এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  সমাজ

  • এক ছাত্রের স্মৃতিচারণা

    দীপ
    আলোচনা | সমাজ | ০৩ মে ২০২৪ | ৪৮৪ বার পঠিত
  • (এক প্রাক্তন ছাত্রের চোখে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্মৃতি)

    আমাদের বাড়িতে ধর্মাচরণ নিয়ে কোনদিনই বিশেষ বাড়াবাড়ি ছিল না। আমার আব্বা নমাজ পড়া বা রোজা রাখার ব্যাপারে বেশ অনিয়মিতই ছিলেন। আমার মা অবশ্য বেশ নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমাকেও এসবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করতেন।

    সালটা ১৯৮৪। অ্যাডমিশন টেষ্ট দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ, পুরুলিয়াতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। বাড়িতে বেশ একটা খুশির হাওয়া। চোখের জল মুছে মা আমার জিনিসপত্র কেনাকাটা, গোছগাছ করছেন। এমতাবস্থায় বাড়ি এলেন আমাদের সম্পর্কিত নানাজান। তিনি এসেই একটা বেয়াড়া প্রশ্ন তুললেন, ”হ্যাঁরে, তোরা ছেলেটাকে শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াবি ? ছেলেটা তো পূজা-আচ্চা শিখে একেবারে কাফের হয়ে যাবে”। আমার আব্বা অত্যন্ত শান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, ”আমি রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে জানি যে, সেখানে কখনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না। স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তিনি এসব শেখাননি”। অবশ্য নানাজান এবং আরো অনেক আত্মীয়স্বজনের বদ্ধমূল এই সন্দেহ ও সংশয় আমার মনে কোন দাগ কাটে নি। কারণ, ততদিনে ছবিতে ভরা কয়েকটি বই পড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীমা সারদাদেবী সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছিল। ওই ছোট্ট বয়সের সীমিত বুদ্ধিতে কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল, খালি গা আর শান্ত চোখের ধ্যানস্থ মানুষটিকে আমি ভালো না বেসে থাকতে পারব না।

    তারপর বিদ্যাপীঠ। শ্রীরামকৃষ্ণ আঙিনায় আমার প্রথম পা ফেলা। সেই প্রশস্ত খেলার মাঠ, বন্ধুদের সাথে খুনসুটি, পড়া না পারায় শিক্ষকের বকুনি আর সকাল সন্ধ্যে দুবেলায় প্রার্থনা। ঠাকুরঘর কেমন হয় সে ধারণা ছিল না। এখনো মনে আছে, সেই অগুরু ও ধূপের গন্ধ; ছোট্ট প্রার্থনাঘরে ঠাকুর,মা ও স্বামীজীর ছবি।শুরু হলো “খন্ডন ভব বন্ধন“। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী প্রায় সমস্ত রকম প্রার্থনাই নিঃশব্দে নীরবে অনুষ্ঠিত হয়। সকলের সাথে একযোগে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এই আরাধনা আমার কাছে নতুন। শুরুর দিকে সেই প্রার্থনায় আমার অংশগ্রহণ ছিল অনেকটা প্রাণের আনন্দে গান গাওয়ার মতো। সমবেত প্রার্থনার শেষে মিনিট খানেক বরাদ্দ ছিল ধ্যানের জন্য। আলো নিভে যাবার পর চুপটি করে বসে থাকার সময় ঠিক কি করব বুঝে উঠতে পারতাম না।

    ওই সময়টুকুতে নিজের আরাধ্য দেবতার উপর মন:সংযোগ করার নির্দেশ ছিল। কিন্তু আল্লা তো নিরাকার –তাঁর কোন ছবি বা মূর্তি তো আমি দেখিনি।তাই কাজটা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। চোখ বন্ধ করলেই আমার চোখের সামনে হাজির হতেন আমার আব্বা ও মা। পরে, অনেক পরে বিদ্যাপীঠের এক সন্ন্যাসীর কাছে শিখেছিলাম জপ ও ধ্যানের পদ্ধতি। তখন অবাক হয়েছিলাম শুনে যে, আমি কোন ভুল করিনি। নিজের পিতা-মাতার বিগ্রহ অন্তরে জাগ্রত করার সেই চেষ্টা ধ্যানেরই এক রূপ। বিস্মিত হয়েছিলাম জেনে যে, নিরাকারেরও ধ্যান করা সম্ভব। ততদিন অবশ্য “খন্ডন ভব বন্ধন"-এর শুরু আমার প্রাণের মাঝে গেঁথে গেছে।

    আরেকটা সমস্যায় পড়েছিলাম প্রণাম করা নিয়ে। পাশাপাশি বন্ধুকে দেখতাম ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর উদ্দেশ্যে তারা দুই হাত জোড় করে প্রণাম ও প্রার্থনা করত। অথচ ছোটবেলা থেকে আমি জানি মোনাজাত করার সময় দুই করলতলকে নিজের চোখের সামনে ধরে প্রার্থনা করতে হয়। আমি প্রার্থনা ঘরে বসে ঠিক মোনাজাতের ভঙ্গীতে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের কাছে জীবনের নানাবিধ চাহিদা গুলো পেশ করতাম। পরে অবশ্য হাত জোড় করে প্রার্থনা করাটাও অভ্যাস হয়ে গেল। বেশ মনে আছে ঠাকুরের কাছে বড়সড় কিছু – যেমন বিকালের ফুটবল ম্যাচে ভালো খেলতে পারা-- চাওয়ার থাকলে করতলে মোনাজাত আর করজোড়ে প্রার্থনা দুটোই করতাম। কেমন যেন মনে হতো, ঠাকুর নিশ্চয়ই অন্যদের থেকে আমাকে বেশি দয়া করবেন। এমনি করে কাটতে লাগলো দিন। কখন যেন আমার চিন্তনে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিলেন ঠাকুর, মা ও স্বামীজী। পুরুলিয়া থেকে বেলুড় বিদ্যামন্দির, তারপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন— ছাত্রজীবনে আমার দিনলিপি তেমন একটা বদলায়নি।

    ছুটিতে বাড়ি ফিরলে দু-একজন আত্মীয় আসতেন দেখতে – আমি সত্যিই কাফেরে পরিণত হলাম কিনা। অনেক প্রশ্ন তাদের – তোকে পূজা করতে হয়? তোরা সকলে একসাথে খাস? তোর সাথে সন্ন্যাসীরা ভালো ব্যবহার করে? – শুনে প্রথম প্রথম ভারী রাগ হতো। একটু বড় হওয়ার পর আমি ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেবার চেষ্টা করতাম। কথামৃতের গল্প, সারদামায়ের জীবনী, স্বামীজীর উক্তি –এইসব কিছুর উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করতাম সেই অহৈতুকী ভালবাসা, যার টানে আমি রোজ বসতাম শান্ত ওই দুই নয়নের প্রার্থনায়। জানি না আত্মীয়রা কতটা বুঝতেন,কিন্তু আমার পিতামাতা পরম নিশ্চিন্ততায় ঐ আলোচনায় অংশ নিতেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন আমি ভুল বলছিনা।

    ঈদের সময় সাধারণত: বাড়ি ফিরে আসতাম। কিন্তু আমার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল মহরম। তাজিয়া দেখা বা লাঠি চালানো - এসব অবশ্য সেখানে সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রায় প্রতি বছর সন্ধ্যাবেলায় যে ছোট্ট অনুষ্ঠান আমাদের হস্টেলে হতো তাতে প্রধানতম ভুমিকা ছিল আমার। শুরুতেই মর্সিয়া নামে বাংলাদেশ থেকে আসা আমার সহপাঠী গান গাইত। আর তারপরেই থাকত আমার দীর্ঘ বক্তব্য, যাতে আমি মহরমের পুরো গল্পটি বলতাম। দেখতাম, সকলে খুব মন দিয়ে শুনছে। সেকারণেই বোধহয় প্রতি বছর আমার গল্প দৈর্ঘ্যে বেড়ে চলত। শেষ পর্যন্ত গল্পটি যুদ্ধ, চক্রান্ত, খুন, জখম--এসব নিয়ে একটি মিনি থ্রিলারে পরিণত হয়েছিল। মীর মোশারফ হোসেনের চেয়ে সেই গল্পে স্বপনকুমার বা এডগার এলান পোর ভাগ বেশি ছিল। শিক্ষকেরা ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন! কিন্তু এই ব্যাপারে তাঁদের কাছে প্রশ্রয়ই পেয়েছি।

    ছাত্রজীবনের সবটা যে ফুলে ঢাকা ছিল তা নয়। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। সারা দেশ জুড়ে সেইসময় উত্তেজনা, দাঙ্গা, মৃত্যু। আমার কিছু বন্ধু হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেল। অকারণ উত্তেজনায় ঝগড়া করত এবং বেশিরভাগ ঘটনার কেন্দ্রে থাকত আমার "ধর্ম"। তাদের দুচোখ জুড়ে দেখতাম--বিদ্বেষ। তখনও রবীন্দ্রনাথ সেভাবে পড়িনি। জানতাম না যে, "ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরেছে সে জন অন্ধ" । দুই সম্প্রদায়ের এই দ্বেষ ও ঘৃণার কারণ পরে বুঝেছিলাম, সেটি ছিল পারস্পরিক জ্ঞানের অভাব। আমরা যদি পরস্পরকে জানি, বুঝি তবেই দূর হবে এই ঘৃণা। সেইসময় থেকে আজও চেষ্টা করি অন্যের ধর্ম, তার রীতিনীতি ও আচার-আচরণ জানতে,বুঝতে। চেষ্টা করি নিজের ধর্মকে অন্যের কাছে সহজবোধ্য করে তুলে ধরতে।

    ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমার শিক্ষার অনেকটাই সম্পূর্ন হয় বিদ্যাপীঠের ইংরেজি শিক্ষকের মাধ্যমে। তাঁর কাছেই জেনেছিলাম, ইসলামের মূল কথাই হল প্রার্থনা। যত প্রার্থনা করা যায় ততই আল্লা দয়া করেন। বিশ্বের প্রায় সব ধর্মের মূলেই হয়ত এই কথাগুলি রয়েছে। আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল আশাতীত ভালো হয়েছিল। অত্যন্ত স্নেহশীল এক সন্ন্যাসী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন," হ্যাঁরে তাজ, তুই এত ভালো রেজাল্ট করলি কি করে? নিশ্চয়ই তুই খুব প্রার্থনা করেছিস!" আসলে পরিশ্রম করেছিলাম প্রচুর, কিন্তু মোনাজাতের মতো করে যখন প্রার্থনা করতাম তখন দুই হাতের করতলের মাঝে ঠাকুরের শান্ত সেই দুটি চোখ খুঁজতাম। আমার আল্লা, আমার ঠাকুর সব তখন একাকার হয়ে যেত। আজও বিশ্বাস করি,সেই সুতীব্র প্রার্থনাই আমায় সফল করেছিল|

    ছাত্রাবস্থাতে একবার মনে হয়েছিল দীক্ষা নেব। গুরু আমায় পথ দেখাবেন। তখন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ যিনি ছিলেন, শুনলাম তিনি পুরুলিয়া আসবেন দীক্ষা দিতে। বিশ্বাস ছিল মা আব্বা কেউই আপত্তি করবেন না। কিন্তু দিন যত এগিয়ে আসতে লাগলো, ততই আমার মনের উৎসাহ কমে আসতে লাগলো। দুবেলা প্রার্থনা করি, মনের সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করি ঠাকুরের পায়ে, কিন্তু দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছাটা আর রইলো না। পরে বুঝেছিলাম --আমার সময় হয়নি। সময় হলে নিশ্চিতভাবে আমি দীক্ষা পাওয়ার অধিকারী হবো। তবু আফশোস রয়ে গেছে।
    যেমনভাবে আরেকটা আফশোস রয়ে গেছে মন্দিরে আরতি করা নিয়ে। বড় ইচ্ছা ছিল, বিদ্যাপীঠের মূল প্রার্থনাঘরে ঠাকুরের মর্মর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর আরতি করব। চামর দুলিয়ে আমার সমস্ত শ্রদ্ধা, সব ভালবাসা নিবেদন করব তাঁর চরণে। আমার পিছনে গান ভেসে আসবে --"জয় জয় আরতি তোমার, হর হর আরতি তোমার, শিব শিব আরতি তোমার"। সে-সাধ মেটেনি। বীজমন্ত্র আমি পাইনি। আর সে-মন্ত্র ছাড়া আরতি সম্ভব নয়।

    স্বামীজি বলেছিলেন, ইসলামীয় শরীর এবং বৈদান্তিক মস্তিষ্কের কথা। রামকৃষ্ণ মিশনে প্রিয় শিক্ষক বারে বারে মনে করিয়ে দিতেন সে-কথা। তখন পুরোপুরি বুঝিনি। আজ যখন চারপাশের জগতের দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি এই সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা। আক্ষরিকভাবে এবং রূপকার্থে --উভয়ভাবেই সেই সমন্বয়ের সুযোগ আমি পেয়েছি। মহীরুহ হয়ে ওঠার সুযোগ আর নেই। তবু এখনো ভালো ছাত্রকে এগিয়ে দিই নিজ সংগ্রহের "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত"। দরিদ্র আদিবাসী ছাত্রকে পড়তে দিই স্বামীজীর রচনার সেই অংশ --যেখানে রয়েছে দরিদ্র আইরিশ মানুষদের কথা, যারা পজিটিভ চিন্তার ছোঁয়ায় নতুন করে বেঁচে উঠেছিল। চেষ্টা করি ধ্যানস্থ মানুষটির শান্ত সেই দু-নয়নকে নিজের অন্তরে খুঁজে পাওয়ার |

    - তাজউদ্দিন আহমেদ / শান্ত সেই দুই নয়নের খোঁজে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kishore Ghosal | ০৭ মে ২০২৪ ১১:১৮742946
  • এমন বিদগ্ধ মানুষরা কখনও ক্ষমতায় আসেন না, আর যারা ক্ষমতায় আসে তারা মানুষকে অন্তরে বাইরে দগ্ধ করে। 
  • দীপ | 2402:3a80:1968:21f3:578:5634:1232:***:*** | ২৯ জুন ২০২৪ ১৭:৫৯743302
  • আরেক ছাত্রের স্মৃতিচারণা।
     
    বেলঘড়িয়ায় আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে টিনের চাল দেওয়া বাড়িতে থাকতেন এক প্রবীণ দম্পতি। বয়স্ক ভদ্রলোককে আমরা ডাকতাম বিলাসদাদু বলে। কী করেন, কেনো করেন, গোত্র-পরিচয় - কোনো কিছুতেই আমাদের কোনো উৎসাহ ছিলো না। বিলাসদাদুর একটাই পরিচয় - আমাদের ঠাকুরদার বন্ধু। অলস সকালে বাজার থেকে ফিরে রাস্তা পেরিয়ে আমাদের দাদা (পূর্ববঙ্গের রীতি মেনে আমরা ঐ নামেই পিতামহকে সম্বোধন করতাম) গিয়ে বসতেন বিলাসদাদুর টিনের ঘরটিতে। দর্জির মেশিনটা পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতেই আড্ডা চলত বিলাসদাদুর। বিলাসদাদুর স্ত্রী ছিলেন ভীষণ চুপচাপ প্রকৃতির, স্বভাবলাজুক। গৃহকর্ম ছাড়া ওঁর সারাদিন কাটতো মা ছাগল আর তার বাচ্চাগুলো সামলে। বাড়ির পাশে একফালি জমিতে একটা ডালিম গাছ। সেখান থেকে ডালিম পেরে দিতেন আমাদের। শীতকালে খেজুরের রস। পরে শুনেছি দর্জির কাজের সূত্রেই বেলঘড়িয়ার রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল বিলাসদাদুর। রোজ সকালে যেতেন আশ্রমে। শীতকালে কান-ঢাকা টুপি পরে।
     
    তখনো রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ নিয়ে আমার ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়। ঠাকুরঘরে ওঁদের প্রতিকৃতি দেখেছি এই পর্যন্ত। দাদার মৃত্যুর পরে ১৯৭৯ সালে যখন নরেন্দ্রপুর, দেওঘর আর পুরুলিয়ায় মিশনের স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিলাম সেই সময় নাগাদই এই ত্রয়ী সম্পর্কে প্রথম জ্ঞান লাভ। পরীক্ষা শেষে ডাক এলো পুরুলিয়া আর দেওঘর থেকে। তারপরই বিলাসদাদুর সঙ্গী হয়ে প্রথম গেলাম বেলঘড়িয়া আশ্রমে। 

    পুকুরপাড়ে ঠাকুরদালান পেরিয়ে একটা একতালা বাড়িতে নিয়ে গেলেন বিলাসদাদু। পৃথুল এক রাশভারি সন্নাসী তখন হাতের তালুতে মুড়ি নিয়ে গোটাকতক শালিককে তা খাওয়াতে ব্যস্ত। আমি তো অবাক। এমনও হয়!। খানিক বাদে আমার দিকে চোখ ফেরালেন। ভয়ে আর সংকোচে গুটিসুটি আমি। বিলাসদাদু বললেন, "প্রণাম করো। ইনি সেক্রেটারি মহারাজ।" তখনো জানিনা প্রতিটি আশ্রমেই একজন করে অধ্যক্ষ থাকেন। তিনিই সর্বেসর্বা। বেলঘড়িয়া আশ্রমের অধ্যক্ষ নৃপেন মহারাজ। সন্ন্যাস নাম স্বামী ধ্যানাত্মানন্দ। আমাকে দেখে বলে উঠলেন, "তুই পুরুলিয়া যাবি। তাঁর আগে দুধ-বিস্কুট খা।" আশ্রমের নিজস্ব গোয়ালের খাঁটি দুধ আর এখন আমরা যাকে বলি লেড়ে বিস্কুট। তারপর প্লেটে করে ঠাকুরঘর থেকে প্রসাদী ফল আর মিষ্টি।

    তারপরে কতবার গিয়েছি নৃপেন মহারাজের কাছে। শ্লেষ মেশানো রসিকতা পচ্ছন্দ ছিলো ওঁর। সেই তুলনায় আপাত গম্ভীর তখন বেলঘড়িয়া শিল্পপীঠের অধ্যক্ষ স্বামী অমলানন্দ । ওঁর লেখা বই "ছোটোদের রামায়ণ" "ছোটোদের মহাভারত" পুরুলিয়াতে আমাদের পাঠ্য । মাধ্যমিকের পর আমাদের যখন তিন মাসের ছুটি তখন দেহ রাখলেন নৃপেন মহারাজ। শেষবারের মতো যখন ওঁর নশ্বরদেহ বেলুড় মঠে নিয়ে যাওয়া হলো তখনো মুখে সেই অতি পরিচিত শ্লেষ মাখানো হাসি।

    গোলপার্কের ইনস্টিটিউট অফ কালচারে পরীক্ষা হয়েছিলো পুরুলিয়া আর দেওঘরের। পরীক্ষা দিতে গিয়ে আলাপ ধ্রুব মহারাজের সাথে। স্বামী পরেশানন্দ তখন স্বামী লোকেশ্বরানন্দ-এর সেবক। পুরুলিয়ায় ভর্তি তালিকায় আমার নাম বের হওয়ার পরে সেই পরিচয় আরো নিবিড় হলো। সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে পেলাম অল্পবয়সীদের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা একটি ইংরেজি বই যার অলংকরণ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা। ধ্রুব মহারাজ-এর সূত্রেই আলাপ রামানন্দবাবুর সাথে, গোলপার্কেই। রামানন্দবাবু আবার পুরুলিয়াতে আমার সহপাঠী বিশুর জ্যেঠু। একাশি সালে একবার নরেন্দ্রপুরেও গিয়েছিলেন। 

    পুরুলিয়া থেকে গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছি। বাবার সাথে গেলাম ধ্রুব মহারাজের সাথে দেখা করতে। গিয়ে শুনি ইনস্টিটিউট অফ কালচার-এর ছাদে ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙেছে ওঁর। আরোগ্যের জায়গায় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ, তবে খবর পেয়ে ধ্রুব মহারাজ আমাকে ডেকে পাঠালেন। তপ্ত দুপুরে ফ্রিজ থেকে বের করে খাওয়ালেন ফালি করে কাটা সুস্বাদু আম আর পায়েশ। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়েছে। গোলপার্ক থেকে ধ্রুব মহারাজ গেলেন সেবা প্রতিষ্ঠান, রহড়ায়। তারপরে আর্জেন্টিনার বুয়েনস্‌ আয়ারসে। একবার ভারতে গেলেন লন্ডন হয়ে। ভিক্টোরিয়া থিসিল হোটেলে ডাক পড়ল আমার। মাঝে এতগুলো বছর যে পেরিয়ে গেছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই। ধ্রুব মহারাজ সেই আগের মতোই উচ্ছ্বল।

    পুরুলিয়া বিদ্যাপীঠে আমাদের প্রধান শিক্ষক স্বামী অমরানন্দ। বড়দের স্কুলে সকালের প্রার্থনার সময় যখন দাঁড়াতেন ভারতের মানচিত্রের ব্রোঞ্জ মূর্তির সামনে তখন মনে হত তিনিই যেন সমস্ত ধীশক্তির আধার। সোমবার করে আমাদের ইন্ডিয়ান কালচার পড়াতেন। পরে জেনেছি উনি একজন পেশাদার প্রকৌশলী। পুরুলিয়ার পরে বেলঘড়িয়া আশ্রমে দেখা আর তার পরে জেনেভায়। ওখানে গিয়ে জেনেভা আশ্রমেই ছিলাম আমি। নিজে হাতে মাংস রান্না করেও খাইয়েছেন সঞ্জীবন মহারাজ। বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষকের মোড়কের বাইরে তিনি তখন এক অন্য মানুষ। সারাদিন জেনেভা ঘুরে রাতে খাওয়ার টেবিলে নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা ।

    সুযোগ বুঝে প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম। "সাধু হলেন কেনো?" নিরুত্তর তিনি। বললাম, "আপনি এমন সফল একজন ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুর, গ্লাসগোতে পড়েছেন। তারপরে সাধু হয়ে যাওয়া কি প্রতিভা-সম্পদের অপচয় নয়? আরো কত কিছুই তো করতে পারতেন যাতে জগৎ সংসারের মঙ্গল হয়।" প্ররোচনাটা ইচ্ছাকৃত। চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। শান্ত অথচ দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেনঃ " আমি তা মনে করি না। প্রতিনিয়ত যা করি তা শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা ভেবেই করি।" 

    সময় যেন থমকে ছিলো কিছুক্ষণ। আমি বাক্‌রুদ্ধ। প্রথম বলে ক্লিন বোল্ড হলে চোখ তুলে তাকাতে যেমন অস্বস্তি হয় তখন আমার তেমনই অবস্থা। খানিক বাদে নিজেই হাল্কা করলেন পরিবেশটা। সহজাত আভিজাত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, "কী করছি বা কেনো করছি তা নিয়ে ভাবি না। বরং মনে করি এটাই এখন আমার করার কথা।" পরে যখনই ভেবেছি তখনই মনে হয়েছে এটা কি অদৃষ্টবাদকে মেনে নিয়ে তাতেই অবগাহন, নাকি নিজের লক্ষ্যে আত্ম-নিবেদন। এখনো উত্তর পাইনি। 

    পুরুলিয়াতেই ছিলেন কালীপদ মহারাজ - স্বামী পূতানন্দ। বসন্ত আসার আগেই আমাদের হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন যাতে ঋতু পরিবর্তনের সময় জ্বর-জ্বারি বাঁধিয়ে না বসি। শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা যখনই হোক ভোরের আলো ফোটার আগেই শিবানন্দ সদনে হাজির কালীপদ মহারাজ। এদিকে নিজের পা ফেটে যে রক্ত ঝরছে সেদিকে কোনো নজর নেই। উনি ছাড়া বাড়ি ছেড়ে আসা ছোটো ছোটো ছেলেগুলোকে আর দেখবে কে! পুরুষ শরীরে এমন মাতৃস্নেহ আমি জীবনে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। 

    একইরকম স্নেহ-বৎসল নরেন্দ্রপুরে অমলদা - স্বামী শিবাত্মানন্দ। পড়াশোনা না করেও পার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু শীতকালে গরম পোশাক না পরলে বা জানালা বন্ধ না করে ঘুমোতে গেলে কোনো ছাড় নেই। শুধু আমাদেরই নয় দরকারে বাবা মায়েদের ডেকেও ধমক দিতেন। তখন রাগ হত খুব, এখন মনে হয় ওটাই তো ওঁদের সাধনা -

     জগতের ভালো করে নিজেদের মোক্ষলাভ।

    Tirthankar Bandyopadhyay 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন