এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • পুরানো সেই দিনের কথা - "চক্রবৎ পরিবর্তন্তে"

    ক্যাপ্টেন হ্যাডক লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ১৬ নভেম্বর ২০২০ | ২৫৯১ বার পঠিত
  • (১, ২) | (৩) | পর্ব ৪ | পর্ব ৫
    আমাদের পৃথিবীতে সব মিলিয়ে যতরকম গাছপালা আর পশুপাখি আছে, গুণে দেখা গেছে তার সংখ্যাটা প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন। এত বড় এবং এত বিচিত্র এই প্রাণীজগৎ, যে গুছিয়ে তা নিয়ে ভাবা যায় না, সব প্রাণীকেই নতুন লাগে। তাই, জীববিজ্ঞানে এই সমস্ত প্রজাতিকে একভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে, একটা ছকে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যাতে এতরকম জীবজন্তুর ভিড়ে আমাদের খেই হারিয়ে না যায়। ছকে বাঁধার পর পুরো ছবিটার মধ্যে একটা ছন্দ ধরা পড়ে। - ভুল বলা হল। আসলে বিজ্ঞানীরা ওই ছন্দ ধরে ধরেই তাঁদের এই ছকটা সাজান। মানুষ সহ সমস্ত জ্যান্ত জিনিস এই ছন্দে গাঁথা।

    ছন্দ বলতে কীরকম?

    দেখা যায়, প্রাণীদের সবার সাথে সবার একটা সম্পর্কের যোগ আছে। একটা আত্মীয়তা আছে। কখনো তা বহু দূরের, কখনো বা একেবারেই নিকট আত্মীয়তা। পুরো প্রাণীজগতকে ধাপে ধাপে বড় থেকে ছোটো ভাগে ভাগ করা যায়। এটা বিজ্ঞানের একটা মূল তত্ত্ব। সবাই সবার সাথে জড়িত, কেউ দূরে, কেউ কাছে, - কার সাথে কার কতটা মিল আর কতটা ফারাক, সেই ভিত্তিতেই জীববৈচিত্র্যের ছক আঁকেন বিজ্ঞানীরা।

    ধরা যাক আমরা চিড়িয়াখানা বেড়াতে গেলাম। চিড়িয়াখানায় নানারকম পশু, নানারকম পাখি। কাঁচের ঘরে সাপ, বাঁধানো পুকুরে কুমীর, অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ। গাছের ডালে ঝুলে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড়। আর চারদিকে অজস্র সবুজ - ঘাস, ঝোপ, গাছ, গাছড়া। এই যে এতরকম কিছু, এদেরকে প্রথমেই আমরা 'দু'রকম' জিনিস বলে চিনতে পারি। একরকম হল গাছ; আরেকরকম হল পশুপাখি। খুবই সহজ, সাধারণ শ্রেণীবিভাগ - অন্তত এই স্তরে। এরপর লক্ষ্য করলে দেখব, চিড়িয়াখানার যত পশুপাখি তাদের সবার ক্ষেত্রে একটা বৈশিষ্ট্য common, - তাদের সবার একটা করে মাথা আছে। মাছ, সাপ, কুমীর, বাঘ, হাতি, পাখি, মানুষ - সবার মাথা আছে। তাহলে এদের সবাইকে একটা দল হিসেবে ধরা যায় - মাথাওয়ালা প্রাণী।

    এবার এই সমস্ত মাথাওয়ালাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, - কিছু কিছু প্রাণীদের হাত-পা আছে, আর বাকিদের তা নেই। যেমন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে - মাছদের কারও হাত বা পা বলে কিছু নেই। মাছ বাদে বাকিদের তা আছে। - হ্যাঁ সাপেরও - সাপের পা ছিল; পরে লোপ পেয়েছে, অনেকটা আমাদের লেজের মতো। - কিন্তু মাছেরা কোনোকালেই পা-ওয়ালা ছিল না। তাই মাথাওয়ালাদের মধ্যে আবার ভাগ করলে, মাছ থাকবে একদিকে, আর বাকিরা থাকবে আরেকদিকে। এদেরকে বলা যাক মাথা এবং পা-ওয়ালার দল।

    এবার দেখা যাবে পা-ওয়ালাদের মধ্যেও নানারকমের জীব রয়েছে। কারও কারও গায়ে পালক, তারা ডিম পাড়ে। কারও কারও গায়ে লোম, তারা বাচ্চা পাড়ে, সেই বাচ্চারা আবার মায়ের বুকে দুধ খায়। কেউ কেউ আবার ডিম পাড়ে, কিন্তু তাদের গায়ে পালক নেই। ডিম-পাড়িয়েদের মধ্যে আবার দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ জলে ডিম পাড়ে, কেউ শুকনোয়। - এইভাবে এদেরকে ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। পালক + ডিম হলে তারা হবে পাখি; লোম + বাচ্চা + দুধ যদি হয় তবে সে স্তন্যপায়ী; ডিম কিন্তু পালক নেই - এমন হলে তারা সরীসৃপ; কিন্তু পাখি বা সরীসৃপ তো ডিম পাড়ে শুকনোয়, - ওদিকে যারা জলে ডিম পাড়ে আর ছানারা জলেই শৈশব কাটায়, - তারা হল উভচর, আমাদের সোনাব্যাঙ-কোলাব্যাঙের জ্ঞাতিগুষ্টি।

    আর যদি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ঢুকে একটা ভাগ খুঁজে বার করি, - যাদের মাথা আছে, হাত-পা আছে, গায়ে লোম হয়, মায়ের দুধ খায়, আর দুই পায়ে সোজা হয়ে হাঁটে, তাহলে দেখব যে এদের নামই মানুষ।

    এতটা অবধি যা দেখা গেল, তা তেমন কঠিন না। স্কুলে থাকতে একটা খেলা শিখেছিলাম - একধরনের guessing game, - খেলাটার নাম Twenty Questions। একজন মনে মনে কোনো একজন বিখ্যাত লোকের নাম ভাববে। এবার তার বন্ধুরা বের করার চেষ্টা করবে নামটা কী। তারা বন্ধুকে এমন ধরনের প্রশ্ন করবে যার উত্তর হ্যাঁ বা না-তে দেওয়া যায়। যেমন, 'লোকটা কি জীবিত?' - উত্তর এলো - না। এর পর প্রশ্ন হল, 'ভারতীয়?' - হ্যাঁ। 'বাঙালী?' - হ্যাঁ। 'সে কি কোনো বিজ্ঞানী?' - না। 'সাহিত্যিক?' - হ্যাঁ। 'তার কী লম্বা সাদা দাড়ি আছে?' - হ্যাঁ। - এতক্ষণে সবাই বুঝে ফেলেছে বন্ধুটির মনের গভীরে কোন্ বিখ্যাত ব্যক্তির নাম ডুবসাঁতার কাটছে। নিয়ম হল কুড়িটা প্রশ্নের মধ্যে বুঝে ফেলতে হবে কার কথা ভাবা হয়েছে। অনেকসময় গণ্ডগোল হত। 'সাহিত্যিক?' - হ্যাঁ। অতঃপর যত সাহিত্যিক আছে সবার নাম নিঃশেষ করে ফেলেও বোঝা গেল না লোকটা কে। তখন কেউ একজন হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল - 'বিজ্ঞানী?' - জবাব এল - 'হ্যাঁ!!!' - শেষে উত্তর বেরোলো - জগদীশচন্দ্র বসু!

    এই খেলাটা শুধু বিখ্যাত মানুষ নিয়ে নয়, পশুপাখি নিয়েও খেলা যেত। মনে মনে ভাবা জন্তুটা ডাঙায় থাকে কিনা, তার পালক আছে কিনা, সে মাংসাশী কিনা, হিংস্র কিনা, একা শিকার করে কিনা, গায়ে ডোরাকাটা দাগ আছে কিনা - এই সব প্রশ্ন ধরে ধরে সহজেই বোঝা যায় কোন্ পশুর কথা ভাবা হচ্ছে। এটাও প্রাণীজগতের ছন্দোবদ্ধ সজ্জার একটা উদাহরণ। সমস্ত প্রজাতি একসাথে একটা ছকে বাঁধা না থাকলে এই খেলা অসম্ভব হত।

    তবে ভুলও কি হত না? চেহারার মিল-বেমিল ধরে পশুপাখিদের পরিচয় বের করে আনা যায় ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো এমন দেখা যায়, যে উপর-উপর কোনো একটা বৈশিষ্ট্য খুব প্রকট হলেও আসলে তার চরিত্র আলাদা। যেমন বাদুড়। বাদুড়ের ডানা আছে, কিন্তু 'ডানাওয়ালা' বলেই তাকে পাখি বলে ধরে নিলে ভুল হবে। আমরা জানি বাদুড় স্তন্যপায়ী - একমাত্র আকাশচারী স্তন্যপায়ী। সেরকম, কেউ যদি ক্লু-তে 'স্তন্যপায়ী' পেয়েই চারপেয়ে পশুদের কথা ভাবতে শুরু করে, তাহলে তিমির কথা আর তার মাথায় আসবে না। তিমির পা নেই, পাখনা আছে - সে সামুদ্রিক!

    সাপের ক্ষেত্রেও এই জন্যেই আমাদের ধন্দ লেগেছিল। সাপের পা নেই - ঠিকই। যে ধরনের জীবনে সে অভ্যস্ত, তাতে পা লাগে না। বাইরে থেকে দেখলে তাই সাপ পা-ছাড়া। তবে ভালো করে খুঁজে দেখলে কিন্তু অন্যরকম কথা উঠে আসে।

    অ্যানাকন্ডা, অজগর, এবং এদের জাতভাইয়েরা - সাপেদের মধ্যে অতিকায় বলে বিখ্যাত। অজগর - আমাদের আশৈশব পরিচিত সাপ, পৃথিবীর দীর্ঘতম সাপ। আমাদের দেশে Reticulated Python বলে একধরনের অজগর আছে, ভারত সহ সারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এর দেখা পাওয়া যায়। একে লম্বায় ৬.৯৫ মিটার অবধি হতে দেখা গেছে। দৈর্ঘ্যের বিচারে একে আর কোনো সাপ টপকাতে পারে না। দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন অরণ্যের সাপ অ্যানাকন্ডা, এরা পৃথিবীর বৃহত্তম সাপ - আকারে এবং ওজনে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাতের যারা, সেই Green Anaconda-র শরীরের ব্যাস হয় প্রায় 30 cm - মানে পাক্কা এক ফুট। ওজন হয় ২২৭ কেজি। আর লম্বায় যদিও এমনিতে হয় মিটার ছয়েক, - কিন্তু আজ অবধি সবচেয়ে বড় যে গ্রীন অ্যানাকন্ডা পাওয়া গেছে, সে দৈর্ঘ্যে অজগরকেও অনায়াসে টেক্কা দেয় - ৮.৮ মিটার।

    একটা অজগরকে চিত করে শুইয়ে যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, তার লেজের কাছে, তলার দিকে - দুটো ছোটো ছোটো কাঁটার মতো রয়েছে, অনেকটা যেন ছোটো শিঙের মতো। লেজের কাছে পেটের দু'পাশ থেকে সে দুটো বেরিয়েছে, বেরিয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। এই ছোটো ছোটো জিনিসগুলো আসলে অজগরের পেছনের পা। পা আর নেই, চিহ্নটুকু টিকে আছে। অ্যানাকন্ডারও এরকম দেখা যায়, পেটের তলায় ছোটো ছোটো কাঁটার মতো দুই পা জেগে থাকে। এই পা আর চলাফেরার কাজে লাগে না, স্মৃতিচিহ্ন হয়েই থেকে গেছে একরকম। বড় জাতের সাপদের অনেকের মধ্যেই এই 'পা' দেখা যায়।

    সুতরাং সাপ সত্যিসত্যিই 'পা-ছাড়া' প্রাণী নয়। অজগরপ্রতিমরা তার সাক্ষী। একসময় সাপের পা ছিল, তা সে হারিয়েছে - তাই বরং তাকে 'পা-হারা' বলা যেতে পারে। কিন্তু মাছ কোনোকালেই পা-ওয়ালা নয়, ডাঙার পয়দল জীবনযাত্রা তার কাছে অলীক।

    তলিয়ে দেখলে এইধরনের ভুল হবার সম্ভাবনা অনেকটাই কেটে যায়। বুকে-হাঁটা সাপ কানকোর বদলে ফুসফুসের সাহায্যে শরীরে অক্সিজেন ভরে নেয়, ডানাওয়ালা বাদুড় তার লোমশ শরীরের পরিচয়ে সহজেই ধরা পড়ে, সামুদ্রিক তিমি নিঃশ্বাসের সাথে জলের ফোয়ারা ছুটিয়ে তার সঠিক পরিচয়ের জানান দেয়। পোকামাকড়-মাছ-উভচর-সরীসৃপ-পাখি-স্তন্যপায়ী, - এই চেনা ছকে আমরা মোটামুটি সবাইকেই এনে ফেলতে পারি।

    তাই, এতদূর অবধি ব্যাপারটা তেমন কঠিন নয়। কঠিন হয় তখনই, যখন খেয়াল করি যে আমাদের সুপরিচিত প্রাণীদের বাইরেও বহু বহু রকম জীবজন্তু এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। তাদের সবাইকে অত সহজে পরিচিত ভাগগুলোর মধ্যে ফেলে দেওয়া যায় না। আর সেই সাথে এটাও আমাদের মনে পড়ে যায়, যে আমাদের চোখের সামনেকার এই বর্তমান কালের অনেক আগে থেকে, - বিগত চল্লিশ কোটি বছর ধরে এই গ্রহে প্রাণের উপস্থিতি রয়েছে। হাজার হাজার এমন প্রাণীরা পৃথিবীতে ছিল, যারা আমাদের সমসাময়িক কোনো ভাগের আওতাতেই পড়ে না। - আর এই অধুনা অনুপস্থিত প্রাণীদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। মাঝে মাঝে শুধু সামান্য চিহ্ন খুঁজে পাই, একটুখানি পায়ের দাগ, এক চিলতে গায়ের আঁশ, এক টুকরো ছোটো ফসিল। খুব ভাগ্য থাকলে হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল। এক একটা আবিষ্কারে নতুন নতুন তথ্য জানা যায়, ছকের একেকটা অংশ ঢেলে সাজানোর কথা ভাবতে হয়। বিজ্ঞানের এই মহলে সবসময়েই মতানৈক্য, সবসময়েই বাগ্‌বিতণ্ডা চলেছে - কেউ বলেন অমুকভাবে সাজাও, কেউ বলেন তমুকভাবে। কেউই কারোর কথা পুরোপুরি কাটতে পারেন না, কারণ পুরো ছবিটা কেমন হবে সে সম্পর্কে সবাইই - 'আমি যে তিমিরে, তুমি সে তিমিরে'। এ যেন এক বিরাট জিগ্-স পাজল সল্‌ভ করতে বসেছেন বিজ্ঞানীরা, কেবল মুশকিল হল পাজলের টুকরোগুলোর অর্ধেকই হারিয়ে গেছে।

    তবুও, হাজার হোক বিজ্ঞান এক self-correcting, self-nourishing, ever-expanding বিদ্যা। অসম্পূর্ণতাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই আমাদের হাতে অন্তত একটা অসম্পূর্ণ ছবি গবেষকরা তুলে দিয়েছেন। নতুন কোনো টুকরোর হদিস পেলেই পরিমার্জন, পরিবর্ধন চলছে। অনেক জায়গা আবছা, ছোটো ছোটো সূত্র ধরে একটা অস্পষ্ট রূপরেখা আমাদের সামনে ফুটে উঠছে। তাই ভেজা-ডিম জলজ উভচরদের থেকে শুকনো-ডিম স্থলজ চারপেয়েদের বংশপঞ্জী এবং বৈশিষ্ট্য যদি খুঁজে দেখতে যাই, তাহলে ঝকঝকে পরিষ্কার ধারণার চেয়ে ছোপ-ছোপ ধারণা পাবার সম্ভাবনাই বেশী। আর সেই শতছিন্ন রোডম্যাপ ধরেই আমাদের এই গাইডেড ট্যুর।

    খুলির কথা বলছিলাম।

    খুলি বলতে আমরা বোঝাই কঙ্কালের মাথার অংশটা, যার মধ্যে মগজ আর চোখ, কান, নাক, জিভ – এই চারটে জ্ঞানেন্দ্রিয় সুরক্ষিত থাকে। খুলির ওপরদিকে দু'খানা বড় গর্ত, সেই কোটরে বসানো থাকে দুই চোখ। ভালো বাংলায় একে বলে অক্ষিকোটর। এই অক্ষিকোটরের পেছনে খুলির গায়ে একটা অংশ থাকে, তার নাম temporal fenestra। দেখতে ছোট ফুটোর মতো, দু’চোখের পিছনে একটা করে। এই ফুটোর সূত্র ধরে - কচ্ছপ, কুমীর, ডাইনোসর, পাখি, স্তন্যপায়ী - সবার মাথার খুলি যদি তুলনা করে দেখি, - তাহলে তাদেরকে কয়েকটা নির্দিষ্ট ধরনে ভাগ করা যায়।

    কচ্ছপের মাথার খুলি যদি নিই, দেখব তার চোখের কোটরের পেছনে কোনোধরনের কোনো ফুটো নেই। একটানা হাড়ের পাত সাজানো রয়েছে, চোখ ছাড়া আর কোনো গর্ত দেখা যাচ্ছে না। এইধরনের খুলি যাদের, তাদেরকে বলে Anapsid।

    কিছু খুলিতে অন্যরকম ব্যাপার। অক্ষিকোটরের পেছনে একটা করে ফুটো দেখা যাচ্ছে। দু'পাশ মিলে দুটো। এই জাতের প্রাণীদের বলা হল Synapsid।

    তৃতীয় আরেকরকম খুলি দেখা যাবে, যাদের চোখের পেছনে একটা নয়, দু'টো করে ফুটো রয়েছে। একটার নীচে আরেকটা। এরকম দুই ফুটো যাদের, তাদের নাম দেওয়া হয়েছে Diapsid।

    অ্যানাপসিড, সাইনাপসিড, ডায়াপসিড = নেই-ফুটো, এক-ফুটো, দুই-ফুটো। এতদূর হল। কিন্তু এই তিন ধরনের উদাহরণ কারা কারা? জীবজন্তুদের মধ্যে কে এখানে কোন্ ভাগে পড়ছে?

    অ্যানাপসিডদের মধ্যে রয়েছে সবরকম কচ্ছপ আর কাছিম। পিঠে-বুকে শক্ত খোলাওয়ালা সরীসৃপ এরা, এদের সবাই এই দলে পড়ে।

    সাইনাপসিডদের মধ্যে যারা পড়ে, তারা আজকে একটা রূপেই বেঁচে আছে। স্তন্যপায়ী। আমাদের দূর পূর্বপুরুষরাও এই দলে পড়ত, আজ থেকে প্রায় এক কোটি বছর আগে সেই অ-স্তন্যপায়ী সাইনাপসিডদের শেষ শাখা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

    ডায়াপসিডদের মধ্যে পড়ে কুমীর, ডাইনোসর, পাখি, সাপ, গিরগিটি - এরা সবাই।

    কিন্তু প্রাণ তো নতুন নতুন রূপ নেয় বিবর্তনের প্রভাবে, প্রকৃতির তাই নিয়ম। তাহলে এই তিন ধরনের প্রাণীরা বিবর্তনের ধারায় কে কার থেকে উঠে এলো? - শ্রেণীবিভাজন করতে গেলে এই প্রশ্নের জবাব আমাদের দিতেই হবে।

    ডাঙার জীবনে উভচরদের প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল তাদের জলে ডিম পাড়ার অভ্যেস। উভচরদের জীবনে শৈশবটুকু কাটে জলে, এই অবস্থায় তাদের বলে লার্ভা। আমাদের জলায় ডোবায় পুকুরে ব্যাঙের লার্ভা সহজেই দেখতে পাই, বদ্ধ ড্রেনের জলে বা বাগানের খোলা চৌবাচ্চাতেও ছোটো ছোটো গোলমাথা ল্যাজওয়ালা ব্যাঙাচির ঝাঁক দেখা যায়। এইসময় এদের পা থাকে না, এরা লেজ দিয়ে সাঁতার কাটে, মাছের মতো ফুলকো দিয়ে শ্বাস নেয়। বড় হলে ব্যাঙাচির লেজ ছোটো হয়ে মিলিয়ে যায়, সামনে পিছনে পা গজায়, লার্ভা থেকে সে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। সব উভচরের ক্ষেত্রেই এরকম হয়, প্রাগৈতিহাসিক আমলেও তাই হত। জন্ম জলে, শৈশব জলে, - সাবালক হলে ডাঙায় উঠে আসা। এবং অবধারিতভাবেই - নিজেরা ডিম পাড়ার সময়ে আবার জলে ফিরে যাওয়া।

    এরকমটা হবার কারণ হল, প্রাণের বৃদ্ধির জন্য আর্দ্রতা আবশ্যিক। তা না থাকলে ডিমের ভিতর ভ্রূণ বাড়তে পারবে না। উভচরদের ডিমে শক্ত খোলা বলে কিছু নেই, ডাঙায় সে ডিম তুললে তা দেখতে দেখতে শুকিয়ে যাবে, ভ্রূণ মারা পড়বে। এইধরনের ডিম স্থলে পাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই উভচররা জলে ডিম পাড়ে। সেখানে তা প্রয়োজনীয় পরিবেশ পায়, শুকিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় থাকে না। বাচ্চারাও জলেই জন্মায়, ধীরে ধীরে ডাঙার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

    উভচরদের এই দুর্বলতা যারা প্রথম কাটিয়ে উঠল, তাদের নাম amniote। জলের প্রয়োজন আর রইল না, এরা এমন ডিম তৈরী করল, যা ডাঙায় শুকিয়ে যাবে না, - শক্ত খোলার আড়ালে যা ভিতরকার ভ্রূণকে অক্ষত রাখতে পারবে। এই প্রথম অ্যামনিওটদের আমরা সরীসৃপ বলেই ধরি, প্রকৃতপক্ষে যদিও 'আসল' সরীসৃপদের সাথে এদের অনেক তফাৎ। কিন্তু শর্টহ্যাণ্ডের খাতিরে আমরা এটুকু আপোষ করে নিই। প্রাথমিক অ্যামনিওটদের দেখতেও অনেকটা টিকটিকির মতোই হত, তাছাড়া নিয়মমতো সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী - এরাও সবাই অ্যামনিওটের মধ্যেই পড়ে। "অ্যামনিওটদের থেকে এরা সবাই এসেছে", আর "অ্যামনিওটদের মধ্যে এরা সবাই পড়ে" - এই দুটোই ঠিক, - দুটোই একই তত্ত্বের কথা বলে। অ্যামনিওট একটা প্রাথমিক দশা - তার থেকে ধীরে ধীরে নানারকম স্পেশালাইজেশন হয়েছিল।

    আকাশের মেঘ আর কাটছে না, সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, সকালেও বিরাম নেই। মাঠে জল জমেছে, ঘাস ডুবে গেছে। ঝোপঝাড় সব আধডোবা। ক্ষেতজমি সব জলের তলায়, ঘোলারঙা সমুদ্র। পাখিরা বোধহয় গত কয়েকদিন গায়ের পালক শুকাতে পায়নি। তবে বর্ষাকালে সবদিকেই প্রাচুর্য, এদিকে যেমন নতুন গাছ, ঘাস আর শ্যাওলার ভিড়, তেমন পোকামাকড় ব্যাঙ সাপেদেরও উৎসব। প্রাণের উদ্বোধন। A grand banquet. সবাই উপস্থিত, কেউ খাবার খেতে, কেউ খাবার হিসেবে, বেশীরভাগই দুইই। নিজের শরীরের জোগান করতে করতে পরের মেনু সাজানো। এর নাম ফুড ওয়েব, কার্বন সাইক্‌ল, কনজারভেশন অফ মাস অ্যাণ্ড এনার্জি। নিজের জন্যে কে কী রাখবে? প্রকৃতি যেন এক লাইব্রেরিয়ান, তার থেকে জিনিস নেওয়া সব ধারে। মেয়াদ ফুরোলে বই ফেরত দিতে হবে, - সেই বই আবার অন্যে নিয়ে যাবে।

    ভিজতে ভিজতে উড়ে এসে বসল পালক-ভেজা উস্কোখুস্কো বক। বক মাঠে কেন? - জল জমেছে যে। ভরা বর্ষায় কীই বা মাঠ আর কীই বা পুকুর। জল পেয়ে দলে দলে পোকা উঠছে। ঘাসফড়িং, উচ্চিংড়ে, ঝিঁঝি। মানুষের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে মশা, বাদলাপোকা। ভেজা সবুজ পাতা বেয়ে শামুকের শম্বুকগতি। এই সবের উৎপত্তি ওইখানে – জল মাটি ঘাস ঝোপের মেটার্নিটি ওয়ার্ড। ইউরোপের রূপকথায় আছে, ছোটো ছোটো বাচ্চারা সবাই তৈয়ার হয় মেঘের মুল্লুকে, সারস পাখিরা সেই বাচ্চাদের বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে যায়। এই বক কিন্তু এখানে বাচ্চা পৌঁছে দিতে আসেনি। আপাতত পেট ভরানোই তার উদ্দেশ্য।

    কোথা থেকে উড়ে এল মাছরাঙা, ঝপাৎ করে জলে ঝাপটা মেরে কী যেন তুলে নিয়ে গেল! কী ধরলি রে ভাই, ব্যাঙ না গঙ্গাফড়িং? ব্যাঙকে যখন সাপ বা পাখিতে ধরে খায়, তখন ব্যাঙ তাদের কথা শোনাতে পারে না? – বড় যে আমায় ধরে খাচ্ছিস। আমরা না থাকলে তোরা আসতিস কোথা থেকে, জানিস পাখির আগে পৃথিবীতে এসেছিল উভচর! – বা সেই যমের দোসর কেরানিপাখি। যদি আফ্রিকার গোখরো তাকে উল্টে বলে, ব্যাটা ছোটো হয়ে দাদাগিরি করছিস। আগে সরীসৃপ, পরে পাখি, তা জানিস। স্তন্যপায়ীরা তো পাত্তাই পাবে না, ছোটোর ছোটো তস্য ছোটো। আমরা যখন ট্রায়াসিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছি তখন তোরা কোথায় ছিলিস!

    ব্যাঙ বা গোখরো কোনোদিন কাউকে এরকম বলেছে বলে খবর নেই। যদি বলত তাহলে তার জবাবও পেত। একালের প্রাণী আর সেকালের প্রাণীরা চরিত্রে এক নয়। কেউ কেউ কোটি কোটি বছর ধরে একইরকম থেকে গেছে ঠিকই, কিন্তু বেশীরভাগই এসেছে নানারকম রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে। আজকের প্রাণীদের মধ্যে এক এক দলকে আমরা এক এক নাম দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি – কিন্তু এরা এই চেহারায় এসেছে ধাপে ধাপে। পাখির আগে সরীসৃপ, স্তন্যপায়ীর আগে সরীসৃপ – এমনটা নয়। কার্বনিফেরাসের সেই যে জীব, যে গোখরো, কেরানিপাখি, নেউল – সবারই পূর্বপুরুষ, সে নিজে এদের তিনজনের কারো দলেই পড়ত না। আজকের দিনে যারা সরীসৃপ, তাদের সাথে তার অনেক পার্থক্য আছে। যেমন পার্থক্য আছে আজকের পাখি বা স্তন্যপায়ীর সাথে। সে আমাদের সবার common ancestor, কিন্তু তাই বলে সে আমাদের মধ্যেকার কেউ নয়। তার থেকে যেমন একদিকে ভবিষ্যতের সরীসৃপরা উদ্ভুত হয়েছে, তেমন অন্যদিকে পেলিকোসর-থেরাপসিড লাইন বেয়ে এসেছে স্তন্যপায়ী। কোনো শাখা আবার বেরিয়ে গেছে কাছিমদের নিয়ে। কোনো দিকে ডাইনোসরদের থেকে উঠে এসেছে পাখিরা। তার নিজের মধ্যে সবার সম্ভাবনাই নিহিত ছিল। সময়ের গতিতে তার প্রকাশ হয়েছে, প্রসার হয়েছে, শাখাপ্রশাখায় ভাগ হয়েছে। মাধ্যমিকের সিলেবাসে যেমন সব বিষয়ই অল্প অল্প থাকে। ব্যাচের সবাইকেই পড়তে হয় বাংলা ইংরেজী অঙ্ক বিজ্ঞান ভূগোল ইতিহাস। পরে তাদের মধ্যে থেকেই কেউ ডাক্তার, কেউ গণিতবিদ, কেউ সাহিত্যিক, কেউ ঐতিহাসিক। আবার দেখা যায় কয়েকজন ইংরেজী নিয়ে অনার্স করল, তারপর কেউ গেল ফিল্মমেকিং শিখতে, কেউ গেল জার্নালিজম পড়তে, কেউ সব ছেড়ে ম্যানেজমেন্ট ধরল। কেউ ইংরেজী নিয়েই এগোল। - এবার জার্নালিজমের ছাত্রকে ইতিহাসের ছাত্র বলতে পারে না, যে তুই আনকোরা নতুন, আমি তোর আগে থেকে নিজের সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছি। - কারণ স্পেশালাইজেশন এসেছে অনেক পরে। একটা সময় অবধি সবারই একই পড়া ছিল, ভিতটায় সবারই এক গাঁথুনি। সাংবাদিকের চেতনাতেও ইতিহাসশিক্ষা রয়েছে, - তবে তা সেই মাধ্যমিকের ইতিহাস, - ঐতিহাসিকের স্পেশালাইজড ইতিহাস নয়।

    ডারউইনের তত্ত্বের অপব্যাখ্যা করে একটা লোক-ঠকানো প্রশ্ন প্রায়ই করা হয় - "বাঁদর থেকে যদি মানুষ হয়ে থাকে তাহলে বাঁদররা এখনও টিকে আছে কেন!" বিবর্তনবাদী এ হেন প্রশ্ন শুনে 'ফেসপাম' দেন। "ওরে ছোঁড়া, বানর থেকে মানুষ এসেছে এমন নয় - বানর আর মানুষ দুইই এক সাধারণ পূর্বপুরুষের থেকে উঠে এসেছে - এই কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে! তোর আফ্রিকার সিলভারব্যাক গরিলা একরাতে ভোল বদলে মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসেনি।" বায়োলজির evolution তো আর হগওয়ার্টসের transfiguration নয়। একই প্রাণশক্তি নতুনতর প্রসাধনে নতুন প্রজাতি হয়ে দেখা দেয় - ডারউইনের ভাষায় 'the origin of species'। আর সেই প্রসাধন আর অঙ্গসজ্জার ড্রেসিংরুম হল ডি এন এ-র ডাব্‌ল হেলিক্স। একেক কম্বিনেশনে একেক নকশার ইঙ্গিত। অ্যালফাবেটের ২৬টা বর্ণ ব্যবহার করেই 'Hamlet' থেকে 'War and Peace' - সব লেখা হয়েছে; আর ডি এন এ স্ট্র্যান্ডে ৪ + ১ + ১ =৬টা অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরী হয়েছে লেডিবার্ড থেকে রেডউড - ছোটো বড়ো সব প্রাণীর ব্লু প্রিন্ট। যার ওপর নির্ভর করে নতুন প্রাণীদেহ গেঁথে তোলা হবে। একেকরকম বাড়ির একেকরকম ব্লুপ্রিন্ট - কিন্তু তৈরী করার সময় শুরুটা সবারই মোটামুটি একরকম। ভিত হবার পর দেওয়াল-ছাদ হয়ে বাড়ি শেষ হবার দিকে এগোতে এগোতে বোঝা যায় - বাংলো উঠল না অ্যাপার্টমেন্ট, তার স্টাইলটা সাবেকী না অত্যাধুনিক এক্সপেরিমেন্টাল।

    হান্স লারসন যে মুরগীর ভ্রূণে সরীসৃপের লক্ষণ দেখেছিলেন, ম্যাট হ্যারিস আর জন ফ্যালন যে মুরগীছানার ঠোঁটে ডাইনোসরের মতো দাঁত জাগাতে পেরেছিলেন, - তা সম্ভব হয়েছিল এই জন্যেই। সব সম্ভাবনার বীজ সবার মধ্যে লুকিয়ে আছে। সময়ের সাথে সাথে কিছু লক্ষণ চাপা পড়ে যায়, অন্য কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বাকিদের ছাপিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। সেই প্রকট বৈশিষ্ট্যের ওপরেই নির্ভর করে – নবজাতক কোন্ জাতের প্রাণী।

    উভচরদের মধ্যে যারা জলে ডিম পাড়ার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠল, তাদের নতুন নাম হল অ্যামনিওট। এবারে অ্যামনিওটদের ভেতর থেকে একদল আবার নতুন ধরনের উন্নতি করল। সাইনাপসিডদের কথাই বলছি। তাদের করোটিতে চোখের পিছনদিকে বিশেষ রকম ফুটো দেখা দিল, যার পোশাকী নাম temporal fenestra। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল এল তাদের দুই পাটি দাঁতে। এদের মধ্যে প্রথম দাঁতের প্রকারভেদ দেখা গেল। কুমীর বা হাঙরের মুখ দেখলে দেখা যায়, ওদের অনেক দাঁত, কিন্তু সব দাঁতই একরকম। কিন্তু আমরা জানি আমাদের দাঁত চাররকম, তাদের কাজও আলাদা আলাদা – সামনের দাঁত দিয়ে খাবার কাটা যায় আর ছেঁড়া যায়, পিছনের দাঁত দিয়ে সেই খাবার চিবোনো যায়। বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া - সবার মুখেই তাই। - এই যে দাঁতের বিভিন্নতা, এটা প্রথম এলো সাইনাপসিডদের মধ্যে।

    সাইনাপসিডদের মধ্যে ছিল পার্মিয়ান যুগের পেলিকোসররা, যাদের পিঠে বড় পালের মতো পাখনা ছিল। এই পাখনা দিয়ে তারা বোধহয় শরীরের তাপমান নিয়ন্ত্রণ করত। পাখনার আকার বেশ বড় হত – শরীরের উপরিতলের ক্ষেত্রফল বেশ কিছুটা বাড়ত তার দরুণ। রোদের দিকে সেই পাখনা ফিরিয়ে বসলে তাড়াতাড়ি গরম হওয়া যেত; আবার ছায়ায় চলে গেলে তাপ কমেও যেত তাড়াতাড়ি। সুবিধে ঠিকই; কিন্তু বিবর্তনের তো কোনো শেষ নেই। পেলিকোসরদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। তাদের ভারী চেহারা, গিরগিটির মতো পায়ের গঠন – শরীরের দু’পাশ থেকে সামনে-পেছনে দু’টো করে পা বেরিয়েছে, তারপর নব্বই ডিগ্রীতে ভেঙে নীচের দিকে এসে মাটি ছুঁয়েছে। এই নব্বই ডিগ্রীটাই প্রথম ‘কনুই’। বা ‘হাঁটু’। – কিন্তু এই ধরনের পায়ে তো দৌড়োনো চলে না, যদিও তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় ঠিকই। ডাঙার উপরে কুমীরের ‘দৌড়’ - মাঝেমাঝে ওয়াইল্ডলাইফ ডকুমেন্টারীতে দেখা যায়, সেই জিনিস দেখলে বোঝা যায় অসুবিধাটা কোথায়; সবসময় মাটিতে পায়ের ঠেকনা রেখে এগোতে হচ্ছে, শরীরকে উৎক্ষিপ্ত করা যাচ্ছে না। ছুটতে গেলে যেভাবে দুই পদক্ষেপের মাঝে খণ্ডমুহূর্তের জন্যে শূন্যে ভেসে থাকতে হয়, কুমীরের পক্ষে তা সম্ভব নয়। পেলিকোসরদের পক্ষেও ছিল না। তাই পেলিকোসরদের একটা শাখা তাদের পায়ের গঠন বদলে ফেলল। পাশের দিক থেকে সরে এসে তাদের পা বেরোল সরাসরি শরীরের তলার দিক থেকে। এরাই থেরাপসিড, পেলিকোসরদের তুলনায় আধুনিকতর সাইনাপসিড প্রাণী।

    পার্মিয়ানের শেষ অবধি এদের সুখের সময় চলেছিল, তারপরে ডাইনোসরদের যুগ এলো। ডাইনোসরের রাজত্বে এরা বামন হয়ে থেকে গেল, অট্টালিকাপ্রমাণ ডায়াপসিডদের ছায়ায় কোনোরকমে টিকে রইল। থেরাপসিডদের মাত্র দুটো শাখা এই দুঃসময়ে চালিয়ে নিতে পেরেছিল, - এক দল cycodont, আর এক দল dicycodont। ডাইসাইকোডন্টরা কিছুদিন থেকে তারপর বিদায় নিল। সাইকোডন্টরাও তার পরে খুব বেশীদিন থাকল না, ক্রীটাশিয়াসের শুরুর দিকেই সবাই প্রায় শেষ হয়ে এল; শুধুমাত্র একটা শাখা দাঁত কামড়ে রয়ে গেল রঙ্গমঞ্চে। তারা হারিয়ে গেল না, লোপ পেল না, বিলুপ্তি তাদের ভবিতব্য নয়; ক্রীটাশিয়াসের শেষে যখন ডাইনোসররা চলে যাবে, তখনও তারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। এরাই স্তন্যপায়ী। ডাইনোসরদের পরে পৃথিবীতে সবচেয়ে উঁচু জায়গা নেবে তারাই।

    এদিকে সবুজের দুনিয়ায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেছে। ডাঙায় ওঠার পর গাছেরা কাণ্ড আর পাতা আগেই অর্জন করেছিল, এবারে তাদের মধ্যে দেখা দিল সেই অপ্রতিম সৃষ্টি - বীজ।

    ডেভোনিয়ানের মাঝামাঝি সময়কার একরকম গাছের ফসিল পাওয়া যায়, তার নাম Runcaria। এটি বীজধারী গাছের এক প্রাচীন পূর্বপুরুষ। বীজের দেখা ভালোভাবে পাওয়া গেল এর কয়েক মিলিয়ন বছর পরে, কার্বনিফেরাস পর্যায়ের দ্বিতীয়ার্ধে।

    বীজের আবির্ভাব গাছপালার ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। ঠিক কেন, কীভাবে এ জিনিস তৈরী হয়েছিল, তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। বিরল এক জীনগত আপতনের ফলে সম্ভবত প্রথম বীজের সৃষ্টি হয়। ঠিক এইরকম জীনগত দৈবযোগ উদ্ভিদের ইতিহাসে আরো একবার এসেছিল এর পরে, - সেও আর এক আশ্চর্যের জন্মকাহিনী। কিন্তু আগে বীজ। যেসব গাছ বীজ পেল, তাদের জন্যে জীবন অনেক সহজ হয়ে গেল এক ধাক্কায়। প্রথমত, বীজ মানেই আবরক। শিশু উদ্ভিদ তার জীবনের প্রথম দশায় একেবারেই নিঃসম্বল অসহায়, ছোট্ট ভ্রূণ মাত্র। তার জন্যে বর্ম হয়ে দাঁড়াল বীজ। বাইরের রোদ হাওয়ায় আর ভ্রূণ নষ্ট হবার ভয় থাকল না। জলাভূমির ওপর নির্ভরতা কমল। আর বীজে আশ্রিত ভ্রূণ সহজেই গাছ থেকে পড়ে দূরে ছড়িয়ে যেতে পারে, শক্ত খোলা তাকে নিরাপত্তা দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, বীজ মানে এক দুর্ভেদ্য ক্যাপসুল, যার মধ্যে গাছের ভ্রূণ দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। একে ইংরেজীতে বলে dormant state, - এই সুপ্তির সময় জীবনচক্রের গতি স্থগিত থাকে। শিশু গাছের বাড় থেমে যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আবার খোলসের ভিতর প্রাণের ঘুম ভাঙে, বীজ ফাটিয়ে তা থেকে সবুজ অঙ্কুর মাথা তোলে।

    এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম - এই পাড়ির মাঝপথে এই যে বিরাম, এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের জীবনচর্যার সাথে গাছের জীবনের পার্থক্য অনেক, এই বিরতি তার এক অনন্য নজির। নবজাত গাছ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েই তার জীবন শুরু করে না। মায়ের শরীর থেকে পাওয়া সামান্য রসদ সম্বল করে, বীজের ভিতর সে গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকে - জীব থেকে জড়বৎ হয়ে যায়। এই অবস্থায় তার জল লাগে না, বাতাস লাগে না, উত্তাপ লাগে না। যতক্ষণ তার বর্ম অটুট থাকবে, যতদিন তার জীবনীশক্তি বজায় থাকবে, ততদিন সে বিনা সহায়ে প্রাণের সম্ভাবনা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। যেদিন উপযুক্ত সময় আসবে, যেদিন বীজ তার প্রয়োজনীয় জল, বাতাস, উষ্ণতা খুঁজে পাবে, সেদিন এই গাছের ঘুম ভাঙবে। তার আগে নয়। তার আগে অবধি সে স্থির, অচঞ্চল, পাথর।

    মরু অঞ্চলে একধরনের গাছ হয়, তাদের ডাকনাম tumbleweed। টাম্বলউইড কোনো প্রজাতিগত নাম নয়, বেশ কয়েক রকম গাছ এর মধ্যে পড়ে। সিনেমায় দেখা আমেরিকার "ওয়াইল্ড ওয়েস্ট" অঞ্চলে, যেখানে ধূ ধূ শুকনো পাথুরে উপত্যকায় নদীর জল বইতে বইতে শুকিয়ে যায়, ক্যাকটাস-প্রসূ বালির রাজ্যে শুধু র‍্যাট্‌লস্নেক আর শিংওয়ালা মরুভূমির গিরগিটিরা ঘুরে বেড়ায়, আর কোমরে-কার্তুজ হলস্টারে-পিস্তল নিয়ে বেপরোয়া কাউবয়রা ধূলো উড়িয়ে সূর্যাস্তের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়, - সেই দেশে এই গাছ দেখা যায়। শুধু আমেরিকা নয়, আফ্রিকা আর এশিয়ার মরুভূমিতেও এরা থাকে। ছোটো ঝোপড়ার মতো দেখতে, জল পেলে গাছে ঝাঁক ধরে ফুল আসে। তারপর একসময় সে ফুল শুকায়। গাছ শুকায়। সূর্যের কিরণে সারা শরীরের সব রসকষ শুষে যায়। শুকিয়ে গিয়ে গাছের সারা শরীরটা কুঁকড়ে গোল হয়ে আসে। মাটি থেকে শিকড় আলগা হয়ে যায়। শুধু একটি মাত্র জিনিস তার মৃত শরীরে প্রাণের অস্তিত্ব ধরে রাখে। তার শুকোনো ফুলের বিদায়ের দান। বীজ। এই বীজের ভার নিয়ে এবার টাম্বলউইড চলতে শুরু করে।

    বাতাসের ধাক্কায় গাছের শুকনো শরীরটা শিকড়ের জায়গা থেকে ছিট্‌কে পড়ে। ছিটকে পড়ে গড়াতে আরম্ভ করে। বাতাসের তোড়ে গড়াতে গড়াতে এগিয়ে যায়। মরুভূমিতে ধূলোর ঝড় ওঠে - সেই ঝড়ের জোরে মরা গাছ মাইলের পর মাইল বালি পেরিয়ে চলে। আর চলার সাথে সাথে সে ছড়িয়ে চলে তার বীজ। অথবা বিকল্প ব্যবস্থা। চলতে চলতে একসময় টাম্বলউইড এসে থামে কোনো ভেজা জায়গায়। যেখানে জল আছে। জীবনের মূল শর্তের জোগান আছে। এবার এই জল শুষে নিয়ে টাম্বলউইডের শুকনো শরীর ফেঁপে উঠে ফেটে যায়। বীজ ছড়িয়ে পড়ে তার ভেতর থেকে। মাটিতে পড়ে তারা নতুন গাছের জন্ম দেয়।

    এক প্রজন্মের অবসান এখানে পরবর্তী প্রজন্মের বাঁচার প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাম্বলউইডের শুকিয়ে যাওয়া নেহাত নির্লিপ্ত মৃত্যুবরণ নয়, তার ওই শরীরই হয়ে উঠবে তার সন্তানদের প্রথম বাহন। তা না হলে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পাবে না। আর এই ঝড়ঝাপটার সময়টুকু তাদের নিরাপদে রক্ষা করবে - বীজ।

    আমেরিকা আর কানাডার জঙ্গলে জ্যাক পাইন নামে একধরনের গাছ জন্মায়। নামেই বোঝা যায় - এরা জাতে পাইন। এদের ফল হয় না, হয় cone - বাংলায় 'মোচক'। পাইনের গায়ে আঠা জাতীয় একধরনের রস হয় - তাকে রজন বলে। জ্যাক পাইনের কোন-এর গায়ে এই রজনের আঠা শক্ত হয়ে জমে থাকে, বীজ ছড়ানোর পথ একেবারে বন্ধ। বছরের পর বছর জ্যাক পাইন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে - রজনের আবরণের ভিতর বীজ, তার মধ্যে ঘুমন্ত ভ্রূণ। অপেক্ষায় থাকে। জলের নয় - অপেক্ষায় থাকে আগুনের।

    বনে যখন দাবানল আসে, তখন জ্যাক পাইনের প্রতীক্ষার শেষ হয়। সে নিজে হয়তো আগুনে পুড়ে মরে। কিন্তু দাবানলের তাপে তার সন্তানরা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। ধূ ধূ আগুনে শক্ত রজনের আবরণ গলে যায়, বীজরা খোলা বাতাসে মুক্তি পায়। পূর্বজের দেহাবশেষের ওপর নতুন করে তাদের জীবনযাত্রা শুরু হয়।

    এই পুরো প্রতীক্ষার সময়টুকু মা গাছের পক্ষেও যেমন ধৈর্য্যের, সন্তান গাছের পক্ষেও তেমনই। মা গাছ তার ডালপালা, পাতা, শিকড় নিয়ে প্রাণের রসদ জুটিয়ে বেঁচে থাকে, বেড়েও চলে। কিন্তু ভ্রূণ গাছের সেরকম কোনো উপায় নেই; তাকে পুরো সময়টা জড়িমায় কাটাতে হয়। আর এটা তার পক্ষে করা সম্ভব হয় - বীজ আছে বলেই।

    নারকেলগাছের ফল কীভাবে ভাসতে ভাসতে সমুদ্র পেরিয়ে দেশে-দেশান্তরে পাড়ি দেয়, তা তো সবার জানা।

    বীজের সবচেয়ে বড় ভূমিকা এটাই। গাছকে একটা সুযোগ করে দেওয়া - তার সন্তান যাতে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত পরিবেশে জীবন আরম্ভ করতে পারে। একবার বড় গাছ ছোট গাছকে জন্ম দেয়, - আর তার পরে ছোট গাছ বীজের থেকে নিজে জন্ম নেয়। এক জীবনে দুই জন্ম। বৈজ্ঞানিক পরিভাষার কথা জানি না - তবে আমাদের বাংলা ভাষায় এর জন্যে একটা সংস্কৃত-থেকে-পাওয়া শব্দ আছে: "দ্বিজ"।

    গাছের মধ্যে এই দ্বিজত্বের বিকাশ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিনশো মিলিয়ন বছর আগে। কার্বনিফেরাস অরণ্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা ফার্ন আর শ্যাওলার পাশাপাশি যে সাইকাডের কথা বলেছিলাম, তারা এই জাতের গাছ ছিল। আর তার পরে এলো পাইনরা। এদের শিকড় আছে, কাণ্ড আছে, পাতা আছে, ডালপালা আছে, - আর আছে নতুন অভিযোজন বীজ। এতদিন নতুন গাছের জন্ম দিতে গেলে কোথায় ভেজা জায়গা পাওয়া যাবে সেই ভরসায় থাকতে হত। এবারে সেই চিন্তা নেই - বীজ ছড়িয়ে গেলেই হল, সুবিধামত অঙ্কুর বেরোবে না হয় পরে। আর বীজের মধ্যে তো শুধু ভ্রূণ নয় - সাথে খানিকটা পরিপোষক জিনিসও জমা থাকে - যেটাকে ভালো ভাষায় বলে endosperm। কাজেই প্রতিকূল জায়গা হলেও চারাগাছের প্রাথমিক খাবারের চাহিদাটা সেই থেকেই মিটে যায়। সব মিলিয়ে বীজধারী গাছদের বহুমুখীতা অনেক বেড়ে গেল, - পাহাড়পর্বতের গায়ে, যেসব জায়গা এতদিন শুকনো বলে খালি পড়ে ছিল - সেখানে পাইন-সাইকাডের বন গজিয়ে উঠতে লাগল। কার্বনিফেরাস রেইনফরেস্ট কোলাপ্সের ধাক্কা পেরিয়ে, পার্মিয়ানের সুদীর্ঘ ৪৭ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে আসন কায়েম করে নিল দলে দলে কনিফার, সাইকাড, গিঙ্কগো। লেপিডোডেনড্রন-সিজিলারিয়ার মতো লাইকোপডরা মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। এল এক বিশাল পরিবর্তনের পালা।

    ওদিকে পোকাদের মধ্যে আরশোলার দাপট কার্বনিফেরাস পর্যায়েও ছিল, পার্মিয়ানেও তা অব্যাহত থাকল। পার্মিয়ানের গোড়ায় কীটপতঙ্গের মধ্যে নব্বই ভাগই ছিল আরশোলা জাতের। ফড়িংদের মধ্যে Meganeuropsis permianaর ডানার মাপ ছিল ৭১ সেন্টিমিটার, আর মাথা থেকে লেজের ডগা অবধি লম্বায় ছিল প্রায় ৪৩ সেন্টিমিটার। এই পর্যায়ে নতুনদের মধ্যে এলো বীট্‌ল জাতের পোকারা (ভালো নাম Coleoptera), আর সিকাডা-অ্যাফিড-ছারপোকা জাতীয় পোকারা, যাদের ইংরিজীতে true bugs বলে (ভালো নাম Hemiptera)। - এই কোলিওপটেরা বা বীট্‌লরা প্রজাতির দিক থেকে সবার মধ্যে অ্যাবসোলিউট মেজরিটি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রাণীদের মধ্যে আন্দাজ পনেরো লক্ষ প্রজাতি আছে, তার মধ্যে ২৫ শতাংশই হল বীট্‌ল। এদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় চার লাখ। - এই বীট্‌লরা প্রথম দেখা দিয়েছিল পার্মিয়ান পর্যায়েই।

    আবার অন্য দিকে ছিল জলচর সরীসৃপের দল। উভচররা হাত-পা গজিয়ে ডাঙায় উঠে এসে অ্যামনিওট হল বটে, কিন্তু কেউ কেউ তা সত্ত্বেও জলের জীবনে ফিরে গেল। 'ফিরে গেল', না 'রয়ে গেল', - সে নিয়ে খানিকটা কুয়াশা আছে। এমন হতে পারে যে স্থলচর সরীসৃপরা কেউ কেউ অ্যাবাউট টার্ন করে জলে ফিরে গিয়েছিল; আবার এমনটাও হতে পারে যে এই ব্যতিক্রমীরা পুরোপুরি স্থলচর কখনোই হয় নি, - semi-terrestrial হয়েছিল মাত্র। ছোটোখাটো চেহারার এই সরীসৃপদের নাম দেওয়া হয়েছে Mesosaur, - 'মাঝারি টিকটিকি'। আন্দাজ ২৯৯ থেকে ২৭০ মিলিয়ন বছর আগেকার জীব এরা। সবচেয়ে পরিচিত মেসোসরের নাম Mesosaurus (লক্ষ্য করার বিষয়: Mesosaur আর Mesosaurus সমার্থক নয়। আগেরটা একটা গ্রুপের নাম। পরেরটা তার মধ্যেকার একটা নির্দিষ্ট জীনাস। 'সর' আর 'সরাস'-এর এই তফাৎটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।) মেসোসরাস মিটারখানেক বড় হত, উপকূলবর্তী অঞ্চলের সমুদ্রে থাকত। এর লেজের চেহারা অনেকটা ঈলমাছের লেজের কথা মনে পড়িয়ে দেয়; ওই লেজ নেড়ে এরা সাঁতার কাটত। আমরা যে পৃথিবীর বিবর্তন নিয়ে কথা বলছি, এই কাহিনীতে মেসোসরাসের একটা নাটকীয় ভূমিকা আছে, - আপাতত সে কথা তোলা রইল।

    মেসোসরদের মনে করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ের প্যারারেপটাইল। Parareptile, - মানে 'সরীসৃপের পাশেই'। প্রায়-রেপটাইল বলা যেতে পারে। অ্যামনিওটরা যে বিশাল দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল, তার মধ্যে একদিকে ছিল সাইনাপসিড, আর অন্য দিকে যারা ছিল তাদের নাম Sauropsid - 'গিরগিটিমুখো'। সরপসিডদের মধ্যে আবার দুই ভাগ - একদিকে আমাদের 'আসল' সরীসৃপরা - ডাইনোসর থেকে শুরু করে পাখি সাপ টিকটিকি কুমীর সবাই, - আর অন্যদিকে এই প্রায়-সরীসৃপের দল। আসলে 'অ্যানাপসিড' বলে যে ভাগের কথা আমরা শুনি, তা আধুনিক নিয়মে চলে না, ধীরে ধীরে সেটা বাতিল হতে বসেছে। সেই জায়গায় যে সঠিকতর শ্রেণীবিভাগ করা হচ্ছে আজকাল, - তাতে এই Parareptilia ভাগটা রাখা হয়েছে। অ্যানাপসিডদের মধ্যে আমরা কচ্ছপ আর কাছিমদের ফেলেছি বটে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, - ওরা আসলে ডায়াপসিড, চেহারা অনেকটা বদলে গিয়েছে বলে চেনা যায় না। যদিও এখনো এই বিষয়ে সবাই সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন, তবুও, 'অ্যানাপসিড' ছেড়ে এবার থেকে আমরা 'প্যারারেপটাইল'ই বলব।

    প্যারারেপটাইলদের মধ্যে প্যারিয়াসর বলে একধরনের সরীসৃপ হত, পার্মিয়ানের মাঠে বনে এদের দেখতে পাওয়া যেত। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, ছোটো লেজ, ছড়ানো থাবা। আহার নিরামিষ। প্যারিয়াসরদের গায়ে বর্মের মতো মজবুত চামড়া থাকত। কুমীরের গায়ে বা কচ্ছপের খোলায় যে শক্ত, বর্মের মতো আচ্ছাদন থাকে, তাকে বলে scute। পাখিদের পায়েও এই জিনিসই থাকে - ঠিক চামড়া নয়, যেন শুকনো আবরণীর মতো অনেকটা, আঁশেরই আরেক সংস্করণ। প্যারিয়াসরদের গায়েও এমনি স্কুট হত। কোনো কোনো জীবাশ্মবিদ এমনও মনে করেন যে এদের থেকেই কচ্ছপদের উৎপত্তি।

    একজাতের প্যারিয়াসর হত, তাদের নাম ছিল Scutosaurus। বোঝাই যায়, শরীরের বর্মের জন্যেই এই নাম। আকারে এরা বেশ বড় হত, প্রায় দশ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, মোটাসোটা ভারী গড়ন। প্রচুর পরিমাণে গাছপাতা খেয়ে এদের পেট ভরাতে হত। সাধারণত মাঠে ঘাটে, নদীর ধারে এদের চরতে দেখা যেত। পার্মিয়ানের ভূখণ্ড তখন সুপারকন্টিনেন্ট প্যানজিয়ার রূপ নিয়েছে, জলবায়ু তখন শুকনো, ঘন অরণ্য কম। ভারী চেহারার স্কুটোসরাসরা ছোটো ছোটো দলে খোলা উপত্যকায় ঘুরে বেড়াত, আর তাদের ওপর হামলা চালাত হিংস্র ছোরাদেঁতো থেরাপসিড শিকারী - ইনোসট্রানসিভিয়া।

    নামটা শুনতে কঠিন। এই জাতের থেরাপসিডদের একসাথে বলা হয় 'গর্গন-মুখী' - Gorgonopsids,- গ্রীক পুরাণে যে ভয়ঙ্কর গর্গন রাক্ষসীদের কথা আছে, তাদের নামে। এই গর্গন শব্দটা কিন্তু আমাদের ঘরের শব্দ - সংস্কৃত 'গর্জন' আর গ্রীক 'গর্গন' - এদের মূল একই। মোট মিলিয়ে গর্গনপসিডরা যে রীতিমতো হিংস্র জানোয়ার ছিল, তা বেশ বোঝা যায়। আর এই গর্গনপসিডদের মধ্যে বৃহত্তম প্রজাতি ছিল Inostrancevia। রাশান ভূবিজ্ঞানী আলেক্সাণ্ডার ইনোসট্রান্টসেভের নামে নাম। এ নিজে প্রায় সাড়ে এগারো ফুট লম্বা হত, ছোরার মতো দাঁতওয়ালা মাথাটাই হত ফুট দুয়েক। ওজন ছিল প্রায় হাজার পাউন্ড। আর ওই যে দাঁত - ওপরের পাটির ছোরামার্কা দু'খানা canine লম্বায় একেকটা হত পনেরো সেন্টিমিটার। স্কুটোসরাসের বর্ম ভেদ করার জন্য জুতসই অস্ত্র চাই তো। খাদ্য খাদক, শিকার ও শিকারী - সবে মিলে জমে গেল পার্মিয়ান ইকোসিস্টেম।

    এই পর্যন্ত এসে, কেমন যেন অনিবার্যভাবেই, একটা গানের কথা মনে পড়ে।

    "আজও যদি তুমি
    কোনো গাঁয়ে দেখো
    ভাঙা কুটিরের সারি...
    জেনো সেইখানে - সে গাঁয়ের বধূর আশা-স্বপনের সমাধি।"

    হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "গাঁয়ের বধূ"। অবসানের গান। মরণের ছোঁয়া লেগে ভরন্ত জীবন ছাই হয়ে শেষ হয়ে যাবার গান।

    নতুন বীজের গাছ, নতুন গড়নের থেরাপসিড, নতুন জাতের কীটপতঙ্গ, - কিশোর পৃথিবীকে ঘিরে চতুর্দিকে প্রাণের তরঙ্গ। সব মিলিয়ে ভালোই ছিল সবকিছু। তার পর এলো দহনবেলা। আজ থেকে আড়াইশো মিলিয়ন বছর আগে, জীবজন্তুগাছপালায় ভরা জমজমাট পার্মিয়ানে ঘটল সেই পৃথিবী-শ্মশান-করা মহাপ্রলয়: the Great Permian Extinction।

    (চলছে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    (১, ২) | (৩) | পর্ব ৪ | পর্ব ৫
  • ধারাবাহিক | ১৬ নভেম্বর ২০২০ | ২৫৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.***.*** | ১৬ নভেম্বর ২০২০ ২২:১০100304
  • অনেকদিন পর। ধন্যবাদ  ক্যাপটেন! 

  • syandi | 2a01:c22:cc6c:8f00:5154:20bf:9f13:***:*** | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০১:৫৩100328
  • বিবর্তন নিয়ে বাংলায় এত রিচ লেখা সাম্প্রতিককালে মুক্তমনা ছাড়া কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ে না। জানি না এখানে এই ধরণের অনুরোধ করা উচিত হবে কিনা, তবে লেখক কি লেখাটার সব পর্বগুলো মুক্তমনাতে দিতে পারেন? মুক্তমনাতে বিবর্তনের উপরে একটা ডিভোটেড আরকাইভ আছে যেগুলোর বেশিরভাগই বন্যাদির লেখা।

  • Amit | 121.2.***.*** | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৪৮100335
  • অসাধারণ লেখা। সত্যি বিবর্তনের মতো  এতো  জটিল বিষয় নিয়ে বাংলায় এরকম সুন্দর লেখা আগে পড়িনি. শুধু তথ্য ই না , লেখার ধরণটাও এতো সুন্দর যে শুরু করে গোগ্রাসে শেষ করে ফেললাম। 

  • লেখাটা একটা রত্ন | 151.14.***.*** | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০৭:১০100342
  • এই লেখাটা একটা রত্ন। এত ভালো লেখা ক্বচিৎ কদাচিৎ পড়তে পাই।

  • Ranjan Roy | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ১২:৩২100368
  • একদম। 

  • | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৫৮100376
  • আরে ওয়েলকামব্যাক! 

  • ক্যাপ্টেন হ্যাডক | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ১৯:৪৮100379
  •  আসলে লেখাটা অনেকদিন আগের। 


    আমার কোথাওই এই লেখা পোস্ট করতে আপত্তি নেই, আমার নিজের ব্যক্তিগত ব্লগেও এটা খোলাই পড়ে আছে। তবে লেখাটা সম্ভবত অসম্পূর্ণতেই শেষ হবে। পাঁচ নম্বর পর্ব অবধি হয়েছে, আর তারপর চেষ্টা সত্ত্বেও এগোয়নি। সবই এক্সটিংশন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন