রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দের মূল পার্থক্যটা এসেনসিয়ালিস্টের সঙ্গে একজিস্টেন্সিয়ালিস্টের পার্থক্য বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব খোঁজখবর রাখা লোক ছিলেন। ফলে যখন 'সভ্যতার সংকট' লিখছেন, তখন দেখুন কীভাবে সমসাময়িক পৃথিবীর অন্ধকার দিকগুলিকে তুলে আনছেন। যে জাপানকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তার হিংস্র রূপ দেখে শঙ্কিত হচ্ছেন। আবার ইংরেজরা ভারত ছেড়ে গেলেও তাতে যে আমজনতার খুব লাভ হবেনা সেটাও বুঝতে পারছেন। কিন্তু শেষে গিয়ে লিখছেন 'পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে;' 'ঐ মহামানব আসে' ইত্যাদি। সব ক্ষতির পরে একটা ক্ষতিপূরণ আছে, এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের আজীবন ছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন 'ইউনিভার্সাল মাইন্ড' বলে একটা জিনিস আমদানি করেন, সেটা স্রেফ এই ক্ষতিপূরণের ধারণাটিকে ইমপ্লিমেন্ট করতে। মানুষের মধ্যে একটা ভালর তপস্যা আছে এরকম একটা কথায় ভরসা করতেন। এই 'ভাল' যে একদিন হয়ে ওঠা যাবে এটাই তাঁর সবচেয়ে গভীর বিশ্বাসের জায়গা ছিল। আধুনিক কবিতার সমালোচনা করতে গিয়েও তাই বলছেন যে সমাজ যখন রোগগ্রস্ত, তার বিছানার পাশে বসে আলোর কথা বলতে হবে, অন্ধকার হতাশার কথা নয়। ছবি তত বুঝিনা, বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন বটে রবীন্দ্রনাথের ছবি তাঁর ভেতরের অন্ধকার দিকটার প্রকাশ। কিন্তু ছবিতেও দেখুন সবসময় সিল্যুয়েট, ফোরগ্রাউন্ডে অন্ধকার, কিন্তু পিছনে ঐ দূরে একটি আলোর উৎস আছেই।
জীবনানন্দ, অপরপক্ষে, সম্পূর্ণ বিপরীত। সবচেয়ে অরাবীন্দ্রিক কবি। সুচেতনার শেষ স্তবক দেখুনঃ
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
শেষ লাইন দেখুন। রাত্রিটাকেও তিনি শাশ্বত বলে মেনে নিচ্ছেন, আবার তার বুকেই অনন্ত সূর্যোদয়। দুটোই সত্য। দুটোর মাঝখানে সিসিফাসের মত মানুষ পাথর ঠেলে চলেছে অবিরাম। এইজন্যই জীবনানন্দ ভীষণ আলাদা। কল্লোল যুগের কবিরা, জীবনানন্দের পরের বামঘরানার কবিরা অনেক চেষ্টা করেও রাবীন্দ্রিক না হয়ে পারেননি। কবিতায় হাজার হাজার শ্রমিক মজুর আমদানি করলেও এক লাইনও নতুন কথা লেখা যায় না। কবিতার ভেতরে দর্শনের যে জায়গা, ততদূর পৌঁছতে খুব কম কবিই পারেন। জীবনানন্দ পেরেছিলেন।
এটা তুলনামূলক আলোচনা স্রেফ। ছোটবড়র ব্যাপার নয়। :-)
'ভানু সিংহের পদাবলী' থেকে ধরলে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবন প্রায় ৬৪ বছরের। এই ৬৪ বছরের মধ্যে সকল কবি, লেখকই তাহলে তাঁর সমসাময়িক।
কবিতাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়না। প্রেম- অপ্রেম মেশানোও হতে পারে। জীবনানন্দের অনেক আগে ' বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে' বলে গেছেন 'To be or not to be......'
@Icm, সার্চে পুরনো টই খুঁজে পাচ্ছিনা।