সন্ধ্যা সামন্ত (নাম পরিবর্তিত): বয়স ৩০। বাড়ি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর। আগে কলকাতায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করতেন। লকডাউনের জেরে কাজ গিয়েছে। বেশ কয়েক মাস বেকার থাকার পর এখন যৌনকর্মী।
মালতি সর্দার (নাম পরিবর্তিত): বয়স ৩৬। বাড়ি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি। আগে বানতলার একটি চামড়ার কারখানায় কাজ করতেন। লকডাউনের সময় কাজে যেতে পারছিলেন না। সে কাজ টেকেনি। অনেক পথ ঘুরে এখন যৌনকর্মী।
হুগলি নদীর জলে সূর্য ডুবলেই ডায়মন্ড হারবারের ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক বা নদীর ধারে ভিড় করেন এ রকম সন্ধ্যা, মালতির মতো আরও অনেকে। তাঁরা কেউ কিছু দিন আগে পর্যন্ত ছিলেন পরিচারিকা, কেউ বা শ্রমিক, কেউ আবার সব্জি ব্যবসায়ী। জেটি ঘাট থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার ধরে জাতীয় সড়কের দু’ধারে রোজ সন্ধ্যাতেই দেখা মেলে তাঁদের। প্রসাধনের মোড়কে নিজেদের ঢেকে ওঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তায়। লকডাউন পর্বে কাজ হারানোর পর করোনা-সংক্রমণের শঙ্কাকে অগ্রাহ্য করে রোজগারের আশায় এই পেশায় ভিড় বাড়ছে রোজ। স্থানীয় সমাজকর্মীদের একাংশের এমনটাই দাবি।
সন্ধ্যার স্বামী যেমন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। গত দু’বছর ধরে শয্যাশায়ী। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি মাসে কয়েক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। দুটো বাচ্চা রয়েছে। আগে কলকাতায় পরিচারিকার কাজ করতে যেতাম। সকালে যাওয়া, রাতে ফেরা। কিন্তু, করোনার সময় আমাকে সে সব বাড়ি থেকে যেতে বারণ করে দিল। আমার জন্য করোনা হতে পারে তাঁদের। তার পর তো ট্রেন-বাসই বন্ধ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কোনও কাজ না পাওয়ায় আমার এক দিদি এই কাজে নামার কথা বলে। সংসার চালানোর জন্য আমিও রাজি হয়ে যাই।’’
কিন্তু যে পেশায় সন্ধ্যা এলেন, সেখানেও তো করোনার থাবা। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এ পেশায় অসম্ভব। কাজেই ‘খদ্দের’ আগের চেয়ে অনেক কম। মালতি যেমন বলছিলেন, ‘‘ভেবেছিলাম এই পথে আয় হবে। পরিবারের চাহিদা মিটবে। কিন্তু রোজই খদ্দের কমছে। যে ক’জন আসেন তাঁদের করোনা-ভয় কাটলেও পুলিশের ভয় থাকে। যখন তখন এসে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। সঙ্গে বাড়ছে আমাদের মতো মেয়েদের এ পথে চলে আসা। কী ভাবে যে জীবন চলবে জানি না।’’
লকডাউনের সময় কাজ হারানোর পর এই পেশাকেই সম্বল করেছেন অনেকে। কিন্তু এখানেও রোজগারে টান পড়ায় দিশেহারা যৌনকর্মীদের অনেকেই এখন সরকারি সাহায্যের দাবি তুলছেন। সন্ধ্যা যেমন বলছিলেন, ‘‘সরকার যদি কোনও রকম একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিত, তা হলে উপকার হত। এখানে তেমন রোজগার নেই। আর ভয়ও করে। যদি কিছু হয়ে যায়!’’
ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক সুকান্ত সাহা যদিও বলছেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে যৌনকর্মীদের জন্য প্রতিটি ব্লক ও পুরসভা এলাকায় বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বনির্ভর প্রকল্পেও তাঁদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’’ সন্ধ্যা-মালতিরা যদিও সে সব কাজের সন্ধান পাননি এখনও।
যৌনপল্লি বাদ দিয়ে ডায়মন্ড হারবারে যৌনকর্মীর সংখ্যা কত, তার কোনও পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে নেই। নেই সমাজকর্মীদের কাছেও। স্থানীয় সমাজকর্মী স্বপ্না মিদ্যা যেমন বললেন, ‘‘যৌনপল্লির একটা হিসাব আমাদের কাছে আছে। কিন্তু এই পেশার অনেকেই এখন রাস্তার ধারে দাঁড়ান। তাঁদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানা নেই। কারণ, বেশির ভাগই নিজেদের পরিচয় গোপন করে রাখেন। তবুও আমাদের অনুমান, এই মুহূর্তে সংখ্যাটা ১০০-র উপরে তো হবেই।’’
সংখ্যাটা যে ধীরে ধীরে বাড়ছে তা-ও মেনে নিয়েছেন স্বপ্না। তাঁর মতে, লকডাউনের জেরে অনেক পেশাতেই সরাসরি কোপ পড়েছে। ফলে সে সব জায়গা থেকে কাজ হারানোদের অনেকেই এই পেশায় আসছেন। কিন্তু সেখানেও সামাজিক চোখরাঙানি রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘দু’বেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্যই অসহায় মহিলারা এই পথ বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকেই তাঁদের ভাল চোখে দেখেন না। পুলিশও মানবিক ভাবে দেখে না এই পেশাকে। তাদের কাছে মানবিক হওয়ার অনুরোধ করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি।’’
‘সামাজিকতা’র বালাই ভুলে কাজ হারিয়ে নতুন কাজে এসেছেন যাঁরা, তাঁরাও কি আদৌ স্বস্তিতে? কোভিড-কালে নিজের শরীর নিয়ে চিন্তা নেই? ‘‘ভয় পেলে পরিবার, সংসার চলবে কী ভাবে,’’— মনে করিয়ে দিচ্ছেন বছর ৫০-এর শ্যামলী নস্কর (নাম পরিবর্তিত)। সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে পেশাগত ব্যস্ততা যখন তুঙ্গে, অনিচ্ছা-সহ জবাব দিলেন শ্যামলী, ‘‘রোগে মরার চেয়ে না-খেতে পেয়ে মরা অনেক বেশি কষ্টের। করোনার ভয় নেই আমাদের। ভয় পেয়ে কী লাভ বলুন তো! ভয় দিয়ে তো আর পেট ভরবে না। সাহায্যের হাত এগিয়ে এলে এ পথে নামতেই হত না।’’ কথা শেষ হতে না হতেই ‘খদ্দের’-এর শরীরী ভাষা পড়ে নিয়েই এলাকা ছাড়লেন তিনি।
হুগলি নদীর পাড়ে, জাতীয় সড়কের ধারে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠছে একটা-দুটো করে। সে আলোর আড়ালেই রাস্তার দু’ধারে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে শুরু করে সন্ধ্যা, মালতী, শ্যামলীদের।