কিছুদিন আগে একটা টইতে নেচার অফ গ্র্যাভিটি নিয়ে অল্প একটু আলোচনা হয়েছিল। তখন ভেবেছিলাম এটা নিয়ে আরেকটু লিখলে ভালো হয়। তো আজকে আমার হাতে কিনা অনেক সময় (স্পেস যদিও অল্প), তাই এই টই। বলা বাহুল্য, এই লেখায় নানান ভুল থাকতে পারে - কেউ ধরিয়ে দিলে খুশী হবো।
বিজ্ঞানী মহলে মোটামুটি কনসেনসাস হলো, এই মুহূর্তে আমাদের জানা সেরা দুটি থিওরি হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স (কিউএম) আর জেনারাল রিলেটিভিটি (জিআর)। কেন? কারন গত প্রায় একশো বছর ধরে দুটো থিওরিকেই নানাভাবে টেস্ট করা হয়েছে, দুটো থিওরিরই নানান প্রেডিকশান বারবার ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই দুটো থিওরি একে অন্যের সাথে মেলেনা - ফলে গত অন্তত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে আমাদের কাছে বিরাট এক সংকট এসে হাজির হয়েছে।
শুরু করি কিউএম দিয়ে। ক্লাসিকাল মেকানিক্স হলো ডিটারমিনিস্টিক, অর্থাত কোন একটা মুহূর্তে একটা সিস্টেমের সমস্ত পার্টিকলের অবস্থান, ভর, আর গতিবেগ জানা থাকলে সেই সিস্টেমের পুরো ভবিষ্যত ইভোলিউশান বলে দেওয়া যাবে, এমনকি আগে কি অবস্থায় ছিলো তাও পুরো বলে দেওয়া যাবে। কিন্তু কিউএম হলো প্রোবাবিলিস্টিক, অর্থাত সমস্ত পার্টিকলের অবস্থান, ভর, আর গতিবেগ জানা থাকলেও সেই সিস্টেমের ভূত বা ভবিষ্যত বলে দেওয়া যাবে না। এর কারন কোয়ান্টাম লেভেলে একটা পার্টিকলের কমপ্লিমেন্টারি প্রপার্টিস এক সাথে সম্পূর্ণভাবে জানা যায় না, যেমন একই সাথে পোজিশান আর মোমেন্টাম জানা যায়না। একে বলে হাইজেনবার্গের আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল। খেয়াল করবেন, এই আনসার্টেনটি মানুষের মেজারমেন্টের অক্ষমতাজনিত নয়, এ হলো আমাদের মহাবিশ্বের প্রপার্টি। আর এই আনসার্টেনটির ফলে উদ্ভব হয় কিউএম এর সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল সমস্যার, যার নাম মেজারমেন্ট প্রব্লেম। সংক্ষেপে এরকমঃ যদি একটা ইলেকট্রন বা ফোটন গানের সামনে দুটো স্লিট রাখা হয় আর তার ওপারে একটা স্ক্রিন, আর যদি একটা একটা করে ইলেকট্রন বা প্রোটন নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে অনেক হাজার ইলেকট্রন বা প্রোটন নিক্ষেপ করার পর দেখা যাবে স্ক্রিনের ওপর একটা ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে। অনেকটা এরকমঃ
এরকম কেন হচ্ছে? কারন একটা ইলেকট্রন যখন গান থেকে বেরিয়ে স্লিটের মধ্যে দিয়ে স্ক্রিনের দিকে যাচ্ছে, তখন সেটা ওয়েভের মতো, ফলে নিজেই নিজের সাথে ইন্টারফেয়ার করছে, একই সাথে দুটো স্লিটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করছে, স্ক্রিনের ওপর গিয়ে পড়ছে। কিন্তু যেই স্ক্রিনের ওপর পড়ছে, বা মেজারমেন্ট হচ্ছে, ওমনি সেই ওয়েভের বদলে ইলেকট্রনটা একটা পার্টিকলের মতো হয়ে যাচ্ছে, ফলে স্ক্রিনের কোন একটা পয়েন্টে সেটা পিং করছে। এই ওয়েভ এর ইকুয়েশন প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন শ্রডিংগার, আর এই ইকুয়েশান লেখা হয় ওয়েভ ফাংশান রূপে। মজা হলো, ইলেকট্রনটা ততোক্ষনই ওয়েভ ফর্মে থাকবে যতোক্ষন না সেটাকে মেজার করা হচ্ছে। গান থেকে স্ক্রিন, এই পথের কোথাও যদি মেজার করা হয়, এমনকি স্লিট পেরনোর পরেও, তাহলেও প্রোবাবিলিটি ওয়েভ কোল্যাপ্স করে যাবে, ইলেকট্রনটা ততক্ষনাত পার্টিকলের মতো বিহেভ করবে, ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্নও মিলিয়ে যাবে। কেন এরকম হয়? আমরা এখনও জানিনা।
যা জানি, তা হলো কিউএম আমাদের আবিষ্কার করা সবচেয়ে অ্যাকিউরেট থিওরি, কিউএম দিয়ে সমস্ত পার্টিকল আর সমস্ত ফোর্স আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি, একটা "ফোর্স" বাদে - গ্র্যাভিটি। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমরা জানি। কারন, আইনস্টাইনের জিআর ফ্রেমওয়ার্কে গ্র্যাভিটি আসলে কোন ফোর্স না, স্পেসটাইমের কার্ভেচার মাত্র (অন্যভাবে বললে, একটা এমার্জেন্ট ফেনমেনন)। কিন্তু জিআর এর একটা বড়ো খামতি আছে, তা হলো, এটা কোয়ান্টাম লেভেলে কাজ করেনা। যেখানেই কোয়ান্টাম আনসার্টেনটির অবদান বড়ো হয়ে ওঠে, সেখানেই জিআর অ্যাপ্লাই করা যায় না। এর একটা উদাহরন ব্ল্যাক হোল, যার ভেতরে গ্র্যাভিটি এতো শক্তিশালী যে কোয়ান্টাম এফেক্ট উপেক্ষা করা যায় না, ফলে জিআর অ্যাপ্লাই করলে আমরা পাই সিঙ্গুলারিটি, যেখানে স্পেসটাইমের কার্ভেশার ইনফাইনাইট, ফলে গ্র্যাভিটিও ইনফাইনাইট। আরেকটা উদাহরন হলো আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন, নিউট্রন, প্রোটন, বা অ্যাটোম ইত্যাদি। জিআর এর মতে, এনার্জি বা মাস স্পেসটাইমে কার্ভেচার সৃষ্টি করে, অর্থাত যার এনার্জি বা মাস আছে, তারই গ্র্যভিটিও আছে। কিন্তু একটু আগেই আলোচনা করলাম যে কোয়ান্টাম লেভেলে যতোক্ষন না মেজারমেন্ট হচ্ছে ততোক্ষন সবকিছু একটা প্রোবাবিলিটি ওয়েভের মতো আচরন করছে। তাহলে একটা ইলেকট্রন, যা কিনা একটা প্রোবাবিলিটি ওয়েভের মতো ছড়িয়ে আছে, যে ওয়েভের বিস্তৃতি অপরিসীম, তার গ্র্যাভিটেশনাল এফেক্ট ঠিক কোথায়? সেটা কি লোকালাইজড নাকি ডিসট্রিবিউটেড? অথচ জিআর এর মতে গ্র্যাভিটি লোকালাইজড, কারন এই মহাবিশ্বে কোন ইনফরমেশান বা ইনফ্লুয়েন্স আলোর চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না। (আইনস্টাইন স্বয়ং স্পুকি অ্যাকশান অ্যাট আ ডিসট্যান্স এর বিরোধিতা করেছিলেন)।
মুশকিল হলো, গ্র্যাভিটির কোন ওয়েভ ফাংশান আমরা লিখতে পারিনা কারন কিউএম দিয়ে আমরা গ্র্যাভিটিকে ব্যাখ্যা করতে পারিনা। কেন? কারন স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে সমস্ত পার্টিকল দুধরনের - মাস পার্টিকল আর ফোর্স ক্যারিয়ার পার্টিকল (ফার্মিয়ন আর বোসন যথাক্রমে)। যে তিনরকম ফোর্স কিউএম দিয়ে আমরা ব্যখ্যা করতে পারি, অর্থাত ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম, স্ট্রং ফোর্স, আর উইক ফোর্স, সেই তিনটেরই ফোর্স ক্যারিইং বোসন পার্টিকল আছে, অর্থাত এই তিনটেই কোয়ান্টাইজড। ফিল্ড থিওরি অনুসারে, মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাথমিক স্ট্রাকচার বা ক্যানভাস বা ব্যাকগ্রাউন্ড হলো স্পেসটাইম ফ্যাব্রিক। এই ফ্যাব্রিক এর ওপর একেকটা ফিল্ড, যেমন ইলেকট্রন ফিল্ড, আর সেই ফিল্ডের ওপর কাজ করে একেকটা ফোর্স ক্যারিয়ার বা ফোর্স এক্সচেঞ্জিং পার্টিকল বা বোসন, যার ফলে ইলেকট্রন বা অন্যান্য পার্টিকল গুলো ফোর্স অনুভব করতে পারে। কিন্তু গ্র্যাভিটি যেহেতু সেই ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যানভাসের কার্ভেচার মাত্র, তাকে কোয়ান্টাইজ করা বা পার্টিকল এর রূপ দেওয়াও সম্ভব না।
তাহলে এই সমস্যার সমাধান কি? আমাদের এমন কোন গ্র্যাভিটির থিওরি খুঁজে বার করতে হবে যা কিনা কোয়ান্টাম স্কেলেও কাজ করে। নিউটনের গ্র্যাভিটেশনাল থিওরি যেমন সাধারন বা ছোট ভরের ক্ষেত্রে কাজ করে কিন্তু বড়ো ভরের ক্ষেত্রে কাজ করে না, তখন তার বদলে জিআর ব্যবহার করতে হয়, ঠিক তেমনি কোয়ান্টাম লেভেলে জিআর এর বদলে এই নতুন থিওরি ব্যবহার করতে হবে। অর্থাত নিউটনের থিওরি ইন দ্য লিমিট অফ লার্জ মাস জিআর, তেমনি জিআর ইন দ্য লিমিট অফ স্মল পার্টিকলস এই নতুন থিওরি।
এই নতুন কোয়ান্টাম থিওরি অফ গ্র্যাভিটি কেমন হতে পারে? বহু দশক ধরে এই নিয়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কেন? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের দেখতে হবে কিউএম এ পার্টিকল ইন্টার্যাকশান কিভাবে দেখানো হয়। ধরা যাক একটা ইলেকট্রন আর একটা পজিট্রন ধাক্কা খেলো, দুটোই মিলিয়ে গিয়ে পড়ে রইলো একটা ফোটন, আবার খানিক পরে ফোটনটা ডিকে হয়ে চলে এলো একটা ইলেকট্রন আর একটা পজিট্রন। এটা দেখানোর জন্য ফাইনম্যান এক বিশেষ ধরনের ডায়াগ্রাম আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে আমরা এখন বলি ফাইনম্যান ডায়াগ্রামঃ
ওপরের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, একটা ইলেকট্রন আর একটা পজিট্রন পরস্পরকে অ্যানাইহিলেট করে তৈরি করলো একটা ফোটন, সেটা একটু পরে ডিকে করে একটা ইলেকট্রন আর একটা পজিট্রন তৈরি হলো। কিন্তু এখানে একটা ব্যপার আছেঃ কোয়ান্টাম আনসার্টেনটির জন্য, ফোটনটা স্পেসটাইম ভ্যাকুয়াম থেকে খানিকটা এনার্জি চট করে ধার নিয়ে অন্য দুটো পার্টিকল এ ডিকে করে যেতে পারে, কেউ কিছু বোঝার আগেই সেই দুটো পার্টিকল এনার্জি ফেরত দিয়ে আবার একটা ফোটন হয়ে যেতে পারে (এক্ষেত্রে কম্প্লিমেন্টারি প্রপার্টিদুটো হলো টাইম আর এনার্জি)। খানিকটা এরকমঃ
ওপরের ছবিতে মাঝখানের বৃত্তটা হলো ফোটনটার ডিকে আর অ্যানাইহিলেশান। তো মাঝখানে এরকম ডিকে আর অ্যানাইহিলেশান যেহেতু অসীম উপায়ে হতে পারে, তাই যদি শ্রডিংগারের ওয়েভ ইকুয়েশান আমরা অরিজিনাল ফর্মে সলভ করতে যাই তো একগাদা ইনফাইনাইট ইন্টারয়াকশানের সম্মুখীন হবো। তাহলে উপায়? এর সলিউশানও ফাইনম্যানই দেখিয়েছিলেন, রিনর্মালাইজেশান নামের এক বিশেষ উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। মুশকিল হলো, যদি ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের মধ্যে আমরা গ্র্যাভিটেশনাল ইন্টারঅ্যাকশানও দেখাতে যাই, তাহলে সবরকম স্পেসটাইম কম্বিনেশানও দেখাতে হয়, আর তখন রিনর্মালাইজেশান আর কাজ করেনা।
অর্থাত কিনা কিউএম ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আমরা গ্র্যাভিটিকে আনতে পারিনা, গ্র্যাভিটন এর মতো এমন কোন পার্টিকল এর ইকুয়েশান লিখতে পারিনা যা কিনা গ্র্যাভিটির ফোর্স ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রচুর কাজ হয়েছে, এখনও অবধি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দুটো থিওরি নিয়ে কাজ হয়েছে সেদুটো হলো সুপারস্ট্রিং থিওরি আর লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা এলকিউজি। সুপারস্ট্রিং থিওরিস্টদের মতে সব কিছুই স্ট্রিং এর ভাইব্রেশানের ফলে তৈরি হয়েছে - স্পেসটাইম, মাস, ফোর্স ইত্যাদি সবই এগারো ডাইমেনশানে ভাইব্রেশানের ফল। আর এলকিউজিতে চেষ্টা করা হচ্ছে স্পেসটাইমকেও কোয়ান্টাইজ করার, যাতে কিনা রিনর্মালাইজেশান আবার কাজ করতে পারে। দুটোই এখনও ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস, তবে বিজ্ঞানী মহল আস্তে আস্তে এলকিউজির দিকেই ঝুঁকছেন। আর কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি অবশেষে যখন আবিষ্কার হবে? তখন এমন সব টেকনোলজি আমরা তৈরি করতে পারবো যা এখন একেবারেই সায়েন্স ফিকশান।
তথ্যসূত্রঃ বেশ কিছু য়ুটুব ভিডিও, ওয়েবসাইট আর দুয়েকটা বই এর সাহায্য নিয়ে এই লেখা। বিশেষ করে সাবিন হসেনফেল্ডার, আর্ভিন অ্যাশ, আর রজার পেনরোজের নাম উল্লেখ করতে পারি।