ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। প্রথম দু'বছর সায়েন্স নিয়ে পড়লেও আগাগোড়া সাহিত্যের প্রতি অগাধ টান থাকায় আইএসসি থেকে বাংলা অনার্সে বিএ পাশ করেন। বাবা যদিও চেয়েছিলেন বটানি নিয়ে ছেলে পড়াশোনা করুক। ফরেস্ট অফিসার হোক। কিন্তু তা আর হওয়া হলো না। হলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক, সম্পাদক এবং অভিনেতা। তিনি নিজেই এনসিসি করার কারণে মিলিটারির দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবার নিষেধের কারণে সেটা হওয়া হলো না। তাঁর বাবা বললেন, "ওই লাইফ তোমার পক্ষে ঠিক হবে না"। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে, তাঁর বাবা উত্তর দেন- "আর্মিতে প্রতিটি বিষয়ে তোমার ঊর্ধ্বতনকে স্যালুট ঠুকতে হবে। সেটা তুমি পারবে না।" তাঁর বাবার এই অন্তর্ভেদী কথা সারা জীবন তাঁর নানা কাজে লক্ষ্য করা গেছে। তাইতো বর্তমান সরকারের বিপক্ষে NRC- র বিরুদ্ধে সই করতে দেখা গিয়েছিল। আজীবন শিরদাঁড়া সোজা করে চলেছিলেন, কারো সামনে মাথা নত করেননি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মার্ক্সের সমর্থন হলেও কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। যেমন হননি তাঁর শিক্ষক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ছাত্র-শিক্ষক হলেও দু'জনে বন্ধুর মতো মিশতেন একে অপরের সঙ্গে। তাইতো, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'রামমোহন' নাটকে রামমোহন হয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর এই অভিনয় দেখে তিনি বলেছিলেন, "সৌমিত্র তুমি একদিন অনেক বড় অভিনেতা হবে। তখন আমি তোমার জীবনী লিখবো"। তিনি হয়তো লিখে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁর সেই অমৃত বাণী ফলে গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ তাঁর জীবনী লিখছেন, পড়ছেন।
নির্মাল্য আচার্য আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় 'এক্ষণ' নামক যে পত্রিকা করতেন, সেই পত্রিকার নামটি দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনুরোধ করেছিলেন পত্রিকার জন্য একটি নাম দিতে, তিনি তাঁর বাড়িতে যেতে বলেছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানে গিয়ে দেখলেন একটা লম্বা কাগজে নামের লিস্ট করা আছে। আর প্রথম নাম যেটি ছিল, সেটি হল এক্ষণ। এই পত্রিকার ইতিহাসটি ঠিক এইরকম- নির্মাল্য আচার্য আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দু'জনেই বাংলা অনার্সে একসাথে পড়তেন, কিন্তু তার আগে আইএসসি পড়ার সময় কমন ক্লাস হিসাবে বাংলা আর ইংরেজি ক্লাসে পরিচয় ঘটে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ইতিমধ্যে দীপা চ্যাটার্জীকে বিয়ে করেছেন। কপি হাউসে আড্ডা দিয়ে বেরিয়েছেন স্ত্রীকে সাথে নিয়ে, তখন নির্মাল্য আচার্য বললেন, "শোন, আমি একটা কাগজ বের করতে চাই। শর্ত একটাই, তুই আর আমি জয়েন্টলি বের করবো।" তখন নিজে সম্পাদক হিসাবে না থেকে সবসময় পত্রিকার পাশে থাকার কথা বললেও নির্মাল্য আচার্য কিছুতেই সে আপত্তি স্বীকার করলেন না। শেষমেশ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চ্যাটার্জী বললেন, "তোমাদের এতদিনের শখ কাগজ বের করার, তাহলে করছো না কেন? তোমরা একসঙ্গে বের করো কাগজ"। ততদিনে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর একটা আশ্চর্যের বিষয়, সত্যজিৎ রায় এক্ষণের প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদ করে দিতেন।
কফি হাউসে আড্ডা দেওয়ার মাধ্যমে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁকে 'পুলুবাবু' বলে ডাকতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখনি কোনো বই প্রকাশ করতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে ম্যানুস্ক্রিপ্ট দেখাতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দিয়ে এই কাজ করাতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা হল, "ও একজন প্রকৃত কবি একথা যেন ভুলে না যাই।" সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যদিও কখনো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ছন্নছাড়া জীবন কাটাননি। তিনি ধারাবাহিক ভাবে শৃঙ্খলতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। আর এটি সম্ভব হয়েছিল তাঁর বাবার শাসন, শিশির ভাদুড়ীর প্রভাব এবং সত্যজিৎ রায়ের গাইড।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা লেখা শুরু করেন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর প্রথম দিককার কবিতাগুলো ভীষণ খারাপ ছিল। তাঁর একজন বন্ধু গাইড মাস্টার হিসাবে ছিলেন গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়, যিনি তাঁকে সবসময় বলতেন, 'Not a day without a line'. সবসময় লিখে যেতে বলতেন, চাই সে খারাপ হোক কিংবা ভালো হোক। আবার কিছুদিনের মধ্যে সেটা ভুলে যেতে বলতেন, নাহলে পরের কবিতাটা লিখতে পারবে না। অসাধারণ এই দর্শনকে কাজে লাগিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীতে অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শেষ বয়স পর্যন্ত তিনি এটাকে মেনেও ছিলেন। কারণ, অনেক বড়ো বড়ো কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল আবৃত্তিশিল্পী হিসাবে, কিন্তু নিজের কবিতা কখনো মুখস্থ বলতে পারতেন না।
নাট্যকার শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সাথে 'প্রফুল্ল' নাটকে তিনটি চরিত্রে মধ্যে সুরেশের চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম দর্শকের মন জয় করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে একটি ইয়ুথ ফেসটিভালে অভিনয় করে সেরা অভিনেতার খেতাব পেয়েছিলেন। এর ফলেও সবাই তাঁকে ভালো অভিনেতা হিসেবে চিনতে শুরু করেন।
নাটক তাঁকে অভিনয় কীভাবে করতে হয় শিখিয়েছে, সিনেমাতে যে সুযোগ থাকে না। তাই নাটকে অভিনয় না করলে তিনি সেরা অভিনেতা হতে পারতেন না। এ কথাটি তিনি নানা সাক্ষাৎকারেও বলেছেন।
সত্তর দশকের দিকে ভারত সরকার 'পদ্মশ্রী' দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়'কে, কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। তার একমাত্র কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, টালিগঞ্জ ইন্ড্রাস্ট্রি সেইসময় ডুবতে বসেছিল, তাই কেবলমাত্র তাঁকে গুরুত্ব দিলে হবে না, পুরো ইন্ড্রাস্ট্রিকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেটি না করায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরে তিনি পদ্মভূষণও পান।
আমার সাথে ওঁর শেষ কথা হয় ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০। এর আগেও বহুবার কথা বলেছি। প্রথমবার কথা বলেছিলাম ২০১২ সালে। 'যা বাকি রইল' কাব্যগ্রন্থ পড়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতে এবং আরো একটি বিষয় জানতে; যেটা সেইসময় আমাকে বিস্মৃত করেছিল। ওই কাব্যগ্রন্থের কোথাও কোনো ছেদচিহ্নের ব্যবহার করেননি। ওই বিষয়টি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নানা কথা চলেছিল, যে আলোচনাটা 'একদিন' পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। ১ অক্টোবর, ২০২০ তে বর্ণিক পত্রিকা- Bornik Magazine -র জন্য লেখা দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই লেখা দেওয়াও সম্ভব হয় নি। তবে সুস্থ হলে পরে যে অবশ্যই লেখা পেতাম, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। তার কারণ, আমি 'স্বপ্ন সন্ধানী' পত্রিকাটি অর্থনৈতিক কারণে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, আবার নতুন উদ্যোমে 'বর্ণিক' পত্রিকার সম্পাদনা করছি শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। সবসময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। প্রত্যেক সংখ্যার সূচি দেখে, সে কী উচ্ছ্বাস! শঙ্খ ঘোষ, নির্মলেন্দু গুণ, জয় গোস্বামী, সেলিনা হোসেন, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, মনোরঞ্জন ব্যাপারী,সাধন চট্টোপাধ্যায়- এঁরাও যে বর্ণিকে লিখেছেন বা নিয়মিত লিখছেন দেখে এবং শুনে কী খুশি। খুশি তো হবেন, তিনিও যে অভিনয় জগতের পাশাপাশি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং সফল সাহিত্যিকও ছিলেন। আজীবন সাহিত্য চর্চা করেছিলেন, তার ফসল হিসাবে আমরা পাই- 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে' (১৯৭৫), 'ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা' (১৯৭৬), ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’ , ‘শব্দরা আমার বাগানে’, ‘যা বাকি রইল’, ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’, ‘ধারাবাহিক তোমার জলে’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। সিনেমা জগতের পাশাপাশি, সাহিত্য জগতেরও অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এ অভাব পূরণ হবার নয়। একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে গেল। আমি একজন অভিভাবককে হারালাম।
সুস্থ হয়ে যদি বাড়ি ফিরতেন, তাহলে বর্ণিক পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতাম এবং পত্রিকার উদ্বোধন তাঁর হাতেই করাতাম, স্ট্রিম ইয়ার্ডের মাধ্যমে হোক অথবা সরাসরি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
ঋণস্বীকার:
১. আমার অল্পবয়স: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (নিউজ পেপার- গণশক্তি)
২. Rtv Entertainment এর সাক্ষাৎকার
৩. সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে বর্ণিকের সম্পর্ক: ইউসুফ মোল্লা (নিউজ পেপার- বাংলাদেশ চিত্র)
এক্ষণ পত্রিকার নামকরণ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী করেন কিকরে ?
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মারা যান ১৯১৫ সালে।
এক্ষণ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬১তে । এক্ষণ নামটি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
এক্ষণ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬১তে । এক্ষণ নামটি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।