অরণ্যর সাথে সহমত।
বাহ কত্ত সবুজ ☺
সকলকে ধন্যবাদ। নিমোতে সবুজের ছড়াছড়ি, এটা সত্য, অন্তত এখনও পর্যন্ত
শিবাংশুদা - ধন্যবাদ। অনেক দিন আপনার লেখা দেখি না - একটা জম্পেশ লেখা জমা দিন এই নতুন বছরে!
এই লেখাটা গুরুতে আমার ব্লগেই আছে স্বতন্ত্র ভাবে, কিন্তু নিমোর গল্প বলে এই থ্রেডে জুড়ে দিলাম।
-----------------------------------
কাঠমিস্ত্রীর বাবা ও কাঠমিস্ত্রী
----------------------------------
আমাদের পুরানো বাড়িতে কাঠের কাজ করেছিল রাজারাম, তা সে প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। ঘোষ পাড়ার যৌথ বাড়ি থেকে আমরা স্থানান্তরিত হলাম পাল পাড়ায়, পুকুরের এপাড় আর ওপাড়। আমাদেরই বাগান বাড়িতে গড়ে উঠল আমাদের নতুন বাড়ি। গ্রামে আমাদের তখন কাঠের মিস্ত্রী বলতে ওই রাজারাম ও তার ভাই জয়রাম। আদপে হিন্দুস্থানী হলেও রাজারাম ও তার ভাইকে আমরা কোনদিন হিন্দী বলতে দেখি নি আমাদের সামনে। তবে ওদের দুজনের বউ কিন্তু খাঁটি বিহার থেকে আমদানী কৃত হবার জন্য ভালো বাংলা বলতে পারত না। ফলতঃ বাড়িতে ভালোই শান্তি বজায় ছিল – দুই ভাই মদ খেয়ে কাঁচা বাঙলায় বাওয়ালি করত বউদের উপরে, যারা সেই বাংলার মর্মোদ্ধার আজ বিবাহের চল্লিশ বছর পরেও করে ওঠার মত শিখে উঠতে পারে নি। এবং ভাইস ভার্সা – বউরা হিন্দী ভাষায় যে বাক্যবাণ থ্রো করত তা রাজা বা জয় কোন রামই কোনদিন উদ্ধার করে উঠতে পারে নি। বাড়িতে ইক্যুইলিব্রাম বজায় ছিল, অন্তত আমাদের বাড়িতে কাজ করতে করতে রাজারাম সেটাই দাবি করত।
নতুন বাড়িতে জানালা দরজা বানাবার জন্য আমাদের কাঠ কিনতে হয় নি। যে বাগান কেটে বাড়ি তৈরী হয়, সেই বাগানেরই নিম কাঠ দিয়ে হয়েছিল ফ্রেম, আর সোনাঝুরি দিয়ে হয়েছিল জানালা দরজার পাল্লা। কাঠ চেরাই হয়েছিল অন্য এক বিহারীর কাঠ কলে যে আবার আমার বাবার ছাত্র ছিল – ফলতঃ আমাদের বাড়ির সাথে বিহারীদের সমন্ধ বেশ অঙ্গাঙ্গী বললে অত্যুক্তি হয় না। রাজারামের ফুল ফর্মে কাঠের কাজ করা আমার আজ সব মনে পরে না – তবে মনে পড়ে বাবার সাথে রাজারামের রোজকার আলোচনা, স্ক্রু (রাজারাম যাকে ইস্ক্রুপ বলত) কেমন ভাবে কাঠের কাজে ব্যবহার হওয়া উচিত এই নিয়ে। স্ক্রু –কে প্যাঁচ দিয়ে টাইট করা রাজারামের স্বভাবে ছিল না, দুম-দুম করে দিল হাতুরী দিয়ে দুই ঠোক্কর, স্ক্রু কাঠের মধ্যে সমাহিত। বাবা রাজারামকে বোঝানোর চেষ্টা করত যে পেরেকের মত ঠুকে কাজ সারা উচিত নয় স্ক্রু-র ক্ষেত্রে, কারণ তাহলে স্ক্রু উদ্ভাবনের দরকার হত না। কিন্তু কে শোনে কার কথা – বাবা যতক্ষণ আছে রাজারাম ততক্ষণ স্ক্রু টাইট দিচ্ছে, চোখের আড়াল হলেই দুম-দাম। আমার প্রথম গুপ্তচর বৃত্তিরও হাতেখড়ি তখনই – বাবা আমাকে রাজারামের ঠোকার উপর নজর রাখতে বলেছিল। গুপ্তচররা সাধারণত গুপ্ত থাকে, কিন্তু আমার কাজ ছিল রাজারামের আশেপাশে যতক্ষণ ঘুরঘুর করা যায়। আমার কাজ রাজারামের ভাষায় গুপ্তচর এবং আমাদের দিক থেকে নজরদারি – এই দুইয়ের মাঝে ঝুলে ছিল সেই সময়।
সময় এগিয়ে গেছে – আমাদের নতুন বাড়ির মধ্যে আবার একটা বাড়ি হল উঠোনের অপর দিকে। ‘নতুন’ বাড়ি হয়ে গেল পুরানো। এখনকার নতুন বাড়ি গড়ে উঠল আমাদের এখনকার বাগানের কিছু গাছ সরিয়ে। দুটো আম গাছ কাটা গেল – মুড়ি ভাজার চালা উঠে গেল, ভাঁড়ার ঘর সরে গিয়ে ঠাঁই নিল এক কোণের দিকে। ঠাকুমার বয়স হয়ে যাবার পর আর অবশ্য আমাদের চালায় মুড়ি ভাজা হত না, মুড়ি ভাজা নামটাই থেকে গিয়েছিল। ভাঁড়ার ঘর তবে পুরোপুরি ব্যবহার হত চাষের সামগ্রী, সার, কাস্তে-কোদাল, বস্তা এবং আরো অসংখ্য জিনিসে। সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন এসেছিল গরু নিয়ে – অনেক চোখে জল ফেলে প্রথমে চাষের হেলে-গরু দুটোকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কারণ ছিল মূলত আর কেউ লাঙল ধরতে চাইত না – ততদিনে মাঠে ট্রাক্টর এবং হ্যান্ড ট্রাকটরে ভরে গেছে। নাগাড়ে কিষেণের অভাব আমাদের নতুন বাড়ির জায়গাকে এমনি অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারপর ক্রমে গেল গাই গরু গুলি – বাড়িতে রাখাল রাখার আর ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না – ঠাকুমার বয়স হয়ে গিয়ে মারা গেল – বাবা একা আর চারিদিক সামলাতে পারছিল না। নতুন বাড়িতে আমার এখনকার বেডরুমের ঠিক নীচেই ছিল এককালে আমাদের গোয়ালঘর। তবে বাড়ি হবার পরেও থেকে গিয়েছিল কিছু সুপারী গাছ, একটু লীচু, নারকেল এবং একটি আমগাছ।
আমার নতুন বাড়ির দরজার ফ্রেম আর নিম গাছ দিয়ে হল না – হল সেগুন গাছ দিয়ে। বেলেডাঙা পড়ায় আমাদের পুকুর পাড়ে যে বড় সেগুন গাছ দুটি ছিল, সেই দুটি চেরাই করেই নতুন বাড়ির কাঠের সমস্যা মিটে গেল। তবে রাজারাম এখন আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে যায় না – তার ছেলে রবি এখন আমাদের গ্রামের একমাত্র কাঠমিস্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। রবি আমার ভাইয়ের বয়সী – এবং নিমো গ্রামের ট্র্যাডিশন মেনে, অনেক দিন হল সে আমার বন্ধু স্থানীয় হয়ে গেছে। যতবার বাড়ি যেতাম রবির কাছে তার বাবা রাজারামের খোঁজ নিতাম। রবি বলত, ‘বুঝলে দাদা একেবারে জ্বালিয়ে মারছে। সন্ধ্যা হলেই মদ নিয়ে বসবে, আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার ধমকি দেবে। এদিকে নিজে সারাদিন কাজ কিছু করবে না, সংসার চলছে আমার জন্য’। রবি মুখে বাবাকে গাল দিলেও মনে মনে দারুন ভয় খেত – যার কারণ আমার জানা ছিল না। রাজারামের মদ খাওয়া আরো অনেকের মত আমাদের গাঁয়ে সুবিদিত। আরো একটা কারণে রাজারামের নাম ছিল, সেটা ছিল তার দিল দরিয়া মেজাজ। নিজে খাও এবং পরকেও খাওয়াও, এই নীতি নিয়ে রাজারাম চলত।
এবার বাড়ি গিয়ে রবির সাথে কথা বলতে বলতে ওর বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছি – দেখি রাজারাম রেজাক মাষ্টারের সাথে কথা বলছে। রেজাক কাকা আমার বাবার বন্ধু এবং খুবই শান্ত লোক। রাজারাম বলছে,
- বুঝলে রেজাকদা, এই যে মদ খাওয়া খারাপ লোকে বলে, সেই নিয়ে হইচই করে – এগুলো সব ফালতু কথা
- কেন রে? – রেজাক কা জিজ্ঞেস করল
- কেন মানে? এই যে আমি তিরিশ বছর ধরে মদ খাচ্ছি, কিছু হয়েছে আমার? যত সব আল-বাল কথা, মদ খেলে নাকি শরীর খারাপ হবে!
নির্বিবাদ রেজাককা খানিক ক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে কোনক্রমে বিদায় নিল। এই করতে করতে রশিদ চাচার ছেলে গোলাপ এল ওর ওর্ডার দেওয়া তক্তার খোঁজ করতে।
- কাকা, তক্তাটা ভালো করে বানিও কিন্তু
- হ্যাঁরে বাঁড়া দেব, তবে মুরগী না খাওয়ালে, কাঠের প্যানা আর মারব না, শুধু গজাল দিয়েই সারব।
- তোমার শুধু মুরগী খাব খাব
- আগের বার তো খুব টুপী পরিয়ে তক্তায় প্যানা মারিয়ে নিয়ে গেলি মুরগী খাওয়াব বলে, কিন্তু এখনো তো মুরগী এল না
- আসলে কি জানো তো কাকা, বউ মুরগী গুলো খুব ভালোবাসে – আগের বার তোমার জন্য ধরতে গেলাম, কিন্তু বউ কান্নাকাটি শুরু করে দিল
- ঠিক আছে, মুরগী খাওয়াতে হয় না – তোর তক্তাও তেমন হবে
- রাগ করো কেন কাকা – আচ্ছা, এবার আমি তোমাকে খাওয়াবোই মুরগী। একটার পা একটু খোঁড়া আছে, সেটাই না হয় তোমাকে দেব।
আমি এই পর্যন্ত দেখে চলে এসেছিলাম। কিন্তুদিন পরে আমি রবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে মুরগী কেমন খেলি। রবি বলল
- আর বলো না, গোলাপের মুরগীর জন্য আমার যা লস হলো
- কেন রে, মুরগী তো পেলি ফ্রীতে, লসটা আবার কিসের?
- তুমি তো সেদিন দেখে এলে খোঁড়া মুরগীটা গোলাপ বাপকে দেবে বলে এল। এখন হয়েছে কি, খোঁড়া মুরগীটা বেশ অনেকটাই বড়। গোলাপের বউ দিতে রাজী ন্য় – শেষে অনেক বলে কয়ে গোলাপ একটা ছোট মুরগী নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে হাজির।
- তোর বাপ কি বলল?
- বাপ তো মুরগীর সাইজ দেখে রেগে ফায়ার – বলল, সব কাঠের প্যানা টেনে খুলে দেব বোকাচোদা, আমাকে আবার মুরগী বানানো হচ্ছে! অনেক কষ্টে বাপকে শান্ত করলাম, গোলাপ মুরগী দিয়ে বিদায় নিল। বাপ সেই মুরগী একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখল পরের দিন মালের চাট করবে বলে।
- তা এতে তোর লস কোথায়?
- আরে শোনই না – পরের দিন সকালে বাপ ঝুড়ি তুলে গেছে মুরগী ধরতে। সেই শালা মুরগী হচ্ছে দেশী, ধরা দেবে কেন? গেছে পালিয়ে – আমার দুজন মিস্ত্রী এসেছিল কাজে, তাদের বলছে তোরা মুরগী ধর এবার।
- মানে?
- মানে আবার কি, ২০০ টাকা করে মজুরী দিই মিস্ত্রী গুলোকে আমার কারখানায় কাজ করার জন্য, তাদের দুজন নিয়ে বাপ বেলা দুটোর সময়েও মূর্গী ধরে বেড়াচ্ছে! বাচ্ছা একটা মুরগীর জন্য আমার দুটো মিস্ত্রীর মজুরী জলে গেল।
- তুই কিছু বললি না?
- বলতে গেলাম বলে আমার বউয়ের সামনেই আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল, তুমি তো জানোই।
তা জানি – আরো জানি যে রবি গালাগাল পারে না খুব একটা, তদোপরি বাপকে নিদারুন ভয় খায় বিয়ের পরেও। তবে রবি ভালো ছেলে, আমাদের গ্রামের অনেকেই বলে। সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত কাজ করে রবি – তারপর রেষ্ট, এবং আমাদের সাথে বিকেলে নিমো স্টেশনে আড্ডা। রাত আটটার মধ্যে আবার রবি ঘরে ঢুকে পরে, বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পরে তাই আমরা ওকে নিয়ে আর আগে ঘরে ঢোকার টান নিয়ে রসিকতাটা করতে পারি নি। ১২টা পর্যন্ত কাজের মধ্যে আবার গ্রামের কাউকে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া, কাউকে বাইকে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে কাউকে খাবার পৌঁছে দেওয়া, মিউনিসিপ্যালিটির কাজ – এ সবই করত।
কিছু বছর আগে থেকে রবির মনে রাজনীতির ঝোঁক লাগে। কেন লাগে বলতে পারব না – কারন ও নিজে ছিল ‘ওয়ার্কার’ শ্রেণির মেধা যুক্ত। জটিল বুদ্ধির কোন রূপ চিহ্ন ওর আপাত সরল মস্তিষ্কে ছিল না। তবে কিনা ওর অনেক বন্ধু ছিল খুব রাজনীতি সচেতনে – তাদের চাপে পরেই মনে হয় ও গা ভাসাল রাজনীতিতে। গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটে ওরা এক নির্দল মহিলা প্রার্থী খাড়া করে সামনে শিখন্ডী স্বরূপ – নেপ্তথ্যে থাকে ওরা। তা গ্রামের লোক বেইমান নয় – রবি এবং ওর বন্ধুদের গ্রামের সেবার কথা মনে করে সবাই ওদের ভোট দেয় – সি পি এম এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে ওদের প্রার্থী বিপুল ভোটে জেতে।
নিমো গ্রামে এই ভাবে এক কমপ্লেক্স পরিস্থিতির সৃষ্টী হয় – কিছু আসনে সি পি এম, কিছুতে তৃণমূল এবং একটায় রবিদের দল জয়লাভ করে। তৃণমূল তবু ঠিক আছে, কিন্তু নির্দল থেকে জেতায় রবিদের উপর চাপ বাড়ে। সন্ধ্যাবেলা রবি আর আমাদের সাথে আড্ডা মারতে আসে না – বরং যায় পার্টির অফিসে। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী, যে পাড়া থেকে রবিরা জয়লাভ করেছে, সেই পাড়ার সকল ঝামেলার ফার্ষ্ট পয়েন্ট অব কন-ট্যাক্ট হচ্ছে ওদের দল। ফলে রোজ সন্ধ্যেতেই প্রায় বিচার সভা বসে। বিচার সঞ্চালনে রবিদের পার্টির ব্যাকবোন হচ্ছে নিতাই, পচা ও মজনু। আমি বহু দিন গ্রাম ছাড়া বলে এবং আমার সাথে সবার সম্পর্ক ভালো থাকার জন্য, এদের বিচার সভার অ্যাক্সেস ছিল আমার কাছে। কোন সন্ধ্যেবেলা সময় না কাটলে আমি রবির সাথে বিচার দেখতে যেতাম।
তেমনি একদিন সন্ধ্যাবেলা বিচার সভা বসেছে ডাইনী অববাদ দিয়ে – বাউরি পাড়ার নীরজের বউ নাকি ডাইনী এবং সেই অপবাদ দিয়ে ওকে পাড়া থেকে একঘরে করে দেবার বন্দোব্যস্ত হয়েছে। নীরজের বউ বিচার চায়। সব কিছু শোনার পর পচা বলল –
- তোমরা তো খুব এক জটিল সমস্যা এনেছো গো
- এ পচা, এই মাগী ডাইনী আছে, ইতে আবার জটিল কি হলো?
- না, মানে তোমরা ডাইনী বললেই তো আর ডাইনী হবে না – প্রমাণ করতে হবে।
- কি প্রামন লিবি? উ যেদিন বাপের বাড়ি থেকে আসে, সি দিন আমার ষাঁড়া মোরগটা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে!
- আরে ধুর, এটা কোন প্রমাণ হল – একে বলে কো-ইনসিডেন্ট!
- হ্যাঁ, আমার মনটাও ‘কু’ গাইছিল বটেক, তবে?
- আরে ‘কু’ নয়, ‘কো’ – যাগগে ছাড়ান দাও। আর কি প্রমাণ আছে?
- এ বছর জমিতে আলু পাতার আগে ওর বিয়ে হলোক, আর দ্যাখো, এবার আলুর দাম! চাষের দাম উঠে নাই –
- ঠিক আছে মানছি, এবারে আলুর দাম নেই – কিন্তু তার জন্য তো ও দায়ী নয়!
- তবে কে দায়ী বটে?
- ওসব তোমরা বুঝবে না। বরং বলো, কি করলে তোমরা জানবে যে ও ডাইনী নয়?
পচার এই প্রশ্ন খুব গুঞ্জন তুলল বিচার সভাতে – বাউরি পাড়ার লোকেরা নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনাতে ডুবে গেল। অনেক আলোচনার পরে
- উ যদি শিমলাগড়ের কালী বাড়িতে গিয়ে ঠাকুরের থানে হাত দিয়ে বলে যে উ ডাইনী নয়, তাহলে আমরা মেনে নেব
- এটা ভালো প্রস্তাব [নীরজের বউয়ের দিকে ফিরে] – কি গো তুমি রাজী তো বলতে?
- [নীরজের বউ] আমি রাজী আছি, কিন্তু তুমাদের একজনকে যেতে হবে সাথে, সাক্ষী থাকতে
পচা পরল সম্যাসায়, কাকে পাঠানো যায় দিনের বেলা ওদের সাথে! সবার কাজ থাকে। অনেক ভেবে –
- তাহলে মজনু, তুমি কি করছ কাল সকালে?
- না এই মানে একটু ভাবছি, হয়ত –
- বুঝেছি তোমার কাজ নেই কাল, তাহলে তুমি কাল সকালে যাবে নীরজের বউয়ের সাথে।
মজনু দেখল সে ফেঁসে গেছে, তা একটা ফাঁসে কেন, তাই বলল
- তা, ষষ্টেরও তো কাজ নেই কাল সকালে, ও তো কালকেই মাছ নিয়ে এল ডায়মন্ডহারবার থেকে
ষষ্টে কিছু বলার আগেই, পচা বলে উঠল
- তাহলে ষষ্টে, তুমিও কাল মজনুর সাথে যাবে
বিচার ফাইন্যাল হয়ে গেল প্রায়, ঠিক হল কাল সকালে ৮.৪৫ এর ট্রেনে দুই পক্ষ শিমলাগড় যাবে, আর সাক্ষী হিসাবে যাবে মজনু ও ষষ্টে। আমরা উঠতে যাচ্ছি পার্টি অফিস থেকে এমন সময় দেখলাম আমাদের গ্রামের গ্যাঁড়া সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হট্ করে দেখি নিতাই ডেকে উঠল, এই গ্যাঁড়া শোন এখানে। গ্যাঁড়া পার্টি অফিসে ঢুকল। নিতাই বলল –
- গ্যাঁড়া, তুই কিন্তু কি করছিস, কোথায় যাচ্ছিস – সাব আমার রেডারে ধরা পড়ছে!
গ্যাঁড়া গেল ঘাবড়ে – আমিও কিছু বুঝতে পারলাম না। গ্যাঁড়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে রেডার কি জিনিস ভাবতে ভাবতে চলে গেল। আবার হতভম্ভ ভাব দেখে নিতাই আমাকে বলল –
- বুঝলি না, গ্রামের ছোকরাদের এইভাবে আন্ডার কন্ট্রোল রাখতে হয়, থ্রেট দিয়ে।
আমি বুঝলাম – সেই দিনের বিচারের এফিসিয়েন্সী দেখে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। যাই হোক, পরের দিন বিকেলে নীরজের বউয়ের সাথে দেখা, জানতে চাইলাম সব মিটমাট হয়েছে কিনা। নীরজের বউ বলল –
- সকালে স্টিশনে গিয়েছিলুম, কিন্তু তুমাদের পচা যাদের আস্তে বলে ছিল, তারা কেউ তো এলো নাই!
আমি সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ব্যাপারটা পার্টি অফিসে জানার জন্য ঢুঁ মারতে বাঁশতলার কাছে বাঁকটা নিয়েছি, দেখি পার্টি অফিস থেকে আরেক সদস্য দিবাকর হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে এসে কানের গোড়ায় ফিসফাস করে জিজ্ঞেস করল –
- কাউকে দেখলি তুই?
- কাকে দেখব? আর এই অন্ধকার শুনশান রাস্তায় এতো কানের গোড়ায় এসে ফিসফাস করে বলারি বা কি আছে?
- তুই বুঝছিস না – সব স্পাই এ ছেয়ে গেছে, চারিদিকে শুঁকে বেড়াচ্ছে –
আমি দিবাকরের কোড ওয়ার্ড কিছুই বুঝতে না পেরে ওর সাথে পার্টি অফিসের দিকে এগুলাম। কাছে গিয়ে শুনলাম, নিতাই হুঙ্কার দিচ্ছে –
- সব শালার ভিতরে ঢুকিয়ে দেব, চারিদিকে আমার নজর – কোথায় যাবি?
আমার জিজ্ঞাস্যু ভাব দেখে, চোখ টিপে নিতাই বলল,
- কন্ট্রোলে রাখতে হয় বুঝলি? চাপে রাখতে হয়।
আমি ঘাড় নাড়লাম, যদিও বুঝতে পারলাম না নিতাই কাকে কিভাবে চাপে রাখতে চাইছে। পচাকে আমি নীরজের বউয়ের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলাম, কেন কেউ যায়নি – পচা বলল
- আরে ছাড় তো, কত যাবি? বিচার করে দিলাম, এটাই অনেক।
খানিক গল্প হল সেদিন। আমাকে বলল, তোকে কালকে লাগতে পারে – মল্লিক পাড়া বনাম হাজরাদের একটা কেস আছে। দুই দলই দাবী করছে জমি তাদের। একটা পুরানো কোর্টের রায় আছে ইংরাজীতে, তুই একটু পড়ে দিবি, তার পর আমরা বিচার করব। আমি বললাম আমি পড়লে হবে কিনা। বলল, তুই তো নিরপেক্ষ, সবাই তো চেনে, প্রবলেম নেই। দরকার হলে ডেকো বলে চলে এলাম।
রবিকে জিজ্ঞেস করলাম পরের দিন, আচ্ছা তোদের দল কি পয়সা মাড়ছে? আমি জানি রবি সৎ ছেলে, অন্তত এখনো। রবি জানালো যে, ইন্দিরা যোজনায় ঘর করতে গরীবদের টাকা দেওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত থেকে। আর সেই টাকা পাইয়ে দিতে ওদের দলের কে নাকি ৩০ হাজার করে দাবি করছিল। তাকে গুচ্ছ ক্যালানি দেওয়া হয়েছে এবং দল থেকে বিতারিত। ওরা সৎ ভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছে। আমাকে জানালো যে ওদের অনেক ভালো পরিকল্পনা আছে – কিছু দিন পরে গরীবদের কম্বল বিতরণ করবএ, চাঁদা দিতে হবে। আমি দিলাম, মনে করিয়ে দিলাম যে মরে দিস না যেন টাকাটা। ক্ষমতায় আসার পর থেকে রবিদের দল কি কি ইন্টারেষ্টিং কাজ করেছে জানতে চাইলাম – নিম্নলিখিত টপিক গুলি উদ্ধৃত হলঃ
- কাশী এবং কাশীর তৃতীয় পক্ষের বউয়ের মধ্যে চলা দীর্ঘমেয়াদী কলহের পরিসমাপ্তি। তৃতীয় পক্ষের বউয়ের গর্ভে জন্মানো মেয়েটি যে কাশীর নিজেরই ঔরসজাত, সেটা কাশির স্বীকার করে নেওয়া।
- নিমোর রাস্তা চওড়া করতে গ্রাম্য অভিযান। সে সমস্ত লোকেরা রাস্তার জায়গায় বসার চেয়ার বা সদর দরজা বসিয়েছিল সেই সব ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া। [কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে, এর প্রধান কালপ্রিট হবে নিতাই নিজে, আমি সেটা পয়েন্ট আউট করলে, নিঃস্তব্ধতা নেমে এল]।
- গ্রামের রাস্তা মোরাম থেকে পীচ এ উত্তীর্ণ হবার জন্য টাকা স্যাঙসন এবং অনেকটা অলরেডি হয়ে যাওয়া।
- কিছুদিন আগে নিদারুণ বৃষ্টি জনিত বন্যার সৃষ্টি হলে কবলিত এলাকায় চিঁড়েমুড়ি ও ত্রিপল বিতরণ।
আমি ব্যর্থতার কথা কথা জিজ্ঞেস করলাম – আমাকে বলা হল, “জানোই তো”। বুঝলাম অনেক! রবিকে মনে করিয়ে দিলাম যে পার্টি করতে গিয়ে আমার জানালা-দরজা পালিশ করে দেবার যে কথা ছিল সেটা যেন না ভোলে। বলল – কাল থেকেই পাঠাচ্ছি!
ভালো হয়েছে।
এটাও কিঞ্চিত লিখেছিলাম আগে - তবে নিমোর গল্প বলে এখানেও তোলা থাক।
আমাদের ভ্রাতৃস্থানীয় ব্যাচে এখন নিমোতে দুজন পুলিশে চাকুরী করে - তপন আর বামুনদের পল্টু।
তপন আমার এবং আমাদের এক নির্ভর যোগ্য খুঁটি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে পিকনিক হবে – আমি শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করে আর টাকা দিয়েই খালাস – তপন ছোটাছুটি করে চল্লিশ জন ছেলেকে খবর দেওয়া, বাজার করা থেকে শুরু করে বাকি সব কিছুই করত – যার মধ্যে বাজার করা, মদের অ্যারেঞ্জমেন্ট, আর রাঁধতে আসতে না চাওয়া বুধো কলুকে পুনরায় পিকনিকে রান্নায় রাজী করানো, লাইটের ব্যবস্থা, রান্নার সরঞ্জাম জোগাড় – এই সব নানা বিধ কাজ জুড়ে ছিল। পড়াশুনার লিমিটেশনের দরুণ এবং বাপ পুলিশ হবার জন্য তপনের ভবিতব্য যেন পুলিশ হবার জন্যই ঠিক হয়ে ছিল। আমরা এক সময় মাঠে ভোর বেলা ছোটা প্র্যাক্টিস করতে গেছি – আমি ফিট থাকার জন্য আর তপন কনস্টেবলের দৌড় আর লঙ-জাম্প পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। যথাসময়ে তপন চাকুরী পেয়ে ব্যারাকপুরে চাকুরী করতে গেল – এটা আগের বছরের ঘটনা। ব্যারাকপুরে ট্রেনিং পিরিওডের গল্প আমাকে তপন শুনিয়েছে। প্রায় চারশো ছেলের জন্য মাত্র একটা পায়খানা, তপন সেখানে রাতে ভয়ে ঘুমাতো না ভোর বেলা পায়খানার লাইনে চান্স পাবে না বলে। ভোর চারটের সময় সে পায়খানা সারত – জলের কৌটা যার নিজের নিজের। আমি আর লজ্জা বশতঃ প্যানে জল কে ঢালত – সেই প্রশ্নটা আর করি নি। ট্রেনিং পিরিওডের শেষে তপনের পোষ্টিং হল শিলিগুড়িতে – সে বারে পুজোয় গিয়ে দেখা তপনের সাথে একদিন সকালে নিমো ভারত সেবক সমাজ ক্লাব চত্ত্বরে।
ততদিনে তপনের বিয়ে হয়ে গেছে, শুনেছিলাম যে বিয়ের পর তপন বউকে নিয়ে দীঘা গ্যাছে নাকি হানিমুনে। জিজ্ঞেস করলাম কেমন বেড়ালি -
- আর বলো না, হাওড়া থেকে গেছি তো দুরন্ত-তে। বউ বলল এসি-তে যাবে। আমি বউকে বললাম, দ্যাখো আমি ট্রেনে উঠে কাগজ পেতে পেচ্ছাপ খানার পাশে চুপ করে সেঁটিয়ে যাওয়া পাবলিক – এসি-ফেসি তে যেতে গিয়ে কি কেলো হবে আমি জানি না। বউ নাছোর – হাওড়া তে গিয়ে কম্পর্টমেন্টে সিট খুঁজে বসলাম। বাঁড়া, কি ঠান্ডা করছিল দাদা তোমায় বোঝাতে পারব না। বসে আছি তো বসেই আছি – বাল, কেউ আর ওঠে না। বউ খোঁছাচ্ছে, কিগো ঠিক চাপলাম তো। আমি তো দিলাম ঝেড়ে, বলেছিলাম আমি এই সব বুঝি না – কোনদিন এসি মারিয়েছি যে জানব? ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলে একটা খাবার নিয়ে যাওয়া ভেন্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা এখানে এতো ঠান্ডা করছে কেন? সুইচ-টুইচ কোথাও আছে নাকি? আর বাকি পাবলিকই বা গেল কোথায়? মালটা আমাকে বলল যে, আজকে ট্রেন ফাঁকা আছে – অন্য কামরায় গিয়ে বসতে। সেই শুনে আবার পিছনের দিকে লোকজন থাকা কামরায় গিয়ে বসলাম।
এরপর জিজ্ঞেস করলাম চাকুরী কেমন চলছে বা চাপ আছে কিনা -
- আর বলো না দাদা – এই তো পুজোর সময় ‘ডান্সিং কার’ নিয়ে খুব বিজি ছিলাম।
আমি এক ‘ডান্সিং কার’ বুঝি – কিন্তু সেই জিনিস তপন কি করে জানবে ভেবে কনফিউজড হয়ে গেলাম। তাই ক্লারিফিকেশনের জন্য
- ‘ডান্সিং কার’ কি রে?
- পুজোর সময় রাতে টহল দিয়ে বেরিয়ে মাঝে মাঝে দেখি রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর গাড়ি নড়ছে, মানে দাদা ভিতরে কাজ চলছে আর কি!
তপনের ‘ড্যান্সিং কার’ আর আমার জানা ‘ড্যান্সিং কার’ একই বোঝা গেল – আরো ক্লীয়ার হল যে পুলিশে আজকাল সত্যি করেই পড়াশুনা জানা ছেলেরা জয়েন করছে।!
- তোরা কি পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিস?
- তাই করি বেশীর ভাগ সময়। তবে এই পুজোর সময় পুলিশ ড্রাইভার সব ব্যস্ত থাকায় সিভিল ড্রাইভার ভাড়া করতে হয়েছিল। সে খানকীর ছেলে কিসুই জানে না – আরে বাঁড়া, গাড়ি তো সামনে নিয়ে গিয়ে আড়াআড়ি দাঁড় করাবি! তা না, দিল শালা পিছনে গিয়ে দাঁড় করিয়ে – তা সেই টাটা সুমো থেকে বেরিয়ে আর কি মাল ধরা যায়? মনে হয়ে ওই মালেরা অ্যাক্সিলেটারে পা দিয়েই কাজ করছিল- যেভাবে হুস করে বেরিয়ে গেল!
- যাঃ, তাহলে কিছু কামাই হাতছাড়া হল। আর কিছু ইন্টারেষ্টিং করেছিস কি এর মধ্যে?
- এক দিন হায়না মারতে গিয়েছিলাম বুঝলে দাদা। সে তো বনবিভাগের লোক এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া ঘুম পাড়ানি গুলি নিয়ে গ্যাছে কি করে জানব? আমাদের আই সি-র পিছু পিছু আমরা যাচ্ছি। দু এক খান গুলি চলল, কারো গায়ে লাগলো না। অনেক তাড়া করার পর একটা গিয়ে লেগেছে হায়নার গায়ে, মাল নাতিয়ে পড়ে গ্যাছে। স্যার এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা বলছি স্যার যাবেন না। কে শওনে কার কথা – কাছে গিয়ে দ্যাখে হায়না ঘুমায় নি – দিয়েছে তাড়া। আই সি ছুটছে, বন বিভাগ ছুটছে, আমরা ছুটছি – তখনি জানতে পারলাম ওই সব ঘুম পাড়ানি গুলি অনেক দিনের পুরানো। আমরা তো ছুটে গিয়ে পুলিশ ভ্যানে ঢুকে ভিতর থেকে দিয়েছি লক করে। অনেক পরে আই সি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে, “আমাকে তোরা ফেলে চলে এলি? আর এখানে এসে গাড়ি লক করে বসে আছিস?”
- তোদের আই সি কি জাঁদরেল?
- জাঁদরেল না বাল! একবার শালা থানায় আটক করা গাড়ির নতুন টায়ার বেচে দিয়েছিল আর একটু হলে!
- বলিস কি রে! তা নিজে নিজে খুলল কি করে?
- আরে সেই বার একটা অ্যাক্সিডেন্টের গাড়ি থানায় আনা হয়েছে – গাড়ির ছটা টায়ারই নতুন। প্রায় ৩০-৪০ হাজার করে এক একটা টায়ার। বুজতেই পারছো দু-আড়াই লাখের ব্যাপার। তা আই সি করেছে কি, লক আপে থাকা দুটো চোরকে ফিট করেছে। তাদের বলেছে যে, আমি তোদের রাতের বেলা ছেড়ে দেব, তোরা টায়ার গুলো খুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে দিবি – আবার এসে ঢুকে পড়বি লক আপে। যা হবে ভাগ করে নেব। তা রাতের বেলায় হয়েছে কি মাল তো দিয়েছে ছেড়ে চোর গুলোকে। এবার যে রাতে ডিউটি থাকে, সে দেখতে পেয়ে গেছে চোর পালাচ্ছে, দিয়েছে সাইরেন বাজিয়ে। ধর – ধর – চোর ধরা পড়ে এই মার সেই মার। চোর চিৎকার করে আর বলে, মেরো না গো, তোমাদের স্যারই আমাদের চুরি করতে বলেছে! তখন ব্যাপার বোঝা যায় – বাকি সবাই স্যারকে বলে, আরে আগে জানাবেন তো যে আপনি ছেড়েছেন! তা তো জানাবেন না – কারণ পুরোটাই নিজে খাবার ধান্ধায় ছিলেন।! স্যার তখন আবার ছেড়ে দাও – ছেড়ে দাও বলে ব্যাপার সামলায়!
গল্প করতে করতে এবার পল্টু এসে ঢুকলো – ও পেয়েছে ওর বাবার চাকরীটা। অনেক দিন আগে, পল্টু যখন বাচ্ছা তখন ওর বাবা অন ডিউটি মারা যায়। তা সেই চাকুরী এখন করছে পল্টু। তবে পল্টুর লাইফ ইজি – চুঁচড়োর পুলিশ লাইনে থাকে আর একটা ব্যাঙ্কে গার্ডের ডিউটি দেয় (এই মুহুর্তে চুঁচড়ো কোর্টের জাজের বডিগার্ড)। আমি পল্টুর কাছ থেকে এককথা সে কথার পর ওদের উপরি ইনকামের চান্স আছে কিনা জানতে চাইলাম। পল্টু বলল
- আমাদের দিকে দাদা উপরি হয় অ্যাক্সিডেন্ট হলে!
- তার মানে?
- ওই সেটেল করা পয়সা আর কি মালিক কি আর কোর্টে যেতে চায়! একদিন বিকেলে মুড়ি খাচ্ছি পুলিশ ফাড়িঁতে, হঠাৎ করে খবর এলো বালি ব্রীজে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সব দূর দার করে রেডি হতে লাগল। কেউ তো গেঞ্জী পরেই ছুটলো। আমাকে বলল, “মুখার্জী – তাড়াতাড়ি গেঞ্জীটা গলিয়ে নাও – পরে জীপে জায়গা পাবে না”। তা দেখলাম ঠিকই – গিয়ে দেখি দুটো জীপ চলে গ্যাছে, আমরা ৩ নম্বর জীপটায় কোন ক্রমে ঝুলতে ঝুলতে চললাম।
- এতে তোদের ইনকাম টা কোথায়?
- শোনো না – লরী তো থানায় নিয়ে চলে এলাম। লরী মালিক চলে এলো স্যারের সাথে সেটেল করতে। আমরা বাইরে কান পেতে বসে আছি। স্যার বলছে – “এক লাখের কমে কি করে সেটেল করব বলুন তো? কত গুলো আমার ছেলে গিয়েছিল দেখেছেন তো? তাদের দিতে হবে, আবার আমাকে উপরে কিছু পাঠাতে হবে। এর কমে সেটেল করলে আমি কি করে জবাব দেব?” গাড়ির মালিক অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে ৭৫ হাজারে উঠল। এবার স্যার বলছে – “ঠিক আছে, আপনি ওটা ৮০ করে দিন, রাউন্ড ফিগার। এর কমে হয় না – আপনি বলেই ব্যালেন্স করে নিচ্ছি”। মালিক চলে গেল টাকা দিয়ে – আমাদের পাঁচশো করে দিয়ে বোকাচোদা বাকিটা নিজের পকেটে পুরলো!
গল্প করতে করতে দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেল প্রায় – নিমো ভারত সেবক সমাজ সকাল বেলার মত ক্লোজ হবার সময় হয়ে এল। আবার খুলবে সন্ধ্যেবেলা – বাকি গল্প তখন হবে বলে আমরা উঠে পড়লাম।
আগেও পড়েছি। আবারও পড়লাম।
চিরনতুন।
ধাতু-বিদ্যা
------------------
তখন আমি ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করি। সেবার ছুটিতে নিমো এসেছি, একদিন পাকড়াও হয়ে গেলাম বারোয়ারী তলায়। সেই বারোয়ারী তলায় নিমোর রাজ্যের জ্যাঠা সকল গুলতানি করত। আমাকে এক জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলঃ
- সুকান, তোর বাপ বলল যে তুই নাকি বিলেত গেছিস পড়াশুনা করতে। তা আমাদের মত করে একটু বুঝিয়ে বলত, তুই ওখানে ঠিক করছিস টা কি?
আমি ফাঁপরে পরে গেলাম, মেটালার্জি – করোশন এই সব কি ভাবে সহজ করে বোঝাবো! একটু ভেবে বললাম,
- জ্যাঠা, ওই ধাতু নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর কি
জ্যাঠা নড়েচড়ে উঠল,
- বলিস কি রে সুকান, ও দেশেও ধাতু নিয়ে মাতামাতি আছে!
দিয়ে পাশের শিবে জ্যাঠার দিকে ঘুরে বলল, “শিবে, তালেপরে এ সমস্যা শুধু আমাদের নয় – সাহেবদেরও টনক নড়েছে”। এবার আমার দিকে ফিরে
- তা ধাতুর কোন ব্যাপারটা নিয়ে তুই নাড়ানাড়ি করিস?
আমি তখনো কেস বুঝতে পারি নি কোন দিকে গড়াচ্ছে। বেশ সরল মনে বললাম,
- জ্যাঠা, আমি ওই ধাতু-ক্ষয় নিয়ে পড়াশুনা করছি
জ্যাঠা আরো বেশী উত্তেজিত
- শিবে, কি বললাম। আমরা শালা না জেনেই শুধু শুধু নিজেদের দোষারোপ করি। সাহেবরাও তো মানুষ নাকি – মনুষ্য অঙ্গের সমস্যা কাউকে কি আর ছাড়বে!
এর পর আমার উপর ফরমান এল
- তা ভালো জিনিস নিয়ে পড়াশুনা করছিস সুকান। বলি কি, তাড়াতাড়ি শেষ করে দেশে ফিরে আয়। আমাদের না হয় বয়স হয়ে গ্যাছে। কিন্তু তুই ফিরে এলে আর গ্রামের ছোকরা গুলোকে ডাঃ কাশেম কাছে ছুটতে হবে না বারে বারে!
পাশ থেকে কে বলে উঠল – “জ্যাঠা, ডাঃ কাশেম শুধু কেন? কেজা গ্রামের মানু ডাক্তারও তো রয়েছে”।
জ্যাঠা উত্তর শুনতে শুনতে আমি বাড়ির দিকে এগুলাম,
“তুই আর আমাকে ঠাকুর তলায় বসে মুখ খারাপ করাস নি। মানু করবে ধাতুর চিকিৎসা? ওর নিজেরটা …
বাকিটা আর কানে এল না আমার -
যাচ্ছেতাই :-)
বাঁকুর বউ আমাদের বাড়ি কুমড়ো কিনতে আসত একসময়। পাইকারী নয়, ঢাউস কুমড়ো হলে একটা, আর একটু ছোট হলে দুটো কিনে নিয়ে গিয়ে বর্ধমানে তেঁতুলতলা বাজারে বসে কেটে বিক্রী করত।
সকাল সাতটার আগেই বাঁকুর বউ কুমড়ো কিনতে হাজির। কুমড়োর গাদা থেকে টুক-টাক ঠোকা মেরে কুমড়ো পছন্দ হল, একটু ফালি কেটে দেখা হল ভিতর লাল কিনা - কারণ রঙ না হলে কুমড়োর দাম নেই।
এর পর শুরু হত আসল গল্প। বাবা বলল,
- কি বউ, কি দাম দেবে?
- দাদা, আপনি বলেন
বাঁকুর বউ জুত করে উঠোনে বসে ঠাকুমার সাথে গল্প করতে করতে পান সাজতে শুরু করল। বাবা মাঠ দেখতে গিয়ে, একেবারে নারাণের দোকানে চা খেয়ে ঘন্টা খানেক পরে ফিরে
- কি, বউ - কি ঠিক করলে?
- দাদা, আপনি বলেন যা বলার
আবার গল্পে নিমজ্জিত হয়ে গেল ঠাকুমার সাথে - বাবাও আবার খামাড়ে ধান ঝাড়া দেখতে গেল
এই করে করে বেলা দশটা হয়ে গেল, এবার বাবা স্কুল যাবে। ফাইনাল জিজ্ঞাসা
- বউ, এবার বল কি দাম দিচ্ছ
- দাদা, কি আর বলি, আগের দিনের দামটাই নেবেন
- ঠিক আছে, তাই দিও
সাড়ে দশটায় বাঁকুর বউ মুড়ি খেয়ে ঝাঁকা নিয়ে বিদায় নিল।
আজকাল ওয়ার্কিং-ফ্রম-হোম আর অনলাইন ক্লাসের ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার বাঁকুর বউয়ের কথা খুব মনে হয়।
আজকে আমাকে স্মৃতিতে পেয়েছে - তাই বলেই রাখি। একজনের কাজকর্ম দেখে আজকাল আমার গঙ্গা পাঁজার কথা খুব করে মনে আসছে।
গঙ্গা পাঁজা আমার মামার বাড়ির দেশের লোক - যাত্রা করে বিশাল নাম করেছিল। এমনিতে ছাগল চড়িয়ে খেত, কিন্তু যাত্রা - যাত্রা করে গায়ে রঙ চঙে পোষাক চাপিয়ে এক বিশাল ইমেজ গড়ে তুলেছিল রাজা রাজা ভাব একটা।
তো সেবার যাত্রা হচ্ছে - গঙ্গা পাঁজা গ্রীন রুম থেকে খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে স্টেজে। পাবলিক সব থরোথরো টেনশনে, কি হয় কি হয় ভাব।
স্টেজে ঢোকার জাষ্ট একটু আগে একটা গরু বাঁধার গোঁজ ছিল - আলো আঁধারে ঠিক দেখতে না পেয়ে গঙ্গা পাঁজা বিশাল হোঁচট খেয়ে ছিটকে ঢুকলো স্টেজে। তলোয়ার হাত থেকে ছিটকে সেই ওদিকে, জামা কাপড়ে ধূলো লেগে একশা। কিন্তু গঙ্গা পাঁজা অনেক দিনের খেলোয়াড় - ওতেও টলল না। ধীরে ধীরে উঠে তলোয়ারটা নিল হাতে, দিয়ে গোঁজের দিকে তাকিয়ে, বিশাল উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
"কেবা হেথা গাড়িয়াছে গোঁজ, তারে আমি দিব শাস্তি সমুচিত"।
পাবলিক ঠিক বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে - তারা গঙ্গা পাঁজাকে নয়নের মণি করে রেখেছে। তারা ভালোবাসে হায়, হায় করে উঠলো - গুরু কি দিলে! হাততালিতে ভরে গেল যাত্রা প্রাঙ্গণ।
দু একজন সন্দেহ প্রকাশ করল যে গঙ্গা ছড়ানোর পরে মেকাপ দিচ্ছে - কিন্তু তাদের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল বাকি গঙ্গা পাঁজার ফ্যানদের গলার জোরে।
আমার খুব গঙ্গা পাঁজার কথা মনে হচ্ছে একজনার কাজ কর্ম দেখে।