কত গল্পই তো লেখা হয় নি – এমনকি নিমোর গল্পও! সেবারে রাস্তায় চাঁদু-মাষ্টার দাঁড় করিয়ে বললে, “সুকান, তোর বইটা তো পড়লাম। কিন্তু তুই তো অনেক গল্পই লিখিস নি! ডাবা-র গল্প লিখলি না, আসগার-এর কথাই বা লিখলি কোথায় – বা সঞ্জুর গল্প ওই এক প্যারাগ্রাফে ক্রিকেট নিয়ে লিখেই শেষ”! চাঁদু স্পষ্টতঃই মনক্ষুণ্ণ – কথা দিলাম যে নিমো গ্রামের গল্পের সেকেন্ড পার্ট লিখলে, ওদের কথা থাকবে।
এর ওর কথা থাকলে, বাড়ির ছেলেপুলেরাই বা বাদ যায় কেন! সেলফি আমি তুলতে পারি না – কিন্তু এবারে পয়লা জানুয়ারী দামোদরের ধারে পিকনিক করতে গিয়ে এই সেলফিটা তুলেছিলাম। এখন কাটাছেঁড়া করে দেখলাম যে ছবিটা নিতান্তই খারাপ ওঠে নি! ছবির একদম ডানদিকে আছে পল্টু – ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিশাল বড় কর্তা এখন। যদি ওর ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলেন বা লোন নেন, তাহলে আপনার টাকা কিভাবে সামলালে ভালো হবে সেটা আপনি পল্টুর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন। এমনকি হয়ত কালো জিনিস সাদা কেমন করতে করতে হয় তেমন গোপন পরামর্শও পেয়ে যেতে পারেন। আমার নিজের টাকা পয়সা তেমন নেই বলে পল্টুর পরামর্শ তেমন কোন কাজে লাগে না। ব্যাপার হল পল্টুকে কোন ছবিতে হাসতে দেখা যায় না। ওর বউ-কে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁগো, এত দিন বিয়ে হয়েছে, আর একটা ভালো করে ছবি তোলার কায়দা পল্টু-কে এখনো শেখাতে পারো নি!” বলল, “আর বলবেন না, আপনার ভাই অমন-ই! ওই জন্যই আমিও বেশী ছবি তুলতে চাই না!”
পল্টুর পাশে সাদা কালো গেঞ্জীতে রয়েছে বাবু। ওদিকে নেপাল আর একদিকে বাবু ছাড়া বৃহত্তর ঘোষ পরিবার এখন প্রায় অচল। দুর্গা পুজোর হোমের অশোক কাঠ কোথায় পাওয়া যাবে, থেকে শুরু করে বলির ছাঁচি কুমড়ো, টাইমে কামারের ঠাকুর বাড়িতে পোঁছানো এই সবের ভার আমার বাপের পর এখন বাবু-ই তুলে নিয়েছে। তার উপর আছে ‘দশকর্মা’ বিষয়ে জ্ঞান। এই সামনে সরস্বতী পুজো আসছে – যারা বাংলার বাইরে থাকেন তাঁরা এই দশকর্মা-র ব্যাপারটা পুরো ছড়িয়ে ফেলেন। পুরোহিতের উপর ভরসা করে সেকেন্ড হ্যান্ড মাল দিয়ে তিন-হাত ফেরত কমিশন দিয়ে পুজোর মাল আনান। এ থেকে মুক্তি পেতে এবার থেকে সরাসরি বাবু-কে কনট্যাক্ট করতে পারেন। আমি বলে এসেছি, যে কোন পুজোর মাল এবার থেকে পুরো প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেবে অর্ডার দিলে। তবে বাবু-কে নিয়ে এত পরিচিত না লিখলেও চলত। নিমোর চার কিলোমিটারের মধ্যে যেকোন খাবারের দোকানে গিয়ে যদি বলেন, বাবু-দা পাঠিয়েছে – তাহলে আপনি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাবেন। চাইকি যারা খাচ্ছিল তাদের টেবিল থেকে ঠ্যেলে তুলে দিয়ে আপনার বসার ব্যবস্থা করে দেবে দোকানদার। এত জমকালো কাষ্টমার বাবু। যখন ও ছোট ছিল, তখন একবার বলেছিলাম জি টি রোডের ধারে শক্তিগড়ের ল্যাঙচার দোকান থেকে কিছু ল্যাংচা এনে দে তো কুটুম্ব বাড়ি নিয়ে যাব। তা সে নিয়ে এসেছিল – ১৪টা দোকানের প্রত্যেকের দুটো করে ল্যাংচা খেয়ে সেরাটা বেছে।
ছবির একেবারে বাঁদিকে আছে হলুদ গেঞ্জি পরে সুমন – সম্পর্কে যে যদিও আমার ভগ্নিপতি হয়। কিন্তু কে আর কাকে সম্মান দিচ্ছে! আচ্ছা সুমন এখন পঞ্চায়েতের সরকারী বড়কর্তা। এবারে যে সরকারী বাঙলোয় পিকনিক করে এলাম তার ব্যবস্থা সুমন-ই করেছিল। কিন্তু পঞ্চায়েতে সারাদিন কাজ কি করে বলতে পারব না – দু একবার জিজ্ঞেসও করেছিলাম। বলেছিল “আমি নিজে জানতে পারলেই তোমাকে জানিয়ে দেব”!
তাহলে বাকি রইল হালকা নীল রঙের জামা পরা ক্যাপ্টেন – পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লোক। ক্যাপ্টেনের ছেলে আর আমার ছেলে মেহুল মাস কয়েকের ছোট বড়। সেদিন বললাম, “ছেলেগুলো তো বড় হয়ে গেল রে! প্রায় আট-এ পা দিয়ে চলল”। শুনে ক্যাপ্টেন অবাক, বলল, “সুকান-দা বাইরে থেকে থেকে তোর মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে! ছেলে গুলো সবে চার পেরুলো!” পাশ থেকে বৌমা যখন মনে করিয়ে দিল যে সত্যি করেই আট বছর বয়স হয়ে গেল তার নিজের ছেলের – সে প্রবল অবাক, “বলো কি! খেয়াল করি নি তো!”
ক্যাপ্টেনের সাংসারিক জিনিসের প্রতি তেমন নজর দেবার সময় হাতে থাকে না। একদিন বাড়ি থেকে কাকিমা হাঁক পারল বামুনদের দোকান থেকে নুন এনে দেবার জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন তখন অনলাইন দাবা খেলায় ব্যস্ত এক চাইনীজ ছেলে লিং-পিং এর সাথে – ওর থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তো আর নুন আনা হতে পারে না! দাবা খেলা ছাড়া বাকি সময় ক্যাপ্টেন ব্যস্ত থাকে ক্যুইজ নিয়ে – আমাকে বলেছে ট্রাভেল ক্যুইজ অ্যারেঞ্জ করছে নাকি, আমাকে প্রশ্ন তৈরী করে পাঠাতে হবে। পৃথিবীর যত অবাঞ্ছিত জ্ঞানের ভান্ডার ক্যাপ্টেনঃ
- ভিয়েতনামে তরমুজ কত করে কিলো যাচ্ছে,
- চীনের প্রাচীর তৈরীর সময় শ্রমিকরা কোথায় হাগত,
- টারগার শ্রফ কত সাইজের স্যান্ডো গেঞ্জী পরে নাচানাচি করে সিনেমায়,
- জগতশেঠের লাল গরুর দুধ দৈনিক কত কিলো করে সিরাজদৌল্লার জন্য যেত
এই সব প্রশ্নের উত্তর আপনি পাবেন ক্যাপ্টেনের কাছে।
তবে কি এদের জন্যই জীবন এত ভালো লাগে – এদের জন্যই নিমোর মায়া কাটানো যায় না। হয়ত এদের গল্প নিয়েই নিমো-পার্ট ২ লেখা উচিত, কি বলেন?
ও হ্যাঁ, বইমেলার সময় কয়েকজন আমাকে ম্যাসেজ করে জানালো গুরু-র স্টলে নিমোর বই পাওয়া যাচ্ছে না, শেষ হয়ে গ্যাছে। ভাবলাম জনতা না গিয়েই কেনার ভয়ে গুল দিচ্ছে! কিন্তু পাই-কে জিজ্ঞেস করে জানলাম “নিমো গ্রামের গল্প” বইটির তৃতীয় মুদ্রণও শেষ! তাই অনেকে বইমেলায় স্টলে গিয়েও পান নি। সুখবর, আবার এসেছে প্রিন্ট হয়ে – এবার চতুর্থ মুদ্রণ – পাওয়া যাচ্ছে আবার।
জানিনা অ্যাড-টা কে তৈরী করেছে, কিন্তু বড় ভালো লাগলো, তাই ডকুমেন্টের খাতিরে এখানেও থাকঃ