ছোটবেলা থেকেই আমাদের মনে স্বর্গ - নরক, পাপ - পূণ্য ইত্যাদির সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে দেওয়া হয়। বাড়ীই হোক বা সমাজ কিংবা স্কুল, সর্বত্রই সরাসরি অথবা ঘুরপথে শিশুমনে গেঁথে দেওয়া হয় এই ধারণাগুলো। শিক্ষিত - অশিক্ষিত, ধনী - দরিদ্র সকলের মনেই ছোটবেলা থেকে এই অলৌকিক এবং বিমূর্ত ধারণাগুলো তৈরী হয়ে যায় সমাজের কারণেই। পরবর্তীতে খুব কম মানুষ এই ধারণাগুলো থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে। কিন্তু যে অসংখ্য মানুষ লৌকিক জগতে ফিরতে পারে না বা বিচরণ করতে পারে না, রক্তের তেজ কমতে শুরু করলে এই বিমূর্ত ধারণাগুলো আরও শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে তাদের মানসিক স্তরে। শিশুমনে যে বীজ পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছটাই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে বটবৃক্ষের চেহারা নিয়ে নেয়। পাপ, পুণ্যের হিসেব কষা তখন সেই মনের নিত্যকাজ হয়ে ওঠে কারণ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া রক্তের নিভন্ত তেজে আগামী ভবিষ্যতের অদৃশ্য ভবিতব্য এক দানবীয় ভয়ে পরিণত হয় তখন।
সেই কারণেই কি শেষ বয়সে এসে মন বারবার ফিরে যেতে চায় অতীতে? পুনর্জন্মে যারা বিশ্বাস করেন তাদের মত হলো, এই জন্মের সমস্ত ঘটনা ধীরে ধীরে মনের ভেতরে রিওয়াইন্ড হতে থাকে এবং ক্যাসেটের টেপ যেমন একদিকে এসে জড়ো হয় তেমনি সব অতীতটাকেই মন টেপের মধ্যে জড়ো করে ফেলে পরবর্তী জন্মের জন্য। এই ব্যাখ্যা জীবনের একেবারে শেষ লগ্নে সত্যি হলেও হতে পারে, যদিও বিজ্ঞান এখনও এর সত্যতা খুঁজে পায়নি। কিন্তু শেষ বয়স আর শেষ লগ্ন তো এক কথা নয়। এটাকে নস্টালজিক হওয়া বলা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তব এটাই যে বয়স পঞ্চাশ পার হলে মন বিনা বাক্য ব্যয়ে অতীতে চলে যায় শুধু। পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিয়ে ঝিনুকের মধ্যে থেকে মুক্তো খুঁজে আনার চেষ্টা করে। হয়তো বর্তমান অবস্থা মনের পছন্দ হয়না বলেই অতীতে ফিরে ফিরে যেতে চায়, স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় বারবার। আবার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নিশ্চয়ই থাকবে এর পেছনে। ছোট বয়সে যেমন যাদের বা যে বয়সের লোকেদের পড়াশুনা থাকে না তাদেরকে দেখলে খুব ভালো লাগে তেমনি বড় হয়ে মনে হয় পড়াশুনার সেই জীবনটাই ভালো ছিল।
কারণ যাই হোক, ঝিনুকের মধ্যের মুক্তো খুঁজতে গিয়ে আশেপাশের বালি আর ঝিনুকের নাড়িভুড়িও মেলে কিছু। ফলে মনের মণিকোঠায় শুধুই যে সুখস্মৃতি ভেসে বেড়ায় তা নয়, অনেক দুঃখের, কুকর্মের স্মৃতিও ভেসে বেড়ায়। মনে প্রথম অনুভূত হয় যে জীবনে কি কি পাপ কাজ করেছি। কারণ খারাপ কাজ যখন সংঘঠিত হয়েছিল তখন মস্তিষ্কের নির্দেশেই সেইসব কাজ করা হয়েছিল। ফলে সেই কাজ জঘন্যতম হলেও মনের মধ্যে কোনো অনুতাপের সৃষ্টি হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্তের তেজ কমতে শুরু করলে ন্যায় - অন্যায়ের অনুভূতি শুরু হয় মনে এবং ক্রমে তা প্রবল হতে থাকে। ফলে বোধ হতে শুরু হয় জীবনে অনেক অন্যায় বা পাপ কাজ করেছি। সেদিন সেই লোকের মুখের ওপর ওই জবাব দেওয়া ঠিক হয়নি, সেই ছেলেটাকে ওইরকম ভাবে ঘুঁষি মারাটা উচিৎ হয়নি, সেদিন বাবার পকেট থেকে অত টাকা সরানোটা ঠিক হয়নি, ওইদিন বাড়ীতে ফিরে সেই মিথ্যে কথাটা বলা ঠিক হয়নি, সেইদিন বন্ধুদের পাল্লায় পরে নেশা করাটা ঠিক হয়নি, ওইদিন ওই দোকান থেকে ঘুগনি খেয়ে পয়সা না দেওয়াটা ঠিক হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। সুখস্মৃতির সাথে এইসব স্মৃতি মনের আঙিনায় যখন ঘোরাফেরা শুরু করে তখনই সমস্যার শুরু। এতদিন মনের অবস্থা ছিল, জীবনে সবকাজই ঠিক করেছি, অন্যায় কিছু করিনি। এবার মনের অবস্থা হলো, এতকিছু খারাপ কাজ বা অন্যায় করেছি, তাহলে আমার ভবিষ্যত কি? শাস্তি তো আমায় পেতেই হবে, তাহলে শেষের সেদিন কি ভয়ঙ্কর?
আপনাদের মধ্যে এই চিন্তা এসেছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমার মধ্যে এই চিন্তা এখন প্রখর। সময়ে, অসময়ে মন ঘুরে বেড়ায় অতীতে। অনেককিছুই মনে আসে যে কাজগুলো এখনকার হিসেবে ঠিক করিনি। সেই কাজগুলোর বিনিময়ে পাপের ঝুলি ভরেছে বলেই মনে হয়। এই চিন্তা থেকেই ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণের ইচ্ছা বাড়ছে ক্রমশঃ। অতীত চর্বনে এই বয়সে এসে পুরনো কোনো ঘটনায় নিজের দোষ খুঁজে না পেলেও মনে হয় ঘটনাটা ঐরকম না ঘটলেই ভালো হতো। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের দোষ খোঁজার জন্যই বোধহয় এই অতীত বিচরণ। রক্তের তেজ কমে যাওয়ার ফলেই হয়তো মানসিকতার এই পরিবর্তন। কিন্তু এই মানসিকতার কারণে এবং অতীত বিশ্লেষণের ফল হিসেবে ভবিষ্যত সম্পর্কিত শঙ্কায় মন ভরে উঠছে ক্রমশঃ। ছোটবেলার স্বর্গ, নরকের যে ধারণা মনে প্রোথিত হয়েছে সেটাও মনের গহীনে ডালপালা মেলেছে, তাই নরক সম্পর্কে ভীতি প্রবল। আবার চলতি কিছু অণুগল্পের মতো মনে হয়, মদ বিক্রি করে যে সে, মদের দোকানের বাইরে যে চাট বিক্রি করে সে, আসরে যে বাইজী নাচে সে, সবাই যদি নরকে যায় তবে তো সেটা স্বর্গই হলো। আবার কখনো মনে হয় এই পৃথিবীর চেয়ে খারাপ কোনো জায়গা হতে পারে না। আবার কখনো মনে হয় নরকের ভীতিকে কাটানোর এইগুলো একটা চতুর চেষ্টা।
পুরাণে কথিত এবং শিশুমনে গেঁথে যাওয়া সেই বৈতর্ণ নদীর কথা মনে পড়ে যায়। যমের দক্ষিণ দুয়ারে অর্থাৎ নরকে যেতে এই নদী পার হতে হয়। পুণ্যবানেরা এই নদীতে অমৃতের মতো জলে ভরা দেখতে পান আর পাপীরা রক্তে ভরা দেখেন। পাপীরা দক্ষিণ দুয়ার দিয়ে নরকে প্রবেশ করেন আর পুন্যবানেরা স্বর্গে যায় বিচারের পর। আবার অনেক জায়গায় বলা আছে পুণ্যবানদের এই নদী পেরোতে হয় না। আবার অনেকে এই নদী পেরোতে পারে না কারণ তারা কোনো নৌকা দেখতে পায়না। এই পৃথিবীতেই তাদের ঘুরে বেড়াতে হয় ভুত হয়ে। আবার বলা হয় যে, একজন ব্যক্তি পাপী হলেও, যদি সে একজন প্রকৃত কোনো আধ্যাত্মিক গুরুকে অনুসরণ করে, তবে পাপী তার গুরুর হাত ধরে নদী পার হতে পারে। তাই অতীত ফিরে দেখলে উপরি পাওনা হিসেবে ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণের চিন্তা প্রবল হয়। পাশাপাশি মনে আসে কোন ঘাটে নৌকা ভিড়বে আমার? আদৌ নৌকা পাবো কিনা। যদি পাই তাহলে দক্ষিণ দুয়ারে না অন্য কোথাও? নৌকা আর মাঝির মূল্যবান ভূমিকা আছে এখানে কারণ তারা যদি দেখা না দেন তো ভুত হয়ে থাকতে হবে। দেখা দিলেও আবার কোথায় নিয়ে যাবেন কে জানে, দক্ষিণ দুয়ার যদি হয়? অতীত রোমন্থনের পরেই তাই সেই মাঝিকে মনে মনে জিজ্ঞেস করি, সঙ্গে সমর্পণের সুরও থাকে, নিজের অজান্তেই মন বারবার গুনগুনিয়ে ওঠে,
সুজন মাঝিরে, কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও?
আমি পারের আশায় বইসা আছি,
আমায় লইয়া যাও।
কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও?
সুজন মাঝিরে, কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও?
......
তোমার দেখা পাইনা বলে,
নিত্য ভাসি নয়ন জলে।
হয়না আমার তোমায় পাওয়া,
চঞ্চলিয়া চলিয়া যাও।
কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও?
সুজন মাঝিরে, কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।