এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সভ্যতার সংকট না সংকটে সভ্যতা

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ নভেম্বর ২০২২ | ১০৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • শিরোনামটা দেখেই সকলের দুটো শব্দের কথা মাথায় আসবে, দ্বান্দিকতা আর প্যারাডক্স। দ্বান্দ্বিকতার অর্থ হল, দুটি পরস্পর বিরোধী সংঘাতজনিত প্রক্রিয়া। আর প্যারাডক্স কথার অর্থ হলো, যে উক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য বর্জিত নয়। এককথায় সভ্যতা শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, সভ্যতার ইংরেজি শব্দ হল civilization যা ল্যাটিন শব্দ civis থেকে এসেছে এবং যার অর্থ হলো, নগরে বসবাসরত কোন ব্যক্তি। অর্থাৎ মানব ক্রমবিকাশের যে ইতিহাস আমরা জানি, আদিম থেকে ক্রমশঃ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব, খোলা আকাশ থেকে ক্রমশঃ বাসস্থান তৈরী, উলঙ্গ থেকে ক্রমশঃ নিজের লজ্জা নিবারণ করা, গাছের ফল আর কাঁচা মাংস খাওয়া থেকে ক্রমশঃ চাষ-আবাদ করে খাদ্যদ্রব্য তৈরী ও ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ, গোষ্ঠী থেকে ক্রমশঃ সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরী করা, শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানের ফ্রিজ-এসি-মোটরগাড়ি-কলকারখানা-মাইক্রোওভেন-সেক্সডল ইত্যাদি সমৃদ্ধ বিলাস বৈভবের জীবন, একেই সভ্যতা বলে। তাহলে বিকশিত হওয়ার স্তরে বা পদ্ধতিতে কোনো সংকট আসতে পারে অথবা বিকশিত হওয়ার কারণে কোনোরকম সংকটে পড়তে হতে পারে তা কল্পনা করা খুব মুশকিল। এইকারণেই শিরোনামটি দ্বান্দিকতায় ভরা আবার পাশাপাশি প্যারাডক্সও নিশ্চয়ই।
     

    মূল আলোচনায় ঢোকার আগে সভ্যতা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক এবং দেখে নেওয়া যাক সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামত। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে যিনি তাঁর ছদ্মনাম ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত, তিনিই প্রথম সভ্যতা শব্দটি ব্যবহার করেন। সভ্যতা বা civilization শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায় নর্বার্ট ইলিয়াস এর "দ্য সিভিলাইজিং প্রসেস" (১৯৩৯) বইটিতে। বইটিতে মধ্যযুগীয় কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সামাজিক রীতিনীতি বর্ণিত হয়েছে। আবার আলবার্ট স্কেইউটজার তাঁর "দ্য ফিলোসফি অফ সিভিলাইজেশ্যন" (১৯২৩) বইতে দুইটি মতামতের কথা উল্লেখ করেন। একটি মত অনুসারে জাগতিক সবকিছুর মূল পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং আরেকটি মত হলো জাগতিক সবকিছু পদার্থ ও নিজস্ব ধর্ম দ্বারা তৈরি৷ তিনি বলেছিলেন পৃথিবীতে দুরবস্থা তখন থেকে শুরু হয় যখন মানবজাতি সভ্যতার সকল নৈতিক ধারণা ভুলে যাওয়া শুরু করে। 'Civility' (আভিধানিক অর্থ নাগরিতা) এর মত শব্দের উদ্ভব হয় ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে। গুণবাচক বিশেষ্য 'civilization' যার অর্থ 'সভ্য অবস্থা', ১৭৬০ সালে ফরাসি ভাষা থেকে আগত হয়। ১৭৫৭ সালে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ ভিক্টর দ্য রিকুয়েটি। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শব্দটি ব্যবহার করেন অ্যাডাম ফারগুসন। তিনি ১৭৬৭ সালে "এসেয় অন দ্য হিস্টোরি অফ সিভিল সোসাইটি" বইতে উল্লেখ করেন "Not only the individual advances from infancy to manhood but the species itself from rudeness to civilisation।" বাক্যটি মূলত ছিল অভদ্রতা (Barbarism) ও রূঢ়তার বিরোধিতা করার জন্য। ১৭০০ সালের শেষ দিকে ও ১৮০০ সালের শুরুর দিকে ফরাসি বিপ্লব এর সময় সিভিলাইজেশন শব্দটি একবচন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, বহুবচন হিসেবে না। অর্থাৎ, সমগ্র মানবজাতিকে এক ধরে সেটির উন্নয়ন বিবেচনা করা হতো। এখনো ফ্রান্সে এই ধারণাই বিদ্যমান। ১৯ শতকে কখনো কখনো সিভিলাইজেশন শব্দটি গণনাবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল কিন্তু ২০ শতকে এটি সাধারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং কখনো কখনো সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে এক ধরা হয়েছিল (সভ্যতা বা culture গণনাবাচক বিশেষ্য নয় কিন্তু নৃতাত্ত্বিক ধারণা অনুসারে পরবর্তীতে একে গণনাবাচক বানানো হয়)। ১৮ শতকের দিকেও সভ্যতাকে উন্নয়ন হিসেবে গণ্য করা হতো না। জেনেভা এর দার্শনিক জিন জ্যাক্স রোজিয়াওয়ের "ইমাইল, অর অন এডুকেশনতে" বইতে সাংস্কৃতি ও সভ্যতার একটি ঐতিহাসিক পার্থক্য উল্লেখিত রয়েছে। তাঁর মতে, সভ্যতা বিষয়টি সামাজিকভাবে পরিচালিত এবং মানুষের আচার-আচরণের সাথে পুরোপুরি সদৃশ নয় এবং মানুষের পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব সঠিকভাবে প্রাকৃতিক ঐক্যের মাধ্যমে। এর ফলে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। (সর্বপ্রথম জার্মানিতে)। এর পেছনে ভূমিকা রাখেন জার্মান দার্শনিক জোহান গটফ্রাইড হার্ডার, ফ্রেডরিক নিয়েশ এবং ড্যানিশ দার্শনিক কিয়েরকেগার্ড। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী সংস্কৃতি একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যার সাথে মনস্তাত্তিক কোনো কিছুর মিল থাকে না। সভ্যতা যদিও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কিন্তু এটির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে পদার্থগত উন্নয়নের মাধ্যমে। তবে পদার্থগত উন্নয়নের ফলে সমাজে প্রতারণা, ভন্ডামি, বিদ্বেষ ও অর্থলিপ্সা বেড়ে যায় যার ফলে সমাজে ক্ষতিসাধন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর সময় জার্মান-আমেরিকান রাজনৈতিক দার্শনিক লিও স্ট্রস জার্মানি থেকে পালিয়ে আমেরিকা গিয়ে ব্যাখা দেন যে গটফ্রাইড হার্ডারদের বক্তব্যে যা উঠে এসেছে তা হলো, জার্মান নাৎসিবাদ, সামরিকতা ও নাস্তিক্যবাদ এর মূল কারণ। অস্ট্রেলিয়ান সমাজবিজ্ঞানী ভিয়ার গর্ডন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন যা সভ্যতাকে সমাজ হতে পৃথক করে। সভ্যতাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয় জীবিকা নির্বাহের উপায়, জীবন ধারণের পদ্ধতি, স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা অভিবাস, সরকারের ধরণ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজের বিভিন্ন স্তর, শিক্ষার হার ও বিভিন্ন সংস্কৃতিগত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। কানাডিয়ান সাংবাদিক এন্ড্রু নিকিফরিউক যুক্তি দেন যে, সভ্যতা মানুষের পেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল৷ দাসদের পেশি শক্তি গ্রহণ করে এটি ফসল ফলায়, কাপড় বোনে ও শহর তৈরি করে।" এছাড়াও দাসপ্রথাকে প্রাক-আধুনিক সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সভ্যতা সবসময়ই কৃষির উপরে নির্ভরশীল ছিল। তবে ধারণা করা হয় পেরুতে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে সমুদ্র ও এর বিভিন্ন উপাদানকে কেন্দ্র করে। সাধারণত দানাশস্য খামার কোনো এলাকার মানুষকে খাদ্য সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে এবং এর ফলে খাদ্যের যোগান সহজ হয়। বিশেষত, কৃত্তিমভাবে নিষেক প্রক্রিয়া, সেচ ও ফসল নির্বাচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার দরুন খাদ্য উৎপাদনে সময় ও শ্রম কম দরকার পড়ে। কিন্তু হর্টিকালচারের ফলে খাদ্য উৎপাদন করা গেলেও এতে শ্রম বেশি লাগার কারণে খুব কম সভ্যতাই হর্টিকালচারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। দানা শস্যের সংরক্ষণ ব্যাপারটিকে বিশেষত গুরুত্বসহকারে দেখা হতো কারণ এগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষিত করা যায়। উদ্বৃত্ত শস্য দরিদ্রদের ভেতরে বিলিয়ে দেওয়া ও অন্যান্য মানবিক কাজে ব্যয় করা সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিছু প্রাচীন সভ্য জাতিসমূহ উদ্বৃত্ত শস্য সৈন্য, কারিগর, ধর্মযাজক ও অন্যান্য উঁচু বর্গের পেশার লোকেদের জন্য নির্ধারিত রাখতো৷ তবে ধারণা করা হয় যে মেসোলিথিয় সময়কালে নাটুফিয়ান সংস্কৃতির উদ্ভবের সময়ে প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের কিছু শিকারী উদ্বৃত্ত খাদ্যগ্রহণের অনুমতি পেয়েছিল। উল্লেখ্য যে, মেসোথিলিয়া একটি প্রত্নতাত্ত্বিক যুগ এবং নাটুফিয়ান সংস্কৃতিকালের উদ্ভব হয় প্রায় ১১৫০০ বছর থেকে ১৫০০০ বছর আগের কোনো এক সময়ে। যা হোক, বহুল সামাজিক সংস্থা, শস্য সংরক্ষণ ও শ্রম বন্টনের ফলে বাস্তুতন্ত্রে উদ্ভিদ ও পশুপাখিদের ক্ষতিসাধন শুরু হয়। সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা রাষ্ট্র গঠন করে৷ রাষ্ট্রের কয়েকটি সামাজিক শ্রেণির দেখা পাওয়া যায়৷ যেমনঃ শাসক শ্রেণি, যারা রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থার সাথে সরাসরি জড়িত ও রাষ্ট্র শাসনে ভূমিকা রাখে। নৃতাত্ত্বিক মর্টন ফ্রাইড ও ইলম্যান সার্ভিস মানব সমাজ ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সামাজিক বৈষম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। উক্ত শ্রেণিবিভাগ চারটি ক্যাটাগরি নিয়ে তৈরি। 

    ১. শিকারী সমাজ: পশু পাখি হত্যা ও শাক সবজির উপর নির্ভরশীল সমাজ৷ এরা সকলেই সমতাবাদী৷
    ২. উদ্যান-পালনভিত্তিক (Horticultural) সমাজ: এই সমাজ দুই শ্রেণির লোক নিয়ে গঠিত। সমাজ প্রধান ও সাধারণ ব্যক্তি৷
    ৩. চিফডোম: এ ধরণের সমাজ রাজা, প্রজা, মন্ত্রী, দাস এদের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
    ৪. সভ্যতা: যা জটিল সামাজিক অনুক্রম ও পূর্নাঙ্গ ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত৷ সামাজিক অনুক্রম বলতে বোঝায় রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ।
    এছাড়াও অনেক দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ সভ্যতাকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বা দিয়েছেন। আবার সভ্যতা সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ধ্যান-ধারণাও থেকে গেছে আমাদের মধ্যে। সবগুলোই যে ভুল তাও নয়। দর্শন বা দার্শনিকদের তত্ত্বের মধ্যে না ঢুকে খুব সাধারণভাবে আমাদের মনে যে ধারণাটা আছে সেটা হলো, সভ্যতার মানেই শহরকেন্দ্রিক। এই ধারণা মেনে নিলে মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের একটা বিরাট অংশকে অস্বীকার করতে হয়। ফরাসী ভাষা অনুযায়ী সভ্যতার অর্থ যেহেতু "সভ্য অবস্থা", সেইহেতু এই ধারণা ঠিক ধরা যেতে পারে, কিন্তু সভ্যতা শব্দের প্রকৃত অর্থের সাথে এই ধারণা খাপ খায় না। আবার বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বললেও, মানুষের সাথে প্রকৃতির সামঞ্জস্য এবং প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করা সভ্যতার অন্যতম প্রয়োজনীয় শর্ত - এটাই তাঁদের মূলকথা। সুতরাং শর্ত যখন আছে, তখন শর্তপূরণের অঙ্গীকার থাকতে হবে। আবার শর্তপূরণ করতে না পারার ব্যথাও থাকবে। এইখানেই বিষয়বস্তুটির সাথে দ্বান্দিকতা আর প্যারাডক্সের সহবাস শুরু হয়ে যায়।
     

    এই দ্বান্দিকতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ভাবিয়ে তুলেছিল এবং সেই ভাবনা তাঁর যথেষ্ট পরিণত বয়সে। 'সভ্যতার সংকট' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন তিনি, যা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১ লা বৈশাখ, ১৩৪৮ সালে এবং কবিগুরুর আশিতম জন্মদিন পালনোৎসবে শান্তিনিকেতনে পুস্তিকা আকারে সকলকে বিতরণ করা হয়েছিল। এটাই ছিল কবিগুরুর জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব। কবিগুরুর উপস্থিতিতে ক্ষিতিমোহন সেন উত্তরায়ন প্রাঙ্গনে উপস্থিত আশ্রমবাসী এবং অতিথিদের সামনে এই প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন। সত্যদ্রষ্টা কবির  বাস্তব জীবন-অভিজ্ঞতার শেষ স্বাক্ষর বহন করছে এই প্রবন্ধটি। আশি বছর বয়স অতিক্রান্ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির জীবনে দেখেছেন সভ্যতার সংকট। মানব জাতির ইতিহাসে এই সভ্যতার সংকটে তিনি স্বভাবতই বিচলিত ও ক্রুদ্ধ। এই প্রবন্ধ যখন লিখছেন তিনি, তখন শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে ইউরোপের জ্ঞান ও বিজ্ঞান একদিন সমস্ত মানব জাতিকে পথ দেখাবে বলে ভাবা হয়েছিল, সেই ইউরোপ আজ সমস্ত পৃথিবীর বুকে ডেকে এনেছে ধ্বংসের তাণ্ডব। নিজেদের ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নখ-দন্ত বের করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষ সরাসরি এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও, ভারতবর্ষের উপরে যে এই সাম্রাজ্যবাদী লালসার ছায়া সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পড়েছে তা যুগদ্রষ্টা কবির পক্ষে বোঝা অসম্ভব হয়নি। দীর্ঘ দুশো বছর ধরে ভারতবর্ষ ইংরেজদের দ্বারা পদানত।অথচ ইংরেজের এই অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী পরিচয়টুকুই সব ছিল না একসময়। ভারতবর্ষ তার দীর্ঘকালীন মধ্যযুগীয় অবশেষ ত্যাগ করে ইংরেজদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্পর্শেই নতুন করে জেগে ওঠার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। ইংরেজের মাধ্যমেই ভারতবাসী ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। তাদের সামনে খুলে গিয়েছিল এক নতুন আকাশ। সেই আকাশে কোথাও ছিল না সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কালো কঠিন মুখ। রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন এই প্রসঙ্গে। অল্প বয়সে তিনি যখন ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, সেখানের পার্লামেন্টে তিনি শুনেছিলেন জন ব্রাইটের বক্তৃতা। সেই বক্তব্যের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন চিরকালীন ইংরেজের বাণী। সেই বাণী মানবতার। সেই বাণী উদারতার। সেই বাণীর মধ্যে কোথাও জাতিগত সংকীর্ণতা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নিজের আত্মীয় হিসাবে গ্রহণ করার ঔদার্য ছিল সেই বাণীর মধ্যে। আর শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্রই যে শুধু ইংরেজরা আবিষ্কার করেছিল তা নয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন উদার মানবতার বাণী। শেক্সপীয়রের নাটক, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলির কাব্য, মেকলের প্রবন্ধ –সবকিছুর মধ্য থেকেই ভারতবাসী তাদের প্রাণের রস সন্ধান করেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ চরিত্রে। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম। ক্রমে ইংরেজ এ দেশের শাসক হয়ে বসেছে। বণিকের মানদণ্ড পরিণত হয়েছে শাসকের রাজদণ্ডে। তা সত্ত্বেও ইংরেজের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভবটি অনেকের মনেই জাগ্রত ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এতো গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে’। কিন্তু ইংরেজ সম্পর্কে এই শ্রদ্ধার বোধ বর্তমান পরিস্থিতিতে আর বজায় রাখা সম্ভব নয় বলেই মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিগত কয়েক দশক জুড়ে ইংরেজরা পৃথিবীর উপর যে অমানবিক তান্ডবলীলা চালিয়েছে তাতে তাদের অতীত গৌরব ধূলিসাৎ হয়েছে। জ্ঞানের অগ্রদূত হয়ে যারা ভারতবর্ষে এসেছিলেন, অচিরেই তাদের মধ্যে দেখা দিল বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ। মানবতার দূত হিসাবে যাদের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া, তারাই বিশ্বজুড়ে মত্ত হল মানবতা লঙ্ঘনের খেলায়। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখেছেন, প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে। দীর্ঘ প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতবর্ষ ক্রমশ হীনবল হয়েছে। জনগনের উপর নেমে এসেছে একের পর এক দুর্বিষহ অত্যাচার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পুরোমাত্রায় নষ্ট হয়েছে। সমগ্র ভারতবর্ষ ইংরেজের তথাকথিত সভ্য শাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। ‘সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হল, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধহয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনোদেশেই ঘটেনি’। সভ্যতার বড়াই করে যে দেশ ও জাতি তাদের কাছ থেকে সভ্যনামধারী মানব আদর্শের এতোবড় নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ দেখে রবীন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়েছেন। শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্ব-রাজনীতি পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ তুলে এনেছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সভ্যতাগর্বী ইংরেজ কি নিষ্ঠুর তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। চীনের অহিফেন যুদ্ধ (১৮৪০-৪২) তেমনই এক আগ্রাসন। চীনে ইউরোপীয় দেশগুলির অবাধ বাণিজ্য নিষিদ্ধ ছিল। এ সময় চীনে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসাবে আফিমের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ইংরেজ বণিকেরা চোরাপথে চীনে প্রচুর পরিমাণে আফিম সরবরাহ করতে থাকে। এবং কালক্রমে তা চীনাদের নেশায় পরিণত হয়। আফিমের কুপ্রভাব থেকে দেশবাসীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ক্যান্টন বন্দরে ২০ হাজার পেটি আফিম বাজেয়াপ্ত করে (১৮৩৯) ধ্বংস করে চীনা সরকার। ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ সরকার এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। চীন তা অগ্রাহ্য করলে শুরু হয় প্রথম অহিফেন যুদ্ধ। শক্তিশালী ব্রিটিশরা সহজেই চীনকে পরাজিত করে। স্পেন থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একই ভাবে ইংরেজেরা নিজেদের মানবতাবিরোধী কর্মধারাকে বজায় রেখেছে শক্তির মদমত্ততায়। অন্য দেশের সম্পদ লুঠ করে এনে নিজেরা হয়েছে সমৃদ্ধতর। ইংরেজকে অনুসরণ করে ফরাসী, ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপীয় জাতিরাও নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষকে লুণ্ঠনের খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের সেই লোভের কারণেই ঘটে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অবক্ষয় দেখে মনে হয়েছিল এমন কালো সময় হয়তো আর পৃথিবীর বুকে কোনওদিন আসবে না। কিন্তু তা থেকেও ইংরেজ সহ ইউরোপের দেশগুলি কোনও শিক্ষা নেয় নি। শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়ে লিখেছেন, এমন সময় দেখা গেল, সমস্ত যুরোপে বর্বরতা কিরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।   
    কিন্তু, প্রবন্ধের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার এই সংকটকে তুলে ধরলেও, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের বিধ্বস্ত রূপ প্রকাশ করলেও, নিজের গভীর জীবনপ্রজ্ঞায় তিনি যেন অনুভব করেছেন এই ধ্বংসই মানব সভ্যতার শেষ কথা নয়। আজকের রক্তলেখা বাস্তব যে ইতিহাসের শিশুপাঠ্য কাহিনিতে স্থান পাবে এ তার স্থির বিশ্বাস। নিজের মানসচক্ষে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, ইংরেজের আসন্ন পতনের ভবিষ্যৎ। ইতিহাসের গভীর প্রজ্ঞায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে ইতিহাস সাক্ষী, বড় বড় অত্যাচারী শাসকেরা হাজার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের শুভবুদ্ধিরই জয় ঘটেছে। তেমনি ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনই শেষ কথা হয়ে থাকবে না। এ কথা ঠিক ইংরেজের অত্যাচারে ভারতবর্ষের অবস্থা আজ খুবই করুণ। কিন্তু ঔপনিষদিক চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, একদিন পাশ্চাত্যের এই লালসার সামনে প্রাচ্যের ত্যাগের বাণীই প্রাচীর হয়ে দেখা দেবে। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য আবির্ভূত হবেন প্রাচ্যের মহামানব। বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের মতোই যথার্থ প্রজ্ঞার পথ উদ্ভাসিত হবে পৃথিবীর সামনে। ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই’। আর তাই এই প্রবন্ধের শেষে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের চরম আশাবাদই ধ্বনিত হয়। মানব সভ্যতা বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজ এখানে এসে পৌঁচেছে। হয়তো বর্তমান খুব কঠিন, কিন্তু যখনই মানব সভ্যতা এই রকম কালবেলায় উপনীত হয়েছে, ততবারই উদিত হয়েছে নতুন ভোর। তাই রবীন্দ্রনাথ আশা রেখেছেন মানুষের শুভ চৈতন্যের প্রতি। ‘কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব’। প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা ও মদমত্ততা ও অহঙ্কার পরিণতিতে যে বিনষ্ট হবেই এই তাঁর গভীর বিশ্বাস। উপনিষদের বাণী উদ্ধৃত করে তাই তিনি বলেন, ‘অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি…’ অর্থাৎ, অধর্মের দ্বারা মানুষ বাড়িয়া ওঠে, অধর্ম হইতে সে আপন কল্যাণ দেখে, অধর্মের দ্বারা সে শত্রুদিগকেও জয় করে। কিন্তু পরিশেষে একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায়’।  ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে? একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে? জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি'।
     

    বিশ্বমানবের যে চিত্র এঁকেছিলেন কবিগুরু তাঁর সমগ্র জীবনের সাহিত্যে, সেই বিশ্বমানবের চিত্রও কিন্তু বাস্তবে অন্যরকম পাই। সেই মোহভঙ্গের কথা তিনি স্বীকারও করেছেন "সভ্যতার সংকট" প্রবন্ধে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান বা রাশিয়া, যারা বাকী বিশ্বের চেয়ে সভ্যতার নিরিখে অনেক এগিয়ে বহু যুগ থেকেই, তাদের কোনদিনই আমরা বাকী বিশ্বের লোকেদের সভ্যতার নিরিখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম ভূমিকা নিতে দেখিনি। বরং অনুন্নত বা অসভ্য বিশ্বের লোকেদের শোষণ করতে, অত্যাচার করতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখি। আমরা যেদিন থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা বানিয়েছি, সেদিন থেকেই শাসক আর শোষিতের জন্ম হয়েছে। একই দেশের কথা ভাবলে শোষণের রূপ একরকম আবার দুই বা তার বেশী দেশের কথা ভাবলে রূপটা দাঁড়ায় এইরকম: তুমি আমার প্রতিবেশী দেশ হলে আমার বশ্যতা (allegiance) স্বীকার করেই চলতে হবে আর যদি প্রতিবেশী দেশ না হও তাহলে আমার আধিপত্য (supremecy) স্বীকার করে চলতে হবে। এইভাবেই আমরা যত ক্রমবিবর্তিত হয়েছি, শাসক আর শোষিতের চেহারাটাও ক্রমশঃ নগ্ন হয়েছে। আবার গ্রাম ও শহরের মধ্যেও একই লড়াই চলেছে যুগ যুগ ধরে। গ্রামের সবুজ আমাদের খাদ্য দেবে, পুকুর-জলাশয় আমাদের মাছ দেবে, গ্রামের হাঁস-মুরগি-ছাগল আমাদের প্রোটিন দেবে, গ্রামের সবুজ বনানী আমাদের নির্মল অক্সিজেন দেবে। কিন্তু আমরা গোগ্রাসে গ্রামের পর গ্রাম গিলতে থাকবো, ধ্বংস করতে থাকবো শহরায়নের নাম করে। গরীব ও বড়লোকের ক্ষেত্রেও সেই একই দৃশ্য, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতর ক্ষেত্রেও সেই একই দৃশ্য। এইরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু ক্রমবিকাশের কোনো স্তরেই আমরা দেখতে পাইনা যে, শাসক শোষিতকে সাহায্য করছে শাসকের পর্যায়ে উঠে আসার জন্য, শহর রক্ষা করছে গ্রামকে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, বড়লোক চেষ্টা করছে গরীবদের বড়লোক শ্রেণীতে উঠে আসার জন্য, শিক্ষিত লোকেরা অশিক্ষিতদের শিক্ষার জন্য প্রাণপাত করছে। ফলে ক্রমবিকাশের শুরু থেকেই সভ্যতার বাস্তুতন্ত্র ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে এবং সময়ের সাথে সাথে সেই ভারসাম্যহীনতা বেড়েই চলেছে। সভ্যতা তার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বক্সারের জঙ্গলে বা মেঘালয়ের পাহাড়ে কোনো ইমারত উঠলে আমরা গেল গেল রবে প্রাণপাত করতে থাকি কিন্তু কলকাতার বুকে ইমারত উঠলে খুশিতে মেতে উঠি। আটলান্টিকে বা এভারেস্টে বরফ গললে আমরা গেল গেল রব তুলি কিন্তু অত্যন্ত গর্বের সাথে বলি নিজের বাড়ীতে দুটো ফ্রিজ, চারটে এসি আছে। পাহাড়ে গাছ কাটার কথা কাগজে দেখলে সম্পাদককে প্রতিবাদপত্র পাঠাই কিন্তু নিজের দুচাকা বা চারচাকা বিগত বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ-ত্রিশ বছর ধরে চালিয়ে যাই। সমস্ত গ্রামাঞ্চল আর মফস্বলে কাটা তেলে ইঞ্জিন ভ্যান চলতে দেখে নির্বিকার থাকি উপরন্তু সেইসব ভ্যানে চেপেই যাতায়াত করি। প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং যত্রতত্র ফেলে দেওয়া সম্পর্কে আমরা নিশ্চুপ বরং বাজারে বা দোকানে প্লাস্টিক না দিলে তর্ক বাঁধিয়ে দিই। এই প্রসঙ্গে আর একটি প্যারাডক্সের কথা না বললেই নয়, "বিজ্ঞান - মানবজীবনের আশীর্বাদ না অভিশাপ"। সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তর পেড়িয়ে মানুষ এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত প্রাণী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বিজ্ঞানের অগ্রগতি করতে পেরেছে বলেই। বিজ্ঞান মানুষকে একদিকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ, উন্নত জীবনশৈলী দিয়েছে অন্যদিকে বাস্তুতন্ত্রকে নিকেষ করার, এই গ্রহকে মুহূর্তে ধ্বংস করার চাবিকাঠিও দিয়েছে। আমরা ক্ষমতার লোভে, শাসকের আসনে বিরাজমান হওয়ার জন্য বাস্তুতন্ত্রকে নিঃশেষ করে চলেছি প্রতি মুহূর্তে। বিভিন্ন প্রাণীকুল, উদ্ভিদকুল পৃথিবী থেকে এরমধ্যেই বিদায় নিয়েছে, আরও অনেকে বিদায় নেওয়ার প্রহর গুনছে। বিজ্ঞানের সাহায্যেই আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকি বানিয়েছি, অজস্র যুদ্ধের পাশাপাশি দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ করেছি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দরজায় কড়া নাড়ছে। ওজোন-স্তরের পিন্ডি চটকে দিয়েছি, এমনকি মহাকাশেও জঞ্জালের পাহাড় বানিয়েছি। সুতরাং যার সাহায্যে আমরা এগিয়ে চলেছি, সে আমাদের শুধু পিছিয়ে দিচ্ছে না, বিপদের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বিজ্ঞান, সভ্যতার মতোই মানবজীবনে একদিকে যেমন আশীর্বাদ তেমনি অন্যদিকে অভিশাপ। 
    একইভাবে বলা যায়, আমরা নিশ্চয়ই সভ্য অবস্থায় এসেছি কিন্তু আমাদের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে একদিকে যেমন আমাদের সভ্যতার কারণে এই গ্রহে, এই সমাজে, এই গ্রহের বাস্তুতন্ত্রে সংকট তৈরী হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তেমনি আমাদের সভ্যতাও সংকটপূর্ণ হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সভ্যতা যত এগোবে, প্রকৃতির সাথে সম্পর্কহীন বলে বা প্রকৃতির সাথে যুক্ত নয় বলে, সভ্যতার উপজাত হিসেবে সংকটও বৃদ্ধি পাবে আবার সমাজে সংকট বৃদ্ধির কারণে সভ্যতাও ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে ও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। এইকারণেই দ্বান্দিকতা আর প্যারাডক্স শব্দ দুটি আমাদের সভ্যতার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে এবং বিকাশ ও বিনাশের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়াও সম্ভব নয় কোনোভাবেই।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ar | 108.26.***.*** | ২৬ নভেম্বর ২০২২ ২০:২০514184
  • লেখাটা একটানা না লিখে যদি কয়েকটা প্যারা করে দেন তো পড়তে সুবিধা হত।
  • Surajit Dasgupta | ২৬ নভেম্বর ২০২২ ২০:৩৬514186
  • অনুচ্ছেদ করে দিলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন