এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পিরীতজলার_ভূত

    Tanima Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ৫১০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • কিরে গুপে অমন গোলাপ হাতে চল্লি কোথা? নৌকো থেকে লাফ দিয়ে নামা গুপেকে শুধোয় নফরা। 

    এসব তুমি বুঝবেনি কো চাচ্চা, এ হলো গে পেম্পিরীতের সাতকাহন। 

    পেম পিরিতের এই সাতকাহনটা কি বটে হে বাপু?  খুরপিতে ফুলকপি গাছের আল কাটতে কাটতে গুপীকে জিগালো নফরচন্দ্র। 

    ডায়মন্ড হারবার থেকে আরও আট দশ ক্রোশ দূরে গঙ্গার তীর ঘেঁষে পলি জমে জমে জেগে উঠেছে এই নতুন দ্বীপ। লোকে কয় নবদ্বীপ। না হে আমাদের নিমাইচাঁদের নবদ্বীপ নয় সে। ধু ধু ফাঁকা ডাঙা, যে পারো সস্তা দামে যতটা খুশি দখল করে নাও। 

     সেখানে পলি জমির উপর কাশেম আলির এই বিরাট আবাদ চাষজমি। 
    এপারে নৌকো ছাড়লে ওপারে জলে জলে হলদিয়ার কারখানায় চলে যাওয়া যায়। দূর থেকে  দেখা যায় আবছা আবছা। সে কারখানায় কাজ করে গুপী। সেখানে টাউনশীপ। বিস্তর কোটপেন্টুল পরা লোকজন, ঝকঝকে দোকান পাট। হুটেল রেস্তোরাঁ। 
    তাই সে আধুনিক সমাজের অনেক কিছু জানে। তার কাছে নুতুন এষ্টাইলের ছোঁয়াছুঁয়ি মুবাইল ফোনও আচে যে। সেকানে পিড়িং পিড়িং কতই না দেশ দুনিয়ার খবর টবর আসে। 

    খুরপি দিয়ে মাটি কুপানো, নদীর ধারের শুকনো দলঘাসের জ্বালে আঁচ ধরানো নফরের কাছে সে খবর নেই। নফরের কাছেও অবিশ্যি একখান মুবাইল ফোন আচে, তবে সে সেই আদ্যিকালের বোতাম টেপা ফোন। অনেক কষ্টে বুড়াকালে অ আ ক খ ওয়ান টু শিকেছে নফরা। সেও কী আর  সহজ কাজ রে। তবুও পেটের দায়ে কতই কি যে করতে লাগে, বাবুদের নম্বর ধরতি হয়, কে ফুন দিছে তা দেখতি লাগে। ওটুকুনই। 

    তা হ্যাঁ বাপ বল্লি নে তো ওই পেম পিরিতের সাতকাওন ব্যাপারখানা কী? 

    গুপী বিড়ির আগুনে হুশহুশ টান মেরে বুকের হাপর ভরে নিয়ে মা গঙ্গার পানে উদাস চোকে তাকিয়ে কয়, ফেব্রুয়ারি মাসের সাত থেকে চোদ্দো এই হচ্ছে পেরেমের উচ্ছব গো কত্তা। দুগগো পুজোয় যেমন একদিনে বোধন, পরদিনে আবাহন, তার পরে  বলিদান, সন্ধিক্ষণ,  ঘটবিসজ্জন, বিজয়াযাত্রেরা এইসপ হয় তেমনি এই উচ্ছবেও 
    পেত্থম দিনে গুলাপ দেয়া
    তাপ্পরের দিনে কয়ে দেয়া আমি তুমারে ভালবাসি, 
    তিতিয়োদিনে লেবেঞ্চুস দেয়া 
    তাপ্পরদিনে পুতুল দেয়া, 
    তাপ্পরদিনে কয়ে দেয়া আমি তুমারে ছেঁইড়ে কুত্থাও যাবুনি কো 
    তাপ্পর দিনে জাপুটে জইড়ে ধরা 
    তাপ্পর চুমু খেইয়ে ফেলা চকাস কইরে। 
    শেষ দিনে পেরেমের বোত উজ্জাপন। সেদিনে খাওয়া দাওয়া আনন্দ ফুত্তি এইসপ। 

    নফরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গুপের দিকে, কয়, তা এমুনধারায় পেরেম পিরিত সইত্য সইত্য হবে?  কি জানি বাপু তুমাদের আজকালকার মন মর্জির গড়ন। 

    সঠিক করে পেরেম দিতে বুকে বড়ো দম লাগে গো, অনেক কিছু ছাড়ছাড়ান দিতে হয়, আনেক আঁচ আগুন পেরুতে লাগে। ভালবাসা কি আর অমন সস্তা কথা গা? 
     
    ভালবাসায় ধোজ্জি লাগে, অপিক্ষা লাগে, ক্ষমা লাগে, নিবেদন লাগে গো বাপ। 

    ভালবাসা ছোঁয়াচ,  অবহেলার বিষ, লাথি, ভালবাসার জড়ান  আগল যে আমার পালং শাকের গাছটিও বোঝে রে, তার গোড়ায় খুরপি দি, কুলকুলিয়ে জল দি, সে হেসে খেলে দলদলিয়ে সবজে হয়ে ওঠে, যেনো তিপ্তখুশ মনিষ্যির পারা গলা খুলে গান গায়। 

     আমার পোষা কুকুরটাও বোঝে, একদিন দেখতি না পেলে আমার মাদুরে শুয়ে কুঁই কুঁই করে কান্দে। কান্দে আর খোঁজে, খোঁজে আর ডাকে। বুকটি তার থম মেরে থাকে হয়তো।  কইতি তো আর পারে না, বুঝাইতেও তো পারে না। তবু খোঁজে, তবু ডাকে, তবু থম মেরি জুলজুল করে চায়। 
     ওসব  কষ্ট ক্ষত গুলাপ নেবেঞ্চুসে কি  পূরণ হব্যেক গা? 

    বিড়ির শেষ সুখটানটায় ধোঁয়াটুকু টেনে নিয়ে গুপে কয়, কিন্তু দুনিয়া এখন এসবেই মজেছে কত্তা। পিরিত করতে গুলাপ চাই, নেবেঞ্চুস চাই, পুতুল চাই, চোদ্দকথার পিতিজ্ঞে চাই, জড়িয়ে ধরে চুমু চাই, লোকদেখানো ফোটোক চাই, নইলে তারে পিরীত বলে গেরাজ্জি করতেছে না গো কেউ। 

    নফরা এসব বোঝে না, ছয় ছেলে আর দুই মেয়ে বিইয়ে তাদের ঘরদোর সামলে দিয়ে বৌটা তার মরেচে। সে মরা ইস্তক দেশ গাঁয়ে আর মন লাগে না, তাই সে কাশেম আলির এই ক্ষেতের আগলদারের কাজ নিয়ে পাইল্যে এয়েচে এদ্দুরে। এরা খেতে দেয় দুবেলা, মাস গেলে ট্যাকা দেয় সামান্য, সে গাছেদের প্রেম দেয়, হাঁস মুরগির ছানাদের দানা দেয়, পুষ্যি কুকুরটার গায়ের গরম ঘেঁষে শুয়ে থাকে হিম হিম জোছনার রাত্তিরে। তার জেবনে অমন ছিষ্টির পিরিত টিরিত নেই কোনো। 

    পাশ দিয়ে মা গঙ্গা বয়ে যান কুলুকুলু। রাতবিরেতে ক্ষেতের আগল ঠেলে কত মাগী মরদ চুপিচুপি  লুকিয়ে চুরিয়ে ঢোকে  ক্ষেতএলাকায় সে টের পায়, তারা বোতল আনে, মদ খায়, শরীরে শরীর ঘসে পেরেম খোঁজে, নাকি কি খোঁজে কে জানে?  
    কার রিস্তা কদ্দিন টেঁকে?  কার রিস্তা হিসেব নিকেশ করতি করতি চুলোর দুয়োরে ফুইরে যায় কে জানে?  কে কারে নাচায়, কে কার তালে নাচে কে জানে?  কে কার গায়ে আগুন দেয়, কে কার কপালে ধুনি জ্বালে, 
    কার আকাশে ভালবাসার ঘুড়ি ওড়ে, কার ওড়ার আগেই ভোকাট্টা হয়ে যায়, 

    আবার কে কার সুতো ধরে টান দিলে মরমে হ্যাঁচকা টান লাগে কে জানে?  

    এসব টানের রশি একলা একলা বইতে হয় গো, সে চলার কায়দা কি আর সব্বাই জানে?  

     যে তার ছন্দটি আঁকড় করে ধরতি পারে সেই তো পীরিত জলার ভূত পাগল। শরীর টরীর ছেড়ে সে অশরীরী  তখন বন্ধনসুখে মাতোয়ারা হয়ে ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে।

    তাকে ধরে কার এমন সাধ্যি!!!।।। ত নি মা।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Angsuman Ghosh | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:১৮516249
  • খুব ভালো লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন