মিনমিনে এই হাওয়া ঘরে ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে সব। পর্দা উড়ছে তো উড়ছেই, বালিশ থিতু হয়ে পড়ে আছে, ধনসম্পদ থিতু হয়ে এ ঘরেই আছে বটে। কাপড় নিয়ে নিয়ে শর্মি চলে গেছে। ওর শরীর দেখা যাচ্ছে না কোথাও তবে বালিশ পড়ে আছে। শর্মি বালিশ নিয়ে যায় নি। সে রেখে গেছে কিছু দায়িত্ব বটে। গোটা মানুষটার দায়িত্ব নিয়ে পিন্টু বাড়ি ও বালিশ পাহারা দিচ্ছে। মানুষটা শর্মির ছেলে যার জন্ম হয়েছিল শর্মির জন্য, এ জন্য তার কোন কৃতিত্ব নেই বলে ভাবছিল পিন্টু। কিন্তু ভাবলে কী হবে মানুষ তো আছেই। সে নড়তে পারে না, চড়তে পারে না কেমন এ মানুষ। সে আবার ততো ছেলেমানুষও নেই। এর কথা বলার কথা হতে পারে কি? না যদি হয় তবেও কথা বলা চলে। কারণ মানুষটা অব্যক্ত গোঙানির মতো কিছু বলল যার সঙ্গে পিন্টু নিজেকে জড়িয়ে নিতে গিয়ে বুঝল নতুন করে তার আর কিছু করার নেই। সে মানুষটার ডায়াপার বদলাতে বদলাতে দেখল পিউবিক হেয়ারটা অনেক বেড়ে গেছে। এরকম করে বাড়ার কারণ কী? নিঃঝুম উদ্ভিদের যেমন বর্ষার মাঝে ও পরে ঘন আচ্ছাদন হয় এও কি তেমন কিছু? উদ্ভিদের মতো থিতু থেকে থেকে মানুষটা কি ওই রকম কিছু আচ্ছাদনের স্বভাব পেল যাতে তার নখ বাড়ে, চুল ও পিউবিক হেয়ার ঋতু ভেদে বাড়তে থাকে, কমতে থাকে — এরকম কিছু হয় নাকি, হবেও বা হয়ত। তবে শর্মি যাবার সময় নানা কিছু খুঁজে পেতে গিয়েছিল। এই মানুষটার জন্য পিন্টুকে কদিনের জন্য বহাল রাখতে হলে কী কী করতে হয় ও এঁকে দিল।প্রথমে একটা ঘরের ছবির মাঝে বিন্যাস করে করে মডিউলার কিচেনে বসালো সব রকমের নানান বাসনপত্র, তৈজসপত্র, মশলাপাতি , চাল , ডাল, তেল, নুন। সব গরম অঞ্চল নির্দিষ্ট করার পর ও এক ফ্রিজ এঁকে তাতে মাছ, মাংস, চিংড়ির বরফ ঢাকা কয়েকটা টুকরো আর গোটা কয় বিয়ার ঢুকিয়ে না আঁকা প্রাচীন বইয়ের তাক থেকে, তার অনেক পেছন থেকে ঢুকিয়ে রাখা বোতলটা বার করে বলে, “নাও।”
—— কী ?
—— ঢুকিয়ে রেখেছিলে। মনে নেই?
—— সত্যি, খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।
—— ভুলো মন।
পিন্টু বোতলটার দিকে তাকিয়ে দেখল। পুরো বড় বোতল মাঝারি হুইস্কি, দল বেঁধে জঙ্গলে বেড়াতে যাবার সময় বেঁচে গিয়েছিল। সেটাই পড়ে আছে। কারও মনে নেই, তারও না। সে বেড়াতে গেলে বাড়ির বা মানুষটার দায়িত্বে শর্মিই থাকে সে একটু বেশিই থাকে মানে থাকতে হয় আরকি। রোজ অফিসের জন্য, আড্ডার জন্য, হুল্লোড় বা নানান জীবন সম্পর্কীয় ব্যাপার স্যাপারে পিন্টু কখনও দূরে যায়, বাড়ি ছেড়ে যায় , কখনও বা কাছেই গিয়ে আবার কিছু ব্যবধানে ফিরে এসে বাড়িতে শুয়ে ঘুম দেয়। সে সময় শর্মিই কিন্তু বাড়ির আঁকা বা না আঁকা জগত ও মানুষটাকে নিয়ে থাকে। এবার পুজোর সময় শর্মি যাচ্ছে। খুব দূরে যাচ্ছে না কিন্তু বেশ কিছু দিনের জন্যই যাচ্ছে যাতে দূরত্বটা কম হলেও ব্যবধান অনেক বেশি হবে। এ ফাঁক কি পিন্টু ভরাট করে দেবে? শর্মি নিশ্চিত হতে আরও বেশি করে বাড়িটাকে আঁকার জগতে নিয়ে ছবির মতো করে বোঝাতে থাকে। আশা করা যায় তার কেন্দ্রে থাকবে মানুষটা যে বিচরণের কেন্দ্রেই আছে কারণ তার কোন বিচরণ নেই। পিন্টু ভাবল একটা গুরুতর ভারের মতো কিছু দিয়ে যাচ্ছে শর্মি। সে যে নিখুঁত ছবিটা আঁকছে তার মধ্যে কোথাও হয়ত পিন্টু থাকবে তবে নতুন আঁকা সব কিছুর মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকা তার কম্ম নয়। সে থাকবে অনেকটা পুরনো তাকের মতো, লক্ষীর ছবি বা হারিয়ে যাওয়া প্রদীপ ইত্যাদির মতো। যেমন নিখুঁত ছবির বিন্যাসের আঁতিপাঁতি খোঁজে শর্মি লুকনো মদের বোতলটা বের করে ফেলল সে রকমই আরও অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু জিনিষের অপেক্ষায় ছিল পিন্টু। শর্মি বলে চলেছিল, “এই কিচেনের তাক। কোথায় কী আছে ভালো করে দেখ।”
—— ঠিক আছে।
—— কী ঠিক আছে। দেখ। এসো দেখিয়ে দিচ্ছি। সব রাখা আছে।
—— ঠিক আছে।
—— কিচ্ছু ঠিক নেই।পুজোর সময় কোন কাজের লোক পাবে না। দেখে নাও।
—— আচ্ছা।
—— হ্যাঁ, দেখে নাও কোথায় কী। ওকে ঠিক মতো চান করাবে। ডায়াপার বদলে দেবে। খাইয়ে দিও কিন্তু। আমি হাতের নখগুলো কেটে দিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা কর না কিন্তু।
—— হ্যাঁ। আমি তো আগেও করেছি।
—— হ্যাঁ । আর এই আলমারিতেই গয়না রাখা আছে সে হুঁশ আছে।
—— হুঁ।
—— কী হুঁ। গয়না। গয়না বললাম। কম্পিউটার থেকে চোখ সরাও।
—— শুনছি তো।
—— বাড়ি থেকে একদম বেরবে না।
—— ভাবছি পুজোর কদিন সন্ধের দিকে ।
—— একদম না।
—— ওকে দেখার জন্য কল সেন্টার থেকে আয়া।
—— খবদ্দার নয়।
—— এ ঘরেই তো গয়না।
—— অন্য ঘরে রাখলে হয় না।
—— তোমার কি মাথা খারাপ।
—— ঠিক আছে, ঠিক আছে।
—— কদিন সামলাতে পারবে না। সারা বছর ধরে তো আমি ।
—— আচ্ছা রে বাবা। ঠিক আছে রে বাবা। বেরব না।
—— হ্যাঁ ।
ঘন মেঘ বৃষ্টির কারণ হবে এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টি হল না আর হাওয়াকে ভিজে ভিজে মনে হওয়ায় সব যেন চেপে এল। বাড়ির ভেতরের ছবিটাও বদলে ভিজে অত্যন্ত ভারী লাগে। শর্মির আঁকা ঘরের ছবিটা অনেকটা বদলাতে থাকে। মডিউলার কিচেনে কোথায় যেন কুচকাওয়াজ হচ্ছে, বাসনগুলো ঝনঝন করে সেই তালে তালে বাজতে থাকে। সে বাজনা কিছুটা উৎসবের, পুজোর বাজনার সঙ্গে মেলে কিছুটা মেলে না। কেমন যেন বেখাপ্পা, বেসুরো লাগতে থাকে। বসার ঘরটা ছোটখাট এক অফিস ঘর হয়ে উঠেছে। সেখানে মৃদু বাজনা বাজছে আর ফিসফাস আওয়াজ। চাপা আলোয় কানে হেডফোন লাগিয়ে নানা নির্দেশ দেওয়া হয় আর রাস্তায় পুজোর চলতে থাকা ভিড়ে সেই সব নির্দেশ নিখুঁত ভাবে পালিত হতে থাকে। যে ছবির কেন্দ্রে ছিল মানুষটা, তাকেও এক কোণে রেখে দেওয়া হল। যদিও তার যত্ন আত্তির কোন ত্রুটি ছবিতে দেখা যায় নি। ঘর ক্রমশ এক আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার ও অর্থকরী কাণ্ডের দিকে চলে আসায় পিন্টু খুব ভ্যাবাচাকা মেরে যায়। সে শর্মিকে ক্যাবে তুলে দেয়। ক্যাবের জানলা তোলার আগে বলল, “আবার এসো।” শর্মি বলে, “ফাজলামি হচ্ছে। ঠিকঠাক থেক। ওকে সাবধানে রাখবে।”
কথা শেষ করে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাচ তুলে দিয়ে শর্মি আন্তরিক ভাবে চলে গেল। ও আবার আন্তরিক ভাবে ফিরে আসবে। শর্মি যে অত্যন্ত আন্তরিক এ ভেবে পিন্টু মনে মনে স্বস্তি পায়। তার হঠাৎ মনে হয় ক্যাবের পেছনের দরজায় পাওয়ার উইন্ডো না থাকায় এতক্ষণ কথা বলার সুযোগ পেল। এখনও হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাচ তুললে এই সুযোগ পাওয়া যায় তবে সে কচিৎ কখনও।
এবার পুজোয় বৃষ্টি হচ্ছে ও এই এক মিনমিনে হাওয়া। অকারণে হাওয়া দেওয়া ভালো নয়। তাতে ঘরের আঁকা ছবিটা এলোমেলো হয়ে সব নির্দিষ্ট ছক ভেঙে যেতে পারে। মুছে যেতে পারে সমস্ত আঁকার চিহ্নগুলো বিশেষ করে সে আঁকাগুলো তো তার নয় - সব শর্মির আঁকা। তাই সে কী করে অন্যের আঁকা ফিরিয়ে দেবে এ নিয়ে হাওয়ার ওপর রাগ করে বসেছিল পিন্টু। কিন্তু প্রচুর কারণ তাকে নির্দিষ্ট করে তুলল। সে টুকটাক জিনিসপত্র কিনতে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেল যাওয়ার আগে মানুষটার সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে গেল। যথেষ্ট সংযোগ অনুভব করতে করতে গেল যেন সব ঠিকঠাক থাকে ও সে সময় মতো ফেরার এ্যালার্মটা নিজেই দিয়ে গেল। এখন তো তাকে সব কিছুই করতে হবে একা একা। দিন দিন করে সময় কাটল। পিন্টু সব ঠিকঠাক করে চলল তারপর রাত হলে পুরো বোতলটা নিয়ে বসে। একাই বসে। বাইরে আওয়াজ হয়। পুজোর তাল বেতাল স্বর শুনতে শুনতে সে মদ খায়। খেতে খেতে সে মানুষটার ঘরে যায়। ঘুমের আওয়াজ আসে। মানুষটা ঘুমোয়। কোন ঘোঙানির মতো শব্দ হয় না। তার ঘুমের মধ্যে নিঃসাড়ে পেচ্ছাব করতে পারে বলে ডায়াপার লাগানো আছে। মাঝে মাঝে তা বদলাচ্ছে পিন্টু। এখন আর বদলানোর দরকার নেই। সে ঘরের ছবিটা আবার পুনর্বার দেখতে থাকে। তার কিছু করার থাকে না। সে অন্যের আঁকা ছবির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে, পারে না। সে ভেতর থেকে বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। অদ্ভূত এক ধনসম্পদ সে পাহারা দিচ্ছে, খুবই দামি কিনা জানা যায় না অথচ পাহারা দিতে হয়। ক্রমশ জঙ্গলের অবশিষ্ট মদ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল — এক প্রকাণ্ড শিংওলা বুনো মহিষ পাহারা দিচ্ছে আলমারিটা যার মধ্যে আছে বাক্স। ওই বাক্স এক অদ্ভূত কাঠের ও পুরনো গাছের যাতে কী ফুল ফলে এখন আর কেউ জানে না কারণ সে কাঠ হয়ে গেছে আর মধ্যে আছে গয়না আর গয়না। সেই বাক্সের কাছাকাছি পৌঁছে যায় পিন্টু। শর্মির আঁকা ছবির কেন্দ্রস্থলে পৌঁছতে পেরে তার আনন্দ হয়। ও কি মাথা ছাপানো বড় বড় ঘাসের জঙ্গলে গেছে যার মাথা ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল শিংওলা বুনো মহিষ, পাহরা দিচ্ছে ধনসম্পদ? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না পিন্টু। সে শর্মিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কখনও ওয়াটার বাফেলো দেখেছ?” শর্মি পুজোর বা কার্নিভালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে যেতে থাকে। পিন্টু তাই স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়চ্ছিল সে শুনল শর্মি বলছে, “তুমি জঙ্গলে নিয়ে যাবে বলেছিলে না? নিয়ে গেলে না তো?” পিন্টু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “হ্যাঁ, যাব। নিশ্চই যাব।” ঘরের কেন্দ্রে বিশাল শিংওলা বুনো মোষের ছবি কে যে এঁকে দিয়ে যায় বোঝা যায় না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।