********************
মৃতা স্ত্রীকে নিয়ে কবি-স্বামীর লেখা বাংলা কবিতা পড়েছি। অক্ষয় বড়ালের 'এষা’।
মৃত স্বামীকে নিয়ে কবি-স্ত্রীর লেখা বাংলা কবিতা পড়েছি। গিরীন্দ্রমোহিনীর ‘অশ্রুকণা’।
কিন্তু মৃত মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে এখন-প্রায়-পঁচাত্তর দেবারতি মিত্র—রুগ্ণ দরিদ্র এবং নিঃসঙ্গ—যে-দাম্পত্যপ্রেমের কবিতাগুলি লিখে চলেছেন, বাংলা ভাষায় লেখা দাম্পত্যপ্রেমের কবিতা-ঐতিহ্যে কি কোথাও এগুলির তুলনা পাওয়া যাবে? এমনকি মৃতা মৃণালিনীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা—‘স্মরণ’ ও স্মরণাধিক—কি এর ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারবে? এর স্বর্গীয় সহজতা জীবনের সেই গভীরতা থেকে উত্থিত যে-গভীরে মাথা ডোবানো মোটেই সহজ নয়।
‘এক কাপ চা দাও’ তুমি বললে
কতদিন পরে আজ কতদিন পরে।
অনন্তের পার থেকে তোমার গলার স্বর
তীক্ষ্ণ নীল সূর্যরশ্মি নয়, নয় এ তো
শ্রাবণসন্ধ্যার একটানা ঝিল্লিরব।
বেলফুল গাছের গোড়ায়
একটু একটু করে জল ঢালবার মতো
তোমার গলার স্বর
আমার আত্মাকে শান্তি দিল,
লোকান্তরে নিয়ে গেল আজ।
তুমি-যে ‘অনন্তের পার থেকে’ আমার কাছে এক কাপ চা চাইলে, তোমার সেই চাওয়া যেন ‘বেলফুল গাছের গোড়ায়/একটু একটু করে জল ঢালবার মতো’ ‘আমার আত্মাকে শান্তি দিল’, নিয়ে গেল তোমার সান্নিধ্যে—লোকান্তরে। জীবিত এখানে মৃতের শান্তিকামনায় জল ঢালেনি, বরং মৃতই যেন জল ঢেলেছে জীবিতের অস্তিত্বের শিকড়ে।
আর-একটি কবিতা—
শোকের আগুনে
অশ্রুজলে সেদ্ধ হতে হতে
একমুঠো চাল আমার জীবন
আজ হাঁড়িভরতি ভাত
উথলে পড়ছে, উপচে উঠছে।
এই অন্ন কেউ খাবে?
এই অন্ন কাকে দেব?
এসো, বোসো,
তোমাকেই আস্তেব্যস্তে বেড়ে দিই—
তুমি খাও, খেয়ে তৃপ্ত হও।
ছোটোখাটো কবিরা আজ আর কেউ ‘শোকের আগুন’ বা ‘অশ্রুজলে সেদ্ধ’ –র মতো অতিব্যবহারে ভোঁতা ছুরিকে পুনর্ব্যবহার করবার সাহস করবেন না; কিন্তু দেবারতি ছোটোখাটো নন বলেই অক্লেশে তা করেছেন। একমুঠো চালের মতো স্বল্পসম্পদ তাঁর জীবন আজ স্মরণবেদনার ঐশ্বর্যে নিজেকে অতিক্রম করে উপচীয়মান—লৌকিক তণ্ডুলগুলি রূপান্তরিত হয়েছে অ-লৌকিক শিল্পের অন্নে—‘এসো, বোসো,/তোমাকেই আস্তেব্যস্তে বেড়ে দিই--/তুমি খাও, খেয়ে তৃপ্ত হও’। রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য অমিতকে বলেছিল, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান’; আর দেবারতি বললেন, তোমার বিরহেই আমার এই গরিব হাঁড়ি—যুধিষ্ঠিরের সেই মায়ামোহময় কটাহ—দ্রৌপদীর অনিঃশেষ অন্নপাত্রে পরিণত হয়েছে, এসো আহার করো।
এইবার এই গুণীভূতব্যঙ্গ্যটুকুকে দেখুন—
বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ডের মতো চাঁদ কাঁধে নিয়ে
চলেছে ব্যাপারী।
বেশি পাকা হলদে কুমড়ো হাটে বিক্রি হয়নি
তাই মুখ ভার,
তার কাঁচাপাকা চুল, মোটা ভুরু যেন
ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ,
ফুটি ফুটি তারাগুলি ডান হাতের শুকনো নিমফুল।
বাতাসের প্রাণ নেই, সাড় নেই—
আকাশ যে দেখি হাটবাজার হয়ে উঠল!
কোথায় নিশ্বাস নেব আজ?
এর ব্যঙ্গ্য তো ব্যাস্ এইটুকুই যে, বৃদ্ধা বিধবার আকাশে বুড়ি চাঁদ উঠেছে পূর্ণিমার—সঙ্গে রয়েছে ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ আর ফুটি ফুটি তারা। যেহেতু বাতাসের প্রাণ নেই, সাড় নেই, তাই এই ব্যঙ্গ্যকে গুণীভূত করে দিয়ে আকাশ একটি স্থির বাচ্যকেই মুখ্যরূপে চিত্রিত করে তুলে—সংবৃতনিশ্বাস—ধরে রাখতে পারল। কী সেটা? হাটবাজারে এক কাঁচাপাকা চুল আর মোটা ভুরু -ওয়ালা ব্যাপারী তার পাকাহলুদ বুড়ো কুমড়োখানি বেচতে না পেরে অগত্যা কাঁধে নিয়েই গোমড়ামুখে ফিরে চলেছে, তার ডান হাতে রয়েছে কয়েকটা শুকনো নিমফুল।
ওই মোটাভুরুর বুড়োটা-যে মণীন্দ্র গুপ্ত, তাও কি বলে দিতে হবে? কী ভেবেছিলে তুমি? বুড়ি বউটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিশেষরূপে-বহন-করা ‘বিবাহ’ শব্দ থেকে খালাস পাবে? অত সহজে তোমাকে নিস্তার দেব নাকি! কেউ নেবে না তোমার বুড়িকে, এক তুমি বুড়ো ছাড়া।
অতএব এই-যে বুড়ো মুখ ভার করে কাঁধে বুড়ো কুমড়ো নিয়ে দাম্পত্যে ফিরছে—এ কি সত্যিই নিরুপায় প্রত্যাবর্তন? দূর—তাহলে কি আর বুড়োর ডান হাতে ওই শুকনো নিমফুলগুলি থাকত? ওই ডান হাতের উপরেই-না আর-একজন তার বাঁ-হাতখানি রেখেছিল কতকাল আগে! যেদিন ‘নিমফুলের গন্ধ অন্ধকার ঘরে/অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণ নিয়ে’ এসেছিল ‘শাপমোচন’-এর কমলিকার কাছে, সেদিন ‘কোন্ জন্মান্তরের, কোন্ লোকান্তরের’ সদ্যজাগ্রত স্মৃতির মধ্যে মিশে গিয়েছিল ওই নিমফুলের ঘ্রাণ।
কবিপুরুষ তাঁর ভিতর-জীবনে স্ত্রীকে ঢুকতে দেন না—এই অনুযোগ ইদানীন্তন নয়। কিন্তু স্ত্রীটি নিজেও যদি কবি হন? তাহলেও কি পরিস্থিতি একই থাকে? ‘অক্ষয় মালবেরি’-তে মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘ছেলেবেলা থেকে অতি ছোট, একলার মতো, নিভৃত কুটির বানাবার ঝোঁক ছিল আমার। ঘর কত ছোট আর হালকাপলকা হতে পারে আমি তার অনেক রকম নকশা ভাবতাম। স্টীমারের সারেঙের কেবিন, ক্যাপ্টেন স্কটের জাহাজের খুপরিটি, ঢাকনা খোলা কফিন, এক-তাতামির জাপানী কুঁড়ে, পানের দোকানের নিচে বিড়ি বাঁধার ঘর, গ্রামের ঘরের ভিতে হাঁসের খোঁয়াড়, সাধুর গুহা, নীলগিরির টোডাদের কুটির—ছোট নির্জন ঘরের বিচিত্র সম্ভাবনা।’ এই ‘এক-তাতামি’ অর্থাৎ এক-মাদুরেই-মেঝে-ঢাকা-যায় এমন ছোট্ট ঘরে কি আর দুজনকে ধরে?
মণীন্দ্রের এই একলার ঘরটিকে দেবারতি চড়িয়ে দিয়েছেন ‘টঙে’। এর কারণটা পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথে : ‘জগতের উপরে মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কারখানা—সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি।'
এইবার দেবারতির এই কবিতাটি পড়ুন—
পাতার বাড়িতে যাই এক পা এক পা করে
সিঁড়ি বেয়ে টঙে উঠি।
চটি খুলে ঘরে ঢুকি। রেখে আসি
স্বচ্ছ এক গ্লাস জল, চা ও অশ্রু, খবর কাগজ।
কে আসে, কে চলে যায়, ভ্রূক্ষেপ নেই তার—
দোলনাগড়ন ছায়ার ভঙ্গিতে চায়,
মায়ার প্রস্বরে কথা বলে,
গলাগলি করে শুনি আলো-বাতাসের সঙ্গে।
ভুলে যায় আমারও তো তৃষ্ণা থাকতে পারে।
নীচে ক্ষুধা, সবই জানে—
অনিবার্য খুন ও প্রশ্রয়,
পরিত্রাহি জীবজন্তু অরণ্য ও বন।
ছন্নছাড়া মন কাকে বা আশ্রয় করে বেঁচে থাকে,
কাকে বলে সমস্যার কথা?
সন্ধ্যাবেলা যাইনি তো কোনোদিন।
তখন কি নীলাভ অন্তর ফেটে তার আলো জ্বলে,
তখন কি মানুষের ভবিষ্যৎ পাঠ করো,
তার সঙ্গে শরীরী তুমিও?
স্বামীর কবিত্বের এই একলার ঘরটিতে স্ত্রী নিজে কবি হলেও নেহাতই বহিরাগত অতিথি—‘চটি খুলে ঘরে ঢুকি’। জল-চা-খবরের কাগজের সঙ্গেই মিশে থাকে ‘অশ্রু’, ‘কে আসে, কে চলে যায়, ভ্রূক্ষেপ নেই তার’, আলো-বাতাসের সঙ্গে গলাগলি-করা সেই বিশ্বসত্ত্ব কবি ‘ভুলে যায় আমারও তো তৃষ্ণা থাকতে পারে’! ‘ছন্নছাড়া মন কাকে বা আশ্রয় করে বেঁচে থাকে,/কাকে বলে সমস্যার কথা?’ এই অনুযোগ আর অভিমানগুলি নারীর এবং তা অত্যন্ত অভিনব নয়; কিন্তু অন্তিম স্তবকে যে-দেবারতি সন্ধ্যাবেলায় নীচে থেকে উপরের দিকে মণীন্দ্রের ঘরটির দিকে তাকান, কিন্তু স্বেচ্ছায় কদাপি উপরে ওঠেন না, সেই দেবারতি নিজে কবি বলেই জানেন যে, সৃজনের সেই তুরীয় মুহূর্তগুলিতে এমনকি দাম্পত্যের অধিকারকেও সংযত রাখতে হয়। এই সংবেদনময় আত্মনিবৃত্তির আভিজাত্যেই নিজের নারী-অভিমানকে কবি দেবারতি অতিক্রম করেছেন।
আধুনিক বাংলা কবিতায় যথার্থ কবি-দম্পতি একমাত্র এঁরাই : মণীন্দ্র গুপ্ত আর দেবারতি মিত্র। হ্যাঁ, বইমেলার মহার্ঘ্য দেয়ালে থাকুন-না সুবোধ আর মল্লিকা। বিপণনের চৌকশ দুনিয়াদারিতে যাঁরা পরাভূত হলেন, সেই পরাভবের মধ্যেই তাঁদের পরমায়ু।