    কিন্তু না! এখানেই হিন্দী সিনেমার মত টুইষ্ট। ব্রোচে তাঁর পরীক্ষাগুলো ওয়াইন বিশারদদের গাধা প্রমাণ করার জন্য করেন নি। তিনি নিজে একজন ওয়াইন প্রেমিক এবং এক ভিনিয়ার্ডের মালিক। ব্রোচে যুক্তি খাড়া করেছেন যে তাঁর পরীক্ষা আসলে এটাই প্রমাণ করে যে পারস্পেকটিভ এক্সপেক্টশনের প্রভাব অনেকটাই দূরবর্তী। অর্থাৎ ব্রেন অনেক সময় ক্ষুদ্র পার্থক্যকারী অনুভবকে প্রসেস করে না – তার বদলে ব্রেন তার অভিজ্ঞতা তৈরী করে দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ ও স্বাদ এই সব সেন্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে। দূর্ভাগ্যক্রমে (বা সৌভাগ্যক্রমে) ব্রোচের রায় অনুযায়ী ব্রেন দৃশ্য থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে ২০ গুণ বেশী জোড় দেয় বাকী সেন্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যের থেকে। অর্থাৎ গ্লাসে আমরা রেড ওয়াইন দেখে মস্তিষ্ককে জানাচ্ছি ওটা রেড ওয়াইন – ব্রেন এই ডাটার উপরেই বেশী জোর দিচ্ছে। তার পর জিহ্বা থেকে প্রাপ্ত তথ্য তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না – আমাদের পারসেপশনই রিয়েলিটি হয়ে যায়। এবং আরো আশ্চর্য্য ভাবে, ব্রোচের মতে যত অভিজ্ঞ, যত বেশীর ট্রেণড হবে সেই ওয়াইন ড্রিংকার, তার ভুল করার চান্স ততো বেশী হবে। কারণ তার ব্রেন হাইলি ট্রেনড রেড ওয়াইনকে একভাবে টেষ্ট করতে। সে তার আগেকার পারসেপশন/ধারণা থেকে বেরোতে পারে না।

    তবে আমার মতে ব্রোচে একটু ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন ব্রেন-ফ্রেন এই সব ঢুকিয়ে। ৫৮ জনের সবাই যে এই ভাবে ছড়াবে, তাও খোদ ব্রোচেও বুঝতে পারেন নি। অতএব দে শালা দোষ ব্রেনকে – মাতলামোর জন্য আমরা এসো দোষ দিই তালগাছকে। ব্রোচে মালটা আপসেট হয়ে গিয়ে মনে হয় পেপারটা আর পাবলিশই করে নি!

    তাহলে ব্যাপার কি দাঁড়াচ্ছে – ওয়ালমার্ট, টেসকো, সেনসবেরী, ওয়েটরোজ এই সব ডিপার্টমেণ্ট স্টোরে দৌড়ান পরের পার্টির আগে। পাতি ওয়াইন কিনে ভরে ফেলুন কিছু ফ্যান্সি বোতলে – কেউ টেরটি পাইবে না। ট্রেই নিয়ে দেখতেই পারেন! তবে কিনা আপনি কি সিওর যে এই একই ট্রিকস আপনার উপরে অন্য কেউ খাটিয়ে ফেলে নি ইতিমধ্যে!

    ব্রোচে তাই পয়েণ্ট আউট করেছেন যে বেশীরভাগ ওয়াইন ফ্রড ধরা পরে লেবেলিং গোণ্ডগোল থেকে – কাষ্টমারের স্বাদ বিষয়ক অভিযোগ থেকে নয়। ভাবুন তা হলে – গত সপ্তাহে কেনা ৫০ ডলারের আপনার ওয়াইনের বোতলটা কোন দলে?

    অন্তিমে বলি গুরুতে গুনী পাবলিকের ছড়াছড়ি – আমি না ওয়াইন এক্সপার্ট, না নিউরোসাইন্টিস্ট। এঁরা আরো ভালো বলতে পারবেন কেসটা আদপে কি। আমি শুধু কিছু না জেনেও জানি যে ওয়াইন নিয়ে বেশীর ভাগটাই আঁতলামো। ডাক্তারে বলছে যে রোজ হাফ গ্লাস (বাবার বিয়েতে দানে পাওয়া কাঁসার গ্লাস নয়!) করে ওয়াইন খান – হার্ট ভালো হবে নাকি! কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বলছে যে রক্ত নাকি এতে পিউরিফাই হয়! আপনি রে মিটের সাথে রেড খান, চিকেনের সাথে হোয়াইট। প্রকৃত মাতাল পার্টিতে তাড়াতাড়ি এই ওয়াইন আঁতলামো শেষ করে আরো গভরী ঢুকে যায়। লুঙ্গি পরে ওয়াইন মানায় না, কাপড়, শাড়ী পড়েও না – পাজামা, চুড়িদারেও না। ওয়াইনের সাথে আঁতলামো করতে হলে ওয়েষ্টার্ণ ড্রেস মারুণ। আর তা না হলে আমার মতন ভাবতে শিখুন – আমাদের দ্যাশে এর থেকেও ভালো অলটারনেটিভ আছে। খেজুর আর তাল রস নিয়ে কবিতা লেখা যায় না - এই যা!

    কৃতজ্ঞতাঃ
    ১। এফ ব্রোচে (২০০১), “কেমিক্যাল অবজেক্ট রিপ্রেজেনটেশন ইন দি ফিল্ড অব কনশাননেস”।
    ২। অ্যালেক্স বয়সি, “এলিফেন্টস অন অ্যাসিড অ্যান্ড আদার ব্রীজায়ার এক্সপেরিমেন্ট,” বস্কট্রি, ২০০৭।
  • sosen | 125.24.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ ২০:১০582346
  • :)
  • কৃশানু | 213.147.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ ২০:৪৬582347
  • বেড়ে লিখেছেন মহায়।
  • de | 130.62.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ ২১:৪৩582348
  • সুকি যাই লেখেন একদমে শেষ করি -- খুব হাসলাম ঃ))
  • dd | 120.234.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৪:২৩582349
  • তাহোক। আমি একটু ছিটগ্রস্থতা ও খ্যাপামির ফরে। এমন কি সেটি অর্থকরী হলেও অসুবিধে নেই। প্যাশন? প্যাশন বোঝেন তো? অহৈতুকী। সেই সব চাই আমাদের জীবনে।

    সে স্ট্যাম্প কলেকটিং বা ওয়াইন চাখা বা ভয়ানক কঠিন শর্ট ফিল্ম বানানো। যাবতীয় শিল্প কলা সে হোক না একটু লোক দেখানো। ঢ্যামনামি আর আদেখলা আৎলামি তো থাকবেই। সেও থাকুক।

    কিন্তু খ্যাপামিটা থাকুক। এই অসম্ভব হিসেব করা ক্যালকুলেটিং আলুনী জীবনে নামতার বাইরে এরম কিছু মিছু থাকুক। নির্দোষ। অন্যের ক্ষতি করে না। অসুবিদে করে না।

    এই আমার প্রো ক্ষ্যাপা ইস্তাহার।
  • গান্ধী | 213.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৫:০৮582350
  • :)
  • সুকি | 212.16.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৬:৪২582351
  • সবাইকে ধন্যবাদ যাঁরা লেখাটি পড়লেন।

    ডিডি,
    আপনি যে এই লেখাটি সময় নিয়ে পড়েছেন এবং তার উপর বাংলায় এতো টা লিখেছেন তার জন্যই অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি আপনার সাথে শতকরা ১০০ ভাগ একমত প্যাশন ব্যাপারটি নিয়ে।

    প্যাশন না থাকলে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে পার্থক্য কি রইল! আমার বউ এই কথাটি আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দেয়। তেনার মতে আমি অনেক বিষয়ে প্যাশন দ্যাখাতে পারি না - যেমন ব্যাগ কেনা। বউ আমার ইতালির মিলান থেকে প্যাশান হেতু হাতব্যাগ কিনবেন - অরিজিন্যাল লেদারের নাকি। তা দাম শুনে আমি বললাম যে আমাদের গ্রামে এই টাকা দিলে মানুষের চামড়ার ব্যাগ হয়ে যাবে। ওর অর্ধেক টাকায় আমার গ্রামে অনেক পাবলিক পাছার চামড়া বিক্রীর জন্য লাইন লাগিয়ে দেবে!
  • dd | 120.234.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৬:৫০582352
  • সুকি। জাস্ট কিউরিয়াস।

    ঐ উপরি উক্ত ব্যাগটির দাম কতো? মানে ,তাইলে গ্রামের লোকেদের পাছার চামড়ার একটা আইডিয়া হয়ে যায় আর কি।
  • সুকি | 212.16.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৭:১১582353
  • ডিডি,
    গ্রামের লোকেদের পাছার এবং তাতে লেগে থাকা চামড়ার প্রায় কোন দামই থাকে না অনেক সময় - তাই ওই সবই প্রতীকি ব্যাপার আর কি। আমার দৌড় বেশী দূর নয় - ব্যাগটা লো-এণ্ড ফ্যাশান টাইপের, তাতেই সেই অবস্থা। ভাবে নিন না দাম কিছু একটা - ১০০০-১২০০ ইউরো মতন হলে চলবে?
  • shanku | 127.199.***.*** | ১৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৭:৩০582345
  • সস্যের তেলে কষিয়ে ছোলাড্ডালের ধোঁকাও মন্দ হয় না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন