এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বিদেশি কবিতার অনুবাদ

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ০৮ জুন ২০১৯ | ১৭০৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ernesto Cardenal | ***:*** | ২৯ জুন ২০১৯ ১০:২৮383611
  • আরনেস্তো কারদেনাল-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা"
    প্রভু :
    পৃথিবীতে মারিলিন মনরো নামে পরিচিত এই বালিকাটিকে গ্রহণ করুন
    যদিও তা ওর প্রকৃত নাম নয়
    ( কিন্তু আপনি মেয়েটির প্রকৃত নাম জানেন : অনাথ মেয়ে ৯ বছর বয়সে ধর্ষিত
    দোকানের কর্মচারী মেয়ে যে ১৬ বছর বয়সে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল )
    যে এখন আপনার সামনে নিজেকে তুলে ধরছে কোনো সাজগোজ না করে
    কোনো কাগজের দালাল সঙ্গে নেই
    কোনো ফোটোগ্রাফার নেই অটোগ্রাফ সইয়ের ব্যাপার নেই,
    নভোচরের মতন একা রাত্রির মুখোমুখি যার নাম মহাকাশ ।
    বালিকা হিসাবে, মেয়েটি গির্জায় নগ্ন থাকার স্বপ্ন দেখেছিল ( টাইম ম্যাগাজিন যেমন বলে )
    সাষ্টাঙ্গ জনগণের সামনে, মেঝেতে মাথা পেতে,
    আর ওকে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল যাতে তাদের মাথায় না পা রাখতে হয়।
    মনোবিদদের চেয়ে ভালো আপনি এই স্বপ্নগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন ।
    গির্জা, বাসা, গুহা হলো মায়ের বুকের মতন সুরক্ষিত
    কিন্তু তার চেয়েও বেশি…
    মাথাগুলো মেয়েটির ভক্ত, তা পরিষ্কার
    ( আলোর এক স্রোতের তলায় অন্ধকারে মাথার জমঘট )।
    কিন্তু মন্দিরটা তো টোয়ান্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স স্টুডিও নয় ।
    মন্দির -- শ্বেতপাথর আর সোনায় -- মেয়েটির দেহের মন্দির
    যেখানে মানবপুত্র, চাবুক হাতে,
    টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স ব্যাবসাদারদের তাড়ায় ।
    যারা আপনার প্রার্থনার বাড়িকে চোরেদের গুহায় বদলে দিয়েছে।

    প্রভু :
    এই জগত কি পাপ আর বিকিরণে দূষিত,
    আপনি দোকানের কর্মচারী মেয়েটিকে কেবল দোষ দিতে পারেন না
    যে, আর সমস্ত দোকানের কর্মচারী মেয়েদের মতন, তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল।
    আর ওর স্বপ্ন ছিল বাস্তব ( কিন্তু যেমন টেকনিকালারও বাস্তব )।
    মেয়েটি কেবল আমাদের দেয়া স্ক্রিপ্ট অভিনয় করেছিল,
    যা আমাদের নিজেদের জীবন, এক অদ্ভুত স্ক্রিপ্ট ।
    মেয়েটিকে ক্ষমা করুন, প্রভু, আর আমাদের ক্ষমা করুন
    আমাদের বিশ শতকের জন্য
    বিশাল অতি-উৎপাদনের জন্য যাতে আমরা সবাই খেটেছি।
    মেয়েটি ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল আর আমরা দিয়েছি ঘুমের ওষুধ।
    যে দুঃখের জন্য আমরা কেউই পবিত্র নই
    মেয়েটিকে মনোবিদ দেখাবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
    মনে করুন প্রভু ক্যামেরা সম্পর্কে মেয়েটির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আতঙ্ক
    সাজগোজকে ঘৃণা, প্রতিটি দৃশ্যের জন্য তাকে নতুন করে তোলার জন্য দাবি
    আর কেমন করে আতঙ্ক বেড়ে যেতে লাগলো
    আর স্টুডিওতে অনেক দেরিতে পৌঁছোনো ।
    দোকানের কর্মচারী মেয়েদেরর মতন
    মেয়েটি তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ।
    আর মেয়েতির জীবন ছিল অবাস্তব, স্বপ্ন যা মনোবিদ ব্যাখ্যা করে আর নথি করে রাখে।
    মেয়েটির রোমান্স ছিল দুই চোখ বন্ধ করে চুমু খাওয়া
    কিন্তু তারপর চোখ খুলে যায়
    আর আবিষ্কার করে প্রচুর আলো ওর দিকে মুখ করা
    তারপর আলোগুলো অন্ধকার হয়ে যায় !
    আর লোকেরা ঘরের দুটো দেয়াল ভেঙে ফ্যালে ( তা ছিল ফিল্মের সেট )
    পরিচালক নিজের নোটবই নিয়ে চলে যান
    কেননা দৃশ্যটা তোলা হয়ে গেছে ।
    কিংবা প্রমোদভ্রমণের পোতে, সিঙ্গাপুরে একটা চুমু, রিওতে নাচ
    উইন্ডসর প্রাসাদে ডিউক ও ডাচেসের অভ্যর্থনা
    এক মর্মন্তুদ ফ্ল্যাটের ছোটো বৈঠকখানায় দেখা ।
    শেষ চুমু ছাড়াই ফিল্মটি শেষ হয় ।
    ওরা মেয়েটিকে তার বিচানায় মৃত পেলো, হাতে ফোন ।
    আর গোয়েন্দারা জানতে পারেনি কাকে মেয়েটি ডাকছিল ।
    তা ছিল
    সেইরকম যে বন্ধু কন্ঠস্বরকে চেনে তাকে ফোন করতে চাইছিল
    কেবল রেকর্ড করা কন্ঠস্বর শোনার জন্য যা বলবে : রং নাম্বার
    কিংবা কারোর মতন, যে, ডাকাতদের দ্বারা ঘায়েল
    তার ছেঁড়া ফোনের দিকে হাত বাড়ায় ।
    প্রভু :
    কাকে ডাকার চেষ্টা মেয়েটি করেছিল তাতে কিছুই আসে-যায় না
    কিন্তু পারেনি ( আর হবতো তা কেউ ছিল না
    কিংবা কেউ যার নাম্বার লস অ্যাঞ্জেলেস ফোনের বইতে নেই ।

    আপনিই ফোনের জবাব দিন !

    "দক্ষিণের সমুদ্র"
    রাফায়েল হেলিওদোরো ভালে-র জন্য
    তেইশে মার্চ আমি আকাপুলকো বন্দর থেকে যাত্রা করেছিলুম
    আর শনিবার পর্যন্ত যাত্রাপথ নিয়ত রেখেছিলুম, চৌঠা এপ্রিল, যখন
    ভোর হবার আধ ঘণ্টা আগে, আমরা চাঁদের আলোব দেখলুম
    পাশাপাশি একটা জাহাজ এসেছে
    যার পাল আর সামনে দিক রুপোর তৈরি ।
    আমাদের কাণ্ডারী ওদের দিকে চেঁচিয়ে বলল দূরে থাকতে
    কিন্তু কেউই উত্তর দিল না, যেন ওরা সবাই ঘুমোচ্ছিল ।
    আবার আমরা হাঁক পাড়লুম : “কোথা থেকে তোদের জাহাজ আসছে ?”
    আর ওরা বলল : পেরু !
    তারপর আমরা ভেরীধ্বনি শুনলুম, আর বন্দুক চালাবার শব্দ,
    আর ওরা আমাকে নির্দেশ দিলো ওদের জাহাজে যেতে
    যেখানে ওদের ক্যাপ্টেন ছিল সেখানে ।
    আমি দেখলুম উনি ডেকে পায়চারি করছেন,
    ওনার কাছে গিয়ে, হাতে চুমু খেলুম আর উনি জিগ্যেস করলেন:
    “ওই জাহাজে কতো রুপো আর সোনা আছে ?”
    আমি বললুম, “কিছুই নেই,
    কিচুই নেই, স্যার, কেবল আমার ডিশগুলো আর পেয়ালাগুলো।”
    তখন উনি জিগ্যেস করলেন আমি ভাইসরয়কে চিনি কিনা ।
    আমি বললুম, চিনি । আর ক্যাপ্টেনকে জিগ্যেস করলুম,
    “উনি কি ক্যাপ্টেন ড্রেক নিজেই অন্য কেউ নন তো ?”
    ক্যাপ্টেন জবাবে বললেন
    “উনিই ক্যাপ্টেন ড্রেক যার বিষয়ে আমি বলছি।”
    আমার অনেকক্ষণ কথা বললুম, রাতের ভোজনের সময় পর্যন্ত,
    আর উনি নির্দেশ দিলেন আমি যেন ওনার পাশে বসি।
    ওনার থালাগুলো রুপোর আর তারা কিনারায় সোনা
    তাতে ওনার চিহ্ণ ।
    স্ফটিকের শিশিতে ওনার রয়েছে বহু গন্ধদ্রব্য আর সুগন্ধী জল
    যা, উনি বললেন, রানি ওনাকে দিয়েছেন ।
    উনি সন্ধ্যা আর রাত্রির ভোজন সর্বদা বেহালার সঙ্গীতের সাথে সম্পন্ন করেন
    আর নিজের সঙ্গে সর্বত্র চিত্রকরদের নিয়ে যান যাঁরা আঁকতে থাকেন
    তাঁর জন্য সমুদ্রতীরগুলো ।
    উনি চব্বিশ বছর বয়সী, ছোটোখাটো, লাল দাড়ি ।
    উনি হুয়ান অ্যাকুইনা, বিখ্যাত জলদস্যুর ভাগ্নে ।
    আর উনি সমুদ্রের ওপরে যতো খ্যাতনামা নাবিক আছেন তার অন্যতম ।
    পরের দিন, যা ছিল রবিবার, উনি অসাধারণ পোশাকে নিজেকে সুসজ্জিত করলেন
    আর ওদের দিয়ে পতাকা উত্তোলন করালেন
    মাস্তুলের মাথায় ডুবুরি রঙের ছোটো পতাকা উড়িয়ে,
    পেতলের আংটি, আর শেকল আর রেলিঙ আর
    আলকাজারের আলো সোনার মতন জ্বলজ্বল করছিল ।
    ওনার জাহাজ ছিল যেন শুশুকদের মাঝে সোনার ড্র্যাগন ।
    আর উনি চলে এলেন, ওনার কাগজ নিয়ে, আমার অর্থ-ভাঁড়ার দেখতে ।
    রাত্রির আগে পর্যন্ত সারা দিন আমার কি আছে তা দেখলেন
    আমার থেকে যা নিলেন তা বিশেষ কিছু নয়,
    আমার নিজের কিছু ছোটোখাটো জিনিস,
    আর আমাকে দিলেন একটা ছোরা আর ওদের জন্য একটা রুপোর হাতল
    আমায় অনুরোধ করলেন ওনাকে ক্ষমা করে দিতে
    কেননা ওগুলো উনি ওনার মহিলার জন্য নিয়েছিলেন :
    উনি আমাকে যেতে দেবেন, উনি বললেন, পরের দিন সকালে, বাতাস আরম্ভ হতেই ;
    তার জন্য আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানালুম, আর ওনার হাতে চুমু খেলুম।
    উনি নিয়ে যাচ্ছেন, ওনার জাহাজে, তিন হাজার রুপোর বাট
    তিনটে ভাঁড়ার সোনায় ভরা
    বারোটা ভাঁড়ার আটটা করে ভাগ করা :
    আর উনি বললেন উনি চীনের উদ্দেশে যাত্রা করছেন
    সামুদ্রিক মানচিত্র অনুসরণ করে একজন চীনা চালকের পরিচালনায় যাকে উনি বন্দী করেছেন…

    "নীল উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্য"
    এক গোল ছোটো জানালায়, সবই নীল,
    জমি নীলাভ, নীল-সবুজ, নীল
    ( আর আকাশ )
    সবই নীল
    নীল ঝিল আর জলাশয়
    নীল আগ্নেয়গিরি
    অনেক দূরের জমিগুলো আরও নীল দেখায়
    নীল দ্বীপ নীল ঝিলের মাঝে ।
    এটা মুক্ত করা দেশের মুখ।
    আর যেখানে সব জনগণ যুদ্ধ করেছিল, আমার মনে হয় :
    ভালোবাসার জন্য !
    শোষণের ঘৃণা ছাড়া
    বাঁচবার জন্য ।
    এক সুন্দর দেশে একে আরেককে ভালোবাসার জন্য
    এতো সুন্দর, কেবল নিজেই নয়
    কিন্তু তার অধিবাসীদের জন্য,
    সবার ওপরে তার অধিবাসীদের জন্য ।
    ঈশ্বর সেই জন্যে এই সুন্দর দেশ আমাদের দিয়েছেন
    তার অন্তর্গত সমাজের জন্য ।
    আর যে নীল জায়গাগুলোয় তারা লড়েছিল, যন্ত্রণা ভোগ করেছিল
    এক ভালোবাসার সমাজের জন্য
    এখানে এই দেশে ।

    একটা নীল টুকরো অনেক বেশি গাঢ় দেখায়…
    আর আমি ভাবলুম আমি সেখানে সব কয়টা লড়াইয়ের জায়গা দেখতে পাচ্ছি,
    আর সমস্ত মৃত্যুর,
    ওই ছোটো গোল জানালার কাচের পেছনে
    নীল
    যতো রকমের নীল হয় ।
  • Osip Mandelstam | ***:*** | ২৯ জুন ২০১৯ ১৯:৪৩383612
  • ওসিপ ম্যানডেলস্টাম-এর কবিতা ( ১৮৯১ - ১৯৩৮ )
    ( স্তালিন এনাকে জেলে পুরেছিলেন )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    'কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে'
    কেবল বাচ্চাদের বই পড়তে হবে,
    কেবল শিশুদের জিনিস ভালোবাসতে হবে,
    বড়োদের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে
    দুঃখি চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার পর ।
    জীবন নিয়ে আমি অবসাদে মরে যাচ্ছি
    এতে এমন কিছু নেই যা আমি চাই,
    আর কোনো সুললিত জগত নেই ।
    কাঠের এক মামুলি দোলনা ;
    অন্ধকার, উঁচু দেবদারু গাছের,
    অনেক দূরের বাগানে, দুলছে ;
    যা মনে রেখেছে জ্বরে আক্রান্ত রক্ত ।

    'ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে'
    ফিকে নীল কলাই-করার ওপরে,
    যা এপ্রিল মাস আনতে পারে,
    ভূর্য্য-শাখার অদৃশ্য
    দুলুনি, সন্ধ্যার দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে ।
    সূক্ষ্ম খোদাই করা রেখার জালে,
    রয়েছে নকশার সম্পূর্ণ স্হিতি,
    মনোযোগ দিয়ে আঁকা অভিলাষ,
    যেমন ওই চীনামাটির থালায়,
    চিন্তাশীল শিল্পী বসিয়েছেন,
    মাতাল মহাকাশে,
    বিষণ্ণ মৃত্যুর কাছে যা স্মৃতিহীন,
    শক্তির ক্ষণস্হায়ীত্ব জেনে নিয়ে।

    'এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে'
    এই শরীর নিয়ে কী করব যা ওরা আমাকে দিয়েছে,
    আমার নিজস্ব কতোটা, আমার সঙ্গে এতো অন্তরঙ্গ ?
    বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিময় শ্বাসের আনন্দের জন্য,
    আমাকে বলো, কাকে আমি আশীর্বাদ দেবো ?
    আমিই ফুল, আর তারই সঙ্গে আমিই মালি,
    আর আমি একা নই, পৃথিবীর এই কারাগারে।
    আমার জীবন্ত উষ্ণতা, নিঃশ্বাসে, তুমি দেখতে পাচ্ছ,
    অনন্তকালের স্বচ্ছ কাচে ।
    এক নকশা আঁকা হয়েছে,
    এখনও পর্যন্ত, অজানা ।
    প্রমাণ না রেখে শ্বাস বাষ্পীভূত হয়
    কিন্তু আঙ্গিককে কেই ভাঙচুর করতে পারে না ।

    'এক নির্বাক বিষণ্ণতা'
    এক নির্বাক বিষণ্ণতা
    দুটি বড়ো-বড়ো চোখ মেলে ধরল ।
    জেগে উঠল ফুলের ফুলদানি :
    স্ফটিকের বিস্ময় ছিটিয়ে ।
    সমস্ত ঘর ভরে উঠল
    স্নিগ্ধতায় -- মিষ্টি মিশ্রণে !
    অমন ক্ষুদ্র এক রাজ্য
    ঘুমের সমুদ্র পান করে নেয় ।
    মদের ফিকে রক্তবর্ণ,
    মে মাসের ফিকে রোদ--
    আঙুলগুলো, অনুদেহী, আর শাদা,
    ভাঙছে বিস্কুটের টুকরোগুলো ।

    'শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই'
    শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই :
    কোনও কিছু শোনা চলবে না ।
    কতো দুঃখজনক, আর সুন্দর
    এক পশুর অন্ধকার মন ।
    শোনা যায় এমনকিছু সে করবে না :
    তার কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই,
    এক যুবক শুশুক, লাফায়, ঘুমোয়,
    জগতের ধূসর গভীরতায় ।

    'নৈঃশব্দ্য'
    মেয়েটি এখনও জন্মায়নি :
    মেয়েটি সঙ্গীত আর শব্দ,
    আর তাই অ-ছিন্ন,
    যা ঘাঁটানো হয় তার বুনন ।
    নিঃশব্দ সমুদ্র শ্বাস নেয় ।
    দিনের ঔজ্বল্য উন্মাদ ঘুরে বেড়ায়।
    রুগ্ন বেগুনিফুলের সুগন্ধ ফেননিভ হয়,
    ধূসর-নীল পাতার বাটিতে ।
    আমার ঠোঁট মহড়া দিক
    আদিম নৈঃশব্দ্যের,
    স্ফটিকস্বচ্ছ সঙ্গীতস্বরের মতন
    এমন শব্দ যা জন্ম থেকেই পবিত্র !
    ফেননিভ আফ্রোদিতির মতন হও -- শিল্প --
    আর ফিরে এসো, শব্দ, যেখানে সঙ্গীতের আরম্ভ :
    আর জীবনের উৎসের সঙ্গে মিশে যাও,
    হে হৃদয় লজ্জা পাও, হৃদয় হবার কারণে !

    'ঝিনুক'
    রাত, হয়তো তুমি চাও না
    আমাকে । পৃথিবীর ধরাছোঁয়া থেকে,
    মুক্তোর বীজহীন এক ঝিনুক,
    আমাকে তোমার তীরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ।
    তুমি ঘুরে বেড়াও বিভিন্ন সমুদ্রে,
    আর সব সময়ে গান গাও,
    কিন্তু তবু তুমি আনন্দিত হও
    অনাবশ্যক জিনিসের মাঝে ।
    তুমি কাছেই সমুদ্রতীরে পড়ে থাকো,
    তোমার আঙরাখায় জড়ানো,
    আর ঢেউদ্রের বিশাল ঘণ্টাধ্বনির গর্জন
    তুমি ঝিনুকে বেঁধে রাখো ।
    তোমার কলতানময় ফেনা চুমু খাবে
    ঝিনুকের ভঙ্গুর দেয়ালকে
    বাতাস আর বৃষ্টি আর কুয়াশা দিয়ে,
    সেই হৃদয়ের মতন যেখানে কিছুই বাস করে না ।

    'কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর-সম্বন্ধীয় কবিতায়'
    কালো-হলুদ পাখিরা বনে থাকে আর থাকে স্বর সম্বন্ধীয় কবিতায়
    স্বরবর্ণের ব্যাপ্তি কেবল একমাত্র পরিমাপ ।
    বছরে একবার প্রকৃতি অতিরেকে আকর্ষিত হয়,
    আর বইতে থাকে প্রাচুর্য, হোমারের ছন্দমাত্রার মতো ।
    আজ হাই তোলে, যতির নিলম্বনের মতো :
    ভোর থেকে স্তব্ধতা, আর কষ্টকর সময়হীনতা :
    চাষের ক্ষেতে বলদ, আর সোনালি আলসেমি ;
    খাগড়াবন থেকে, সম্পূর্ণ স্বরের বৈভব আনার জন্য ।

    'প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত'
    প্রকৃতি হলো রোম, আর সেখানেই প্রতিবিম্বিত ।
    আমরা তার জাঁকজমক দেখি, নাগরিকদের প্রদর্শনী :
    স্বচ্ছ বাতাসের এক আকাশ-নীল সার্কাস,
    গড়ে তোলে বিচরমেলা, গাছের স্তম্ভশ্রেনি ।
    প্রকৃতি হলো রোম, তাই,
    মনে হয় এখন প্রার্থনা করা উদ্দেশ্যহীন :
    পড়ে আছে বলিদানের অন্ত্র, যুদ্ধের ভবিষ্যবাণী করার জন্য ;
    ক্রীতদাস, মুখ বন্ধ রাখার জন্য ; পাথর, বেছাবার জন্য !

    'নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।'
    নিদ্রাহীনতা । হোমার । আঁট করে বাঁধা ক্যানভাস ।
    জাহাজের পুস্তিকার অর্ধেক আমার :
    সারসদের ওই উড়াল, দীর্ঘ সারি,
    যা এক সময়ে এগিয়েছিল, হেলাস থেকে ।
    এক বিদেশি দেশের উদ্দেশ্যে, সংঘবদ্ধ সারসদের মতন--
    রাজাদের মাথার ওপরে ফেনিল দেবতারা--
    কোথায় নিয়ে যাচ্ছ জাহাজ ? ট্রয়ের জিনিসগুলো
    তোমাদের কোন কাজে লাগবে, একিয়ানগণ, হেলেনকে ছাড়া ?
    সমুদ্র, অথবা হোমার -- সকলে ভালোবাসার দীপ্তিতে মোহিত ।
    আমি কোনটা শুনবো ? এখন তো হোমার নির্বাক,
    আর কৃষ্ণসাগর তার বাগ্মীতায় গর্জাচ্ছে, করাল,
    আর, ফুঁসছে, গর্জাচ্ছে আমার বালিশকে আক্রমণ করছে ।

    'ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে'
    ঘোড়ার পাল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করছে আর চরছে
    এই উপত্যকা বদলে যাবে, রোমের মতন, কলঙ্কে।
    সময়ের স্বচ্ছ ধারা ধুয়ে দ্যায়
    এক ধ্রুপদি বসন্তের শুকনো ঝলমলে ধুলো ।
    হেমন্তের নিঃসঙ্গ অবসানে,
    ওক পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে, আমার পথ চলে যায়,
    সিজারের বিশুদ্ধ চেহারা মনে রেখে,
    মেয়েলি আদল, ধূর্ত বেঁকা নাক ।
    জুপিটারের মন্দির আর বিচারালয়, বেশ দূরে: প্রকৃতির পতন।
    এখানে জগতের কিনারায় আমি শুনতে পাই
    অগাস্টাসের যুগ, অক্ষিগোলকের মতন তার বল
    গড়াচ্ছে, রাজকীয়ভাবে, পার্থিব এক বলয় ।
    যখন বুড়ো হবে, আমার উন্মাদনাকে উজ্বল হতে দিও ।
    রোম আমাকে জন্ম দিয়েছে : সে ফিরবে।
    হেমন্তকাল, আমার মেয়ে-নেকড়ে, দয়া করে :
    আমাকে, আগস্ট -- সিজারদের মাস -- পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।

    'স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড়'
    স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় এখানে
    যেখানে আমরা অধোলোকের দেবীর দ্বারা শাসিত ।
    আমরা মৃত্যুর বাতাস পান করি, বাতাসের প্রতিটি গোঙানির শ্বাস,
    আর প্রতিটি ঘণ্টা আমাদের মৃত্যু-ঘণ্টার জল্লাদের ।
    সমুদ্রের দেবী, বজ্রময়ী এথেনা,
    তোমার পাথরের বিশাল কচ্ছপখোল সরাও ।
    স্বচ্ছ সাম্রাজ্যিক শহরে আমরা রেখে যাবো শুধু হাড় :
    এখানে অধোলোকের দেবী আমাদের জারিনা ।

    'ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক'
    ভাইরা, স্বাধীনতার গোধুলীকে গৌরবান্বিত করা যাক--
    সেই মহান, অন্ধকার করে তোলা বছর ।
    রাতের ফুটন্ত গরম জলে
    জালের ভারি জঙ্গলগুলো নিশ্চিহ্ণ হয় ।
    হে সূর্য, বিচারক, জনগণ, তোমাদের আলো
    জেগে উঠছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বছরগুলোয়
    মারাত্মক চাপগুলোকে গৌরবান্বিত করা যাক
    জনগণের নেতা যাকে কেঁদে গুরুত্ব দেন ।
    ভাগ্যের অন্ধকার বোঝাকে গৌরবান্বিত করা যাক,
    ক্ষমতার অসহ্য জোয়ালের ভয়কে গৌরবান্বিত করা যাক।
    তোমার জাহাজ কেমন তলিয়ে যাচ্ছে, সরাসরি ।

    'এই রাত অনপনেয়'
    এই রাত অনপনেয় ।
    যেখানে তুমি আছো, তা এখনও উজ্বল ।
    জেরুজালেমের দরোজায়
    এক কালো সূর্য আলোকময় ।
    হলুদ সূর্য অসহ্য,
    ঘুমোও, খুকি, ঘুমোও ।
    মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
    আমার মাকে গভীরে কবর দিয়েছে ।
    কোনো যাজক ছাড়াই, আশীর্বাদহীন,
    তাঁর চিতাভস্মের ওপরে, ওপখানে
    মন্দিরের আগুনে ইহুদিরা
    প্রার্থনার মন্ত্রোচ্চারণ করেছিল।
    এই মায়ের শরীরে
    ইজরায়েলের কন্ঠস্বর গেয়েছিল।
    আমি জেগে উঠেছিলুম ঝলমলে দোলনায়,
    কালো সূর্যের আলোয় ।
    তখন বৃষ তার খোঁয়াড়ে অলস জাবর চেবাচ্ছিল ।

    'মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে'
    মানুষের মাথার মর্যাদাক্রম অবক্ষয়িত : তারা বহু দূরে ।
    আমি সেখানে লুপ্ত হই, আরেকটি বিস্মৃতজন ।
    কিন্তু ভালোবাসার শব্দাবলীতে, শিশুদের খেলায়,
    আমি আবার উদয় হবো, বলার জন্য -- সূর্য !

    'আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা'
    আমার রক্তে রয়েছে এক শিখা
    পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার শুকনো জীবন, হাড় পর্যন্ত ।
    আমি পাথরের গান গাই না
    আর, আমি গাই বনানীর ।
    তা হালকা আর কর্কশ :
    একটিমাত্র মাস্তুলে গড়া,
    ওক গাছের গভীর হৃদয়,
    আর মাঝির লগি ।
    তাদের গভীরে নিয়ে যাও, খুঁটিগুলো
    হাতুড়ি মেরে শক্ত করো,
    কাঠের স্বর্গোদ্যান ঘিরে
    যেখানে সবকিছুই হালকা ।
  • Margaret Randall | ***:*** | ০১ জুলাই ২০১৯ ১০:৩৪383613
  • মার্গারেট র‌্যানডাল-এর কবিতা ( ১৯৩৬ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে"
    তেওতিহুয়াকানে আমি অসহায় দেখি তুমি পিছলে চলে যাচ্ছ,
    চুষে ফেলা, নিয়ে নেয়া
    এই সময় থেকে অন্য সময়ে ।
    তুমি আমার পাশে হাঁটো,
    ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিরা ভুলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে
    সূর্য আর চাঁদের পিরামিডের মাঝে
    মৃতের চওড়া রাস্তা বরাবর,
    কিন্তু আমি জানি যে তোমার খোলোস কেবল আমার সঙ্গে থাকে
    খড়ির মতন ফ্যাকাশে আর বোবা ।

    পরে তুমি বর্ণনার চেষ্টা করো কোথা থেকে পালিয়ে এসেছ
    কতো কষ্ট করে : ঝুরঝুরে আর শীতল
    দুই সহস্র বছর যা গেছে আর আছে তার মাঝে ।
    কেমন করে তুমি সাক্ষীর কাছ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিলে
    তোমার হলোগ্রাম চোখদুটো,
    একের পর এক বুকের ভেতরে ঢুকে-যাওয়া
    আগ্নেয়শিলার ছুরি, রক্তে জবজবে হৃদয়গুলো
    অন্ধকার থেকে আকাশে তোলা
    পরবর্তী সূর্যের সন্ধানে ।

    দেবতাদের জন্মস্হান, তার মহাগৌরবের মুহূর্তে
    পিরামিডের স্পন্দিত শহর
    আর প্রজাপতি প্রাসাদসারি,
    ২০০০০০ ওটোমি, জাপোটেক, মিক্সটেক,
    মায়া, নাহুয়া আর টোটোনাকদের বাড়ি,
    কারিগরদের, কুমোরদের,
    কোয়েৎজালকোটলের উপাসকরা :
    পালকদেহ সাপ যা ওদের দিয়েছিল
    সাধারণ জীবনের ঝর্ণা ।

    কোনও বীভৎস ব্যাপার এখানে ঘটেছিল,
    এটুকুই কেবল তুমি বলতে পারো
    যখন তুমি শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ফিরে এলে,
    কোনও ঘটনা যা বলা যায় না,
    আর তুমি তা বললে না
    যতদিন না আমাদের কবিবন্ধু মেয়েটি
    তার নিজের মৃত্যুর মুখে-পড়া অভিজ্ঞতার কথা বলল
    পিরামিডের সর্বোচ্চ শিখরে আটক
    নামতে অসমর্থ ।

    চাকোতেও তুমি সেই সন্ত্রাস অনুভব করো,
    বিশেষ করে পুয়েবলো বোনিতোতে : বিশাল বাড়ি
    মাটির তলায় ৬০০টা ঘর রেড ইনডিয়ানদের
    গোলাকার অসম্পূর্ণ দেয়াল, ছোটো দরোজা আর উঁচু জানালা
    ফ্রেমের মতন উড়ন্ত মেঘদলের সৌন্দর্য ধরে রাখতো
    ৮০০ বছর আগে যা ঘটেছিল তাকে আড়াল করে রাখা
    সেসময়ে যখন এটাই ছিল কেন্দ্র,
    পথের মোড় গাণিতিক বাতাসে সর্পিল চলে গেছে ।

    আর কেঅন দ্য চেলিতে, নাভাহো ৎসেগিদের সঙ্গে
    স্পেনিয়দের ঘোটালা -- “গুহার ভেতরে”
    ১৮০৫ সালে যেখানে দুটো স্রোতোধারা মেশে
    সাক্ষী হিসাবে রয়ে গেছে এক বিধ্বস্ত গুহা ।
    আক্রমণকারীরা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের গণহত্যা করল,
    আর দুই শতক পরে
    তাদের ভয় তোমার দেহে বাস করে,
    তুমি নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে নাও,
    সেদিন মরুভূমির বাতাসকে চিরে ফেলেছিল আর্তচিৎকার।

    এক হাজার বছরে যদি আমরা এখনও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি
    পরবর্তী সূর্যের জন্য
    আমি অবাক হবো যদি কোনো পর্যটক আউশউইৎস,
    রামাল্লা, বাগদাদ, কাবুল, সোয়েটো,
    মোরাজান, অ্যাকটেল কিংবা পোর্ট-অউ-প্রিন্স প্রমুখ জায়গায়
    সেখানে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে পারেন
    তাহলে হয়তো অনুভব করবেন তাঁকে একটা দিকে
    টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
    তাদের আর আমাদের সময়ের মাঝে, ভয় হয় তাঁরা
    এখনও একে আরেকের সঙ্গে যা করি তা থেকে পালাতে পারবেন না ।

    "মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি"
    ড্রেসডেন আর টোকিও, হিরোশিমা, বাগদাদ,
    কাবুল, পাইনট্রি রেজ কিংবা সাউথ ব্রংকস,
    ক্যানারিদের মনে করা হয় কোল্যাটারাল ড্যামেজ
    সেই লোকগুলোর কাছে যারা গুলি চালাবার, বোমা ফেলার হুকুম দেয় ।

    ও এক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে যা ওরা বলেছিল আমাদের স্বাধীন রাখবে।
    এখন বাসা হয়ে গেছে টুকরো সাজাবার ধাঁধা যেখানে অনেক টুকরো নেই।
    কেউ আর পুরোনো অবস্হায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না, কেউই নয়
    নৈঃশব্দ্য এখন চলমান স্বপ্ন ।

    দুই ঘণ্টা পর আর প্রতিটি গোপনতার একটি মিথ্যা বরাদ্দ,
    মেয়েটি ভেবেছিল ভেটেরান অ্যাসিসট্যান্স সাহায্য করবে
    কিন্তু মহিলা সেনাদের জন্য তেমন সাহায্যের ব্যবস্হা নেই
    আর যেখানেই আরোগ্যের প্রতারণা ঘাপটি মেরে আছে সেখানে ধর্ষণ লুকিয়ে।

    দেহরক্ষার সাম্প্রতিকতম বর্ম বেশি বিকলাঙ্গের উৎস।
    যদি কোথাও কিছু অবশিষ্ট থাকে
    তা কৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ফেরত পাঠিয়ে দাও
    পতাকায় মোড়া বাক্সের গরিমায় ।

    যারা বাড়ি ফেরে না তাদের জন্য : দীর্ঘ নিরবতা,
    মেয়েটি কখনও পরিচিত হয়নি এমন প্রিয় মুখগুলো,
    কন্ঠস্বরগুলো মেয়েটিকে বলে
    ও হলো মাইনের ভেতরের ক্যানারি পাখি

    "ডেভিড আর গলিয়াথ"
    পাহাড়ের ওপর থেকে সময় গড়িয়ে যায়,
    অ্যালাব্যাস্টারের পাতলা চাদর
    মরুভূমির পালিশের মতন পোক্ত ।
    ভয় জেগে ওঠে
    বুকের হাড় আর হৃদয়ের মাঝে
    তার ধাক্কা খাবার অধিকার জানায়
    যৎসামান্য রেশসহ
    ভিয়েৎনামের জাতীয় সঙ্গীতের ।
    সময় আর সঙ্গীতের পংক্তি
    আমার সংস্কৃতি থেকে এতো বিচ্ছিন্ন
    মনে হয় পর্যটক পাখিদের
    মিল নেই এমন এক জুটি
    আর আমি স্মৃতির টুকরো ওছলাই
    লাইনাস কম্বলের ওপরে
    ---লূতাতন্তু-আলো এখনও জড়িয়ে
    প্রতিটি অমীমাংসিত পুরস্কারে ।

    ভিয়েৎনাম : ডেভিড আর গলিয়াথ
    আমার প্রজন্মের ।
    প্রতিটি ন্যায়নিষ্ঠ সংঘর্ষ
    লোভ ও দোষের দেবতাদের বিরুদ্ধে,
    প্রতিটি নারী ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত
    কেবল তারা নারী বলে,
    প্রতিটি ক্ষুধার্ত শিশু
    বাড়ি সম্পর্কে আতঙ্কিত ।

    ধূর্ততা ছদ্মবেশ পরে থাকে শুশ্রুষার,
    মানচিত্রে ঘুরে বেড়ায় পথগুলো
    যতক্ষণ না তারা টলতে-টলতে কিনারায় গিয়ে পড়ে যায়
    খেলার বিশাল টেবিল থেকে ।
    বরফের অদৃশ্য ফালি
    ত্বকের তলায় গর্ত করে
    যা কেবল আদর খেতে চায়
    প্রতিটি ক্লান্ত গহ্বরে ।

    "মানাগুয়া থেকে লেখা চিঠি"
    একমাত্র যা তুমি চাও তা হল আমাদের হত্যা, যারা টিকে গেছে
    তোমাদের অজস্র পোশাক-মহড়ায়
    এখনও ব্যাপারটা তেমন গুরুতর নয়, আমাদের অনেকেই তোমাদের
    আশা ব্যক্তিগত স্তরে পূরণ করে না : তাগড়া বা নীল-চোখ বা সম্ভাবনাময়
    কেউই করে না তোমাদের বর্তমান আই কিউ অনুযায়ী
    কিংবা ররশাখ যা তোমাদের জীবনের বোধ সম্পর্কে সংজ্ঞা তৈরি করেন ।
    তোমাদের সঙ্গে মতের মিল না হলে ক্ষমা করো
    তোমাদের আণবিক বোমার সংজ্ঞা প্রয়োগ করে
    যুগ্মবৈপরীত্যের রাসায়নিক সমাধান
    কিংবা সালভাদোরের সমাধান যথেষ্ট ব্যথা-নির্মূলক হিসাবে।
    আমরা অত্যন্ত অনুন্নত আমাদের ব্যথা নিজেদের প্রাগতৈহাসিক
    উপায়ে সামলাবার জন্য ।
    আমাদের সমাজ নিয়ে তোমাদের প্রশ্নের যদি সম্পূর্ণ উত্তর দিতে না পারি
    তাহলেও আমাদের ক্ষমা কোরো, যদি একে মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট
    কিংবা সামাজিক-গণতান্ত্রিক, বহুমাত্রিকতাকে মান্যতা দেওয়া
    কিংবা যথেষ্ট খোলা বাজার ।
    যদি আমরা আমাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার প্রক্রিয়া অনুসন্ধানের
    অপক্বতায় জোর দিই
    আমাদের স্বদেশকে তীব্রভাবে ভালোবাসি
    ৫০০০০ বোন আর ভাইরা আমাদের কন্ঠে শিকড় বিছিয়ে রাখে ।
    আমাকে ক্ষমা করবেন, দয়া করে, আমরা সব সময়ে ভুলে যাই
    আমাদের সত্যকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের অনুমতি নেবার প্রয়োজন ছিল
    আর যেমন ভালো বুঝি তেমন করে আমাদের হাসি বিতরণ করা দরকার ছিল।
    নিজেদের মাথা ঘামাবেন না এটুকু বোঝার জন্য যে
    আমাদের সৈন্যদের লড়াই করতে শেখার সঙ্গে কবিতাপাঠও শিখতে হয়
    আত্মসন্মানবোধ আর কেমন করে রক্তের বদলে কালি দিয়ে তাদের নাম লিখবে,
    যখন আমাদের দাদুদিদারা এই জমি খুঁচিয়ে তাঁদের জীবন কাটাতেন
    তোমরা তোমাদের সৈন্য পাঠালে । পরে তোমরা আমাদের দিলে
    “আমাদেই একজন” : কিনলে আর দাম মেটালে
    তোমাদের মার্কিন জীবনযাত্রা দিয়ে ।
    তার ছিল এক ভাই আর এক ছেলে, এক নাতি
    আর অজস্র পকেট ।
    আমরা একাধিকবার বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছি
    কিন্তু তোমরা বিপুল সংখ্যায় আমাদের ভাইদের শিক্ষা দিলে
    তাদের কিনে ফেললে আর ছাঁচে গড়লে
    ( আমাদের ছাঁচে রাখার জন্য )
    আর যে ছাঁচে তারা আমাদের রাখল তা বেশির ভাগই পাইন-বাক্সে
    আর অনুভূমিক । এখানে যুবক হওয়া
    অপরাধ ছিল, আর তোমরা রোজ মনে করিয়ে দিতে
    সেই অপরাধের কথা
    কতোজনের দ্বারা, আর কতো দিন অন্তর করা হয় ।
    কিন্তু আমরা ভেলে যেতুম, আমরা লড়তুম আর তোমাদের চিরন্তন বন্ধুর
    প্রতিরক্ষামূলক পাহারার নিচে থেকে বেরিয়ে আসতুম।
    আমরা লড়তুম আর জিততুম, আমরা কবর দিতুম
    আমাদের বোনেদের আর ভাইদের ( কেউ কেউ ছিল ফর্সা
    বা তোমাদের ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে খাপ খেতো )
    আর আমাদের দীর্ঘ ব্যথা আরম্ভ হতো, নিঃশব্দ আনন্দ, অসম্ভবকে
    আমাদের ইতিহাসের চোখ আর হাত দিয়ে সম্ভব করে তোলা ।
    আমরা জানি আমরা তোমাদের ১৯৮২-এর মাপকাঠির সঙ্গে
    খাপ খাই না যা তোমরা নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্যে তৈরি করেছ ।
    তোমরা চাও কেবল আমাদের খুন করতে । আমরা কেবল চাই বেঁচে থাকতে ।
    ---মানাগুয়া, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২
  • চার্লস বদল্যার | ***:*** | ০১ জুলাই ২০১৯ ১৮:০২383614
  • প্যারিস স্প্লিন : শার্ল বদল্যার
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    সেই বিদেশি
    “রহস্যময় পুরুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো ? তোমার বাবা,
    তোমার মা, তোমার বোন না তোমার ভাইকে ?”
    “আমার বাবা নেই, মাও নেই, বোন নেই, ভাই নেই।”
    “তোমার বন্ধুবান্ধব ?”
    “এই যে তুমি একটা শব্দ ব্যবহার করলে তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি।”
    “তোমার দেশ?”
    “আমি জানি না কোন দ্রাঘিমায় তা অবস্হিত ।”
    “সৌন্দর্য ?”
    “আমি যেচে তাঁকে ভালোবাসবো, তিনি ঈশ্বরী ও অবিনশ্বর।”
    “সোনা ?”
    আমি তা ঘৃণা করি যেমন ঈশ্বরকে তুমি ঘৃণা করো ।”
    “আচ্ছা, তাহলে কীই বা তুমি ভালোবাসো, বিস্ময়কর আগন্তুক ?
    “আমি ভালোবাসি মেঘ...যে মেঘ ভেসে যাচ্ছে...ওপরে ওইখানে...ওপরে ওইখানে…
    বর্ণনাতীত মেঘমালা !”

    দুই
    বুড়ির বিষাদ
    ছোটোখাটো লোলচামড়া বুড়ি ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আহ্লাদিত হলেন, যাকে নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত, যাকে সবাই খুশি করতে চাইছিল ; ওনার মতনই পলকা এই সুন্দর প্রাণী, ছোট্ট বুড়ি, আর --- তাঁরই মতন -- দাঁত আর চুলহীন ।
    উনি বাচ্চাটার কাছে গেলেন, তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি আর হাসিখুশি মুখ দেখাতে চাইলেন ।
    কিন্তু বাচ্চাটা জীর্ণ ভালো বুড়ির আদরে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো, আর সারা বাড়ি নিজের কাঁদুনি দিয়ে ছেয়ে ফেললো ।
    তখন ভালো বুড়িটি ফিরে গেলেন নিজের শাশ্বত একাকিত্বে, এককোনে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন, নিজেকে শুনিয়ে বললেন :
    “আহ, আমাদের মতন অবজ্ঞেয় বুড়িদের জন্য, নিষ্পাপদের আনন্দ দেবার যুগও চলে গেছে ; আর যে শিশুদের আমরা ভালোবাসতে চাই তাদের মনে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলি !”

    তিন
    শিল্পীর পাপস্বীকার
    ওহ, হেমন্তের শেষ দিনগুলো কতো কাঁটা ফোঁটায় -- এমন ফোটায় যে ব্যথার সীমায় পৌঁছে যায়!
    কেননা, তৃপ্তিকর সংবেদগুলোর মধ্যে এমন কয়েকটা আছে, যাদের অনির্দিষ্টতা প্রাচুর্যকে বাদ দিতে পারে না ; আর অনন্ত ছাড়া অন্য কোনও ক্ষুরধার বিন্দু নেই ।
    সমুদ্র ও আকাশের বিশালতার দিকে নিজের চাউনিকে সাঁতরাতে দেয়া যে কি আনন্দময় ! নৈঃশব্দ, একাকীত্ব, ওই আশমানি রঙের অতুলনীয় কৌমার্য ! দিগন্তে কাঁপছে এক ছোটো পর্দা, আর, তার ক্ষুদ্রতা ও নিঃসঙ্গতায়, প্রতিবিধানের অসাধ্য আমার অস্তিত্বকে অনুকরণ করে, ঢেউদের একঘেয়ে সঙ্গীত -- এই সবকিছুই আমার মাধ্যমে চিন্তা করে, কিংবা তাদের মাধ্যমে আমি ( কেননা, এই ভাবাবেশের মহনীয়তায়, ওই “আমি” দ্রুত হারিয়ে যায় ) ; ওরা মনে করে, আমি বলতে চাই, কিন্তু তা গানে, ছবি আঁকায়, কোনোরকম তর্ক, ন্যায়সিদ্ধান্ত, ব্যবকলন ছাড়াই ।
    কিন্তু এই চিন্তাগুলো, তা আমার মধ্যে থেকে আসুক বা বিভিন্ন বস্তু থেকে উৎসারিত হোক, দ্রুত ঐকান্তিক হয়ে ওঠে । যখন তেজোময়তা মেশে ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে, তা থেকে জন্মায় এক অসুস্হতা এবং এক উপকারক যন্ত্রণা । আমার অত্যধিক পীড়িত স্নায়ু কেবল কটু আর দুঃখময় কাঁপন জাগিয়ে তোলে । আর এখন আকাশের গভীরতা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে, স্হবিরতা আমাকে উত্যক্ত করে । সমুদ্রের উদাসীনতা, দৃশ্যের অপরিবর্তনীয়তা আমাকে বিতৃষ্ণ করে...। ওহ, সারাজীবন কি কাউকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, নাকি সৌন্দর্য থেকে চিরকাল পালিয়ে বেড়াতে হবে ? প্রকৃতি, হে নির্দয় মোহিনী, তুমি সব সময়ে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী, আমাকে একা থাকতে দাও!
    আমার আকাঙ্খা আর আমার গর্ববোধকে জাগিয়ে তুলো না ! সৌন্দর্যের পাঠ হলো এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ, যা শেষ হয় হেরে যাবার আগে শিল্পীর কান্নামাখা ত্রাসে ।

    চার
    একজন ভাঁড়
    তখন ছিল নববর্ষের বিস্ফোরণ ; কাদা আর তুষারের বিশৃঙ্খলা, হাজার ঘোড়ার গাড়ির চাকায় মাড়ানো, খেলার জিনিশ আর মোমবাতিতে ঝিলমিলে, লোভী কামনা আর বিষাদে একাকার, এক মহান শহরের অনুমোদিত বিকার, সবচেয়ে দৃঢ় নিঃসঙ্গের মনকেও বিরক্ত করার জন্যে পরিকল্পিত ।
    এই হইচই আর আওয়াজের মাঝে, চাবুকে হাতে এক গেঁয়ো লোকের ধাতানি খেয়ে, একটা গাধা টগবগিয়ে ভিড়ে ঢুকে গেলো ।
    গাধাটা যখন রাস্তার বাঁক নিতে চলেছে, একজন সাজগোজ করা ভদ্রলোক, হাতে সুন্দর দস্তানা, পালিশ খাওয়া চেহারায় আর চুলে তেল দিয়ে, নিষ্ঠুরভাবে নেকটাই বেঁধে আর নিজের নতুন পোশাকে বন্দী, নম্র প্রাণীটার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণত হলেন আর , নিজের হ্যাট নামিয়ে বললেন, “আমি আপনার সুস্বাস্হ্য এবং আনন্দ কামনা করি !” তারপর, বন্ধুবান্ধব যারা তাঁর পেছনে আসছিল তাদের দিকে বোকার মতন তাকালেন, যেন আত্মতৃপ্তির জন্য তাদের অনুমোদন চাইছেন ।
    গাধাটা এই অসাধারণ ভাঁড়কে দেখতেই পেল না, আর যেদিকে তার কাজ সেই দিকে একান্তভাবে টগবগিয়ে যেতে লাগল ।
    যদি আমার কথা ধরা হয়, আমি আচমকাই এই অসাধারণ মূর্খের প্রতি বাঁধভাঙা ক্রোধে আক্রান্ত হলুম, যাকে দেখে আমার মনে হল সে ফরাসিদেশের আত্মা।

    পাঁচ
    যুগল ঘর
    স্বপ্নের মতন এক ঘর, একটা ঘর যা সত্যই জগৎ-বহির্ভূত, যার স্হির আবহাওয়া ফিকে গোলাপি আর নীল ।
    সেখানে আত্মা স্নান করে আলস্যে, সুগন্ধিত হয়ে আছে অনুশোচনা ও কামনায় । -- ব্যাপারটা সন্ধ্যাকালের, কিছুটা নীলাভ, গোলাপি ; গ্রহণের সময়কার এক ইন্দ্রিয়ময় স্বপ্ন ।
    আসবাবের গড়ন লম্বাটে, শোয়ানো, দুর্বল । মনে হয় আসবাবগুলোও স্বপ্ন দেখছে ; তাদের জীবনে যেন রয়েছে ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলার ক্ষমতা, উদ্ভিদ আর খনিজের মতন । পর্দারা মৌনভাষায় কথা বলছে, ফুলের মতন, আকাশের মতন, সূর্যাস্তের মতন । দেয়ালে কোনো শৈল্পিক জঘন্যতা নেই । বিশুদ্ধ স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করলে, অবিশ্লেষিত প্রভাবসহ, একটি নির্দিষ্ট এবং ইতিবাচক শিল্প হল ঈশ্বরনিন্দা । এখানে সবকিছুরই রয়েছে যথেষ্ট স্পষ্টতা, আর সেই সঙ্গে ঐকতানের রুচিকর দুর্বোধ্যতা ।
    অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বেছে নেয়া পরিমেয়ভাবে ক্ষুদ্র এক সুগন্ধ, হালকা আর্দ্রতার সঙ্গে মেশানো, এই বাতাবরণের মাঝ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, যেখানে এক উষ্ণীকৃত ঘরের সংবেদনের মাঝে দোল খাচ্ছে ঘুমন্ত আত্মা । বিছানার সামনে আর জানালায় মসলিন পরম প্রাচুর্যে দুলে ওঠে ; নিজেকে ছড়িয়ে দেয় তুষারপ্রপাতের মতন । এই বিছানায় শুয়ে আছেন এক প্রতিমা, স্বপ্নের রানি। কিন্তু কেনই বা তিনি এখানে ? কে তাঁকে এনেছে ? কোন ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা তাঁকে এই ভাবাচ্ছন্ন ও ইন্দ্রিয়সুখী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে ?
    কীই বা তাতে আসে-যায় : উনি তো রয়েছেন ! আমি ওনাকে চিনতে পারছি ।
    হ্যাঁ, এই চোখদুটি তাদের আগুন দিয়ে সন্ধ্যাকে ছিন্ন করে ; এই তনুকৃত ও ভয়ঙ্কর চোখদুটি, তাদের আতঙ্কজনক অশুভ কামনাকে আমি শনাক্ত করতে পারি । তারা আকর্ষণ করে, তারা বশে আনে, কারোর হঠকারী চাউনি যদি তার প্রতি মনোযোগ দেয় তাহলে তাকে গিলে খেয়ে ফ্যালে । আমি অনেকসময়ে নিরীক্ষণ করেছি, কৌতূহল ও বিস্ময়ের দাবিদার এই দুটি কালো নক্ষত্রকে ।
    কোন সেই দয়ালু দানব যার কাছে এরকম রহস্য, স্তব্ধতা, শান্তি আর সুগন্ধে আচ্ছাদিত থাকার জন্য আমি ঋণী ? হে স্বর্গসুখ ! যাকে আমরা সাধারণত বলি জীবন, এমনকি তার আনন্দময় প্রাচুর্যের সময়ে, আমি এখন যে পরম জীবনের কথা জানি, তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই, আর আমি তা সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড, মিনিটের পর মিনিট উপলব্ধি করি !
    না ! আর কোনও সেকেণ্ড নেই, কোনও মিনিট নেই ! সময় উধাও হয়ে গেছে ; এখন অনন্তের শাসন, অনন্তকালীন পরমানন্দ !
    কিন্তু এক মৃদু, ত্রাসময় কড়া নাড়ার আওয়াজ দরোজায় শুনলুম এবং, যেমন নারকীয় স্বপ্নে ঘটে থাকে, আমার মনে হল আমার পেটে কুঠারাঘাত করা হয়েছে । তারপর প্রবেশ করল এক অপচ্ছায়া । সে বিচারকের প্রতিনিধি, আইনের নামে আমাকে নির্যাতন করতে এসেছে ; একজন নোংরা উপপত্নী “বিপর্যয়ের” কান্না কাঁদতে এসেছে আর নিজের জীবনের তুচ্ছতার সঙ্গে জুড়তে এসেছে আমার দুঃখ ; কিংবা হয়তো কোনো সংবাদপত্র সম্পাদকের স্যাঙাত পাণ্ডুলিপির বাকি অংশ চাইতে এসেছে।
    স্বর্গীয় ঘরখানা, প্রতিমা, স্বপ্নের রানি, মহান রেনে শাতোব্রিয়োঁ যেমন বলেছেন ‘সিলফাইড’-এর কথা -- যাবতীয় ইন্দ্রজাল মিলিয়ে গেল অপচ্ছায়ার নির্দয় কড়া নাড়ার দরুন ।
    আতঙ্কজনক ! এখন আমার মনে পড়েছে ! মনে পড়েছে ! হ্যাঁ ! এই জঘন্য বাসা, অনন্তকালীন একঘেয়েমির এই বাসা, আসলে আমারই । সেই একই বোকা আসবাবপত্র, ধুলোমাখা, বিধ্বস্ত; তাপ পোয়াবার আগুনহীন, এমনকি স্ফূলিঙ্গও নেই এমন চিমনি, থুতু-গয়েরে নোংরা ; লজ্জাকর জানালা, যার ওপরে ধুলোয় দরানি এঁকেছে বৃষ্টি ; পাণ্ডুলিপি, মুছে-ফেলা বা অসম্পূর্ণ ; ক্যালেণ্ডার, যার ওপরে কাজ নিষ্পন্ন করার ভীতিকর তারিখগুলোতে পেনসিল দাগানো!
    আর সেই ভিনজগতের সুগন্ধ যা আমার অভিজাত সংবেদনকে আচ্ছন্ন করতো, হায়, তার জায়গা নিয়েছে তামাকের সঙ্গে মেশানো, ঈশ্বরই জানেন কোন বমি উদ্রেককারী ছত্রাকের পূতিগন্ধ। এখন, এখানে, তুমি নিঃশ্বাস নেবে কেবল নিঃসঙ্গতার বাসি জীর্ণতা ।
    এই জগতে, এতো ঘিঞ্জি তা সত্বেও বিতৃষ্ণায় ঠাশা, কেবল একটি পরিচিত জিনিশই আমার দিকে তাকিয়ে হাসে : আফিমের শিশি , একজন পুরোনো আর ভয়ঙ্কর বন্ধু ; আর সব বন্ধুই যেমন হয়, হায়, আমাকে আদর করতে আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে উদারচিত্ত ।
    ওহ, হ্যাঁ ! সময় ফিরে এসেছে ; সময় এখন রাজার মতন সাম্রাজ্য চালায় ; আর বীভৎস বুড়োটার সঙ্গে আসে স্মৃতি, আফশোষ, আক্ষেপ, ভয়, উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, ক্রোধ আর স্নায়বিক পীড়ার দানবেরা ।
    আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি যে মিনিটগুলো এখন শক্তিমত্তায়, সমারোহে ঘনঘোর, এবং প্রতিটি, ঘড়ি থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, বলে : “আমিই জীবন, অসহ্য, অপ্রশম্য জীবন!”
    মানবজীবনে একটিমাত্র মিনিট থাকে যার উদ্দেশ্য হল সুসংবাদ ঘোষণা করা, যে সুসংবাদ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভয়কে প্ররোচিত করে ।
    হ্যাঁ ! সময় রাজত্ব করে ; সে তার নৃশংস স্বৈরাচারকে দৃঢ়ভাবে জাহির করেছে । আর সে আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়, তার দুদিকে ধারালো লাঙল টেনে-টেনে, যেন আমি একটা বলদ : “ চলে এসো, ওহে গাধা ! গায়ের জোর খাটাও, ক্রীতদাস ! বেঁচে থাকো, ঘৃণ্য কোথাকার !”

    ছয়
    যে যার অসার দানবের পাল্লায়
    বিশাল অনুজ্বল আকাশের নীচে, পথহীন ঘাসহীন কাঁটাগাছহীন বিছুটিহীন এক ধূলিধূসরিত বির্স্তীর্ণ সমতলভূমিতে, কয়েকটা লোককে দেখতে পেলুম যারা ঝুঁকে হাঁটছিল।
    তারা প্রত্যেকে নিজের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বিরাট দানব, এক বস্তা আটা কিংবা কয়লার মতন ভারি, কিংবা প্রাচীন রোমের পদাতিক সৈন্যের পিঠের বোঝার মতন । কিন্তু দানবিক জানোয়ারটা নিষ্ক্রিয় ছিল না ; বরং বিপরীত, সে নিজের পেশির স্হিতিস্হাপকতা আর গায়ের জোরে লোকগুলোকে জড়িয়ে ধরে কষ্ট দিচ্ছিল ; নিজের দুটো বড়ো-বড়ো দাঁড়া দিয়ে বাহকের বুক আঁকড়ে ধরেছিল ; আর তার পৌরাণিক মাথা ছিল বাহকের মাথার ওপরে , সেই আগেকার দিনের ভারি হেলমেটের মতন যা প্রাচীন যোদ্ধারা পরে মনে করত যে সেটা শত্রুদের মনে ভয় জাগিয়ে তুলবে ।
    তাদের মধ্যে থেকে একজন লোককে আমি জিগ্যেস করলুম, এই রকম অবস্হায় তারা কোথায় যাচ্ছে । সে বলল যে সে কিছুই জানে না, সেও জানে না অন্যেরাও জানে না ; কিন্তু তারা কোথাও যাচ্ছে, কেননা তারা হাঁটবার অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজন-তাড়িত ।
    চোখে পড়ার মতন কৌতুহলজনক : এই পর্যটকদের কাউকে দেখেই মনে হচ্ছিল না যে এক ভয়ঙ্কর জানোয়ার তার গলা জড়িয়ে রয়েছে আর পিঠের ওপরে ঝুলে আছে বলে তার অসুবিধা হচ্ছে ; যেন প্রত্যেকে মনে করছে সেটা তার দেহের অংশ ।
    এই সমস্ত পরিশ্রান্ত, গম্ভীর মুখগুলো কোনও বিষাদ ব্যক্ত করছে না ; আকাশের বিষণ্ণ গম্বুজের তলায়, আকশের মতোই নিরানন্দ ধূলিধূসর মাটিতে পা পুঁতে, তারা পরাজিত মুখে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে গেল সেই সব লোকের মতন যারা চিরকালীন আশায় দণ্ডপ্রাপ্ত ।
    পুরো দলটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল, তাড়াতাড়ি মিলিয়ে গেল আবছা দিগন্তে, সেই দিকে যেখানে গ্রহের গোলাকার পাটাতন মানুষের কৌতূহলময় দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যায়।
    এবং কয়েক মিনিটের জন্য আমি জেদের সঙ্গে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করলুম ; কিন্তু তখনই এক অপ্রতিরোধ্য উদাসীনতা আমার ওপর ভেঙে পড়ল, আর ওই লোকগুলো যে অলীক দানবের ভারি ওজনে নুয়ে পড়েছিল তার চেয়েও ভারি বোঝার ভার আমার ওপর চেপে বসল।

    সাত
    মূর্খ এবং প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
    কি সুন্দর দিনটা ! সূর্যের জ্বলন্ত চোখের তলায় বিশাল বাগানটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, যেমনটা যৌবনে ঘটে প্রেমের প্রভূত্ববিস্তারে ।
    বস্তুজগতের সর্বব্যাপী আহ্লাদ কোনও শব্দের দ্বারা অভিব্যক্ত হচ্ছিল না ; মনে হচ্ছিল জলরাশিও নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছে । মানুষের উৎসবাদির থেকে একেবারে আলাদা, এখানে মহোৎসব ছিল নৈঃশব্দের ।
    যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া আলো, বস্তুদের আরও বেশি ঝিলমিলে করে তুলছিল ; যেন উত্তেজিত ফুলগুলো, আকাশের নীলাভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, স্বকীয় রঙের তেজপূঞ্জ দিয়ে নিজের আকাঙ্খায় পুড়ছিল, আর যেন উত্তাপ সুগন্ধকে করে তুলছিল দৃষ্টিগোচর, বাষ্পের মতন নক্ষত্রদের দিকে উড়ে যাবার কারণ হয়ে উঠছিল ।
    যাইহোক, এই সর্বজনীন আমোদপ্রমোদের মাঝে, আমার চোখে পড়ল এক দুর্দশাগ্রস্ত প্রাণী।
    প্রেমের অতিকায় অধিষ্ঠাত্রীদেবীর পায়ের কাছে, রাজাকে আনন্দ দেবার কাজে আত্মনিয়োজিত ভাঁড়েদের মধ্যে সেই সব কৃত্রিম মুর্খদের একজন, যখন কিনা আত্মগ্লানি কিংবা বিষাদ তাদের মুক্ত করতে পারত, রঙচঙে, হাস্যকর পোশাক পরার ফাঁদে পড়ে, মাথায় শিঙ আর ঘণ্টা, বেদিতে হেলান দিয়ে অশ্রুভরা চোখ মেলে ধরল অবিনশ্বর ঈশ্বরীর দিকে।
    আর তার চোখ বলল : “আমি মানবসমাজে ক্ষুদ্রতম এবং অত্যন্ত একা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত, আর তাই ত্রুটিপূর্ণ পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট। কিন্তু তবু আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আমিও, যাতে অবিনশ্বর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও অনুভব করতে পারি ! আহ, ঈশ্বরী ! আমার দুঃখ ও উন্মাদনার প্রতি দয়া করো !”
    কিন্তু অপ্রশম্য অধিষ্ঠাত্রীদেবী শ্বেতপাথরের চোখ মেলে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি জানি না কিসের দিকে, দূরে ।

    আট
    কুকুর আর শিশি
    “আমার চমৎকার কুকুর, আমার ভালো কুকুর, আমার ছোট্ট কুকুর, এখানে এসো আর গন্ধ শোঁকো অত্যুৎকৃষ্ট সৌরভের, শহরের শ্রেষ্ঠ সৌরভ প্রস্তুতকারকের কাছে কেনা।”
    কুকুরটা ল্যাজ নাড়ালো, যে ইঙ্গিত, আমি মনে করি, নগণ্য প্রাণীদের মধ্যে থাকে, যারা জোরে বা মৃদু হাসি পাবার যোগ্য, এগিয়ে এলো, কৌতূহলের সঙ্গে ভিজে নাক খোলা শিশিতে ঠেকালো -- আর তক্ষুনি, ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে, আমাকে উদ্দেশ্য করে ঘেউঘেউ করল, যেন ভর্ৎসনা করছে।
    “আহ, তুই বোকা কুকুর, তোকে যদি আমি এক প্যাকেট গু দিতুম, তুই আনন্দে তার গন্ধ শুঁকতিস আর হয়তো খেয়েও নিতিস । এই প্রসঙ্গে আমি তোকে শ্রদ্ধা করি, আমার যন্ত্রণাময় জীবনের অযোগ্য সহচর, জনসাধারণের মতনই তুই, যাদের চটিয়ে দেবে এমন মিহি সৌরভ কখনও উপহার দেয়া যায় না, তার বদলে তাদের দাও গোবর, ভালোভাবে বাছাই করে।”

    নয়
    জানালায় কাচ বসাবার খারাপ কর্মী
    এমন অনেক বিশেষ চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব আছে, কাজের একেবারে অযোগ্য, যারা তা সত্বেও অনেকসময়ে, কোনো রহস্যময়, অজানা প্রেরণার বশীভূত হয়ে, এমন দ্রুতির সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে যে তারা নিজেরাই বিশ্বাস করবে না অমন ক্ষমতার তারা যোগ্য।
    এই ধরনের লোক যে, দারোয়ান তাকে কোনো হয়রানির খবর দেবে, ভেতরে ঢোকার সাহস যোগাতে না পেরে ঘণ্টাখানেক যাবত নিজের দরোজার বাইরে ভীতুর মতন উঁকিঝুঁকি মারে;
    সেই ধরণের লোক যে একটা চিঠিকে দুই সপ্তাহ যাবত খোলে না, কিংবা কোনো নির্ণয় নিতে ছয় মাস নেয় যখন কিনা কাজটা পুরো করতে এক বছর লাগবে -- তারপর সে নিজেকে আচমকা আবিষ্কার করে যে কোনো বিবেচনাহীন কাজ তড়িঘড়ি করতে চলেছে, ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীরের মতন । নীতিবাদী এবং চিকিৎসক, যাঁরা সবজান্তার ভান করেন, এই আচমকা উন্মাদ কর্মশক্তির উৎসের ব্যাখ্যা দিতে পারেন না, যা জেগে ওঠে অলস, সংবেদনময় চরিত্রে, আর কেমন করে, অত্যন্ত সরল ও জরুরি কাজ করার অযোগ্যতা সত্বেও, তারা কোনও মুহূর্তে অসম্ভব এমনকি বিপজ্জনক কাজ করার ঝুঁকি নিয়ে ফ্যালে ।
    আমার বন্ধুদের একজন, অতিনিরীহ স্বপ্নদ্রষ্টা, একবার জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল যাতে ও দেখতে পায়, ও বলেছিল, যে লোকজন যেমন বলে থাকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সে কথা সত্যি কিনা তা পরখ করতে চায় । পরপর দশবার, তা ঘটেনি ; কিন্তু এগারোবারের সময়ে তা ভালোভাবে ঘটেছিল ।
    আরেকজন বারুদের বাক্সের পাশে বসে সিগার জ্বালাতো, কেবল দেখার জন্য, যাতে ও জানতে পারে, অদৃষ্টকে লোভ দেখাবার জন্য, নিজের কাছে প্রমাণ করার জন্য, যে একজন জুয়াড়ির উদ্দীপনা তো ওর আছে, যা থেকে ও উদ্বেগের আনন্দ নিতে পারে, কিংবা অকারণেই, খেয়ালখুশিতে, অন্য কোনো কাজ হাতে নেই বলে ।
    এই ধরণের কর্মক্ষমতা একঘেয়েমি আর দিবাস্বপ্ন থেকে উৎসারিত হয় ; আর যাদের জীবনে তা অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা দেয় তারা সাধারণত, যেমন আগেই বলেছি, সবচেয়ে শ্রমবিমুখ আর অলীক-কল্পনা করার প্রাণী । আরেকজন, অন্যেরা তার দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নেয় এমন ভীরু, মনের সমস্ত জোর খাটিয়ে কফিহাউসে ঢোকে কিংবা নাট্যমঞ্চকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেখানে ওর মনে হয় যে টকিট বিক্রেতারা গ্রিক পুরাণের মিনোস, এজিনার রাজা ইকস, আর মৃতদের বিচারক রাদামানথুসের মতন ডাঁটে বসে থাকে, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে রাস্তায় ওর পাশ দিয়ে যেতে থাকা একজন বৃদ্ধের গলা আঁকড়ে ধরবে, আর অবাক পথচারীদের সামনে অতিউৎসাহে তাকে আলিঙ্গন করবে । কেন ? কারণ...কেননা সেই বিশেষ চেহারা তার কাছে দুর্নিবার আকর্ষক মনে হয়েছিল বলে ? হয়তো ; কিন্তু এ কথা অনুমান করা বেশি ন্যায়সঙ্গত যে সে নিজেই তার কারণ জানত না ।
    আমি এক বারের বেশি এই ধরণের সঙ্কট এবং উত্তেজনার শিকার হয়েছি, যা আমাদের বিশ্বাস করায় যে আমাদের মধ্যে অশুভ দানবেরা চুপিচুপি ঢুকে পড়ে, আমাদের তেমন কাজকর্ম করতে বাধ্য করে, যা আমাদের অজানা, তাদের বিদকুটে ইচ্ছেগুলোকে পুরণ করার জন্য ।
    একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠলুম, খারাপ মেজাজে, হতোদ্যম, আমার আলস্যে বিরক্ত, আর তাড়িত, আমার মনে হল, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু করি, কোনও সুন্দর কাজ ; আর, হায়, জানালা খুললুম !
    ( অনুরোধ করছি, আপনি লক্ষ করুন, লোকজনের সঙ্গে মজা করার উৎসাহ ভাবনাচিন্তার কিংবা সচেতন পরিকল্পনা নয় বরং আকস্মিক প্রেরণা, আর তার সঙ্গে লাগোয়া, উৎসাহবাহিত আকুলতা, যে ঠাট্টা-ইয়ার্কিকে চিকিৎসকরা বলেন বায়ুরোগ আর যাঁরা চিকিৎসকদের তুলনায় আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন তাঁরা বলেন শয়তানি, যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, প্রতিরোধহীন, অসংখ্য জঘন্য কাজ করতে ।) জানলা খুলে রাস্তায় প্রথম যে লোকটাকে দেখলুম সে ছিল একজন কাচের শার্শি বদলকারী, যার বেসুরো চিল চিৎকার প্যারিসের ঘন, দুর্গন্ধিত বাতাস ভেদ করে উঠে এলো আমার কাছে । বলা একেবারে অসম্ভব যে ওই বেচারা লোকটাকে দেখে আমার মন ঘৃণায় ভরে গেল, যা ছিল আকস্মিক আর সেই সঙ্গে হুকুমকারীর মতন । “ওহে ! ওহে !” আমি ওকে ওপরে আসতে বললুম । সেই ফাঁকে ভাবলুম, বেশ মজা করা যাবে, আমার ঘরটা সাত তলায় আর সিঁড়িটা বেশ অপ্রশস্ত হওয়ায়, ওপরে উঠে আসতে লোকটার বেশ খাটুনি হবে, আর ওঠার পথে ওর ঠুনকো জিনিশপত্র নানা জায়গায় ধাক্কা খাবে ।
    শেষ পর্যন্ত লোকটা এলো : আমি খুঁটিয়ে ওর শার্শিগুলো দেখলুম, আর ওকে বললুম, “কী ? তোমার কাছে রঙিন কাচ নেই ? গোলাপি কাচ নেই, লাল নেই, নীল নেই, ঐন্দ্রজালিক শার্শি নেই, স্বর্গের শার্শি নেই ? বেহায়া মূর্খ কোথাকার ! তুমি গরিবদের পাড়ায়-পাড়ায় ফিরি করে বেড়াচ্ছ অথচ জীবনকে সুন্দর করে তোলে এমন শার্শি নেই !” আমি ওকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিলুম, যেখানে ও থমকে দাঁড়িয়ে ঘোঁতঘোঁত করল ।
    আমি বারান্দায় ফিরে গিয়ে ফুলের একটা ছোট গামলা তুলে নিলুম, আর লোকটাকে যখন নীচে সিঁড়ির বাইরে বেরোতে দেখলুম, আমি আমার যুদ্ধাস্ত্র সোজা নীচে ফেলে দিলুম ওর পিঠের বস্তার ওপর ; ধাক্কায় ও পেছনে হেলে পড়ে গেল, আর তার ফলে ভেঙে ফেলল, নিজের পিঠের চাপে, ওর সমস্ত মর্মন্তুদ ভ্রাম্যমান ঐশ্বর্য, স্ফটিকের তৈরি প্রাসাদে বিদ্যুৎ পড়ার মতন জাঁকালো আওয়াজ করে ।
    আর নিজের উন্মাদনায় মাতাল, আমি লোকটার উদ্দেশে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলুম, “জীবনকে সুন্দর করে তোলো ! জীবনকে সুন্দর করে তোলো !”
    এই ধরণের বাজে ঠাট্টা বিপদহীন নয়, আর প্রায়ই তার জন্য বড়ো খেসারত দিতে হয় । কিন্তু যে মানুষ একটা ক্ষণের মধ্যে আনন্দের অনন্তকাল আবিষ্কার করেছে, তার কাছে অভিশপ্ত অবিনশ্বরতা কি কোনো ব্যাপার হতে পারে ?

    দশ
    দুপর একটার সময়ে
    শেষ পর্যন্ত, একা ! যা শোনা যাচ্ছে তা কেবল কয়েকটা পুরোনো, ক্লান্ত ঘোড়ার গাড়ির চাকার আওয়াজ । কয়েক ঘণ্টার জন্য, আমাদের থাকবে, আরাম না হলেও, নিস্তব্ধতা । শেষ পর্যন্ত ! আমাকে এখন ছায়ায় স্নান করার ঢিলেমি দেয়া হয়েছে ! কিন্তু প্রথমে, ঘড়িতে দুই বার চাবি দিতে হবে : আমার মনে হয় এই বাড়তি চাবি ঘোরানো আমার একাকীত্বকে বল দেবে আর জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পাঁচিলকে পোক্ত করবে ।
    ভয়ঙ্কর জীবন ! ভয়ঙ্কর শহর ! সারা দিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক : কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হল, তাদের একজন আমাকে জিগ্যেস করলে যে স্হলপথে কি রাশিয়ায় যাওয়া যায় ( স্বাভাবিক যে ও রাশিয়াকে একটা দ্বীপ বলে মনে করেছে ) ; এক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে অনেকক্ষণ তর্ক হল, যিনি প্রতিটি আপত্তির একটাই জবাব দিচ্ছিলেন, “এই যে, আমরা শোভনতার পক্ষে,” যার মানে দাঁড়ায় যে অন্য সব পত্রিকা চালায় বজ্জাতের দল ; প্রায় কুড়িজন লোককে শুভেচ্ছার অভিবাদন করলুম, যাদের পনেরোজনকে আমি একেবারে চিনি না ; ততোজনের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলুম, আর গ্লোভস কেনার পূর্বাহ্ণিক সতর্কতা না নিয়ে ; বৃষ্টির ঝর্ণা বাঁচিয়ে সময় কাটাবার জন্য, একজন ফালতু নর্তকীর কাছে গেলুম, যে আমার কাছে অনুনয় করল যে “ভিস-নিস” অভিনয় করার জন্য তার পোশাকটার নকশা যেন আমি তৈরি করে দিই ; একজন নাটক-পরিচালকের কাছে হাজিরা দিলুম যে বলল, আমাকে বাতিল করে, “তুমি অমুকের সঙ্গে পরিচয় করলে ভালো করবে ; ও সবচেয়ে ভোঁদা, বোকা, আর লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত, ফলে তার কাছে তুমি হয়তো কিঞ্চিদধিক গুরুত্ব পেতে পারো। ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, আর তারপর দেখা যাবে”; বেশ কয়েকটা নীচ কাজ যা আগে করিনি সে সম্পর্কে গর্ববোধ ( কেন ? ) করলুম, আর ভীতুর মতন আমার অনেক দুষ্কর্মকে অস্বীকার করলুম যেগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গেই আমি করেছিলুম -- দম্ভোক্তি করার আহ্লাদ, মানবিক শোভনতার বিরুদ্ধে অপরাধ ; এক বন্ধুকে অনায়াস সাহায্য করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান, আর একজন পাক্কা বোকার সুপারিশ করে লিখলুম চিঠি -- উফ ! ফিরিস্তি শেষ হল ?
    সবকিছু সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, নিজের সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, আমি সত্যিই প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, রাতের নৈঃশব্দ ও একাকীত্বে এক চিলতে গর্ববোধ । যাদের অন্তরাত্মাকে ভালোবেসেছি, যাদের অন্তরাত্মার গান গেয়েছি, আমাকে শক্তি দেয়, সমর্থন করে, জগতসংসারের মিথ্যা ও ভ্রষ্টাচারের বাষ্প থেকে আমাকে দূরে রাখে, আর তুমি, আমার দেবতাত্মা ঈশ্বর ! কয়েকটা সুন্দর পংক্তি সৃষ্টি করার কৃপা আমাকে দাও যাতে নিজের কাছে প্রমাণ করতে পারি যে মানুষের মাঝে আমি সবচেয়ে হীন নই, আমি যাদের অবজ্ঞা করি তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট নই !

    এগারো
    অসভ্য নারী আর ছোট্টো রক্ষিতা
    সত্যি, হে প্রিয়া, তুমি আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছ ; তোমার অভিযোগগুলো দয়ামায়াহীন, বেখাপ্পা । তোমার দীর্ঘশ্বাস শুনলে, যে কেউ ভাববে ষাট বছরের বুড়ি জঞ্জাল কুড়ানির চেয়ে কিংবা সেই বুড়ি ভিখারিনীরা যারা রেস্তরাঁর দরোজার বাইরে রুটির টুকরো কুড়োয়, তাদের চেয়ে তুমি বেশি দুঃখযন্ত্রণায় ভুগছ ।
    “যদি তোমার দীর্ঘশ্বাস অন্তত অনুশোচনা প্রকাশ করত, তা তোমাকে সন্মান দিত ; কিন্তু তা কেবল ফাঁস করে দেয় যে তুমি ভালোভাবে জীবনযাপনে পরিতৃপ্ত, আর তুমি অতিরিক্ত বিশ্রাম করে হাঁপিয়ে পড়েছ । আর তারপর, তোমার বকবকানির স্রোত থামে না : ‘আমাকে বেশি করে ভালোবাসো ! আমি তা ভীষণভাবে চাই ! আমাকে এইভাবে সান্ত্বনা দাও, সেইভাবে আদর করো।’ দ্যাখো, আমি চেষ্টা করছি তোমার সুস্বাস্হ ফিরে আসুক ; আর হতে পারে যে আমরা তার উপায় বের করে ফেলব, কাছাকাছি কোনো মেলায় গিয়ে দুটাকা খরচ করে।
    “দয়া করে, বিবেচনা করো, যে লোহার শক্তপোক্ত খাঁচার ভেতরে বসে, পতিতের মতন খ্যাঁকখ্যাঁক করে, নির্বাসনে পাগল ওরাঙওটাঙের মতন খাঁচার গরাদ নাড়িয়ে, বাঘের পাক খাওয়ার নিখুঁত অনুকরণ করে, আর এখন শ্বেতভাল্লুকের মতন মূর্খ জবুথবু হাঁটাচলা করে, মনে হয় লোমশ দানবীর চেঁচামেচি আনেকটা তোমারই মতন ।
    “এই দানবী সেইসব জানোয়ারের অন্যতম, যাকে কেউ সাধারণভাবে ‘আমার দেবকন্যা’ বলে ডাকে! -- মানে, একজন নারী । তার সঙ্গে যে আরেকটা দানব, যার হাতে ছড়ি রয়েছে, গলার জোর খাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, একজন স্বামী । নিজের আইনসঙ্গত স্ত্রীকে জানোয়ারের মতন শেকল বেঁধে রেখেছে, আর মেলার দিনগুলোয় শহরতলিতে তাকে প্রদর্শন করে বেড়ায় -- স্বাভাবিকভাবে, অফিসারদের অনুমতি নিয়ে ।
    “সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করো ! দ্যাখো কেমন গোগ্রাসে ( হয়তো লোকদেখানো নয় ! ) রক্ষকের ছুঁড়ে দেয়া জ্যান্ত খরগোশগুলোকে আর গ্যাঁকগ্যাঁকে মুর্গিগুলোকে মেয়েটা ছিঁড়ছে । ‘রোসো’, লোকটা ওকে বলে, ‘তোমাকে সব খাবার এক বারে খেয়ে ফেলতে হবে না,’ আর এই উপদেশ দিয়ে লোকটা সতর্ক হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে তার শিকার কেড়ে নেয়, ভয়ঙ্কর জানোয়ারটার দাঁত থেকে কিছু নাড়িভূঁড়ির টুকরো ঝুলতে থাকে -- মানে, আমি ওই নারীর কথা বলছি।
    “দ্যাখো ! মেয়েটাকে শান্ত করার জন্য ছড়ির এক সুন্দর খোঁচা ! --- কেননা মেয়েটা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে, কেড়ে নেয়া খাবারের জন্য, লালসায় ক্ষেপে গিয়ে । হায় ঈশ্বর ! ছড়িটা মঞ্চে মজা দেখাবার জন্যে নয় ; মেয়েটার মাংসে যে সপাং আওয়াজ হল তা শুনলে তো, জটপড়া নকল চুল সত্বেও ? আর মেয়েটার চোখ যেন ওর মুণ্ডু থেকে বেরিয়ে আসছে, ও এবার স্বাভাবিকভাবে চেঁচাচ্ছে । রাগের চোটে, মনে হয় ওর সারা শরীর কাঁপছে, লোহাকে পিটলে যেমন হয় ।
    “অ্যাডাম আর ইভের উত্তরসূরীদের এরকমই দাম্পত্যজীবন, তোমার আয়ত্বে এই সমস্ত কাজ, হায় ভগবান ! এই নারী সত্যিই যৎপরোনাস্তি দুঃখযন্ত্রণায় রয়েছে, যদিও, হয়তো, খ্যাতির সুড়সুড়ির আনন্দ ওর অজানা নয় । এর চেয়েও খারাপ দূরপনেয় যন্ত্রণা আছে, এবং তা ক্ষতিপূরণহীন । কিন্তু যে জগতে ওকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, ওর মনে হয়নি যে একজন নারীর এর চেয়ে আলাদা অদৃষ্ট হতে পারে ।
    “আর এবার, নিজেদের কথায় ফেরা যাক, আমার দামি প্রাণীটির দিকে ! এই জগতের লোকজন যে নরকে থাকে, তোমার বিশেষ সুন্দর নরক সম্পর্কে আমার কাছে কী আশা করো, তুমি, যে কখনও নিজের খসখসে ত্বকের তুলনায় অন্য কোনো জিনিশে হেলান দাওনি, আর যে কেবল অনুগত চাকরের রাঁধা মাংস খাও প্রতিটি গ্রাসে ?
    “আর কেমনভাবেই বা আমি এই ছোট দীর্ঘশ্বাসগুলোকে মেনে নেব যা তোমার সুগন্ধিত স্তনকে ফুলিয়ে তোলে, আমার পোক্ত ছোট্ট ছিনাল ? আর বই পড়ে জড়ো করা এই সমস্ত কৃত্রিম আচরণ, আর এই ক্লান্তিহীন বিষাদ, দর্শকের মনে দয়ার বদলে অন্য একরকমের ভাবপ্রবণতা জাগাবার চেষ্টা ? সত্যিই, আমি অনেকসময়ে ভাবি তোমাকে শিখিয়ে দিই কাকে প্রকৃত দুঃখযন্ত্রণা বলে ।
    “ আমার তুলতুলে সুন্দরী, তোমার পা কাদায় আর তোমার চোখ গাগনিকভাবে আকাশের দিকে, যেন তোমাকে একজন মহারাজা এনে উপহার দেয়া হবে, যে কেউ তোমাকে মনে করবে একটা কচি ব্যাঙ, সেই আশা পূর্ণ করার প্রয়াস করছ । যদি তুমি বর্তমান রাজাকে অবজ্ঞা করো ( যা বর্তমানে আমি, তা তুমি ভালো করেই জানো ), পরের বার যে আসবে তার সম্পর্কে সাবধান হও, সে তোমাকে চিবোবে, গিলে ফেলবে, আর নিজের ইচ্ছেমতো কোতল করবে !
    “হতে পারে আমি একজন কবি, কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ আমাকে তেমন ঠকাতে পারবে না, আর যদি তুমি তোমার মূল্যবান কাঁদুনি গেয়ে আমাকে প্রায়ই ক্লান্ত করো, আমি তোমার সঙ্গে অসভ্য মেয়েমানুষের সঙ্গে যেমন করা উচিত তেমন ব্যবহার করব, কিংবা খালি বোতলের মতন জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেবো ।”

    বারো
    ভিড়
    টবে স্নান করার মতন করে জনতার ভেতরে সবাই নিজেকে চোবাতে পারে না ; ভিড়ের মজা নেয়া হলো শিল্প ; আর কেবল সেই লোকগুলো মানবজাতির শৌর্যকে উৎসবে পরিণত করতে পারে যাদের, তাদের শৈশবের দোলনায়, একজন পরী এসে ছদ্মবেশে আর মুখোশ পরে এসে, বাড়ির প্রতি ঘৃণার, আর ভ্রমণের নেশার শ্বাস ফেলেছিল ।
    জনতা, একাকীত্ব : এই অভিধাগুলোর মর্মার্থ সক্রিয় ও বহুপ্রসূ কবির কাছে একই এবং সমভাবে বিনিমেয় । যে লোক জানে না যে তার একাকীত্বকে কেমন করে জনতা দিয়ে ভরে তুলতে হয়, সে জানতে পারবে না ব্যস্ত ভিড়ে কেমন করে একা থাকা যায় । এই অতুলনীয় সুবিধা উপভোগ করেন একজন কবি, তিনি হয়ে উঠতে পারবেন, যেভাবে তিনি চান, হয় নিজে স্বয়ং কিংবা আরেকজন । যে ভবঘুরে আত্মারা দেহের খোঁজে বেরিয়েছে, তাদের মতন, তিনি প্রবেশ করেন, যখনই তিনি চান, সকলের চরিত্রে । শুধুমাত্র তাঁর কাছে, সবকিছুই ফাঁকা, তা এইজন্যে যে তাঁর দৃষ্টিতে সেখানে যাওয়ার পরিশ্রম করার কোনো মানে হয় না যেখানে যাওয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ ।
    একা, চিন্তামগ্ন পথচারী এই সর্বজনীন অংশীদারিত্বে খুঁজে পান একক মাদকতা । যে মানুষ ভিড়কে বিয়ে করেন, তিনি অতিব্যাকুল মহানন্দ উপভোগ করেন, যা থেকে অহংকারীরা বঞ্চিত, যারা সিন্দুকের মতন তালা দেয়া, আর অলসদের ভাগ্যেও তা জোটে না, যারা ঝিনুকের মতন নিজেতেই আবদ্ধ । তিনি তাঁর কাছে ঘটণাচক্রে উপস্হাপিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে, সমস্ত রকমের আনন্দ আর সমস্ত দুঃখযন্ত্রণাকে নিজের করে তোলেন ।
    লোকেরা যাকে প্রেম বলে মনে করে তা এতো ক্ষুদ্র, এতো সীমাবদ্ধ, এতো দুর্বল, সেই অনির্বচনীয় মহোল্লাসের তুলনায়, আত্মার পবিত্র বেশ্যাবৃত্তি যা সম্পূর্ণ নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তার যাবতীয় কবিতা ও পরার্থবাদিতা, অভাবনীয়দের কাছে, অচেনাদের কাছে, যেমন যেমন তারা দেখা দেয় তাদের কাছে বিলিয়ে দেয় ।
    যারা এই জগতের সৌভাগ্যবান তাদের শিক্ষিত করে তোলা অনেক সময়ে ভালো, যদি তাতে তাদের মূর্খ গর্বকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে দেয়া যায়, অর্থাৎ তারা যা জানে তার চেয়ে আরেক উচ্চতর আনন্দ আছে, বিশাল ও অধিকতর সংস্কৃতিসম্পন্ন । বসতের প্রতিষ্ঠাতারা, জনগণের চালকরা, জগতের সীমায় নির্বাসিত মিশনারি যাযকরা, সন্দেহ নেই যে তাঁরা এই রহস্যময় মাদকতা সম্পর্কে যৎসামান্য জানেন ; আর তাঁদের প্রতিভা থেকে তাঁদের হৃদয়ে যে বিশাল পরিবারের জন্ম হয়েছে, তাঁরা অনেক সময়ে সেই লোকগুলোকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন যারা তাদের কষ্টপূর্ণ ভাগ্য আর পবিত্র জীবন নিয়ে হাহুতাশ করে ।

    তেরো
    বিধবারা
    অভিজাত ভভেনার্গুস বলেছেন যে জনগণের বাগানে এমন সমস্ত হাঁটাপথ আছে যার ওপর নিরাশ উচ্চাকাঙ্খী, অভাগা আবিষ্কারক, ব্যর্থ সাফল্যের লোক, ভাঙা হৃদয়, ভুত চরে বেড়ায়, সেই সব বন্ধ আত্মার দল যাদের মধ্যে ঝড়ের শেষ দীর্ঘশ্বাস এখনও গুরুগুরু আওয়াজ তোলে, আর যারা হাসিখুশি ও অলস লোকেদের দুর্বিনীত চাউনি দেখে নিজেদের গুটিয়ে নেয় । এই ধরণের ছায়াময় আশ্রয়গুলো হলো জীবনে মার খাওয়া সেই সমস্ত মানুষের মিলনস্হল। তাছাড়া, কবি ও দার্শনিকরা নিজেদের প্রিয় অনুমানগুলো এই ধরণের জায়গায় যাচাই করতে চান। এখানে আছে এক বিশেষ ধরণের পুষ্টিসাধক খাবার । কেননা, যদি কোনও একটা জায়গা থাকে যেখানে তাঁরা প্রবেশ করতে ঘৃণা বোধ করেন, তা হল এইটি, যার কথা আমি বললুম, জায়গাটা হলো বৈভবের আনন্দ উপভোগ করার । এই ফাঁকা ঘনঘটায় তাঁদের আকর্ষণ করার কিছুই নেই। বরং বিপরীত, তাঁরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষিত বোধ করেন তার প্রতি যা দুর্বল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুর্দশাগ্রস্ত, অনাথ ।
    অভিজ্ঞ চোখ কখনও প্রবঞ্চনা করে না । এই সমস্ত অনমনীয় বা পেটানো বৈশিষ্ট্যে, এই সমস্ত শূন্য, ফ্যালফেলে চোখে, বা ধ্বস্তাধস্তির শেষ আলোয় যা তখনও দীপ্যমান, এই সমস্ত গভীর ও অসংখ্য কুঞ্চনে, এই সমস্ত শ্লথ ও ভাঙাচোরা চলনভঙ্গীতে, ক্ষণিকের মধ্যে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয় তাদের প্রতারিত প্রেমের, অব্যাখ্যাত আত্মোৎসর্গের, ব্যর্থ প্রয়াসের, ক্ষুধার এবং মুখ বুজে সহ্য করে নেয়া শীতের অসংখ্য কিংবদন্তিগুলোকে ।
    তুমি কি কখনও লক্ষ্য করেছ ফাঁকা বেঞ্চে বসে থাকা গরিব বিধবাদের ? তারা শোকপালন না করলেও, সহজেই চেনা যায় । আর তাছাড়া, গরিবদের শোকপালনে সর্বদা কিছুর অভাব থাকে, সমন্বয়ের অনুপস্হিতি যা তাদের হৃদয়কে আরও ভেঙে ফ্যালে । তারা তাদের মর্মযন্ত্রণায় সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় । ধনীরা নিজেদের মর্মযন্ত্রণাকে সবাইকে দেখিয়ে বয়ে বেড়াতে পারে।
    কে সেই সবচেয়ে দুঃখী ও অত্যন্ত মর্মন্তুদ বিধবা, যে একজন শিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে সে নিজের চিন্তাধারা ভাগাভাগি করতে পারে না, নাকি যে একেবারে একা ? আমি জানি না ...। একদিন এমন হয়েছিল যে আমি অনেকক্ষণ ধরে একজন বয়স্ক, ভারাক্রান্ত দেখতে বিধবাকে অনুসরণ করছিলুম ; সে ছিল ঋজু, সোজা পিঠ, পুরোনো ছেঁড়া শালে ঢাকা দেওয়া, তার সমস্ত অস্তিত্ব থেকে নির্বিকার গর্বের ছটা প্রকাশিত হচ্ছিল । দেখে সহজে বোঝা যাচ্ছিল যে বার্ধক্যের কৌমার্যের পরম একাকীত্বের অভ্যাসে সে দণ্ডপ্রাপ্ত, আর পুরুষালী চলনভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছিল কঠোর আত্মসংযমের রহস্যময় কটূতা । আমি বলতে পারব না কোন বাজে রেস্তরাঁয় সে দুপুরের খাবার খেয়েছিল, কিংবা কেমন করে খেয়েছিল । আমি তাকে জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত পাঠাগার পর্যন্ত অনুসরণ করলুম ; আর যখন সে একদা কান্নায় পুড়ে যাওয়া সক্রিয় চোখ দিয়ে সংবাদপত্রে অনুসন্ধান করছিল, ব্যক্তিগত আগ্রহের কোনো জরুরি খবরের, তখন অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে নজর রাখলুম।
    শেষ পর্যন্ত, দুপুরবেলা, হেমন্তের মনোরম আকাশের তলায়, সেই ধরণের আকাশ যেখান থেকে ঝরে পড়ে অজস্র পশ্চাত্তাপ আর স্মৃতি, সে পার্কের এক কোনায় বসে, ভিড় থেকে দূরে, শোনার চেষ্টা করছিল, প্যারিসবাসীদের প্রিয় সেনাবাহিনীর কনসার্টের সঙ্গীত ।
    সন্দেহ নেই যে এই নিষ্পাপ বুড়ির সাময়িক আমোদ ( অথবা এই বিশুদ্ধিপ্রাপ্ত বুড়ির ), বন্ধুহীন, কথাবার্তাহীন, সঙ্গীহীন, দুর্বহ দিনগুলোয়, যা ঈশ্বর তাঁর ওপরে হয়তো বহু বছর যাবত চাপিয়ে দিয়েছেন, তা সুঅর্জিত সান্ত্বনা ! বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ।
    আরেকজনের কথা :
    ভিড়ের ফালতু লোকেরা, যারা বেড়া ঠেলে কোনো প্রকাশ্য কনসার্টে ঢুকে পড়তে চায়, তাদের দিকে কৌতূহলভরে না তাকিয়ে আমি থাকতে পারি না, তা সম্পূর্ণ সমবেদী না হলেও । রাতের আনন্দের গানে, আহ্লাদের বিজয়কেতনে, অর্কেস্ট্রা ছড়িয়ে পড়ে । পোশাক পেছনদিকে ঝোলে আর ঝলমল করে, চাউনির অদলবদল হয় ; যারা অলস, কোনো কাজকর্ম না করেও জীর্ণ, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গীত উপভোগ করার শ্রমবিমুখ ভান করে । এখানে ঐশ্বর্য ছাড়া আর কিছু নেই, আনন্দধারা ব্যতীত আর কিছু নেই ; বেঁচে থাকার জন্য যে শ্বাসপ্রশ্বাস বেপরোয়া আনন্দকে উৎসাহিত করে ; কিচ্ছু নয়, ওইখানে ভিড়ের দৃশ্য ছাড়া, যারা বাইরের বেড়ায় হেলান দিয়ে আছে, বিনা পয়সায় সঙ্গীতের সামান্য রেশ শুনতে পাচ্ছে, বাতাসকে ধন্যবাদ, তারা দেখতে পাচ্ছে তাঁবুর ভেতরের ঝকমকানি ।
    গরিবের চোখে ঐশ্বর্যশালীদের আনন্দের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া সব সময়েই বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক । কিন্তু সেই দিন, এই লোকগুলো, যারা তাদের কাজকরার আঙরাখা পরে আছে, আর তাদের সুতির জামা, তাদের ছাপিয়ে আমার চোখে পড়ল এমন একজন অভিজাত মহিলার দিকে যিনি এই ঘিরে-থাকা গেঁয়োগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত । একজন ঢ্যাঙা, মর্যাদাপূর্ণ রমণী, এমন এক মহিমাময়ী চারিত্র্য যে আমি মনে করতে পারলুম না অতীতে অভিজাত সুন্দরীদের জমায়েতে এমন কাউকে দেখেছি । তাঁর উন্নত সততার সুগন্ধ উদ্ভাসিত হচ্ছিল তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব থেকে। তাঁর মুখশ্রী ছিল দুঃখী আর রোগা, শোকের যে আনুষ্ঠানিক পোশাক তিনি পরেছিলেন তার সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খাচ্ছিল । এবং তিনিও, সাধারণ নাগরিকদের মতন, যাদের মাঝে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন আর যাদের উপস্হিতি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না, তিনি আলোকময় জগতকে গভীর আগ্রহে অবলোকন করছিলেন, শোনার সময়ে মৃদু মাথা দোলাচ্ছিলেন।
    একটি একক দিব্যদৃশ্য ! “নিঃসন্দেহে”, আমি নিজেকে বললুম, “ওনার দারিদ্র্য, যদি তা দারিদ্র্য হয়, তার জন্য অর্থগৃধ্নুতার মিতব্যয়ীতার প্রয়োজন ছিল না ; ওই মহিমান্বিত মুখশ্রী তার প্রমাণ। কিন্তু কেনই বা উনি জেনেশুনে অমন পরিপার্শ্বের অংশ হতে চাইলেন, যার মাঝে তিনি উজ্বল বিবর্ণতার মতন দাঁড়িয়ে আছেন ?”
    কিন্তু কৌতূহলবশত যখন ওনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলুম, কারণটা আমি আঁচ করতে পারলুম। দীঘাঙ্গী বিধবাটি একটি শিশুর হাত ধরেছিলেন, তাঁর মতনই কালো পোশাকে ; ঢোকার টিকিটের দাম যুক্তিযুক্ত ছিল, সেই টাকাটা হয়তো বাচ্চাটার কোনো প্রয়োজন মেটাতে লাগবে, কিংবা, আরও ভালো হয়তো, বিলাসদ্রব্য বা খেলনা কেনা যাবে।
    আর উনি হেঁটে বাড়ি ফিরবেন, নিজের চিন্তা ও স্বপ্নে মগ্ন, একা, সর্বদা একা ; কেননা বাচ্চারা চেঁচামেচি করে, একলষেঁড়ে হয়, শান্তস্বভাব হয় না, ধৈর্যশীল হয় না ; আর একাকীত্বের দুঃখ লাঘবের জন্য বাচ্চাটা, সত্যিকার জানোয়ারের মতন, কুকুর বা বিড়ালের মতন, তাঁর অন্তরঙ্গ হতে পারে না ।

    চোদ্দ
    বুড়ো সঙ
    ছুটির দিনের ভিড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল সর্বত্র, মৌজমস্তিতে ব্যস্ত । দিনটা সেই ধরণের উৎসবের ছিল যখন রাস্তার মাদারিরা, দড়াবাজিকররা, পশুর খেলা দেখিয়েরা, ভ্রাম্যমান ফেরিঅলারা, সারা বছরের দুরবস্হাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য চিরকাল এই দিনটির ওপর নির্ভর করেছে । এই রকম দিনে আমার মনে হয় লোকেরা সবকিছু ভুলে যায়, ভালো দিনকাল আর ব্যস্ত কাজকর্ম থেকে মুক্ত ; তারা হয়ে যায় বাচ্চাদের মতন । ছোটোদের জন্য এটা একদিনের ছুটি, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য স্কুলের আতঙ্ক থেকে মুক্তি ; বড়োদের জন্য, দিনটা জীবনের অপকারী ক্ষমতার সঙ্গে ঘোষিত বোঝাপড়ার, শেষহীন সংগ্রামের বিবাদ-বিতর্ক থেকে সাময়িক আরামের। এমনকি সমাজকর্মী আর আধ্যাত্মিক শ্রমে নিযুক্ত মানুষের পক্ষেও এই সর্বাত্মক বিজয়ানন্দের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয় । অপেক্ষা না করেই, তাঁরা তাঁদের অংশের বেপরোয়া বাতাবরনে মিশে যান । আমার কথা বলতে গেলে, সত্যিকার একজন প্যারিসবাসীর মতন, আমি এই ধরণের সমারোহপূর্ণ সুযোগে পথের ধারের ঘুপচি-দোকানগুলোকে নিরীক্ষণ করতে ছাড়ি না ।
    আর তারা নিজেদের মধ্যে হইচই করে প্রতিযোগীতা করে : তারা তারস্বরে চিৎকার করে, ষাঁড়ের মতন চেঁচায়, নেকড়ের মতন ডাক পাড়ে । তা ছিল সব রকম ধ্বনির মিশেল, বাসনের ঘ্যাঙঘ্যাঙ আর বাজি ফাটাবার আওয়াজ । লাল পোশাকে সারিবদ্ধ দড়াবাজিকর আর ডিগবাজি-খাওয়া ভাঁড়েরা তাদের রোদে-পোড়া , বাতাসে, বৃষ্টিতে আর সূর্যের তাপে ক্ষয়ে যাওয়া মুখে, ভেংচি কাটছিল । আত্মবিশ্বাসী অভিনেতারা নিজেদের প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত, তারা চালাক-চতুর ঠাট্টার গল্প বলছিল, মলিয়েরের কমেডির মতন যা একঘেয়ে আর আগেই আঁচ করা যায় । পালোয়ানরা, তাদের বড়সড় অঙ্গ সম্পর্কে গর্বিত, ওরাঙওটাঙের মতন কপাল আর করোটি, আঁটোসাঁটো লোকদেখানো পোশাকে ডিগবাজি খেয়ে বেড়াচ্ছিল, আগেভাগে পোশাক কাচিয়ে নিয়েছিল । নর্তকীরা, পরী কিংবা রাজকন্যার মতন সুন্দরী, দুলছিল আর তিড়িংবিড়িং করছিল, লন্ঠনের আলোয় তাদের ঘাগরা ঝকমক করছিল । সবকিছুতেই ছিল দীপ্তি, ধুলো, চেঁচামেচি, আনন্দ, হই্হল্লা ; কিছু লোক টাকাকড়ি খরচ করল, যখন কিনা অন্যদের লাভ হলো, দুই পক্ষই সমানভাবে খুশি । বাচ্চারা মায়ের পোশাকের খুঁট ধরে লজেঞ্চুশ পাবার আশায় হাঁটছিল, কিংবা তাদের বাবার কাঁধে চেপে ম্যাজিকঅলার দেবতাসূলভ চমৎকারিত্ব দেখছিল । আর সর্বত্র, সব রকমের গন্ধ ছাপিয়ে, চর্বি ভাজার সুবাস ঘুরপাক খাচ্ছিল, যেন তা উৎসবের ধুপধুনো ।
    সবার পেছনে, দুই ধারের দোকানসারির একেবারে শেষে, যেন এই সমস্ত ঘনঘটা থেকে নিজেকে লজ্জায় নির্বাসন দিয়েছে, আমি একজন বুড়ো সঙকে দেখতে পেলুম, ঝুঁকে পড়েছে, রুগ্ন, জরাজীর্ণ, একজন মানুষের ধ্বংসাবশেষ, তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে আছে ; কোনো বুনো বর্বরের চেয়েও ছেঁড়াখোঁড়া তাঁবু, সেখানে দুটো ফুরিয়ে-আসা মোমবাতি, দপদপ করছিল আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁবুর দারিদ্র্য ।
    সর্বত্র, উল্লাস আর মুনাফা আর অসংযম ; সর্বত্র কালকের খাবারের আশ্বাস ; সর্বত্র জীবনীশক্তির ব্যস্ত উচ্চরব । এখানে, চরম দুরবস্হা, পোশাক পরানো দুরবস্হা, যাতে আতঙ্ককে তীব্রতর করা যায়, হাস্যকর কাঁথায়, যে অবস্হায় শিল্পের তুলনায় প্রয়োজন তৈরি করেছে বৈপরীত্য । লোকটা, দীনদরিদ্র, হাসেনি ! লোকটা ফোঁপায়নি, লোকটা নাচেনি, লোকটা অঙ্গভঙ্গী করেনি, লোকটা চেঁচায়নি ; লোকটা কোনো গান গায়নি, তা সে মজার হোক বা দুঃখের ; লোকটা ভিক্ষা চায়নি । লোকটা ছিল চুপচাপ আর স্হির । লোকটা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, লোকটা অধিকার ত্যাগ করে দিয়েছিল । ওর নিয়তি ছিল নিশ্চিত । কিন্তু ভিড় আর আলোর স্পন্দিত জোয়ার ওর বীভৎস দারিদ্র্যের কয়েক পা দূরত্বে এসে থেমেছিল, ওর চাউনি ছিল গভীর জ্ঞানপূর্ণ, ভোলা যায় না এমন ! আমি অনুভব করলুম আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে বায়ুরোগের ভয়ঙ্কর প্রকোপে, আর আমি অনুভব করলুম যে আমার নিজের দৃষ্টি দ্রোহের কান্নায় মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যা থেকে অশ্রু ঝরবে না ।
    তাহলে কীই বা করি ? ছেঁড়া পর্দার পেছনে, অভাগা লোকটাকে যদি জিগ্যেস করি যে এই ছায়ার আড়ালে আমাকে দেখাবার মতন কোন আশ্চর্য , কোন কৌতূহল-জাগানিয়া ব্যাপার আছে, তাতে কী উপকার হবে ? আর সত্যি বলতে, আমার সাহস হলো না ; আর যদিও আমার ভীতির কারণ শুনে তুমি হাসবে, আমি দিব্বি করে বলতে পারি যে আমার ভয় করছিল লোকটাকে অপমান করে ফেলব । শেষ পর্যন্ত, নিজেকে বুঝিয়ে, আমি ঠিক করলুম যে লোকটার পাটাতনের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে কিছু টাকা তার ওপর রেখে দেব, এই আশায় যে সে আমার অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করবে, অথচ সেই সময়েই কোনো অজানা উৎসাহের আকস্মিক ঢেউয়ে ভিড়ের ঠেলায় আমি ওর থেকে অনেকটা দূরে চলে এলুম ।
    আর, বাসায় ফেরার পথে, এই দৃশ্যের আচ্ছন্নতায়, আমি আমার আকস্মিক দূঃখকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলুম, আর নিজেকে বললুম : আমি এক্ষুনি একজন বৃদ্ধ সাহিত্যিকের স্পষ্ট ছবি দেখলুম যে সেই প্রজন্মের চেয়ে অধিককাল বেঁচেছে যে প্রজন্মকে সে এক সময় মেধাবী আনন্দ দিয়েছিল ; বন্ধুহীন একজন বুড়ো কবি, পরিবারহীন, সন্তানহীন, দারিদ্র্যের আর জনগণের অকৃতজ্ঞতা দ্বারা বিধ্বস্ত, তাঁবুর আড়ালে যেখানে ভুলো জগৎ আর ঢুকতে চায় না !

    পনেরো
    কেক
    আমি পর্যটনে বেরিয়েছিলুম । যে ভূদৃশ্যে আমি নিজেকে পেলুম তা ছিল চমৎকারিত্ব ও মহনীয়তায় অপ্রতিরোধ্য । এর কিয়দংশ নিঃসন্দেহে আমার অস্তিত্বে প্রবেশ করেছিল ।
    আবহের সমান সহজতায় আমার চিন্তাধারা উড়াল পেলো ; গেঁয়ো আবেগ, যেমন ঘৃণা ও নিষিদ্ধ প্রেম, মনে হতে লাগল আমার পায়ের নীচে বহুদূরের মেঘদলের মতন ভেসে
    গেছে গভীর অতলে ; আমার ওপরে ঘিরে থাকা আকাশের গম্বুজের মতন বিশাল আর বিশুদ্ধ অনুভব করছিল আমার আত্মা ; বহুদূরের, পাহাড়ের ঢালে আরেক পর্বতমালায় অদৃশ্য চারণভূমির গরুদের ঘণ্টাধ্বনির মতন আমার স্মৃতির পার্থিব ব্যাপার হৃদয়ে এসে দুর্বল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল । স্হির ছোটো জলাশয়ে, তার অতল গভীরতার কারণে কালো, মেঘের ছায়ারা বয়ে যাচ্ছিল, যেন আকাশে ডানাঅলা উড়ন্ত দৈত্যের আলখাল্লার ছায়া । আর আমার মনে পড়ছে সেই সমারোহপূর্ণ, বিরল সংবেদন, ব্যপ্ত নিখুঁত স্তব্ধ সঞ্চরণের দ্বারা উদ্ভূত, আমার অন্তরে সৃষ্টি করেছিল মহোল্লাস ও ভয়ের মিশ্রণ । সংক্ষেপে, আমি অনুভব করছিলুম, আমার চতুর্দিকের উদ্দীপনাময় সৌন্দর্যকে ধন্যবাদ, নিজের ও ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে পরম শান্ত এক সম্পর্ক ; আমি বিশ্বাস করি, আমার পূর্ণ সুখে, আর পৃথিবীর যাবতীয় শয়তানিকে ভুলে যাওয়ায়, আমার এমনকি মনে হতে লাগল সংবাদপত্ররা যে দাবি করে যে মানুষ সৎ হয়ে জন্মায় তা তেমন হাস্যকর নয় । --- কিন্তু যখন জাগতিক প্রয়োজনীয়তা তার চাহিদা মেটাতে চাইলো, আমার মনে হল এতো উঁচুতে চড়ার দরুণ যে ক্লান্তি আর ক্ষুধা দেখা দিয়েছে তা মেটানো দরকার । পকেট থেকে একটা বড়ো রুটির টুকরো, চামড়ার কাপ, আর তখনকার দিনে ডাক্তাররা পর্যটকদের যে ধরণের টনিক দিতেন আর তাতে গলিত তুষার মেশানো যেতো, তার ফ্লাস্ক বের করলুম। রুটিটা চুপচাপ কাটতে লাগলুম, তখনই একটা মৃদু শব্দ আমাকে ওপরে তাকাতে বাধ্য করল । আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছোট প্রাণী, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে আর অবিন্যস্ত, যার ফাঁকা চোখের কোটর, আরণ্যক, আর যেন মিনতি করছে, রুটিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। আর আমি তার নিচুস্বর, কর্কশ কন্ঠের দীর্ঘশ্বাস মেশানো, “কেক” উচ্চারণ শুনতে পেলুম ! আমার মামুলি রুটিকে ওই শব্দে সন্মান করার দরুণ না হেসে থাকতে পারলুম না, আর আমি একটা বড়ো টুকরো কেটে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলুম । ও ধীরে এগিয়ে এলো , ঈর্ষার বস্তুটি থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই ; তারপর হঠাৎই, রুটির টুকরোটা হাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে, তাড়াতাড়ি পেছিয়ে গেলো, যেন ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে আমার উপহার হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিংবা বলে ফেলে আমি পশ্চাত্তাপ করছি।
    কিন্তু সেই মুহূর্তে আরেকজন বুনো কে জানে কোথা থেকে এসে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর দুজনকে এমন একইরকম দেখতে যে মনে হচ্ছিল ওরা যমজ ভাই । দুজনে ধুলোয় গড়াগড়ি খেলো, দামি শিকারের লোভে, মনে হচ্ছিল দুজনেই নিজের ভাইকে অংশ দিতে চায় না । প্রথম জন, হতাশায়, দ্বিতীয়জনের চুলের মুঠি ধরল । দ্বিতীয়জন প্রথমজনের কান দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল, আর অমার্জিত শব্দে গালাগাল দিয়ে রক্তমাখা থুতু ফেলল । কেকের বৈধ দাবিদার চেষ্টা করল দখলদারের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে ; পরবর্তীজন তার হাত দিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা টিপে ধরতে চাইল, আর অন্য হাত দিয়ে জিতে নেয়া পুরস্কার পকেটে পুরে ফেলতে চাইলো । কিন্তু হতাশায় চাগিয়ে উঠে, পরাজিতজন গায়ের পুরো শক্তি খাটিয়ে বিজয়ীর পেটে মাথার ধাক্কা মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো । কিন্তু একটা নোংরা লড়াই, যা তাদের বালকসূলভ চেহারার তুলনায় বেশিক্ষণ বজায় ছিল, তা বর্ণনা করে কীই বা হবে ? মুহূর্তে-মুহূর্তে কেকটার হাতবদল আর পকেটবদল হতে থাকলো ; কিন্তু, হায়, তার পরিমাণেও পরিবর্তন ঘটতে থাকলো ; আর সব শেষে, ক্লান্ত হয়ে, শ্বাসের জন্যে হাঁপিয়ে, রক্তাক্ত, তারা থামলো, কেননা আর লড়াই করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে, লড়াই করার জন্যে বাঁচেনি কিছুই ; রুটির টুকরোটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল গুঁড়ো হয়ে, বালুকণায় মিশে গিয়ে আর পার্থক্য করা যাচ্ছিল না ।
    ঘটনাটার দরুণ ভূদৃশ্য ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল আমার সামনে, আর এই দুই ক্ষুদে মানুষ আসার আগে আমার আত্মা যে শান্তি উপভোগ করছিল তা সম্পূর্ণ উবে গিয়েছিল; কিছুক্ষণের জন্যে আমার মন বেশ ভারাক্রান্ত ছিল, আমি নিজেকে বলছিলুম : “আচ্ছা, তাহলে, একটা চমৎকার দেশ যেখানে রুটিকে বলা হয় কেক, এক বিরল উপাদেয় যা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট !”

    ষোলো
    ঘড়ি
    বিড়ালের চোখ দেখে চীনারা সময় বলে দিতে পারে ।
    একদিন একজন যাযক, নানকিঙের শহরতলির পথ দিয়ে যাবার সময়ে, তাঁর মনে পড়ল যে ঘড়ি পরে আসতে ভুলে গেছেন, আর একটি ছোটো ছেলেকে জিগ্যেস করলেন এখন কয়টা বেজেছে।
    চীন সাম্রাজ্যের লোচ্চা ছোঁড়া প্রথমে ইতস্তত করল ; তারপর ভেবে নিয়ে বলল, “আমি গিয়ে তোমার জন্য জেনে আসছি”। কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এলো, একটা মোটা বিড়ালকে সঙ্গে নিয়ে, আর বিড়ালের চোখ দেখে, তার শাদা অংশের দিকে তাকিয়ে, লোকে যেমন বলে থাকে, কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঘোষণা করল : “এখনও দুপুর হয়নি।” কথাটা সত্যি ।
    আমার কথা যদি বলি, যখন আমি আমার সুন্দর ফিলিনের দিকে ঝুঁকি, বেশ ভালো নাম, যে তার যৌনতার জন্য সন্মানিত, আমার হৃদয়ের গর্ব, আর আমার আত্মার সুগন্ধ -- তা সে রাত হোক বা দিন, ঝলমলে আলোয় কিংবা আবছা ছায়ায় -- তার আদরযোগ্য চোখের গভীরতায় আমি নিখুঁত সময় দেখতে পাই, সর্বদা একই সময়, বিশাল একটি সময়, সৌন্দর্যমণ্ডিত, এবং শূন্যতার মতন শৌর্যময়, মিনিট ও সেকেণ্ডের বিভাজন ছাড়াই -- স্হির একটা সময় যা ঘড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট নয়, কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের মতন হালকা, চোখের পাতা ফেলার মতন দ্রুত ।
    আর যখন আমি সুন্দর ঘড়িমুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি সেই সময়ে কেউ এসে যদি আমাকে বিরক্ত করে, যদি কোনো অসৎ ও অসহ্য জিনপরী, খারাপ সময়ের কোনো দানব এসে বলে, “এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ ? এই প্রাণীর চোখে তুমি কী খুঁজছ ? তুমি কি সময় দেখছ, ওহে অলস, অপচয়ী নশ্বর ?”-- কোনো দ্বিধা না করেই আমি জবাব দেবো : “হ্যাঁ, আমি সময়কে দেখছি ; তা হলো অনন্তকাল !”

    সতেরো
    মেয়েটির কেশদামের গোলার্ধ
    আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।
    আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে -- যাকিছু আমি অনুভব করি -- তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে ।
    তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।
    তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।
    তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।
    আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।
    আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।

    আঠারো
    সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ
    এক দারুণ দেশ আছে, কোকেইন নামের দেশ, লোকে বলে, সেখানে আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে যাবার স্বপ্ন দেখি । তুলনাহীন দেশ, উত্তরের কুয়াশায় ডোবা, যাকে বলা যায় পাশ্চাত্যের প্রাচ্য, ইউরোপের চীন, তেমন অবাধ নিয়ন্ত্রণ তপ্ত, খেয়ালি কল্পনার উৎসার ঘটায় না, আর তাই ধৈর্য ধরে ও জেদে তার গূঢ় ও অপলকা বনানীর স্বপ্নবিলাস এঁকে রাখেনি।
    সত্যকার এক কোকেইন দেশ, যেখানে সমস্তকিছু সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, নিখুঁত ; যেখানে শৃঙ্খলার সঙ্গে বিলাস নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে উদ্বাহু ; যেখানে জীবন শ্বাস নেবার জন্য মোহময় ও মিষ্টি ; সেখান থেকে বিশৃঙ্খলা, উথালপাথাল, এবং যা অচিন্তিতপূর্ব তা নির্বাসিত ; সেখানে নৈঃশব্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আনন্দের ; সেখানে রান্না করার ব্যাপার একই সঙ্গে কাব্যিক, মূল্যবান ও উৎসাহবর্ধক ; সেখানে, হে প্রিয় দিব্যতা, সব কিছু তোমার সদৃশ ।
    তুমি তো জানো আমাদের শীতল দুঃখযন্ত্রণার দিনগুলোতে যে জ্বরময় অসুখ ঘিরে ধরে, সেই অজানা দেশের জন্য মনকেমন, কৌতূহলপ্রসূত উদ্বেগ ? একটা দেশ আছে যা তোমার সদৃশ, সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, এবং নিখুঁত, যেখানে কল্পনা সৃষ্টি করেছে আর সাজিয়েছে এক পাশ্চাত্য চীনদেশ, যেখানে শ্বাস নেবার জন্য জীবন বেশ মিষ্টি, যেখানে আনন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নৈঃশব্দের । সেখানেই আমাদের সকলের যাওয়া উচিত, আমাদের উচিত সেখানে গিয়ে মারা যাওয়া !
    হ্যাঁ, শ্বাস নেবার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য, এবং সময়কে সংবেদনের অনন্তকালীনতা দেবার জন্য, আমাদের যাওয়া উচিত । একজন সঙ্গীতকার ওয়াল্টজ নৃত্যে নিমন্ত্রণ নামে সুর বেঁধেছিলেন ; কোথায় সেই লোক যিনি সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ-এর সুর বাঁধবেন, যা প্রিয়তমাকে উপহার দেয়া যায়, নির্বাচিত বোনকে দেয়া যায় ?
    হ্যাঁ, সেই আবহাওয়াতে বেঁচে থাকা হয়ে উঠবে শ্রেয় -- সেই দূরদেশে, যেখানে স্তিমিত সময়ে বহু চিন্তা একত্রিত হয়, যেখানে ঘড়িগুলো গভীর, অর্থময় শান্তিতে আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি করে । জানালার ঝিকমিকে শার্শিতে, কিংবা গিল্টি-করা দামি কালো চামড়ার ওপরে, চুপচাপ বাস করে আশীর্বাদময়, শব্দহীন, গূঢ় পেইনটিঙ, যেন তা সেই চিত্রকরদের আত্মা যাঁরা সেগুলো সৃষ্টি করেছেন । অস্তগামী সূর্য, যা অভ্যর্থনাঘরের খাবার জায়গায় এমন রঙ এনেছে, সুন্দর পর্দার কাপড়ে সাজানো কিংবা দীর্ঘ জানালায় সীসার পাতলা পটি দিয়ে বাঁধানো একাধিক শার্শি ।
    কাঠের আসবাবগুলো বিশাল, কৌতূহলময়, অদ্ভুত, এবং সূক্ষ্ম আত্মার মতন তালা ও গোপনতা দিয়ে বন্ধ । আয়নাগুলো, বাসনকোসন, আচ্ছাদন, সোনার থালা, আর মাটির জিনিসপত্র চাউনির জন্য বাজায় এক মৃদু, রহস্যময় সঙ্গীত ; আর সবকিছু থেকে, কোনাগুলো থেকে, দেরাজের ফাঁকগুলো থেকে, পর্দার ভাঁজ থেকে, এক একক সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সুমাত্রার এক স্মৃতিচিহ্ণ, গৃহের আত্মার মতন এক সুবাস ।
    সত্যকার এক কোকেইন দেশ, আমি বলি, যেখানে সকলে ধনী, পরিচ্ছন্ন, এবং সুস্হ বিবেকের মতন উজ্বল, রান্নার বাসনকোসনের মতন চমৎকার, যেন পেটা সোনার মতন, বহুরঙা অলঙ্কারের মতন অসাধারণ ! জগতের তাবৎ ঐশ্বর্য সেখানে একত্রিত হয়, যেন কোনো এক শ্রমিকের বাসা যে সারা পৃথিবীর ধন্যবাদ অর্জন করেছে । একটি অনুপম দেশ, সবার চেয়ে উন্নত, যেমন প্রকৃতির তুলনায় শিল্প, যেখানে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নতুন করে গড়া যায়, যেখানে তা পরিশুদ্ধ, সাজানো, পুনর্নির্মিত । ওদের খুঁজতে দাও, ওরা খুঁজতে থাকুক, নিজেদের আনন্দের সীমাকে ওরা অপরিসীম বাড়িয়ে তুলুক, উদ্যানপালনবিদ্যার সেই রাসায়নিকরা !
    তাদের উচ্চাকাঙ্খী সমস্যার সমাধানের জন্য তারা ষাট কিংবা শতহাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করুক । আমার কথা যদি বলি, আমি আমার কালো টিউলিপ আর নীল ডালিয়া খুঁজে পেয়েছি !
    তুলনাহীন ফুল, পুনরাবিষ্কৃত টিউলিপ, আলঙ্করিক ডালিয়া, সেখানে আছে, নয় কি, সেই সুন্দর দেশে যা শান্তিময় আর স্বপ্নালু, যেখানে আমাদের গিয়ে প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠা উচিত ? তুমি কি তোমার নিজের তৈরি উপমা দিয়ে উদ্ভাসিত হতে চাইবে না, এবং তুমি কি সেখানে প্রতিফলিত হতে চাইবে না -- অতিন্দ্রীয়বাদীরা যেমন বলে থাকেন -- তোমার নিজের প্রতিষঙ্গে ?
    স্বপ্ন, সব সময়ে স্বপ্ন ! আর আত্মা যতো উচ্চাকাঙ্খী আর সূক্ষ্ম, সম্ভাব্য থেকে স্বপ্নেরা ততো দূরে সরে যায়। প্রতিটি মানুষ নিজের অন্তরে প্রাকৃতিক আফিমের খোরাক বয়ে বেড়ায়, অশেষভাবে লুকিয়ে রাখা আর অশেষভাবে নবায়িত, এবং জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে, প্রকৃত আনন্দের কতোটা সময় আমরা গুণতে পারি, সুচিন্তিত ও সফল কর্মকাণ্ডে ? আমরা কি কখনও বেঁচে থাকব, আমরা কি কখনও আত্মার রাঙানো নাট্যদৃশ্যে প্রবেশ করব, সেই নাট্যদৃশ্য যা তোমার সদৃশ?
    এই ঐশ্বর্য, এই আসবাবপত্র, এই বিলাসদ্রব্য, এই শৃঙ্খলা, এই সুগন্ধরাজি, এই অলৌকিক ফল, তারা সকলেই তুমি । আর তারা সকলেই তুমি, এই বিশাল স্রোত আর এই স্বচ্ছ খাল । জলবাহিত এই বিশাল নৌপোতগুলো, সবই ধনরত্নে ভরা, জাহাজের দড়িদড়া থেকে মন্ত্রের মতন জেগে ওঠা গান, তারা আমার চিন্তাধারা যেমন জাগ্রট করে, তারা তোমার বুকে ঘুমোয় আর পরিবাহিত হয় ।
    তুমি ধীরে তাদের সাগরে নিয়ে যাও যা অনন্তকালীন, তখন তুমি তোমার আত্মার সুন্দর স্পষ্টতায় আকাশের গভীরতাকে প্রতিফলিত করো --- আর তখন তারা ঢেউয়ের উথ্থানে ক্লান্ত হয়ে যায়, আর প্রাচ্যের ফলমূলে ভারি হয়ে ওঠে, আর নিজের দেশের বন্দরে ফিরে যায়, তারা তখনও থাকবে আমার চিন্তাধারা হয়ে, ঐশ্বর্যময়, আর তোমার নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে আসবে ।

    উনিশ
    গরিবের খেলনা
    আমি একটা নিরীহ ভিন্নমুখের ইঙ্গিত দিচ্ছি । কিছু বিনোদনে অপরাধবোধ নেই!
    তুমি যখন সকালে বাইরে বেরোও, মনঃস্হির করে নিয়ে যে কেবল রাজপথে ঘুরে বেড়াবে, পকেটে কয়েকটা ছোটো গ্যাজেট পুরে নাও যাদের দাম এক টাকাও নয় -- যেন একটা সুতোয় বাঁধা চ্যাপ্টা নাচ-পুতুল, কামার নেহাইয়ের ওপরে পিটছে, ঘোড়া আর তার সওয়ার, লেজ যেন হুইসিলের কাজ করছে -- আর রেস্তরাঁর সামনে, কিংবা গাছতলায়, যে গরিব বাচ্চাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাদের উপহার দিয়ে দাও । প্রথমে তাদের নেবার সাহস হবে না ; তারা তাদের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করবে না । কিন্তু তারপর তাদের ব্যগ্র হাত কেড়ে নেবে উপহার, আর নিয়ে পালাবে, যেমন বিড়ালদের তুমি যখন খাওয়াও তারা সেটা খাবার জন্য বেশ দূরে চলে যায়, মানুষকে অবিশ্বাস করার অভিজ্ঞতার দরুণ ।
    পথে এগিয়ে, বিশাল এক বাগানের গেট অতিক্রম করে, যার পেছনে দেখা যাচ্ছিল সূর্যের আলোয় ঝলকে-ওঠা সুন্দর এক বাগানবাড়ির ঔজ্বল্য, দাঁড়িয়ে ছিল এক সংস্কৃতিমান ও তরতাজা বালক, গ্রামীণ পোশাকে যা বেশ নম্র আর আকর্ষক ।
    বিলাস, দুশ্চিন্তার অনুপস্হিতি, এবং বৈভবের অভ্যাসগত প্রদর্শনী এই বালকদের এমন শোভন করে তোলে যে মনে হবে সাধারণ ও দারিদ্র্যের ছাঁচে গড়া বালকদের চেয়ে এদের গড়ার ছাঁচ আলাদা।
    তার পাশে ঘাসের ওপরে পড়ে আছে এক চমৎকার খেলনা, তার মালিকের মতনই টাটকা, চকচকে আর সোনালী, বেগুনি পোশাক পরানো, ছোটো-ছোটো পালক আর কাচের পুতি দিয়ে সাজানো । কিন্তু ছেলেটি তার প্রিয় খেলনা নিয়ে খেলছিল না ; পরিবর্তে, সে তাকিয়ে ছিল এই দৃশ্যের দিকে :
    গেটের অন্য দিকে, রাস্তার ওপর, শেয়ালকাঁটা আর জংলিঝোপের মাঝে ছিল আরেকজন বালক, অপরিচ্ছন্ন, পুঁচকে, তেলচিটে, সেই ধরণের এক অস্পৃশ্য প্রাণী যার অন্তরে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কেউ দেখলে খুঁজে পাবে, যেমনভাবে একজন বিশেষজ্ঞ আদর্শ পেইনটিঙের ভার্নিশের আবরণের তলায় প্রকৃত শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করেন, তেমন করে দারিদ্র্যের বিকর্ষক চাদর ধুয়ে ফেলে তাকে দেখতে পাবে ।
    এই প্রতীকি পাঁচিল যা দুটি জগতকে আলাদা করে রেখেছে, রাজপথের আর বাগানবাড়ির, গরিব বালকটি ধনী বালকটিকে নিজের খেলনা দেখাচ্ছিল, যে বেশ উৎসাহ নিয়ে সেটা পরখ করছিল যেন তা কোনো বিরল ও অজানা বস্তু । এখন, নোংরা ছেলেটি যে খেলনা দেখিয়ে প্ররোচিত করছিল, খাঁচার ভেতরে ঝাঁকাচ্ছিল আর দোলাচ্ছিল -- তা ছিল এক জ্যান্ত ইঁদুর ! ওর বাবা-মা, নিঃসন্দেহে ব্যয়সঙ্কোচের কারণে, জীবনযাপন থেকেই সরাসরি খেলনা যোগাড় করে ফেলেছিলেন।
    আর বালক দুজন ভাতৃত্ববোধে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছিল, সমান ঔজ্বল্যের সাদা দাঁত মেলে ।

    কুড়ি
    পরীদের উপহার
    সেদিন ছিল পরীদের বিশাল জমায়েত, বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় যারা জন্মেছে তাদের উপহার দেবার ব্যবস্হা করার জন্য ।
    নিয়তির এই সুপ্রাচীন আর খেয়ালি বোনেরা, আনন্দ আর দুঃখের এই অদ্ভুত মায়েরা, একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা : কাউকে মনে হচ্ছিল গম্ভীর আর বদমেজাজি ; আবার কেউ চঞ্চল আর দুষ্টু ; কেউ যুবতী, যারা চিরকালের জন্য যুবতী ; অন্যেরা বয়স্কা, যারা চিরকালই বয়স্কা রয়েছে ।
    যে বাবারা পরীর অস্তিত্ব বিশ্বাস করে তারা হাজির হয়েছে, প্রত্যেকের কোলে সদ্যজাত।
    উপহারগুলো, সামর্থ্যগুলো, সৌভাগ্যগুলো, অজেয় পরিস্হিতিগুলো জড়ো করা হয়েছে এক সালিশিসভার পাশে, যেমনভাবে সান্মানিক স্নাতক উৎসবে পুরস্কারগুলো একটা টেবিলের ওপরে রাখা থাকে । পার্থক্য হলো যে উপহারগুলো প্রয়াসের পরিশোধ হিসাবে নয় ; বরং বিপরীত, তারা ছিল এমন মানুষদের মর্যাদা দেবার উপলক্ষ যারা তখনও পর্যন্ত জীবনযাপন করেনি, এমন মর্যাদা যা দুঃখযন্ত্রণা অথবা, তেমনই সহজভাবে, আনন্দের খাতিরে ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে ।
    বেচারা পরীরা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কেননা দরখাস্তকারিদের সারি ছিল দীর্ঘ, আর মাঝামাঝি জগত, মানবসমাজ ও ভগবানের মাঝে, আমাদের মতনই সময়ের ভয়ঙ্কর আইন আর তার অগুন্তি সন্তানসন্ততি, দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ডকে মানতে তারা মনে হচ্ছিল বাধ্য।
    সত্যি বলতে, তারা সবাই যাযকদের অধিবেশনের দিনের মতন বিক্ষুব্ধ ছিল, কিংবা মঁ-দ্য-পিয়েতের তেজারতি কারবারিদের মতন যখন রাষ্ট্রিয় উৎসবের দিন বিনামূল্যে উত্তরণপ্রাপ্তি ঘোষণা করা হয়, তেমন । আমার সন্দেহ হলো যে সময়ে-সময়ে ওনারা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাচ্ছিলেন ঠিক যেমন মানুষ-বিচারকরা করেন যাঁরা, সকাল থেকে ঠায় চেয়ারে বসে, রাতের ভোজের , পরিবারের কথা, আর তাঁদের প্রিয় চটির ব্যাপারে দিবাস্বপ্ন দেখেন । সেকারণে যদি অতিবাস্তব বিচারের জন্য একটু ব্যস্ততা আর এলোমেলোভাব ঘটে, তাহলে অবাক হওয়া উচিত নয় যে একই ব্যাপার ঘটে থাকে মানুষের বিচারব্যবস্হাতেও । আমরা যদি অবাক হই তাহলে আমরা নিজেরাই অন্যায্য বিচারক হয়ে যাবো ।
    সুতরাং, সেদিন কয়েকটা সাঙ্ঘাতিক ভুল হয়েছিল যা মনে হতে পারে অদ্ভুত, যদি খামখেয়াল নয়, বিচক্ষণতা হয় পরীদের নির্দিষ্ট, শাশ্বত চারিত্র্য ।
    আর তাই চুম্বকের মতন বৈভব আকর্ষণের ক্ষমতা পুরস্কার হিসাবে দেয়া হলো একটি ঐশ্বর্যশালী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে, যার না ছিল পরার্থবাদীতার বোধ বা না ছিল দেখিয়ে বেড়াবার জিনিসপত্র সম্পর্কে আগ্রহ, যার ফলে কোটি কোটি অর্থের ভারে অস্বাভাবিকভাবে বিব্রত তারা শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ঘটিয়েছিল নিজেদের ।
    আর তাই সৌন্দর্য্য এবং কাব্যিক ক্ষমতার প্রতি প্রেম দেয়া হয়েছিল কৌতূকরসবোধহীন এক বুড়ো ইতর দুর্বৃত্ত, পাথরভাঙা মজুরের ছেলেকে, যে নিজের কারিগরি শেখাতে পারেনি ছেলেকে, বা তার নিন্দনীয় সন্তানের সমস্যা লাঘব করতে পারেনি ।
    বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে এই পবিত্র দিনগুলোয় বিতরণের প্রক্রিয়া পুনর্বিচারযোগ্য নয়, আর কোনও উপহার প্রত্যাখ্যান করা যায় না ।
    পরীরা সকলে উঠে দাঁড়ালো, এই মনে করে যে তাদের উঞ্ছবৃত্তি শেষ হয়েছে ; কেননা কোনো উপহার আর বাঁচেনি, দেবার মতন আর খুদকুঁড়ো ছিল না যা মানুষের ভিড়ে ছুঁড়ে দেয়া যায়, তখন একজন সাহসী লোক -- একজন ছোটোখাটো গরিব ব্যবসাদার, দেখে তাই মনে হলো--- উঠে দাঁড়ালো আর নিজের কাছের পরীর বহুরঙা বাষ্পময় পোশাক আঁকড়ে, চেঁচিয়ে উঠলো:
    “ওহ, ঠাকরুন ! আপনারা আমাদের ভুলে যাচ্ছেন ! আমার ছেলেও রয়েছে ! কিচ্ছু পাবো না বলে আমি এতোদূর আসিনি !”
    পরীটি হয়তো সত্যিই বিব্রত হয়ে থাকবে, কেননা আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু তখনই পরীটির একটা সর্বজনবদিত নিয়মের কথা মনে পড়লো যা সচরাচর প্রয়োগ করা হয়না অতিবাস্তব জগতে বসবাসকারী অননুভবনীয় প্রতিমাদের দ্বারা, মানবসমাজের বন্ধু এবং মানুষের আবেগের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য যাদের অনেক সময়ে বাধ্য করা হয়, যেমন পরীরা, যক্ষ-যক্ষিনী, উভচর প্রাণীরা, তন্বীদেবীরা, কৃশকায়াদেবীরা, জলের ভুতেরা, সন্তানবতী মানবাত্মারা আর বনকুমারীরা -- আমি বলতে চাইছি সেই আইনের কথা যা পরীদের, এইরকম ক্ষেত্রে, এমন ঘটনায়, যখন উপহারসামগ্রী ফুরিয়ে গেছে, দেবার মতো ক্ষমতা আর নেই, সম্পূরক হোক বা ব্যতিক্রম, পরীটির যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল যে তৎক্ষণাত কিছু তৈরি করে ফেলতে পারে ।
    অতএব, ভালো পরীটি বলল, তার পদমর্যাদার আত্মনিয়ন্ত্রণ খেয়াল রেখে : “আমি তোমার ছেলেকে দিচ্ছি...আমি তাকে দিচ্ছি...খুশি করার ক্ষমতা !” কিন্তু ছোটোখাটো দোকানদার, যে সাধারণের মতন চিন্তাকারীদের একজন, নিজের মনকে অসম্ভাব্যতার যুক্তিতে উন্নীত করার প্রতিভা যার নেই, এঁড়ে জেদ করে জানতে চাইলো, “কিন্তু কেমন করে খুশি করবে ? খুশি…? কেনই বা খুশি ?”
    “কেননা ! কেননা !’ বলল ক্রুদ্ধ পরীটি, লোকটির দিকে পেছন ফিরে ; আর নিজের সহকর্মীদের মিছিলে আবার যোগ দিয়ে, পরীটি সঙ্গীদের বলল, “এই আত্মাভিমানী ছোট্ট ফরাসি লোকটার সম্পর্কে কী ভাবো তোমরা, যে সবকিছু বুঝে ফেলতে চায়, আর যে, নিজের ছেলের জন্যে সবচেয়ে ভালো ভাগ্য উপহার পেয়েছে, যা জিগ্যেস করা যায় না তাইই জিগ্যেস করার সাহস দেখাচ্ছে, আর যা নিয়ে তর্ক করা যায় না তাই নিয়ে তর্ক করছে ?”

    একুশ
    প্রলুব্ধিগুলো : অথবা যৌনতা, ঐশ্বর্য, এবং খ্যাতি
    দুজন জাঁকজমকপূর্ণ শয়তান আর প্রেতিনী, কম অসাধারণ নয়, গত রাতে সেই রহস্যময় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল যে পথে নরক ঘুমন্ত দুর্বল মানুষকে আক্রমণ করে, আর তার সঙ্গে গোপন বার্তালাপ করে । আর তারা আমার সামনে এসে দ্যূতিসহ জাহির দাঁড়ালো, মঞ্চের অভিনেতাদের মতন ঋজু । আর যখন তারা রাতের অস্পষ্ট গভীরতা থেকে নিজেদের আলাদা করে এগিয়ে এলো, এই তিন ব্যক্তিত্ব থেকে গন্ধকের অত্যুজ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছিল । তাদের দেখে এতো গর্বোদ্ধত আর এতো বেশি কর্তৃত্বময় লাগছিল যে প্রথমে আমি ভেবেছিলুম তারা সত্যকার দেবতা।
    প্রথম শয়তানের মুখ ছিল দ্ব্যর্থক, আর তার দেহের কোমল রেখা আর চেহারা মনে হচ্ছিল প্রাচীনকালের গ্রিকদের আসবদেবতার মতন । তার সুন্দর, ধীরুজ চোখ, ছায়াময়, অবর্ণনীয় রঙসহ, যেন ঝড়ের দেয়া অশ্রুফোঁটায় ভেজা ভায়োলেট ফুল, আর তার দু-ফাঁক করা ঠোঁট যেন তপ্ত ধুনুচির মতন, আতর বিক্রির দোকান থেকে সুগন্ধের শ্বাস ফেলছে ; আর যখনই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, তার অগ্নিময় নিঃশ্বাস থেকে যেন কস্তুরী-সুবাসের কীটেরা উদ্ভাসিত হচ্ছে আর স্পন্দিত হচ্ছে ।
    তার বেগুনি রঙের জামায় এক উজ্বল সাপ বেল্টের মতন করে জড়ানো ছিল, আর মাথা তুলে তার দিকে অগ্নিময় অলস চোখে তাকিয়ে ছিল । এই জীবন্ত বেল্ট থেকে ঝুলছিল, ভয়ানক শিশির ফাঁকে ফাঁকে, চকচকে ছুরি আর শল্যচিকিৎসার অস্ত্রপাতি । তার ডানহাতে সে ধরেছিল আরেকটা শিশি যাতে ছিল লাল উজ্বল বস্তু, লেবেলে এই উদ্ভট কথা লেখা : “পান করো, এ হলো আমার রক্ত, উৎকৃষ্ট বলদায়ক” ; বাঁ হাতে ছিল একটা বেহালা যা স্পষ্টত তাকে সাহায্য করছিল নিজের আনন্দের আর নিজের দুঃখের গান গাইতে, আর কর্মবিরতির জন্য শাস্ত্রনির্দিষ্ট রাতে উন্মাদনার ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে দিতে ।
    তার কমনীয় গোড়ালিতে পরা ছিল সোনার ভাঙা শেকল, আর তার দরুণ যে অস্বাচ্ছন্দ্য তাকে বাধ্য করছিল মাটির দিকে চোখ নামাতে, সে আত্মশ্লাঘায় মুগ্ধ হয়ে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দেখছিল , তা ছিল পালিশ করা মণিরত্নের মতন,
    তার সান্ত্বনাতীত বেদনাময় চোখ, প্রতারণাপূর্ণ মাদকতায় চুর, সে মেলে ধরল আমার দিকে, আর সে আমাকে সঙ্গীতময় কন্ঠে বলল, “তুমি যদি চাও, তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আত্মাদের প্রভূ করে দেবো, আর তুমি জীবন্ত বস্তুর শিক্ষক হয়ে উঠবে, কাদার ভাস্করের চেয়ে বড়ো ; আর তুমি সুখানুভবের সঙ্গে পরিচিত হবে, যা শেষহীণভাবে নবায়িত হবে, তুমি নিজের কাছ থেকে মুক্তি পাবে আর অন্যদের মাঝে নিজেকে ভুলে যাবে, আর অন্যদের তাদের আত্মা থেকে টেনে বের করতে পারবে, এমন এক অবস্হায় থাকবে যেখানে তুমি তাদের থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতে পারবে না।”
    আর আমি জবাবে বললুম, “অনেক ধন্যবাদ ! অন্যের জঞ্জাল নিয়ে আমার কিছুই করার নেই, যাদের হয়তো, আমার চেয়ে বেশি মূল্য নেই । আর যখন কিনা আমার রয়েছে বহু লজ্জাজনক স্মৃতি, আমি কিছুই ভুলতে চাই না ; আর আমি যদি আগে থাকতে তোমাকে নাও চিনতুম, পুরোনো দানব কোথাকার, তোমার রহস্যময় ছুরি-চামচ, তোমার সন্দেহজনক শিশিগুলো, যে শেকল তোমার পা বেঁধে রেখেছে সেগুলো সবই এমন প্রতীক যা স্পষ্টভাবে তোমার বন্ধু হওয়ার বিড়ম্বনা ব্যাখ্যা করে । তোমার উপহার তোমার নিজের কাছেই রাখো।”
    দ্বিতীয় শয়তানের তেমন বিয়োগান্তক হাসিমুখের হাবভাব ছিল না, তেমন সূক্ষ্ম, পরোক্ষ ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণও নয়, তেমন মোলায়েম আর সুগন্ধিত সৌন্দর্যও ছিল না । লোকটা ছিল পেল্লাই, চোখহীন মস্তবড়ো মুখ, ফোলা ভুঁড়ি ঝুলে পড়েছে উরু পর্যন্ত, আর তার গায়ের চামড়া ছিল সোনালী ও ছবি আঁকা, যেন উলকি দেগে দেয়া হয়েছে, তাতে প্রতিনিধিত্ব করছিল দুঃখদুর্দশার সর্বাত্মক আঙ্গিকে খুদে-খুদে বিচরণশীল প্রাণী । সেখানে ছিল ছোট্ট রোগা মানুষ যারা স্বেচ্ছায় পেরেক থেকে ঝুলছে ; ছিল ছোট্ট, টিঙটিঙে , বিকলাঙ্গ পাতালপ্রেত যাদের মিনতিভরা চোখ তাদের কাঁপতে-থাকা হাতের তুলনায় সার্থকভাবে ভিক্ষা চাইছিল ; আর তারপর তাতে ছিল বুড়ি মায়ের দল যারা নিজেদের চোপসানো বুকে আঁকড়ে রেখেছিল রুগ্ন শিশুদের । আর ছিল অনেক কিছু।
    মোটা শয়তান নিজের পেল্লাই ভুঁড়িতে ঘুষি ঠুকলো, যার ফলে শোনা গেল দীর্ঘক্ষণ, ঠুঙঠাঙ, ধাতব আওয়াজ, যা শেষ হলো বহু মানুষের কন্ঠে অস্পষ্ট গোঙানিতে । আর ও হেসে উঠলো, অশ্লীল কায়দায় নিজের ভাঙা দাঁত দেখিয়ে, সে এক চওড়া জড়বুদ্ধি হাসি, যেমন বহু দেশে দেখা যায়, বেশি খাবার-দাবার খেয়ে কিছু লোক অমন করে থাকে ।
    আর ও আমাকে বলল, “আমি তোমাকে এমনকিছু দিতে পারি যার দরুণ তুমি সবকিছু পাবে, যা সবকিছুর দাম মেটাবে, যা প্রতিটি জিনিসকে বদলে দিতে পারবে !” আর সে নিজের দানবিক পেটে ঘুষি ঠুকলো, যার নাকিসুর প্রতিধ্বনি তার কর্কশ কথাগুলো সম্পর্কে মন্তব্যের মতন শোনালো ।
    আমি বিরক্তিতে পেছন ফিরলুম, আর জবাবে বললুম : “আমার আনন্দের জন্যে, আমি অন্যের দুঃখদুর্দশা, চাই না ; আর ওয়ালপেপারের মতন তোমার চামড়ায় আঁকা পাপগুলো, নোংরা মাখানো কোনো ঐশ্বর্য, চাই না ।”
    যদি প্রেতিনীর কথা বলি, অস্বীকার করা মিথ্যা হবে, যদি বলি যে তার মধ্যে প্রথমে অদ্ভুত একটা মনোহারিত্ব আমি পাইনি । এই মনোহারিত্বকে যে একটি মাত্র কথায় বলতে পারি তা হলো সেই সব সুন্দরী রমণীরা, যাদের সৌন্দর্য ঝরে গেছে, কিন্তু তবু যারা বুড়ি হয়নি, যাদের সৌন্দর্য ধ্বংসের তীব্র কৌতূহলের ইন্দ্রজাল ধরে রাখে । প্রেতিনী ছিল একই সঙ্গে উদ্ধত এবং জবুথবু, আর তার চোখদুটো, মেলে-মেলে ক্লান্ত, তা সত্তেও মোহিনীশক্তি বজায় রেখেছিল ।
    যা আমার সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় মনে হলো তা হলো প্রেতিনীর কন্ঠস্বরের রহস্য, যাতে আমি পেলুম স্তিমিত সুরের মাধুর্যের প্রতিধ্বনি, সেই সঙ্গে বহুক্ষণ ব্র্যাণ্ডি পান করার ফলে গলায় যে খসখসে ভাব থাকে, তাই ।
    “তুমি তোমার ক্ষমতা জানতে চাও ?” মেকি ঈশ্বরী বলল তার মনোমুগ্ধকর, স্ববিরোধী কন্ঠস্বরে।
    “শোনো ।”
    আর প্রেতিনী তার ঠোঁটে একটা বিরাট আড়বাঁশি ঠেকালো, যা থেকে ঝুলছিল একাধিক ফিতে, খেলনার বাঁশির মতন, যার ওপরে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সংবাদপত্রের নাম লেখা ছিল, আর নিজের আড়বাঁশি বাজিয়ে প্রেতিনী আমার নাম ঘোষণা করল, যা শতহাজার বজ্রধ্বনির ক্ষমতায় ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পরিসরে, আর সবচেয়ে দূর থেকে আসা উপগ্রহের প্রতিধবনির মতন ফিরে এলো আমার কাছে ।
    “প্রেতিনী !” আমি বললুম, অর্ধেক পরাভূত, “জিনিসটা দামি বটে !”
    কিন্তু ফোসলানো বাঁশিটা খুঁটিয়ে লক্ষ করে, আমার একটা অস্পষ্ট অনুভব হলো যে আমি একে চিনি, আমার জানাশোনা কয়েকজন মূর্খের সাথে কোথাও একে মদ খেতে দেখেছি ; আর আমার কানে ওর কাঁসার কর্কশ আওয়াজ আবছাভাবে মনে করিয়ে দিল এক বারবনিতাসূলভ আড়বাঁশির ।
    তাই আমি বললুম, অত্যন্ত তাচ্ছল্যে, “এখান থেকে কেটে পড়ো ! নাম বলতে চাই না এমন লোকেদের রক্ষিতাকে বিয়ে করার জন্যে আমি জন্মাইনি।”
    নিঃসন্দেহে আমার সাহসী প্রত্যাখানের জন্যে আমার গর্ববোধ করার অধিকার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমি জেগে উঠলুম, আর আমার সমস্ত শক্তি আমায় ছেড়ে চলে গেলো। “সত্যি”, আমি নিজেকে বললুম, “এই ধরণের শুদ্ধ বিবেক প্রদর্শন করার সময়ে আমি নিশ্চয়ই গভীর নিদ্রায় ছিলুম । আহ, যখন জেগে ছিলুম তখন যদি ওরা আসতো, তাহলে আমি অতো ভদ্রতা করতুম না!”
    আর আমি যতো জোরে পারা যায় চিৎকার করে ওদের বললুম, আমাকে ক্ষমা করে দিতে, তাদের অনুগ্রহ পাবার জন্যে আমি আত্মঅপমানিত হতে রাজি হলুম ; কিন্তু আমি তো ওদের বেশ অপমান করেছি, তাই ওরা আর কখনও ফেরেনি ।

    বাইশ
    গোধূলীসন্ধ্যা
    দিন ফুরিয়ে আসে । সারা দিনের খাটুনির দরুণ ক্লান্ত আত্মাগুলোর অন্তরে এক বিশাল শান্তিময়তা সৃষ্টি হয় । আর এই সময়ে তাদের চিন্তায় ফুটে ওঠে গোধুলীর অভিমানী, অনিশ্চিত রঙ।
    কিন্তু পাহাড়ের চূড়া থেকে, এক অত্যুচ্চ আর্তনাদ আমার বারান্দায় পৌঁছোয়, রাতের উঁচু পাতলা মেঘের ভেতর দিয়ে, দূরত্বের সঙ্গে মিশ-খাওয়া বিসদৃশ কান্নায় তালগোল-পাকানো বিষণ্ণ ঐকতান, ঠিক যেমন ফুঁসে-ওঠা জোয়ার কিংবা জেগে-ওঠা ঝড়ে ঘটে ।
    সেই অভাগারা কারা যারা সন্ধ্যার দ্বারা শান্ত হয় না আর যারা, পেঁচার মতন, এসে-পড়া রাতকে মনে করে অপবিত্র ডাইনির শাস্ত্রসন্মত ছুটির সংকেত ? এই অমঙ্গলের লক্ষণপূর্ণ উলুধ্বনি আমাদের কাছে আসছে পাহাড়ের ওপরের কালো আতুরাশ্রম থেকে ; আর সন্ধ্যাবেলা -- নেশা ফোঁকার সময়ে বিশাল নীরব সমতলভূমির কথা গভীরভাবে বিবেচনা করি, যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক বাড়ি যার প্রতিটি জানালায় লেখা, “এখন এখানে শান্তি বিরাজ করছে ; এখানে এখন পারিবারিক আনন্দ !” -- যখন ওখান থেকে বাতাস বয়ে আসে, আমি আমার চমকে-ওঠা চিন্তাগুলো নরকের ঐকতানের ওই অনুকরণের মাঝে খেলাতে পারি । গোধুলী পাগলদের উত্তেজিত করে। -- মনে পড়ছে আমার দুজন বন্ধু ছিল যারা গোধুলীর কারণে অসুস্হ হয়ে পড়েছিল । একজন, সেই সময়ে, প্রথমে যে তার কাছে পৌঁছোত, বন্ধুত্বের আচরণ আর বিনয়কে ভুল বুঝে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত । আমি ওকে দেখেছিলুম প্রধান সেবকের দিকে ভালোভাবে রাঁধা মুর্গির মাংস ছুঁড়ে দিতে, ও মনে করেছিল তাতে বুঝি কে জানে কোন অপমানজনক সংকেতলিপিতে লেখা বার্তা আছে । সন্ধ্যায়, সবচেয়ে স্বাদু খানাপিনার প্রথম পাত হেয় করার পর, ওর জন্য নষ্ট হয়ে যেত যাবতীয় রসালো খাদ্যবস্তুগুলো ।
    আরেকজন, নিজের উচ্চাকাঙ্খায় আহত, সূর্যাস্ত আরম্ভ হতেই ক্রমশ আরও তিক্ত, আরও বিষণ্ণ, আরও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতো । দিনের বেলায় প্রশ্রয়দানকারী আর বন্ধু, সন্ধ্যায় হয়ে উঠতো নির্দয়, আর তা কেবল অন্যদের ক্ষেত্রেই নয়, গোধূলীর পাগলামি সে নিজের ওপরেও বাঁধনছাড়া ক্রোধে প্রয়োগ করত ।
    প্রথমজন পাগল হয়ে মারা গেল, নিজের স্ত্রী আর বাচ্চাকেও চিনতে পারত না ; দ্বিতীয়জন নিজের অন্তরে অবিরাম অসুস্হতার উদ্বেগ বয়ে বেড়ায়, আর আমি বিশ্বাস করি যে রাষ্ট্র আর রাজপুত্ররা তাকে সন্মান জানিয়ে সন্তুষ্ট করতে চাইলেও, গোধুলী তার ভেতরে তবুও কাল্পনিক স্বাতন্ত্রের লোভের আগুন জ্বালিয়ে দিতো । রাত্রি, যা তাদের আত্মায় অন্ধকার পুঁতে দেয়, আমার ক্ষেত্রে আলো আনে ; আর যদিও একই ব্যাপারের দুটি ভিন্ন পরিণতি বিরল নয়, তবু ব্যাপারটা আমাকে একই সঙ্গে বিহ্বল ও সতর্ক করেছে ।
    হে রাত্রি, হে তরতাজা করে তোলা ছায়াগণ ! আমার জন্যে তুমি অন্তরের পবিত্র দিনের সংকেত, তুমি মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদানকারী ! সমতলভূমির একাকীত্বে, গলিঘুঁজির পাথুরে রাজধানী শহরগুলোয়, তুমি, ঝিলমিলে নক্ষত্রের আর রাস্তার লন্ঠনের ঝরে পড়া আলোয়, স্বাধীনতা-দেবীর আতশবাজি !
    গোধূলী, তুমি কতো মিষ্টি আর কোমল ! দিগন্তে এখনও ছড়িয়ে পড়তে থাকা গোলাপি রশ্মি, রাতের বিজয়ী অত্যাচারের চাপে দিনের মৃত্যু-সংঘর্ষের মতন, সূর্যাস্তের শেষ গৌরবের ওপারে ঘন লাল দাগ তৈরি করে দেয় ঝাড়বাতির উজ্বল আলো, পূর্বদিকের নিগূঢ়তা জুড়ে এক অদৃশ্য হাত টাঙিয়ে দেয় ঠাসবুনান কাপড়ের ঝালর --- জীবনের ম্লান সময়ে একজন মানুষের হৃদয়ে যুদ্ধরত এগুলো হলো জটিল অনুভূতির অনুকরণ ।
    কিংবা, পূনর্বার, নর্তকীরা যেমন অদ্ভুত পোশাক পরেন, যার মলিন স্বচ্ছ কাপড়ের তলায় দেখা যায় একদা বিস্ময়কর স্কার্টের ফিকে হয়ে আসা সৌন্দর্য, তেমনভাবেই বর্তমানের কালোকে স্বাদু অতীত ভেদ করে ; আর দোদুল্যমান, ছড়িয়ে-পড়া সোনা-রুপোর নক্ষত্ররা কল্পনার সেই শিখাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যা কেবল রাতের গভীর শোকে সুস্পষ্টভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে ।

    তেইশ
    একাকীত্ব
    এক উদার-হৃদয় সাংবাদিক আমাকে বলল যে মানুষের জন্য একাকীত্ব খুব খারাপ ; আর নিজের গবেষণার সমর্থনে ও উদাহরণ দিল, অবিশ্বাসীরা যেমন সদাসর্বদা দিয়ে থাকে, গির্জার যাযকদের উপদেশগুলোও তাই ।
    আমি জানি শয়তান সব সময় জনবসতিহীন অঞ্চল পছন্দ করে, আর হত্যা করার উৎসা্হ ও লালসা আশ্চর্যভাবে নিঃসঙ্গ স্হানে প্রতিপালিত হয় । কিন্তু হতে পারে যে এই নিঃসঙ্গ জায়গাগুলো কেবল অলস, নিরানন্দ লোকেদের জন্যই বিপজ্জনক, যারা জায়গাটাকে নিজের আবেগ আর ছায়ামূর্তি দিয়ে ভরে রাখে ।
    এটা নিশ্চিত যে একজন বারফট্টাই-হাঁকিয়ে, যার মহানন্দ হলো একটা বেদি বা বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের মতামতকে অভ্রান্ত ঘোষণা করা, তার পাগল হয়ে গিয়ে চীৎকার চেঁচামেচির ভয়ঙ্কর বিপদ রয়েছে যদি সে রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপে থাকে । আমি সাংবাদিককে রবিনসন ক্রুসোর সাহসী সততার কথা জিগ্যেস করিনি, কিন্তু আমি ওকে অনুরোধ করেছিলুম যেন সেইসব লোকেদের বিরুদ্ধে নালিশ না করে যারা একাকীত্ব আর রহস্য ভালোবাসে।
    আমাদের বকবককারী জাতিতে কিছু লোক আছে, যদি তাদের ফাঁসির মঞ্চের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে শব্দবহুল বাগাড়ম্বরের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে তারা ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিনের সময়ে বক্তৃতা থামাবার জন্য বাজানো দামামাকে পরোয়া না করেই, মৃত্যুদণ্ডকেও সামান্য অনিচ্ছাভরে মেনে নেবে ।
    তাদের সম্পর্কে আমার নালিশ নেই, কেননা আমি বুঝতে পারি যে অন্যেরা যেমন নিজেদের নৈঃশব্দ আর ধ্যানে আনন্দ পান, তারাও তেমনি তাদের বক্তৃতার নির্গমন থেকে আনন্দ পায় ; কিন্তু আমি তাদের ঘৃণা করি ।
    তাছাড়া, আমি চাইবো যে আমার অভিশপ্ত সাংবাদিক আমাকে আমার মতো করে খেয়ালখুশিতে থাকতে দেবে । “তাহলে, তুমি অনুভব করো না,” ও আমাকে জিগ্যেস করেছিল, যাযকীয় নাকিসুরে, “যে তোমার আনন্দ অন্যের সঙ্গে বাঁটোয়ারা করার প্রয়োজন আছে ?” দ্যাখো এই কৌশলী হিংসুটেকে ! ও জানে যে ওর সুখভোগের ধরণকে আমি অবজ্ঞা করি, তাই ও বিদকুটে রসভঙ্গ করার জন্য আমার মতামত সম্পর্কে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করছে !
    “একা না থাকতে পারার এই অতিঅমঙ্গল হলো…” লা ব্রুয়েরে কোথাও লিখেছেন, নিজেকে ভুলে থাকার জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে লোকগুলোকে অপমান করার জন্য দৌড়ে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা, এই ভয়ে যে সে একা থাকলে নিজেকে সহ্য করতে পারবে না ।
    “আমাদের প্রায় সমস্ত অমঙ্গলের উৎসসূত্র হল নিজের ঘরে না থাকতে পারা,” বলেছেন আরেকজন জ্ঞানী, পাসকাল, আমার বিশ্বাস, এইভাবে নিজের অন্তরজগতের ধ্যানশীলতার কুঠুরীতে সেই সমস্ত উন্মাদ মানুষদের ডাক দেয়ার চেষ্টা করেন যাঁরা নিজেদের আনন্দ এমন কাজকর্মে আর এমন প্রাণীর বেশ্যাবৃত্তিতে খোঁজেন যাকে আমি বলব ভ্রাতৃবৎ, যদি আমার শতকের সুন্দর ভাষায় তা বলতে হয় ।

    চব্বিশ
    পরিকল্পনা
    ও নিজেকে বলল, একা একটা বাগানে বেড়াবার সময়ে : “রাজ দরবারের জটিল সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পোশাকে মেয়েটিকে কতো সুন্দর দেখাবে, সুন্দর সান্ধ্য বাতাসে, রাজবাড়ির শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বিশাল বাগান আর ঝিলগুলোর দিকে যদি ও তাকায় ! কেননা ওর তো রাজকন্যা হবার স্বাভাবিক আভিজাত্য রয়েছে।”
    পরে রাস্তায় হাঁটার সময়ে, ও একটা ছাপার দোকানের সামনে দাঁড়ালো, আর একটা দেয়ালে ক্রান্তিবৃত্তের দেশের উপত্যকার ছবি দেখে, নিজেকে বলল : “নাহ ! রাজপ্রাসাদ তেমন জায়গা নয় যেখানে আমি ওর মিষ্টি জীবনকে অধিগ্রহণ করব ! সেখানে আমরা ঘর বাঁধতে পারব না । আর সোনার ছিটে দেয়া দেয়ালগুলোতে ওর ছবি ঝোলাবার মতন জায়গা থাকবে না ; জাঁকালো দরদালানগুলোতে নিরালা অন্তরঙ্গতার নিভৃতি থাকে না । নিঃসন্দেহে, এইটিই সেই জায়গা যেখানে আমার জীবনের স্বপ্নের চর্চা করতে হবে ।”
    আর, ছাপা ছবিটি খুঁটিয়ে বিস্তারিত দেখার সময়ে, ও নিজেকে আবার বলল, “সমুদ্রের ধারে, এক সুন্দর কাঠের ঘরে, অদ্ভুত আলোকময় গাছে ঘেরা, যাদের নাম আমি ভুলে গেছি....হাওয়ায়, সেই মাদক, ব্যাখ্যাহীন সুবাস...ঘরের ভেতরে, এক তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে, কস্তুরীর...আরও দূরে, আমাদের ছোট্ট এলাকার পেছনে, সাগরের ঢেউয়ে দুলতে-থাকা মাস্তুলের শীর্ষ...আমাদের চারিদিকে, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গোলাপি আলোয় আলোকিত আমাদের ঘর ছাড়িয়ে, বোনা শীতল চাটাই আর সংবেদনী ফুলে সাজানো, ঘন কালো বিরল পোর্তুগিজ রোকোকো চেয়ার ( যার ওপরে ও এলিয়ে বসবে, হাওয়ায়, আফিমদেয়া তামাকের ধোঁয়া উড়িয়ে ), আর তার ওইদিকে, বারান্দায়, রাতের আলোয় মাতাল পাখিদের কুজন, আর ছোটোখাটো আফরিকি মেয়েদের গল্পগুজব...আর রাতের বেলায়, আমার স্বপ্নকে সঙ্গদানের জন্য, সঙ্গীতময় গাছেদের সবিলাপ গান, সবিষাদ ক্যাসুরিনা গাছ । হ্যাঁ, সত্যি, এই ধরনের দৃশ্যপটই আমি চেয়েছি । কেনই বা আমি রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে মাথা ঘামাবো ?”
    আর পরে, তরুশ্রেণীর মাঝখানের পথ দিয়ে যখন সে হাঁটছিল, সে একটা ছোটো পরিষ্কার রেস্তরাঁ দেখতে পেলো, সুতির পর্দায় আলোকিত জানালার ভেতরে, দুটি হাসিমুখ দেখতে পেলো। আর সহসা : “আমার মন”, ও নিজেকে বলল, “নিশ্চয়ই একটা সত্যিকার ভবঘুরে যে অনেক দূরে যা খুঁজতে যায় তা এতো কাছে রয়েছে । যে প্রথম রেস্তরাঁ আমার চোখে পড়ল, তাতেই রয়েছে আহ্লাদ আর খুশি, ভাগ্যক্রমের রেস্তরাঁ, উপভোগের জিনিসে ঠাশা । তাপ পোয়াবার আগুন, রঙিন থালা, চালু রাত্রিভোজন, আমুদে মদ, আর বড়ো বিছানা তার সঙ্গে কম্বল যদিও লোমশ কিন্তু পরিচ্ছন্ন : এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?”
    আর একা বাসায় ফেরার সময়ে, যখন পর্যন্ত বাইরের জীবনের জাঁকজমকে জ্ঞানের বার্তা দূরে মিলিয়ে যায়নি, ও নিজেকে বলল : “আজকে আমি কল্পনায় তিনটে বাড়ি পেয়েছিলুম, যার সবকটাতেই পেয়েছি সমান আনন্দ । কেনই বা আমার শরীরকে জায়গা বদলে বাধ্য করব, যখন আমার আত্মা অমন কর্মতৎপরতায় ভ্রমণে বেরোতে পারে ? আর কেনই বা আমার পরিকল্পনাকে রূপ দেবার জন্য মাথা ঘামাবো, যখন কিনা পরিকল্পনাটা নিজেই যথেষ্ট আনন্দের ?”

    পঁচিশ
    সুন্দরী ডরোথি
    সূর্য তার তপ্ত, উল্লম্ব রোদে শহরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ; বালি ঝকমক করছে আর সমুদ্রের ঢেউ কেঁপে উঠছে । হতচেতন জগত দুর্বল আত্মসমর্পণ করে দুপুরঘুম আরম্ভ করেছে, এক ধরণের প্রিয় মৃত্যুর মতন এমন দুপুরঘুম যে নিদ্রায় ঘুমন্ত মানুষ, অর্ধেক জেগে, নিজের বিলয়নের পরমানন্দ উপভোগ করে ।
    কিন্তু ডরোথি, সূর্যের মতনই তেজি আর গর্বিত, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ছড়িয়ে-পড়া নীলিমার বিস্তারের তলায় এই সময়ে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী, রোদের আলোয় কালো ছায়া ফেলে হাঁটছে ।
    মেয়েটা হালকা চালে এগোয়, চওড়া পাছার ওপরে তার একহারা চেহারা দুলতে থাকে । তার ফিকে গোলাপি রেশমের পোশাক তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে, তার কালো ত্বকের রূঢ় বৈশাদৃশ্য হিসাবে, তার দীর্ঘ চেহারাকে নিখুঁতভাবে মুড়ে, তার পলকা পিঠ, তার বুক দুটো ছুঁচালো।
    রোদ্দুরকে ছেঁকে নিচ্ছে তার লালরঙের ছোট্ট ছাতা, রক্তবর্ণ রুজের প্রলেপ দিচ্ছে তার কৃষ্ণকায় ত্বকে ।
    তার প্রচুর চুলের ওজন, প্রায় নীল, তার সুন্দর মাথাকে পেছনদিকে হেলিয়ে রেখেছে, যা তাকে দিয়েছে বিজয়িনীর শ্রমবিমুখ ঔদ্ধত্য । তার ভারি কানের দুল চুপিচুপি কানে-কানে প্রশংসা করছে।
    থেকে-থেকে সাগরের বাতাস তার ভাসমান পোশাকের একটা কোন তুলে ধরছে, দেখা যাচ্ছে তার মসৃণ, অসাধারণ পা দুটি ; আর তার পায়ের পাতা, ইউরোপ মর্মপাথরের তৈরি যে ধরণের ঐশী দেবীদের জাদুঘরে বন্ধ করে রাখে, মিহি বালুকণার ওপরে অনুগত ছাপ ফেলছে । কারণ ডরোথি এমনই অস্বাভাবিক ছিনাল যে তার মুগ্ধ-প্রশংসার আনন্দকে অতিক্রম করে চলে যায় মুক্তি পাওবার গর্বের দিকে, আর সে স্বাধীন হলেও, পায়ে জুতো না পরেই হাঁটে ।
    তাই মেয়েটি এগিয়ে যায়, সমন্বয়ে ডগমগ, বেঁচে থাকার আনন্দে, মুখের ঝকঝকে হাসি, যেন সে বহু দূরের কোনো আয়নায় তার চালচলন ও সৌন্দর্য প্রতিফলিত হতে দেখছে ।
    এই সময়ে, যখন কুকুররাও রোদ্দুরের কামড়ের নীচে দুঃখে ঘেউঘেউ করে, কোন সে কর্মদ্যোগী উৎসাহ যা শ্রমবিমুখ ডরোথিকে এইভাবে পরিচালিত করছে, ব্রোঞ্জের মতন সুন্দর ও শীতল তরুণী ?
    মেয়েটি কেন তার ছোট্ট ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, যত্ন করে সাজানো, যেখানে অত্যন্ত কম খরচে গোছাগোছা ফুল আর মাদুর গড়ে দিয়েছে নিখুঁত এক খাসকামরা ; সেখানে চুল আঁচড়ে, সিগার টেনে, পাখার বাতাস খেয়ে কিংবা পালকের পাখা-আয়নায় নিজেকে দেখে সে আনন্দিত হয়, যখন সমুদ্র, একশো পা দূরে তীরভূমিতে আছড়ে পড়ে, মেয়েটির অস্পষ্ট কল্পনার সঙ্গে সশব্দ তাল মিলিয়ে, আর যখন লোহার পাত্র, যাতে মেয়েটি কাঁকড়া, ভাত, আর জাফরান ভাপে সেদ্ধ করেছে, দালানের পেছন থেকে উদ্দীপক সুবাস ভাসিয়ে দেয় ?
    হয়তো মেয়েটি কোনো যুবক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করেছে, যে, বহু দূরের সমুদ্রতীরে, তার বন্ধুদের থেকে শুনেছে ডরোথির প্রসিদ্ধি । অবশ্যই, মেয়েটি যুবকটিকে মিনতি করবে, বেচারা, অপেরার নাচের বর্ণনা করতে, আর মেয়েটি তাকে জিগ্যেস করবে সেখানে কেউ খালি পায়ে যেতে পারে কিনা, যেমন রবিবারের নাচগুলোয় বুড়ি কাফ্রিরাও মাতাল হয়ে নিজের আনন্দে নাচতে পারে ; আর তারপর, জিগ্যেস করবে প্যারিসের সুন্দরীরা তার চেয়েও সুন্দরী কিনা ।
    ডরোথিকে সকলেই প্রশংসা আর স্নেহ করে, আর সে খুবই আনন্দ পাবে যদি তাকে তার এগারো বছরের বোনকে, যে এখনই গায়েগতরে তৈরি আর সুন্দরী, তাকে ফেরত কিনে নেবার জন্য প্রতিটি পয়সা বাঁচাতে না হয় ! ও নিঃসন্দেহে সফল হবে, সুকন্যা ডরোথি ; বোনের মালিকটা এতো লোভী, এতো বেশি লোভী যে টাকাকড়ি বোঝে কিন্তু সৌন্দর্য বোঝে না !

    ছাব্বিশ
    গরিবের চোখ
    আহ, তুমি জানতে চাও কেন আজ আমি তোমায় অপছন্দ করছি। আমার ব্যাখ্যা করার তুলনায়, নিঃসন্দেহে, তোমার পক্ষে তা বোঝা কঠিন হবে ; পৃথিবীর মাটিতে নারীর অভেদ্যতার সুন্দরতম উদাহরণে আমি বিশ্বাস করি ।
    আমরা দুজনে সারাটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, যা আমার বেশ ছোটোই মনে হয়েছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে পরস্পরের ভাবনাচিন্তাকে সেদিন বিনিময় করব, আর আমাদের দুটি আত্মা এক হয়ে যাবে -- এমন স্বপ্ন যাতে কোনো মৌলিকতা ছিল না, যাই হোক, কথা হলো যে সবাই এই স্বপ্ন দেখে থাকলেও, কেউই এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি ।
    সেই সন্ধ্যায়, যৎসামান্য ক্লান্ত, নতুন তরুবীথির সদ্য প্রতিষ্ঠিত রেস্তরাঁর সামনে তুমি বসতে চেয়েছিলে, তখনও পর্যন্ত ভাঙাচোরা ইঁটপাথরের মাঝে, কিন্তু বেশ জাঁকজমক করে তাদের অসমাপ্ত জিনিসগুলো তারা সাজিয়েছে । রেস্তরাঁটা ছিল আলো ঝলমলে । গ্যাসবাতিটা নিজেই যেন প্রথম দিনের উত্তেজনাকে অনুভব করছিল, আর নিজের সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে দেয়ালগুলোকে চোখধাঁধানো আলোয় শ্বেতশুভ্র করে তুলেছিল, ঝকমকে আয়নার সারি, সোনালি কার্নিস আর সাজানো কারুকৃতি, বকলেস বাঁধা কুকুরেরা টান মারছে গালফোলা ছোকরা-বেয়ারাদের, হাতের ওপরে বাজপাখি রেখে হাসছেন মহিলারা, পরীরা আর দেবীপ্রতিমারা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে ফলের টুকরি, মাংসপোরা রুটি আর খাবার পাখি, গ্রিক চাকরানি হিবসের দল আর চাকর গ্যানিমিডের দল নিজেদের হাতে ধরে আছে ফেনিল মুসেকেক কিংবা বহুরঙা লম্বাটে আইসক্রিম: যাবতীয় ইতিহাস আর যাবতীয় পুরাণকাহিনি নামিয়ে আনা হয়েছে কোটনাগিরি আর খানাপিনার স্তরে।
    আমাদের ঠিক সামনে পথের কিনারায়, যেন সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে, চল্লিশ বছর বয়সী এক সজ্জন দাঁড়িয়েছিলেন, মুখময় ক্লান্তি আর শাদা দাড়ি, এক হাতে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে আর অন্য হাতে কোলে ধরা আরেকটা বাচ্চা, তখন পর্যন্ত যার হাঁটার বয়স হয়নি । লোকটা আয়ার ভূমিকা পালন করছিল, আর নিজের বাচ্চাদের সান্ধ্যভ্রমণ করাতে নিয়ে বেরিয়েছিল । সকলেই ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে । তিনটে মুখই ছিল অত্যন্ত গম্ভীর, আর ছয়টা চোখ সমানভাবে অবাক হয়ে দেখছিল নতুন রেস্তরাঁর শৌর্য, কিন্তু বয়স অনুযায়ী তারতম্য ছিল । বাবার চোখ দুটো বলছিল, “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! ঠিক যেন গরিব পৃথিবীর সমস্ত সোনা জড়ো করে এই দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে।” ছোটো ছেলেটার চোখ দুটো : “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! কিন্তু এই জায়গাটা এমন যে আমাদের মতন লোকেদের ঢুকতে দেবে না ।” আর সবচেয়ে ছোটো বাচ্চার চোখ দুটো, তারা জাঁকজমকের জৌলুসে এতোই মুগ্ধ যে নির্বাক এবং গভীর আনন্দ ছাড়া আর কিছু ব্যক্ত করতে পারছিল না ।
    গানলেখকরা বলেন যে আনন্দ আত্মাকে উন্নীত করে আর হৃদয়কে করে নম্র । সেই সন্ধ্যায় গানগুলো সঠিক ছিল, আমার ক্ষেত্রে । আমি যে কেবল এই পরিবারের চোখের দ্বারা বিচলিত হয়েছিলুম তাইই নয়, আমাদের তৃষ্ণার চেয়ে বড়ো গেলাস আর মদ্যপানের পাত্র সম্পর্কে একটু লজ্জা বোধ করেছিলুম । প্রিয়তমা, আমি তোমার চোখে চাউনি মেললুম, যাতে সেখানে আমার চিন্তাভাবনাকে পাঠ করতে পারি : আমি গভীরভাবে নেমে গেলুম তোমার দৃষ্টিতে, কতো সুন্দর আর কতো অদ্ভুতভাবে মোলায়েম, তোমার সবুজ চোখের ভেতরে, ওই চোখে বসবাস করে খামখেয়াল, আর চাঁদের প্রেরণা পেয়ে, তুমি আমাকে বললে, “ওইখানে যে লোকগুলো রয়েছে তাদের সহ্য করা যায় না, ওদের চোখগুলো খোলা সিংদরোজার মতন ! তুমি তো প্রধান বেয়ারাকে বলতে পারো ওদের তাড়িয়ে দিতে ?”
    কতো কঠিন পরস্পরকে বুঝতে পারা, আমার প্রিয় পরীরানি, এমনকি যে দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে, আমাদের চিন্তা একে আরেকজনকে জানানো অসম্ভব !

    সাতাশ
    নায়কোচিত মৃত্যু
    ফাঁসিউলে ছিল একজন প্রশংসনীয় জোকার, বস্তুত রাজপুত্রের বন্ধু । কিন্তু সেই সমস্ত লোকেদের ক্ষেত্রে, যাদের কর্মজীবন হাসিঠাট্টায় বাঁধা, গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় তাদের বিপজ্জনকভাবে আকর্ষণ করে ; আর একজন জোকারের মস্তিষ্কে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা যদি স্বেচ্ছাচারীর মতন দখল করে তাহলে তাকে বিটকেল মনে হতে পারে, আর ফাঁসিউলে একদিন কয়েকজন অসন্তুষ্ট অভিজাতদের ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে গেল । সব জায়গাতেই ভালো মানুষেরা থাকে যারা ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বের কাছে দুঃখী ধরনের লোকেদের উৎসর্গ করতে চায় যাতে রাজপুত্রদের বেদখল করে পটের পরিবর্তন করে সমাজে পরিবর্তন আনা যায়, আর তা বিচার-বিবেচনা না করেই। অভিজাতের দল তো গ্রেপ্তার হলোই, সেই সঙ্গে ফাঁসিউলেও, পেল নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড ।
    আমি বিশ্বাস করতে পারি যে তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখে রাজপুত্র কিছুটা বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন । অন্যদের মতন রাজপুত্র যেমন ভালো ছিলেন না তেমন খারাপও ছিলেন না ; কিন্তু অত্যধিক সংবেদনে চালিত হয়ে, অনেক ক্ষেত্রে, তিনি তাঁর অভিভাবকদের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর বেশি উৎপীড়ক হয়ে যেতেন । সুকুমার শিল্পের অনুরাগী, এবং বিচক্ষণ বোদ্ধা, উপভোগের ক্ষেত্রে তাঁকে তৃপ্ত করা যেতো না । মানুষ আর নৈতিকিতার ক্ষেত্রে ছিলেন যথেষ্ট উদাসীন, এবং নিজেও একজন প্রকৃত শিল্পী, যে একমাত্র ভয়ঙ্কর শত্রুর কথা তিনি জানতেন তা হলো একঘেয়েমির ক্লান্তি, এবং সেই অবস্হা থেকে মুক্তির ও তাকে দাবিয়ে রাখার জন্য তিনি এমন উদ্ভট কাজকারবার করতেন যে কোনো কঠোর ইতিহাস লেখক তাঁকে “দানব” খেতাব দিতো, যদি তাঁর রাজত্বে অমনকিছু লেখার অনুমতি দেয়া হতো, যা আদপে আনন্দ বা অনুভূতিতে অসহ্য আঘাত দেয় না, আর অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হলো আনন্দের সবচেয়ে সূক্ষ্ম আঙ্গিক । এই রাজপুত্রের দুর্ভাগ্য যে তার প্রতিভার সমকক্ষ কোনো বড়ো নাট্যমঞ্চ ছিল না । পৃথিবীতে যুবক নিরোরা আছে যাদের গণ্ডীবাঁধা অবস্হায় দম বন্ধ হয়ে যায়, আর ভবিষ্যতের শতকগুলোয় তাদের নাম আর সদিচ্ছা অজানা থেকে যায় । অসতর্ক ভাগ্যবিধাতা এই রাজপুত্রকে জমিজমার তুলনায় সামর্থ্য বেশি দিয়েছিলেন । হঠাৎই গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে শাসক ষড়যন্ত্রকারীদের মাফ করে দেবেন ; আর এই গুজবের উৎস ছিল এক বড়োসড় নাট্যাভিনয়ের ঘোষণা, যে নাটকে ফাঁসিউলে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, অতিপরিচিত ভূমিকায় অভিনয় করবে, আর যাতে অভিযুক্ত অভিজাতবৃন্দও অংশ নেবে, লোকে বলে বেড়াচ্ছিল ; যাদের মগজ ফাঁকা, তারা বলে বেড়াতে লাগল যে অপমানিত রাজপুত্রের দয়ালু চরিত্রের এটা সুস্পষ্ট প্রমাণ।
    একজন মানুষের পক্ষে, যে স্বাভাবিকভাবে আর জেনেশুনে খামখেয়ালি, তার পক্ষে সবকিছু করাই সম্ভব, এমনকি সততা, এমনকি ক্ষমাশীলতা, আর বিশেষ করে যদি সে তাতে কোনো অজানা আনন্দ আবিষ্কার করে । কিন্তু সেই সমস্ত মানুষের পক্ষে, যেমন আমার ক্ষেত্রে, যে ওই অদ্ভুত অসুস্হ আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে, এটা আরও বেশি বিশ্বাযোগ্য যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মানুষের নাট্যপ্রতিভা দেখতে রাজপুত্র বেশি কৌতূহলী ছিলেন । উপলক্ষটাকে কেন্দ্র করে উনি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার ইতিবাচক প্রকোপ নিয়ে শারীরবৃত্তীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইছেন, আর অনুসন্ধান করতে চাইছেন একজন শিল্পীর অভ্যাসগত সামর্থ্য অসাধারণ অবস্হায় পড়লে কতোটা পালটে যেতে পারে ; এই তর্ক বাদ দিয়ে ওনার চরিত্রে কি সুনির্দিষ্ট ক্ষমাশীলতা ছিল নাকি ? এই তর্কের নিষ্পত্তি কখনও হয়নি ।
    শেষ পর্যন্ত সেই দিন এলো, আর ছোটো দরবারকে সাজিয়ে তোলা হলো আত্মম্ভরী আড়ম্বরে, আর কল্পনা করা কঠিন, যদি তুমি না দেখে থাকো, কতোটা জাঁকজমক একটা ছোটো রাজ্যের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেনি, সীমাবদ্ধ সঙ্গতি নিয়ে, একটা দুঃখজনক উপলক্ষে তুলে ধরতে পারে। আর এটা তো ছিল দ্বিগুণ দুঃখদায়ক, প্রথমত বিস্ময়কর বিলাসদ্রব্যের প্রদর্শন, আর দ্বিতীয়ত এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নৈতিক ও রহস্যময় আগ্রহ ।
    ফাঁসিউলে তো নির্বাক ভূমিকায় কিংবা যাতে সংলাপ অল্প ছিল, সেই ধরণের ভূমিকা যা ঐন্দ্রজালিক নাটকে প্রতীকিস্তরে জীবনের রহস্যের প্রতিনিধিত্ব করে, তাতে উৎকৃষ্ট অভিনয় করল । ও মঞ্চে প্রবেশ করেছিল হালকা চালে আর নিখুঁত আত্মসংবরণ করে, যা দেখে জনসাধারণের বিশ্বাস হলো যে ক্ষমা আর দয়া পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ওর আছে ।
    যখন কেউ একজন অভিনেতা সম্পর্কে বলে, “এই লোকটা একজন ভালো অভিনেতা”, তখন সে একটা ফরমুলা প্রয়োগ করে, তা হলো এই যে চরিত্রটির মধ্যে অভিনেতাকে পাওয়া যায় -- তার শিল্প, তার প্রয়াস, তার ইচ্ছাশক্তি । এইবার, কোনও অভিনেতাকে যদি হয়ে উঠতে হয়, যে চরিত্র সে উপস্হাপন করতে চলেছে তাই, তাহলে প্রাচীনকালের সুন্দর মূর্তিগুলোর কী ঘটবে যদি তারা অলৌকিকভাবে প্রাণশক্তি পায়, বেঁচে ওঠে, চলাফেরা করে, দ্যাখে, সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ও বিভ্রান্ত ধারণা -- তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি একক ও নতুন ব্যাপার । সেই রাতে ফাঁসিউলে ছিল একটি আদর্শের নিখুঁত নিদর্শন, এমনই, যাকে কেউ জীবন্ত নয়, অসম্ভব নয়, বাস্তব নয়, বলতে পারত না । তার মাথা ঘিরে ধ্বংসাতীত জ্যোতি নিয়ে জোকার প্রবেশ করল আর চলে গেল, হাসল আর কাঁদল আর নিজের অঙ্গকে আক্ষিপ্ত করল, সেই জ্যোতি এমনই ছিল যা অন্যেরা দেখতে না পেলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলুম, এমনই জ্যোতি যা ছিল শিল্পের রশ্মি আর শহিদের গৌরবের অভাবিত মিশ্রণ । ফাঁসিউলে, কে জানে কোন বিশেষ প্রসংসনীয় গুণে, উপস্হাপন করল, অমিত ভাঁড়ামির মধ্যেও ঐশ্বরিকতা ও অলৌকিকতা । আর ভুলতে পারা অসম্ভব এক সন্ধ্যার বর্ণনা করতে বসে আমার কলম কাঁপছে, আর পোঁছা যায় না এমন অশ্রুর আবেগ জমে ওঠছে আমার চোখে । ফাঁসিউলে আমাকে মানতে বাধ্য করল, অকাট্যভাবে, যে অতলে তলিয়ে যাবার সন্ত্রাসবোধকে ঢেকে ফেলার জন্য শিল্পের মাদকতা অনেক বেশি ক্ষমতাদক্ষ ; কবরের ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিভাবানরা পরমানন্দে এমন ঠাট্টাইয়ার্কি করতে পারে যা কবরটাকে আড়াল করে দেয়, এমন এক স্বর্গোদ্যানে হারিয়ে যায় যেখানে তাদের কবরের আর ধ্বংসের কোনো ধারণা নেই ।
    দর্শকদের মধ্যে সকলেই, আমোদ-ক্লান্ত আর ছেবলা, শিল্পীর ক্ষমতাশীল প্রভাবের কাছে দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল । মৃত্যুর কথা কেউই আর ভাবছিল না, কিংবা শোকের, কিংবা চরম শাস্তির । সবাই আহ্লাদের ঘনঘটায় এমনভাবে মজে গিয়েছিল যা কেবল শৈল্পিক শ্রেষ্ঠ অবদানই দিতে পারে । আনন্দ আর সমাদরের বিস্ফোরণে, বজ্রবিদ্যুতের তেজোময়তায়, নাট্যগৃহের খিলানগুলো অনেক বার কেঁপে উঠছিল । রাজপুত্র নিজেই, উদ্বেলিত, দরবারের সকলরব সমর্থনে যোগ দিলেন ।
    তা সত্তেও, তীক্ষ্ণ চোখ তাঁর উদ্বেলতায় অন্য কিছুর মিশেলও দেখতে পাচ্ছিল । উনি কি নিজের স্বৈরাচারী ক্ষমতার কাছে পরাজিত ? জনগণের হৃদয়ে সন্ত্রাসী আঘাত ও শীতল হতবুদ্ধি সৃষ্টি করার উদ্দেশে নিজের শিল্পের দ্বারা অপমানিত ? নিজের অনুমানের দ্বারা হতাশাক্রান্ত এবং নিজের পরিকল্পনার ফলাফলে বোকা বনে গেছেন ? অমন ভাবনাচিন্তা -- যদিও সর্বাংশে ন্যায্য নয়, কিন্তু একেবারে অন্যায্যও নয় -- রাজপুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তাঁর মুখের পরিচিত বিবর্ণতার ওপর অনবরত নতুন বিবর্ণতার প্রলেপ পড়ছিল, যেমন তুষারের ওপর তুষার জমতে থাকে । উনি বারবার ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন, আর ওনার চোখে জ্বলছিল ঈর্ষা আর তিক্ততার মতন আগুন, যদিও উনি নিজের পুরোনো বন্ধু আর অদ্ভুত জোকারের প্রতিভাকে লোকদেখানো প্রশংসা করছিলেন, যে মৃত্যুতেও ভালোভাবে ইয়ার্কি করতে পেরেছিল । একটুক্ষণ পরে, আমি দেখলুম সিংহাসন অধিকারী তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রাজভৃত্যর দিকে ঝুঁকে কানে-কানে কিছু বললেন । সৌম্যকান্তি ছেলেটির দুষ্টু মুখ হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠল ; তারপর সে রাজপুত্রের দরবার ছেড়ে চলে গেল যেন কোনো জরুরি কাজ করতে যাচ্ছে।
    কয়েক মিনিট পরে, এক তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ হিসহিস-ধ্বনি ফাঁসিউলেকে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মুহূর্তে বিঘ্ন ঘটালো, একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ড আর কান ভেদ করে । আর যেখান থেকে এই অপ্রত্যাশিত অননুমোদন ঘোষিত হয়েছিল, সেই বেদি থেকে একজন বালক দৌড়ে দরবারে এসে চাপা হাসি হাসতে আরম্ভ করল ।
    ফাঁসিউলে, আঘাতপ্রাপ্ত, স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, প্রথমে চোখ বন্ধ করল, তারপর অস্বাভাবিক ভাবে বড়োবড়ো করে মেলে ধরল, মুখ খুলল যেন শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে, হেলেদুলে একটু এগিয়ে, কিছুটা পেছিয়ে, তারপর মঞ্চের ওপর মরে পড়ে গেল ।
    সেই হিসহিসধ্বনি, তারোয়ালের আঘাতের মতন দ্রুত, সত্যিই কি ঘাতককে হতাশ করেছিল ? রাজপুত্র কি নিজেই পূর্বাহ্ণে এই ছলনার স্বশ্রেনিঘাতী কার্যকরতা আঁচ করেছিলেন ? এটা সন্দেহ করা অনুমোদিত । উনি কি ওনার প্রিয় এবং শত্রুভাবাপন্ন ফাঁসিউলের অভাব বোধ করেছিলেন? একথা বিশ্বাস করা মধুর ও আইনসঙ্গত । অপরাধী অভিজাতবৃন্দ শেষ বারের মতন মজার প্রদর্শনী দেখেছিলেন । সেই রাতেই জীবন থেকে তাঁদের মুছে ফেলা হয় । সেই সময় থেকে, বহু মূক নাট্যাভিনেতারা, অন্য দেশে সঠিক সমাদৃত হলেও, “অমুকের” দরবারে অভিনয় করতে এলেও, তাদের একজনও ফাঁসিউলের সমকক্ষ প্রতিভার প্রদর্শন কখনও করতে পারেনি, আর তাদের কেউই একই আনুকূল্যের উচ্চতায় উঠতে পারেনি ।

    আঠাশ
    নকল টাকাকড়ি
    তামাকের দোকান থেকে বেরোনোর পর, আমার বন্ধু টাকা-পয়সাগুলো আলাদা করে গুছিয়ে নিলো : তার কোটের বাঁ দিকের পকেটে রাখলো সোনার ছোটো মুদ্রা ; ডান দিকে, চাঁদিরগুলো; প্যাণ্টের বাঁদিকের পকেটে, একমুঠো কাঁসার ; আর সব শেষে, ডান দিকে, রুপোর একটা দুই ফ্রাংক পয়সা যা ও বহুক্ষণ ধরে যাচাই করেছিল ।
    “বেশ সূক্ষ্ম পৃথগীকরণ !” আমি নিজেকে বললুম ।
    আমরা একজন গরিব ভিখিরির সামনে পৌঁছোলুম, সে কাঁপা হাতে টুপি এগিয়ে দিয়েছিল। ওই মিনতিময় দুটো চোখের নিঃশব্দ বাগ্মীতার তুলনায় আর কোনো অপ্রতিভ ব্যাপারের সঙ্গে পরিচিত হইনি, একজন সংবেদী মানুষ জানে কেমন করে তা বুঝতে হয়, যে চোখে একই সঙ্গে রয়েছে অবমাননার গভীর বোধ আর ভর্ৎসনা । তাতে এমন কিছু ছিল যা কুকুরের চোখের জলে দেখা যায় যখন কুকুরটাকে কেউ চাবুক মারে । আমার বন্ধু আমার চেয়ে বেশি পয়সা দিয়েছিল, আর আমি ওকে বলেছিলুম, “তুমি সঠিক কাজই করেছো ; নিজে অবাক হবার আনন্দের চেয়ে আরও বেশি আনন্দ হলো অন্য কাউকে অবাক করে দেয়া।”
    “ওটা নকল পয়সা ছিল”, ও শান্তভাবে বলল, যেন নিজের বৈভবকে যুক্তিপূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে । কিন্তু আমার দুস্হ মস্তিষ্কে, যা সব সময়ে অনভ কিছু দেখতে ব্যস্ত থাকে যা সাদা চোখে দেখা যায় না ( আমার এই ক্লান্তিকর প্রতিভা প্রকৃতি আমাকে দিয়েছে ), একটা ধারণা তৈরি হল যে আমার বন্ধুবরের অমন কাজ তখনই মাফ করা যায় যদি ও ভেবে থাকে বেচারা গরিবটার জীবনে কোনো আকস্মিকতা সৃষ্টি করবে, আর হয়তো দেখতে চাইছিল কতোরকম প্রতিফল, ভয়ঙ্কর অথবা অন্যরকম বিপদ, একটা নকল পয়সা একজন ভিখারির হাতে দিলে ঘটতে পারে । তা কি ভালো পয়সায় বৃদ্ধি ঘটাবে না ? তা কি ওকে কারাগারে পাঠাবে না ? সরাইখানার মালিক কিংবা কসাই, ধরা যাক, নকল পয়সার জন্য ওকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারে । আর নকল পয়সাটা সহজেই হয়ে উঠতে পারে কোনো ছোটোখাটো বেচারা সাট্টাবাজের বহুদিনের রোজগারের উৎস । আর এই ভাবেই আমার চিন্তাধারা নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, আমার বন্ধু যা ভাবছিল তাতে হয়তো ডানা যোগালো, কতো রকমের সম্ভাবনার কতো রকমের প্রতিফল । কিন্তু ও হঠাৎই আমার ভাবনাস্রোতে বাধা দিয়ে আমারই কথাগুলো পুনর্বার বলল : “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষকে তার আশার চেয়ে বেশি দিয়ে অবাক করার তুলনায় আর মধুর আনন্দ হয় না ।”
    আমি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালুম, আর সেই চোখে প্রশ্নাতীত অকপটতার ঔজ্বল্য দেখে আতঙ্কিত বোধ করলুম । আমি এখন স্পষ্ট দেখলুম যে ও যা করতে চাইছিল তা হলো দানকর্ম, আর সেইসঙ্গে এক ধরণের দরাদরি ; চল্লিশ পয়সা জেতা আর তার সঙ্গে ঈশ্বরের হৃদয়কেও জেতা ; যাতে মিতব্যয়ের মাধ্যমে স্বর্গে যেতে পারে ; আর শেষে, মাঙনায়, দানশীল মানুষের পদমর্যাদা পেতে পারে । আমি ওর অপরাধী আনন্দকে ক্ষমা করে দিতে পারতুম, আমি এখনই অনুমান করতে পারছি যে ওর পক্ষে একাজ করা সম্ভব ; গরিব মানুষকে ঠকিয়ে ও মজা নিচ্ছে, তা হয়তো আমার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করত আর তাকে ভাবতুম বিদকুটে ; কিন্তু ওর অবান্তর হিসেবিপনাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না । বজ্জাত হওয়াটা কখনই মার্জনাযোগ্য নয়, কিন্তু একজন যে অমন তা জানতে পারাটা অর্জন ; আর সবচেয়ে ক্ষমাহীন দোষ হল বোকার শয়তানি ।

    উনত্রিশ
    বদান্য জুয়াড়ি
    কালকে একটা ভিড়েভরা উদ্যানপথে আমি অনুভব করলুম এক রহস্যময় অস্তিত্ব আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেল, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি, আর যাকে তক্ষুনি চিনতে পারলুম, যদিও তাকে আমি সত্যিই আগে দেখিনি । সেও আমার সম্পর্কে একই রকম অনুভব করল, কেননা পাশ দিয়ে যাবার সময়ে অর্থপূর্ণ চোখ মারলো, যা আমি দ্রুত স্বীকৃতি দিলুম । আমি ওকে অনুসরণ করলুম, আর ওর পেছন-পেছন মাটির তলায় একটা ঘরে নামলুম, ঝকমকে জায়গা, বিলাসিতায় এমনই আলোকিত যা প্যারিসের উঁচু স্তরের বাড়িতেও পাওয়া যাবে না । অদ্ভুত মনে হলো যে এই প্রতিপত্তিপূর্ণ আড্ডাঘরের সামনে দিয়ে কতোবার গেছি অথচ প্রবেশপথ নজরে পড়েনি । এক সজ্জাবিলাসী, এমনকি মত্ততাদায়ক বাতাবরণ সেখানে ছেয়ে ছিল, যা তোমাকে প্রায় তৎক্ষণাৎ জীবনের একঘেয়ে গণ্ডোগোলের কথা ভুলিয়ে দেবে ; সেখানে, তুমি শ্বাস নেবে এক বিষণ্ণ স্বর্গসুখে, যেমন পদ্মফুলখোরদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যখন তারা, সূর্যের আলোয় আলোকিত শাশ্বত দুপুরে মায়াবী দ্বীপে নেমেছিল, তারা নিজের অন্তরে অনুভব করেছিল, সঙ্গীতময় ঝর্ণার মোহক শব্দে, যেন বাড়ির দেবীদেবতাদের, স্ত্রীদের, ছেলেমেয়েদের আর না দেখতে হয়, আর সমুদ্রের উঁচু ঢেউয়ে চেপে পাড়ি দিতে না হয় ।
    সেখানে ছিল অদ্ভুত চেহারার পুরুষরা আর নারীরা, মারণ সৌন্দর্যে চিহ্ণিত, যা আমার মনে হলো, এমন সময়ে আর দেশে এর আগে দেখেছি, যা ঠিক এক্ষুনি মনে পড়ছে না, আর যা আমাকে, সচরাচর অচেনা আগুন্তুক দেখে যে অজানা ভীতি হয়, তার বদলে দিলো ভাতৃত্বের সহমর্মিতা। ওদের চাউনির অদ্ভুত অভিব্যক্তিকে যদি বর্ণনা করতে হয়, তাহলে আমি বলব এর আগে আমি কখনও এমন দৃষ্টি দেখিনি যা ক্লান্তির যন্ত্রণায় আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেতে প্রবল সক্রিয়তায় পুড়ছে।
    আমার নিমন্ত্রণকর্তা আর আমি যতক্ষণে বসলুম, আমরা ততোক্ষণে আমরা দুজনে পুরোনো, সহযোগী বন্ধু হয়ে গিয়েছিলুম । আমরা খেলুম, আমরা অনেক ধরণের মদ বেপরোয়াভাবে পান করলুম আর, সবচেয়ে মজার, কয়েক ঘণ্টা পরেও আমার মনে হচ্ছিল যে ও যতোটা মাতাল হয়েছে আমি ততোটা হইনি । কিন্তু জুয়া, সেই অতিমানবিক আহ্লাদ, মাঝে মাঝে আমাদের মদ খাওয়ায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, আর আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি বাজি ধরলুম, আর যে-জিতবে-সে-সবকিছু নেবে খেলায় আমার আত্মাকে নায়কোচিত উদ্বেগহীনতায় আর হালকাচিত্তে হারালুম । আত্মা এমনই এক স্পর্শাতীত জিনিস, বেশির ভাগ সময়ে অকেজো আর অনেক সময়ে এতো বিরক্তিকর, যে তা হারিয়ে ফেলার দরুন আমার কোনো আবেগ হলো না, অনেকটা বেড়াতে বেরিয়ে ভিজিটিঙ কার্ড হারিয়ে ফেলার মতন ।
    আমরা আয়েস করে চুরুট ফুঁকলুম যার অতুলনীয় সুস্বাদ আর সুগন্ধ আমাদের আত্মায় এনে দিলো অজানা দেশ আর আনন্দের মনকেমন, আর এই মাতোয়ারায় মাতাল, সুপরিচিতির তরঙ্গ ওকে অসন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হলো না, আমি সাহস করে চেঁচিয়ে বললুম, কানায় কানায় ভরে গেলাসে চুমুক দিয়ে, “প্রিয় নিক ! তোমার চিরন্তন স্বাস্হ্যের প্রতি ।” আমরা জগতসাংসার সম্পর্কে আলোচনা করলুম, অর্থাৎ প্রগতি আর নিখুঁত হয়ে ওঠার বিষয়ে বিশ্বাস সম্পর্কে, আর সাধারণভাবে মানুষের নানা মোহাচ্ছন্নতা নিয়ে আলোচনা করলুম । এই বিষয়ে মান্যবর চতুর এবং অকাট্য ঠাট্টাইয়ার্কিতে কম যায় না, নিজের মতামত ভদ্র বাক্যবিন্যাসে আর স্বচ্ছ রসিকতায় সাজিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করছিল যা এর আগে মানবসমাজের নামকরা বাগ্মীদের মুখেও শুনিনি । ও আমাকে বিভিন্ন দর্শনের অসম্ভাব্যতা ব্যাখ্যা করে বোঝালো, যে দর্শন এ-পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক দখল করে আছে, এমনকি আমাকে মৌলিক তত্বগুলোর কয়েকটায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইলো, যদিও তত্বের জ্ঞান আর লাভ সম্পর্কে আমি যে কোনো কারোর সঙ্গে আলোচনা করি না । দুনিয়া জুড়ে নিজের কুখ্যাতির বদনাম নিয়ে একেবারেই নালিশ করল না, কুসংস্কার দূর করায় ওর সর্বাধিক আগ্রহ নিয়ে বিশ্বাস জাগালো, আর শপথ করে জানালো যে কেবল একবারই ও নিজের ক্ষমতাকে ভয় পেয়েছিল, যেদিন একজন যাযককে বলতে শুনেছিল, সহযাযকদের চেয়ে বার্তাবহ, বেদির ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিল, “আমার প্রিয় ভাতৃবৃন্দ, কখনও ভুলবেন না, যখন আপনি আলোকপ্রাপ্তির প্রগতি নিয়ে গর্ব করেন, বলেন যে, শয়তানের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ছলনা হলো আপনাদের প্রত্যয় জন্মানো যে তার কোনো অস্তিত্ব নেই !”
    সেই নামকরা বাগ্মীর স্মৃতি স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আমাদের আলোচনাকে নিয়ে গেলো, আর আমার অদ্ভুত নিমন্ত্রণকারী জোর গলায় বলল যে, লেখার কলমকে, বক্তৃতা দেয়াকে, পাতিপণ্ডিতদের ভাবনাচিন্তাকে উৎসাহিত করা ওর মর্যাদার তুলনায় নিম্নস্তরের, আর ও ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ে বিদ্যায়তনিক সভায় উপস্হিত থেকেছে, যদিও অদৃশ্য হয়ে । এই সব দয়ালু কথাবার্তায় প্ররোচিত হয়ে, আমি ওকে ঈশ্বরের কথা আর সাম্প্রতিক কালে ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা জিগ্যেস করলুম । উদাসীন কন্ঠে ও বলল, তাতে একটু দুঃখ মেশানো, “আমাদের যখনই সাক্ষাৎ হয় আমরা পরস্পরকে হ্যালো সম্ভাষণ করি, কিন্তু তা দুজন বৃদ্ধ ভদ্রসন্তানের দেখাসাক্ষাতের মতন হয়, যারা, তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া আভিজাত্য সত্ত্বেও, পুরোনো ঝগড়ার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি ।”
    একজন মামুলি নশ্বরকে মান্যবর এতক্ষণ সময় নিয়ে দর্শন দেননি বলেই মনে হয়, আর বিশ্বাসভঙ্গ যাতে না করে ফেলি সে ভয় আমার ছিল । শেষ পর্যন্ত, জানালায় যখন ভোরের প্রথম আলো দেখা গেল, এই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব, না জেনেই যার গুণগান করেছেন বহু কবি আর যার শৌর্যকে সেবা করেছেন দার্শনিকরা, আমাকে বলল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে তোমার স্মৃতি আনন্দময় হোক, আর তা আমি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব, আমার সম্পর্কে তো কতো খারাপ কথা লোকে বলে বেড়ায়, আমি অনেক সময়ে একজন ‘শুভ শয়তান’ হয়ে যাই , যেমন তোমাদের একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে । তাই, তোমার আত্মার যে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তুমি ভোগ করলে, ভাগ্য তোমার সহায় হলে তুমি যে দাঁওগুলো জিততে --অর্থাৎ, তোমার সম্পূর্ণ জীবনে , ক্লান্তির বিটকেল অসুস্হতার সম্ভাবনাকে প্রশমিত ও পরাভূত করার জন্যে, যা তোমার অসুখ আর এগিয়ে যাবার দুঃখময় কারণ, আমি খেসারত দিয়ে তা পুষিয়ে দেবো । এমন কোনো ইচ্ছে তোমার হবে না যা পেতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না ; ফালতু সহযোগীদের ওপর তুমি কর্তৃত্ব করবে ; তুমি পাবে স্তাবকদল এমনকি সমাদর ; চাঁদি, সোনা, হীরে, পরীরা তোমায় খুঁজে বের করে তাদের গ্রহণ করার জন্য অনুনয়-বিনয় করবে, তার জন্য তোমাকে কোনো প্রয়াস করতে হবে না ; তুমি যখনই চাইবে নিজের দেশ আর জাতীয়তা বদলে ফেলতে পারবে ; আহ্লাদে মাতাল হবে, কখনও তাতে ক্লান্তি আসবে না, সেই সব দেশে যা সর্বদা উষ্ণ আর যেখানে নারীদের গায়ে ফুলের মতন সুগন্ধ --- ইত্যাদি, ইত্যাদি….” ও উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকল , বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে বিদায় নিলো ।
    এরকম জনগণের আড্ডায় নিজেকে অবমানিত করার ভয় যদি না থাকতো, আমি স্বেচ্ছায় এই বদান্য জুয়াড়ির পায়ে পড়ে তার অশ্রুতপূর্ব দানশীলতার জন্যে ধন্যবাদ জানাতুম । কিন্তু ও যাবার পরে, একটু-একটু করে, চিকিৎসার অসাধ্য আমার সন্দেহের অভ্যাস বুকের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলো ; অমন বৈভবপূর্ণ আনন্দে বিশ্বাস করার সাহস হলো না, আর যখন বিছানায় গিয়ে শুলুম, নীচ অভ্যাসের দরুণ প্রার্থনা করার সময়ে, আধোঘুমে বললুম : “হায় ভগবান ! ওহ আমার দেবতা, আমার ভগবান ! আমাকে দেয়া কথাগুলো শয়তানটা যাতে রাখে তা দেখো !”

    ত্রিশ
    দড়ি
    এদুয়ার মানে’র জন্য
    “মায়া”, বন্ধু আমাকে বলল, “যতোরকমের মানব সম্পর্ক হতে পারে ততো অসংখ্য, কিংবা যেমন বস্তু আর জনগণের সম্পর্ক, তেমন । আর মায়া যখন বিলুপ্ত হয়, অর্থাৎ, যখন প্রাণীটি অথবা ঘটনাটি আমাদের বাইরে অবস্হিত, আমাদের একটা অদ্ভুত, জটিল অনুভব হয়, উবে যাওয়া মায়াপুরুষের জন্য অর্ধেক মনখারাপ, আর বাকি অর্ধেক এই অনন্যতায় অবাক হওয়া, এই বাস্তব ঘটনার জন্য অবাক হওয়া।
    এখন, কোনও ব্যাপার যদি নিখুঁতভাবে স্বাভাবিক আর সাধারণ মনে হয়, সব সময়ে একই, যা আমাদের কখনও বোকা বানাতে পারে না, তা হলো মায়ের ভালোবাসা । মায়ের মাতৃত্বহীন ভালোবাসা কল্পনা করা যেমন কঠিন, যেমন তাপহীন আলো ; তাই , মায়ের সব কাজ আর কথাবার্তা, নিজের সন্তান সম্পর্কে, মায়ের ভালোবাসার সঠিক বৈধ কারণ নয়কি ? আর তবু, এই গল্পটার কথা শুনুন, যার দরুন আমি পুরোপুরি প্রাকৃতিক মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলুম।
    “চিত্রকর হিসাবে আমার পেশা অন্যের মুখ খুঁটিয়ে দেখতে আমাকে বাধ্য করে, চলার পথে যে চেহারাগুলো আমি প্রত্যক্ষ করি, আর তুমি জানো এই দক্ষতা থেকে আমরা কেমন আনন্দ উপভোগ করি, অন্য লোকেদের দৃষ্টির তুলনায় আমাদের চোখে যা প্রতিভাত হয়, জীবনকে আরও প্রাণবন্ত এবং অর্থবহ করে তোলে । দূরের যে পাড়ায় আমি থাকি, যেখানে বাড়িগুলোকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে রেখেছে তৃণভূমি, আমি প্রায়ই একটা বাচ্চাকে দেখতুম যার উষ্ণ, দুষ্টু মুখভাব অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আমাকে তৎক্ষণাৎ আকর্ষণ করতো । আমার জন্যে ও অনেকবার পোজ দিয়েছে, আর আমি কখনও ওকে ছোট্ট জিপসি এঁকেছি, কখনও দেবদূত, কখনওবা পূরাণের কামদেব । আমি ওকে ভবঘুরের বেহালা হাতে এঁকেছি, কাঁটার মুকুট আর খৃস্টের শেষযাত্রার আবেগসহ, আর যৌনতার দেবতার আলোকবর্তিকা হাতে । শেষে, ওর মজা করার ব্যাপারে এমন আনন্দ পেতুম যে একদিন আমি ওর বাবা-মাকে, যারা বেশ গরিব, বললুম যে ছেলেটিকে আমায় দিতে, আমি ভালো পোশাক পরিয়ে রাখবো, যৎসামান্য টাকাকড়ি দেবো, আমার বুরুশ পরিষ্কার আর এদিক-ওদিকের কাজ ছাড়া দায়িত্বপূর্ণ কোনো কাজ দেবো না । বাচ্চাটা, আমি ওকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলার পর, বেশ সুশ্রী হয়ে উঠল, আর আমার সঙ্গে যে ধরণের জীবন কাটাতে লাগলো তা ওর বাবা-মায়ের জঘন্য বাসার তুলনায় মনে হয় স্বর্গ । তবে এখানে আমি একটা কথা বলব যে ছোটো ভদ্রলোকটি অনেক সময়ে তার অসাধারণ, অকালপক্ক মর্মযন্ত্রণার আকস্মিক প্রকোপ প্রদর্শন করে আমায় অবাক করে দিতো, আর দ্রুত ও চিনি এবং লিকোয়ার খানিক বেশি করে স্বাদ করার ঝোঁক দেখালো ; এমনই যে একদিন যখন ধরে ফেললুম যে ও এই রকম চুরি আবার করেছে, আমি ওকে বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠাবার ভয় দেখালুম । তারপর কাজে বেরোলুম আর আমার কাজকর্ম আমাকে বাড়ি থেকে কিছু সময়ের জন্যে বাইরে রাখলো ।
    “তুমি চিন্তা করতে পারবে না কীরকম আতঙ্ক আর আকস্মিকতায় বাড়ি ফিরে আক্রান্ত হলুম, যখন সবচেয়ে প্রথমে আমার চোখে পড়ল, ছোটো ভদ্রলোকমশায়, আমার জীবনের দুষ্টু সঙ্গী, কড়িকাঠের হুক থেকে ঝুলছে ! ওর পা প্রায় মাটি ছুঁয়ে রয়েছে ; একটা চেয়ার যা দৃশ্যত লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ; এক কাঁধে ঝুলছে ওর আক্ষিপ্ত মাথা ; মুখ ফুলে উঠেছে আর ওর চোখ, ভয়ার্ত চাউনি মেলে খোলা, প্রথমে দেখে আমার ভ্রম হয়েছিল ও এখনও বেঁচে আছে। তুমি যেমন ভাবছো, ওকে নামানো সহজ কাজ ছিল না । ওর দেহ ইতোমধ্যে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, আর আবর্ণনীয় আতঙ্কে আমার মনে হচ্ছিল ও মেঝেয় পড়ে যেতে পারে । আমি এক হাতে ওকে তুলে ধরলুম আর অন্য হাত দিয়ে দড়িটা কাটলুম । কিন্তু তখনও পর্যন্ত সব পুরো হয়নি ; ছোটো জানোয়ারটা একটা সরু শক্ত দড়ি ব্যবহার করেছিল যা ওর গলার মাংসকে গভীরভাবে কেটে চেপে বসে গিয়েছিল, তখন, একটা ছোটো কাঁচি নিয়ে, ওর ফুলে ওঠা মাংস আর দড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে কেটে ফেলতে হলো, যাতে ওর গলাকে মুক্ত করা যায় ।
    “বলতে ভুলে গেছি যে আমি চেঁচিয়ে সাহায্য চাইছিলুম ; কিন্তু কোনো প্রতিবেশি আমাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলো না, এই ব্যাপারে সভ্য মানুষেরা পরস্পরের আচরণের কাছে একনিষ্ঠ, যারা কখনও, আমি জানি না কেন, গলায় দড়ি দেয়া মানুষের ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না। শেষে ডাক্তার এসে জানালেন যে বাচ্চাটা বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে । আর তারপর, যখন ওকে গোর দেবার জন্য ওর পোশাক খোলার প্রয়োজন হলো, শবদেহ এতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে আমরা ওর অঙ্গ নাড়াতে পারছিলুম না, আর পোশাক খোলার জন্য তা কেটে-ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল ।
    “পুলিশকর্তা, যার কাছে ঘটনার বয়ান দেবার ছিল, অবশ্যই, চোখের কোন দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, ‘এতে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার আছে’ -- বলাবাহুল্য, প্রত্যেকের মনে ভয় জাগাবার ওনার জেদি অভ্যাসবশত, তা সে নিষ্পাপ হোক বা অপরাধী, কথাগুলো বললেন ।
    “একটা বড়ো কাজ রয়ে গেছে”, যা মাথায় আসা মাত্র নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হলুম। আমার কাজ হলো ওর বাবা-মাকে জানানো । সেখানে যেতে আমার পা দুটো রাজি হচ্ছিল না ।
    শেষে সাহস সঞ্চয় করতে পারলুম । কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে, মা ছিলেন অবিচলিত, চোখে জলের একটা ফোঁটাও নেই । এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার কারণ মনে হল ঘটনার আকস্মিকতায় উনি নির্বাক, আর আমার পুরোনো এক প্রবাদ মনে পড়ল : ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শোক প্রকাশিত হয় মৌনতায়।’ বাবা, নিজেকে স্তোক দিলেন, অর্ধেক বিধ্বস্ত, অর্ধেক বিষণ্ণ : ‘যাই হোক, এটা হয়তো ভালোর জন্যই ঘটেছে ; ও তো কোনো কালেই ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারতো না !’
    ‘ইতোমধ্যে, দেহটা আমার ঘোড়ার গাড়িতে রাখা হয়েছিল আর চাকরের সাহায্য নিয়ে আমি অন্ত্যেষ্টির যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলুম, তখন ছেলেটির মা আমার স্টুডিওতে এলেন । উনি বললেন, উনি ওনার ছেলের শব দেখতে চান । আমি ওনার শোক প্রকাশের পরম ও শান্ত সন্তুষ্টির জন্য ওনাকে সত্যই বাধা দিতে পারতুম না । তারপর উনি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন সেই জায়গাটা দেখাই যেখানে ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়েছিল । ‘আহ না, ম্যাডাম’, আমি বললুম, ‘তা আপনার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে !’ কিন্তু অজান্তে আমার দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে গেলো, আর আমি দেখলুম, বিরক্তি আর আতঙ্কের মিশেলে, যে খুঁটিটা তখনও সেখানে ছিল, তা থেকে ঝুলছিল একটা লম্বা দড়ি । আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দুঃখযন্ত্রণার শেষ প্রমাণ ছিঁড়ে সরিয়ে ফেলতে চাইলুম, আর যখন তা জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলতে যাবো, বেচারা মহিলাটি আমার বাহুঁ আঁকড়ে অপ্রতিরোধ্য স্বরে বললেন : ‘ওহ, স্যার ! ওটা আমাকে দিন ! আমি অনুরোধ করছি !’ স্বাভাবিকভাবে, ওনার ব্যথা, আমি ভাবলুম, ওনার মাথা এমন খারাপ করে দিয়েছে যে, যে জিনিসটা ওনার ছেলের মৃত্যুর কারণ, তা প্রত্নবস্তুর মতন যত্নে সামলে রাখতে চাইছেন বলে উনি কোমলতায় নুয়ে পড়েছেন । উনি খুঁটি আর দড়ি কেড়ে নিলেন ।
    “শেষে, শেষে, সবকিছু সমাধা হলো । যা বাকি রইলো তা হলো আমার নিজের কাজে ফেরা, আগের থেকেও বেশি আগ্রহে, আমার মস্তিষ্কের ভাঁজে-ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা ছোট্ট শবের সন্মোহন থেকে মুক্তির জন্য যা ছিল জরুরি, সেই মায়াবালক যে তার ছবি আর চাউনি দিয়ে আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল তাকে আঁকা। কিন্তু পরের দিন আমি এক গোছা চিঠি পেলুম ; কয়েকটা আমার অট্টালিকার নিবাসীদের থেকে, কয়েকটা প্রতিবেশিদের থেকে ; একটা একতলা থেকে, আরেকটা দোতলা, আরেকটা তিনতলা, আর এইরকমই সব ; কয়েকটা ছিল অর্ধেক রসিকতাপূর্ণ, যেন হালকা চালে নিজেদের অনুরোধ লুকোতে চাইছে, কিছু একেবারে নির্লজ্জ আর ভুল বানানে ভরা, কিন্তু সবায়ের উদ্দেশ্য এক, মৃত্যুময় এবং স্বর্গীয় দড়ির একটা টুকরো পাবার প্রয়াস। সাক্ষরকারীদের মধ্যে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু তারা সকলেই, আমি তোমাদের নিশ্চিন্ত করে বলছি, গেঁয়ো নিম্ন শ্রেনির ছিল না । চিঠিগুলো আমি সংগ্রহ করে রেখেছি ।
    “তারপর হঠাৎই, আমি আঁচ করলুম, আর বুঝতে পারলুম ছেলেটির মা কেন দড়িটা কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেমনতর বাণিজ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন ।
    “‘হায় ভগবান’, আমি আমার বন্ধুকে বললুম : ‘গলায় ফাঁসি দেয়া একজন মানুষের এক মিটার দড়ির দাম একশো ফ্রাঁ প্রতি ডেসিমিটার, যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন অর্থ দিয়ে কিনবে, যার যোগফল দাঁড়ায় এক হাজার ফ্রাঁ, বেচারা গরিব মায়ের সত্যিকার সান্ত্বনা !”

    একত্রিশ
    কাজকারবার
    এক সুন্দর বাগানে, যেখানে হেমন্তের রোদ অলস আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছিল, ইতোমধ্যে সবুজ আকাশের তলায়, ভেসে যাওয়া মহাদেশগুলোর মতন সোনালি মেঘেরা, চারটে সুন্দর বাচ্চা, চারজনেই ছেলে, খেলে-খেলে ক্লান্ত, নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল ।
    একজন বলছিল : “কালকে ওরা আমাকে নাট্যগৃহে নিয়ে গিয়েছিল । সেখানের মঞ্চে বিরাট সব দুঃখি-দুঃখি প্রাসাদ ছিল, যার পেছনে সমুদ্র আর আকাশ দেখা যায়, পুরুষ আর মহিলারা, কেউ গম্ভীর কেউ মনখারাপ, কিন্তু চারপাশে যাদের দেখি তাদের চেয়ে সুন্দর আর দামি পোশাকে, আর তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন গান গাইছে । তারা একে অন্যকে ভয় দেখাচ্ছিল, অনুরোধ করছিল, মনখারাপ করছিল, আর কোমরে গোঁজা ছোরায় নিজেদের একটা হাত রেখে কথা বলছিল । ওহ, কী বলব কতো সুন্দর ! আমাদের বাড়িতে যে মহিলারা বেড়াতে আসেন তাঁদের চেয়ে সুন্দরী আর দীর্ঘাঙ্গী ওখানের মহিলারা, আর তাদের বড়ো দীঘল চোখ আর ফোলা গাল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর, কিন্তু তাদের ভালো না বেসে তোমরা থাকতে পারবে না । কখনও তুমি ভয় পাবে, কখনও তোমার কাঁদতে ইচ্ছে করবে, অথচ তা সত্বেও হাসিখুশি থাকবে । তাছাড়া, আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তোমারও মনে হবে অমন পোশাক পরি, আর অমন কাজকারবারই করি, আর ওইরকম কন্ঠস্বরে কথা বলি…”
    চারজন ছেলের মধ্যে একজন, যে তার বন্ধুর কথায় এতোক্ষণ কান দেয়নি, অবাক চোখে দূরের আকাশে কিছু দেখছিল, হঠাৎ বলল, “দ্যাখো, ওপরে তাকিয়ে দ্যাখো ! দেখতে পাচ্ছো ওনাকে ? উনি ছোট্ট আলাদা মেঘে বসে রয়েছেন, আগুনরঙা মেঘটা ধীরে ভেসে যাচ্ছে । উনিও, যেন আমাদের ওপর লক্ষ রাখছেন।”
    “কে ? উনি কে ?” অন্যেরা জিগ্যেস করল ।
    “ঈশ্বর!” ছেলেটা নিশ্চিন্ত গলায় বলল । “ওহ ! উনি তো এখনই অনেক দূরে ; কিছুক্ষণে ওনাকে আর দেখতে পাবে না । উনি বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েছেন, অন্য দেশগুলোয় যাচ্ছেন । দাঁড়াও,
    দিগন্তের প্রায় কাছাকাছি গাছের সারির ওপারে চলে যাচ্ছেন...আর এবার উনি গির্জার চূড়ার পেছনে ডুবে যাচ্ছেন...আহ, আর তোমরা ওনাকে দেখতে পাবে না !” এবং ছেলেটা অনেকক্ষণ যাবত সেইদিকে তাকিয়ে রইলো, ওর চোখ আকাশ আর পৃথিবীর সংলগ্নরেখার দিকে, ভাবাবেশ ও দুঃখের অনির্বচনীয় দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো ।
    “এ পাগলাটে, এই ব্যাটা, ওর মহান ঈশ্বরকে কেবল ওই দেখতে পাচ্ছে,” তৃতীয়জন বলল, যার সম্পূর্ণ ছোটো দেহ ছিল বিরল জীবনীশক্তি আর উদ্যমের বহিঃপ্রকাশ । “আমি, আমি তোমাদের এমনকিছু বলতে যাচ্ছি যা আমার জীবনে ঘটেছে কিন্তু তোমাদের জীবনে ঘটেনি, আর যা তোমাদের নাটক এবং মেঘের চেয়ে বেশি কৌতূহল-উদ্দীপক ।--- দিনকয়েক আগে, আমার বাবা-মা আমাকে ওনাদের সঙ্গে প্রমোদ-ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা যে হোটেলে ছিলুম তাতে আমাদের সকলের জন্যে বিছানা ছিল না বলে, নির্ণয় নেয়া হলো যে আমি কাজের মেয়ের সঙ্গে একই বিছানায় শোবো ।” ছেলেটি বন্ধুদের আরও কাছে আসতে ইশারা করে নিচু গলায় বলল । “ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল, বিছানায় একা না শুয়ে কাজের মেয়ের সঙ্গে শোয়া, তাও অন্ধকারে । আমার ঘুম আসছিল না, নিজের ভাবনা ভাবছিলুম কিন্তু মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল আর আমার হাত নিয়ে ওর নিজের বাহুতে, গলায়, কাঁধে বোলাতে লাগল । ওর বাহু আর কাঁধ অন্য মেয়েদের চেয়ে মাংসল, ত্বক বেশ নরম, এতো নরম, যেন লেখার কাগজ কিংবা সিল্কের কাগজ । আমার তাতে এতো আহ্লাদ হল যে যদি না ভয় করতো আমি অনেকক্ষণ অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারতুম , ওর ঘুম ভাঙিয়ে ফেলার ভয়, আর তাছাড়া জানি না আর কি-কি । তারপর ওর পিঠে ছড়ানো ঘোড়ার লেজের মতন এলোচুলে আমি আমার মুখ গুঁজলুম, আর এতো ভালো গন্ধ পেলুম, তোমরা বিশ্বাস করবে না, এখন বাগানে ফুলগুলোর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছে তেমন । যদি সুযোগ পাও তাহলে চেষ্টা করে দেখো, তখন বুঝতে পারবে !”
    এই অস্বাভাবিক উদ্ঘাটন বর্ণনার তরুণ লেখক, নিজের কাহিনি বলার সময়ে, চোখদুটোকে একধরনের হতচেতন চাউনিতে মেলে ধরেছিল যেন ও তখনও স্মৃতিকে অনুভব করছে, আর সূর্যাস্তের আলো ওর লালচে কোঁকড়ানো চুলের ঢেউকে লালসার গন্ধকবর্ণ জ্যোতিতে আলোকিত করে দিয়েছে । বলা সহজ যে কেউই মেঘ থেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্যে জীবন নষ্ট করবে না, আর তা পাবে অন্য কোথাও ।
    শেষে চতুর্থজন বলল : “তোমরা তো জানো যে বাড়িতে আমি তেমন মজা পাই না ; আমাকে নাটক দেখতে নিয়ে যায় না ; আমার গৃহশিক্ষক বড়োই কড়া মেজাজের ; ঈশ্বর আমার আর আমার একঘেয়েমির সময় জুড়ে থাকেন না, আর আমার কোনো সুন্দরী কাজের মেয়ে নেই যে আদর করবে । আমি প্রায়ই ভাবি যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবো যদি পালিয়ে যেতে পারি, কোথায় যাচ্ছি তা না জেনেই, আর কাউকে উদ্বিগ্ন না করে, আর সব সময় নতুন দেশ দেখে বেড়াবো । আমি যেখানেই থাকি না কেন সুখি থাকি না, আর সবসময় মনে হয় অন্য কোথাও গেলে ভালোভাবে থাকব । তাই ! পাশের গ্রামে গত মেলার সময়ে, আমি তিনজন লোককে দেখলুম যারা অমনভাবে থাকে, যেমনভাবে আমি থাকতে চাই । তোমরা তাদের দেখোনি, তোমরা সবাই । তারা ছিল বিশালদেহ, ময়লা চামড়া, প্রায় কালো, আর যদিও ছেঁড়া পোশাকে তবুও বেশ গর্বিত, মনে হচ্ছিল আর কোনো মানুষের প্রয়োজন ওদের নেই । যখনই বাজনা বাজাতো ওদের বড়ো-বড়ো নম্র চোখ আলোকিত হয়ে উঠতো; এমন চমৎকার সঙ্গীত যে তোমাদের কখনও মনে হবে নাচি, কখনও মনে হবে কাঁদি, কিংবা দুটোই একই-সঙ্গে করি, আর বেশিক্ষণ শুনলে তোমরা যেন পাগল হয়ে যাবে । যে বেহালা বাজাচ্ছিল সে যেন কোনো দুঃখের বর্ণনা করছিল, আরেকজন, নিজের কাঁধে ঝোলানো ছোটো পিয়ানোর চাবিতে ঘা মেরে যেন অন্য লোকটার দুঃখকে ঠাট্টা করছিল, আর তৃতীয়জন মাঝে মাঝে তার খঞ্ঝনি বেশ জোরে বাজাচ্ছিল । তারা নিজেদের নিয়ে এতো হাসিখুশি ছিল যে বুনো সঙ্গীত বাজাতেই থাকলো, এমনকি জনগণ বিদায় নেবার পরেও । শেষে, ওদের দেয়া পয়সাকড়ি কুড়িয়ে, পিঠে নিজেদের বস্তা নিয়ে চলে গেলো । আমি, আমি জানতে চাইছিলুম ওরা কোথায় থাকে, আর জঙ্গলের প্রান্ত পর্যন্ত ওদের অনুসরণ করলুম, সেখানে গিয়ে জানতে পারলুম যে ওরা কোথাও থাকে না ।
    “ওদের একজন বলল : ‘আমরা কি তাঁবুটা খাটাবো ?’
    “‘না, মোটেই নয়,’ আরেকজন বলল, ‘এতো সুন্দর আজকের রাতটা !”
    “তৃতীয়জন, দিনের রোজগার গুণে নিয়ে, বলল, ‘এই লোকগুলো সঙ্গীত বোঝেনা, আর ওদের মহিলারা ভাল্লুকের মতন নাচে । ভাগ্য ভালো যে এক মাসের মধ্যে আমরা অস্ট্রিয়ায় গিয়ে থাকবো, সেখানে পছন্দের লোকজন পাওয়া যাবে ।’
    “আমরা স্পেনে গেলে ভালো হয়, কেননা ঋতু ক্রমশ পালটাচ্ছে ; বৃষ্টিকে এড়াতে হবে, আর এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে গলা ভেজানো যায়’, আরেকজন বলল ।
    “দেখছো তো, আমার সবই মনে আছে । তারপর ওরা এক গ্লাস করে ব্র্যাণ্ডি খেয়ে ঘুমোতে গেল, সেখানে শুয়ে, নক্ষত্রদের দিকে মুখ করে । প্রথমে, আমি ভেবেছিলুম ওদের অনুরোধ করব আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে আর ওদের যন্ত্রসঙ্গীত শেখাতে ; কিন্তু আমার সাহস হলো না, তার কারণ বড়োসড়ো নির্ণয় নেয়া বেশ কঠিন, আর আরও কারণ হলো যে আমার ভয় করতে লাগল ফ্রান্স ছাড়ার আগেই আমি ধরা পড়ে যেতে পারি।”
    বাকি তিন জন বন্ধুর অনাগ্রহ আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করল যে এই ছোটো ছেলেটিকে আগে থেকেই ভুল বোঝা হয় । আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখলুম ; ওর চোখেমুখে সেই অননুভবনীয়,
    বালপ্রৌঢ় সর্বনাশের রেশ দেখা যাচ্ছে যা সাধারণত সমবেদনাকে বেমানান করে দেয় কিন্তু যা, আমি ঠিক জানি না কেন, উত্তেজিত বোধ করলুম, সহসা অদ্ভুত ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে, যে, আমার হয়তো এক ভাই ছিল যার কথা কখনও শুনিনি ।
    সূর্য অস্ত গেল । বিষণ্ণ রাত দখল নিলো । ছেলেগুলো যে যার পথে এগোলো, কিন্তু ওরা কেউই জানত না, নিজের-নিজের নিয়তিকে পরিস্হিতি আর ঘটনাক্রম অনুযায়ী কেমন করে হাসিল করতে হয়, বন্ধুকে বদনাম করতে হয়, আর শৌর্যকে ঘিরে পাক খেতে হয় , কিংবা অপমানের পথে যেতে হয়।

    বত্রিশ
    নাচের ফুলছড়ি ( থায়েরসাস )
    ফ্রানৎস লিৎসের জন্য
    নাচের ফুলছড়ি কি জিনিস ? নৈতিক আর কাব্যিক দৃষ্টিতে, তা পুরুষ-পুরোহিত ও নারী-পুরোহিতদের হাতে-ধরা দেবী-দেবতাদের উৎসব পালনের যাজকীয় নিশান, যাঁদের তারা ব্যাখ্যাকারী আর চাকর । কিন্তু বাস্তবে তা একটা ছড়ি, কেবল একটা ছড়ি, যেমন আঙুরলতাকে তোলার জন্য ব্যবহার হয়, শুকনো, অনমনীয়, আর ঋজু । ছড়িতে জড়ানো থাকে ডালপালা আর ফুল যা সাপের খেয়ালি ভঙ্গীতে খেলে, দোল খায়, কয়েকটা আঁকাবাঁকা আর আঁকড়ানো, কয়েকটা ঘণ্টার মতন ঝোলা কিংবা যেন ওলটানো কাপের মতন । এবং এক পরমোৎকৃষ্ট চমৎকারিত্ব গড়ে ওঠে রেখা ও রঙের এই জটিলতা থেকে, কখনও কোমল, কখনও সপ্রতিভ ।
    মনে হয় না কি যে বেঁকা আর জড়ানো রেখা সোজা রেখাটাকে সেলাম করছে, মূক সমাদরে তাকে ঘিরে নাচছে ? মনে হয় না কি এই সমস্ত সূক্ষ্ম পরাগ, এই সমস্ত পাপড়ি, গন্ধে আর রঙে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, পৌরোহিত্যের ছড়িটার চারিধারে স্পেনীয়দের রহস্যময় ফানডানগো নাচছে?
    এবং তবু, কোন সে ধৃষ্ট নশ্বর যে নির্ণয় নেবার সাহস দেখাবে যে ফুলগুলো আর লতাগুলো ছড়িটার জন্যই বানানো, কিংবা ফুলগুলো আর লতাগুলোর সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য ছড়িটা কেবল একটা ছুতো ? থায়েরসাস নামের ফুলছড়ি হলো দ্বৈততার আশ্চর্য প্রতিনিধি, ক্ষমতাবান এবং শ্রদ্ধেয় পরিচালক, রহস্যময় ও আবেগপ্রবণ সৌন্দর্যের প্রিয় মদ্যপ । অদৃশ্য মদ্যদেবতার দ্বারা উত্তেজিত কোনও সমুদ্রপরী নিজের উন্মাদ সঙ্গিনীদের মাথার ওপরে ফুলযষ্টি নাড়ায়নি, তোমার মতন কর্মশক্তি আর কামখেয়াল নিয়ে, যখন তুমি তোমার প্রতিভাকে তোমার ভ্রাতৃবৃন্দের হৃদয়কে প্রভাবিত করার কাজে লাগাও । --- ছড়িটা তোমার ইচ্ছাশক্তি, ঋজু, শক্ত আর অপ্রতিরোধ্য ; ফুলগুলো তোমার ইচ্ছাশক্তিকে ঘিরে ঘুরে বেড়ানো কল্পনা ; তারা পুরুষের চারিধারে এক পায়ে নৃত্যরতা ঝলমলে নারীউপাদান । সোজা রেখা, জালিদার রেখা, অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি, ইচ্ছাশক্তির ন্যায়পরায়ণতা, শব্দের সর্পিলতা, বিভিন্ন উপায়ে একটি মাত্র লক্ষে পৌঁছানোর প্রয়াস, প্রতিভার সর্বশক্তিময় ও অদৃশ্য মিশ্রণ : কোন সে বিশ্লেষক যার ঘৃণ্য সাহস হবে তোমাকে খণ্ডন ও পৃথক করতে ?
    প্রিয় লিৎস, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে, নদীদের ওই পারে, শহরের ওপরে পিয়ানোগুলো তোমার গৌরবের গান গায়, যেখানে ছাপার প্রেসগুলো তোমার জ্ঞানের অনুবাদ করে, যে দেশেই তুমি থাকো না কেন, অনন্তকালীন শহরের বৈভবে হোক কিংবা স্বপ্নময় দেশের কুয়াশায়, তোমাকে সান্ত্বনা দেবেন বিয়ারের রাজা ক্যামব্রিনাস, তোমার মনোরম কিংবা দুঃখের গানকে নতুন সুরে বাঁধবে, কিংবা কাগজকে গোপনে জানাবে তোমার নিগূঢ় ধ্যানের কথা, শাশ্বত আনন্দ ও ক্ষোভের গায়ক, দার্শনিক, কবি, এবং শিল্পী, তোমার অমরত্বকে আমি সেলাম করি !

    তেত্রিশ
    নিজেকে মাতাল করে তোলো
    তোমার উচিত সদাসর্বদা মাতাল থাকা । এটাই আসল তর্কবিন্দু, একমাত্র প্রশ্ন । সময়ের ভয়ঙ্কর চাপ যাতে তোমার কাঁধ ভেঙে তোমাকে মাটির দিকে নুইয়ে না দেয়, তাই তোমাকে অবিরাম মাতাল থাকতে হবে ।
    কিন্তু কিসে মাতাল ? মদে, কবিতায়, সততায়, যা তোমার পছন্দ । কিন্তু তোমাকে মাতাল থাকতে হবে ।
    আর কখনও কোনো সময়ে, কোনো প্রাসাদের সিঁড়িতে অথবা অবতলের সবুজ ঘাসে কিংবা তোমার ঘরের নিঃসঙ্গতায়, তুমি যদি জেগে উঠে বোঝো যে তোমার মাতলামি কমে এসেছে বা ফুরিয়ে গেছে, তাহলে বাতাসকে, ঢেউদের, নক্ষত্রদের, পাখিদের, ঘড়িকে, যা-কিছু বয়ে চলে যায় তাদের, যা-কিছু গোঙায়, যা-কিছু গড়িয়ে চলে যায়, যা-কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যা-কিছু কথা বলে, তাদের প্রশ্ন কোরো এখন কয়টা বাজে, আর জবাবে বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি বলবে : “এটা মাতাল হবার সময় ! তাই যদি তুমি সময়ের একজন কেনা গোলাম শহিদ হতে না চাও, তাহলে নিজেকে মাতাল করে তোলো ; নিজেকে সদাসর্বদা মাতাল করে রেখো ! মদে, কবিতায়, কিংবা সততায়, যা তোমার পছন্দের ।”

    চৌত্রিশ
    ইতোমধ্যে !
    ইতোমধ্যে একশোবার সূর্য লাফিয়ে উঠেছে, প্রখর বা অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমুদ্রের বিরাট চৌবাচ্চা থেকে, যার পরিধি দেখা দুষ্কর ; একশোবার ফেরত ডুব মেরেছে, ঝলমলে বা মনমরা, নিজের সান্ধ্য স্নানে । অনেকদিন যাবত আমরা নভোমণ্ডলের অপর পারকে অনুমান করতে পেরেছি এবং উপজাতিদের গাগনিক অক্ষরমালার মর্মার্থ বের করতে পেরেছি । এবং প্রতিটি যাত্রী বিলাপ করেছে আর কাতরেছে । যেন ডাঙার কাছাকাছি পৌঁছোবার কারণে তাদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে।
    “কখন, কখন,” ওরা জানতে চেয়েছে, আমরা ঢেউদের উথালপাথালে পাওয়া ঘুম আর ঘুমোবো না, বাতাস এমন নাক ডাকছে যা আমাদের নাক ডাকার তুলনায় বেশি আওয়াজ করছে কেন ?
    কখন আমরা মাংস খেতে পাবো যা আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে থাকা অভিশপ্ত পঞ্চভূতের দেয়া এতো নোনতা নয় ? কখন আমরা স্হির আরামদায়ক চেয়ারে বসে খাবার হজম করতে পারবো?”
    তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল যারা নিজের ভিটেমাটির কথা ভাবছিল, যাদের মনকেমন করছিল তাদের বিশ্বাসঘাতক, গোমড়া বউদের আর এঁড়ে বাচ্চাদের জন্যে । আর অনুপস্হিত ডাঙার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছিল যে, আমার বিশ্বাস, গবাদি পশুদের চেয়ে বেশি উৎসাহে ওরা ঘাস খেয়ে নিতো । শেষে, তীরভূমি দেখতে পাওয়া গেল ; আর আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছোলে, দেখতে পেলুম তা ছিল এক চমৎকার, চোখধাঁধানো দেশ । মনে হলো যেন জীবনের নানা রকম সঙ্গীত এক অস্পষ্ট মর্মরধ্বনিতে সেখানে উৎসারিত হচ্ছে, আর তার তীরভূমি, সব রকমের সবুজে ছত্রালাপ, ফুল এবং ফলের স্বাদু সুবাস চতুর্দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
    হঠাৎই সবাই আনন্দিত হয়ে উঠলো, প্রত্যেকে নিজেকে তার বাজে মনস্হতি থেকে মুক্ত করল । ভুলে গেল ঝগড়াঝাঁটি, মাফ করে দিল পরস্পরের দোষ ; যে দ্বন্দ্বযুদ্ধগুলো হবার ছিল সেগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হলো, আর ধোঁয়ার মতন উবে গেল গোঁসা ।
    আমি একা ছিলুম মনমরা, ধারণার অতীত মনখারাপ । একজন পুরোহিতের মতন, যার কাছে তার দেবতাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে, হৃদয়বিদারক তিক্ততা ছাড়া,আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিলুম না, সমুদ্রের দানবিক আকর্ষণ থেকে, যে সমুদ্র তার ভয়ানক সারল্যে অসংখ্যপ্রকারে বিভিন্ন, যে সমুদ্রে, মনে হচ্ছিল নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে আর প্রতিনিধিত্ব করছে তার কৌশলের, লোভনীয়তার, ক্ষোভের, হাসির, মেজাজের, যন্ত্রণার এবং যতো রকমের আত্মা এতাবৎ বেঁচেছিল, বেঁচে আছে কিংবা বেঁচে থাকবে তার আহ্লাদময় সমুদ্র !
    সেই তুলনাহীন সৌন্দর্যকে বিদায় জানিয়ে, আমার মনে হলো আমাকে আধমরা করে মেরে ফেলা হয়েছে ; আর সেই জন্যেই, যখন আমার সহযাত্রীদের প্রত্যেকে বলল, “যাক শেষ হলো!” আমি শুধু বলতে পারলুম, “ইতোমধ্যে !”
    আর তবু, এইটেই তো পৃথিবী, ধ্বনিময়, আবেগময়, বস্তুময় এবং উৎসবময় এই পৃথিবী ; এ ছিল ঐশ্বর্যময় এবং চমৎকার পৃথিবী, প্রতিশ্রুতিপূর্ণ, আমদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে গোলাপের, কস্তুরীর এক রহস্যময় সুগন্ধ, তার সঙ্গে প্রণয়লীলার হর্ষধ্বনিতে গুঞ্জরিত জীবনের কতোরকম সঙ্গীত ।

    পঁয়ত্রিশ
    জানালাগুলো
    একজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে যতো রকমের ব্যাপার দেখতে পায়, তার চেয়ে বেশি ব্যাপার দেখতে পায় সেই মানুষ যে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে । মোমবাতিতে আলোকিত জানালার মতন আর কোনো বস্তুকে অতো বেশি প্রগাঢ়, অতো বেশি রহস্যময়, অতো বেশি ফলপ্রসূ, অতো বেশি ছায়াময়, অতো বেশি ঝলমলে দেখায় না । যা প্রকাশ্য দিনের আলোয় দেখা যায় তা জানালার পেছনের ঘটনার তুলনায় কম আগ্রহসঞ্চারী । ওই অন্ধকার অথবা আলোকিত গবাক্ষে, জীবন বেঁচে থাকে, জীবন স্বপ্ন দেখে, জীবন যন্ত্রণাভোগ করে।
    ছাদের ঢেউগুলোর ওপর দিয়ে, আমি একজন সম্পূর্ণাঙ্গ নারীকে দেখতে পাই, যে এখনই লোলচর্ম, গরিব, সব সময়ে কিছুর দিকে ঝুঁকে আছে, কখনই বাইরে বেরোয় না -- আর তার মুখাবয়ব লক্ষ্য করে, পোশাকের মাধ্যমে, অঙ্গভঙ্গী দেখে, কোনো জিনিসপত্র ছাড়াই, আমি এই নারীর ইতিহাস নতুন করে গড়ে নিয়েছি, কিংবা তার কিংবদন্তিকে, আর অনেক সময়ে তা নিজেকে শোনাই, চোখে অশ্রুজল নিয়ে । যদি কোনো গরিব পুরুষ হতো তার ইতিহাসও আমি তাড়াতাড়ি গড়ে ফেলতে পারতুম ।
    আমি বিছানায় শুতে যাই, গর্ব বোধ করি যে নিজেকে ছাড়া অন্য লোকেদের জীবনের যন্ত্রণাতে আমি বেঁচে থেকেছি ।
    তুমি হয়তো জানতে চাইবে, “তুমি কি নিশ্চিত যে এই কিংবদন্তি সত্য ?” কিন্তু তাতে কীই বা এসে যায়, আমার বাইরে যে বাস্তবের অবস্হান, তা যদি আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে আর আমি কে তা জানায় ?

    ছত্রিশ
    আঁকার ইচ্ছা
    লোকটা হয়তো মানুষ হিসাবে দুর্দশাগ্রস্ত, কিন্তু সে আকাঙ্খায় বিদীর্ণ একজন সুখী শিল্পী !
    আমি তাকে আঁকতে চাই যে আমাকে অনেক কম দেখা দিয়েছে, যে আমার কাছ থেকে দ্রুত পালিয়েছে, সেইরকম সুন্দর অনুতাপের জিনিসের মতন যা রাতের দ্বারা প্রভাবিত একজন পর্যটক, ফেলে চলে যায় । কতোকাল হলো সে উধাও হয়ে গেছে !
    সে সুন্দরী, সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি সুন্দরী : সে অবাক-করা । অন্ধকার তার মধ্যে উপচে পড়ে: আর যা-কিছুকে সে অনুপ্রাণিত করে তা নিশিময় ও গভীর । তার চোখ দুটি আশ্রয়নিবাস যার মধ্যে রহস্য আবছাভাবে জ্বলজ্বল করে, আর তার চাউনি বিদ্যুতের মতন ঝলকে ওঠে : যেন ছায়াদের বিস্ফোরণ । যদি কেউ আলো-ছড়ানো ও আনন্দময় কালো নক্ষত্রের কল্পনা করতে পারে, আমি তাকে কালো সূর্ষের সঙ্গে তুলনা করতে পারি । কিন্তু ও সাবললীলতায় আমাকে চাঁদের কথা মনে পড়ায়, যা ওর ওপর নিশ্চয়ই প্রচণ্ড প্রভাব রেখে গেছে ; রাখালি কবিতার শ্বেত চাঁদ নয়, শীতল স্ত্রীর মতন নয়, বরং অমঙ্গলময় নেশাধরানো চাঁদ, ঝড়ের রাতের গভীরতায় নিলম্বিত, এমন এক রাত যে দ্রুতগামী মেঘেদের পরস্পরের রেশারেশি চলছে সেখানে ; শান্তিময়, গোপন চাঁদ নয় যে পবিত্র লোকেদের স্বপ্নে দর্শন দেয়, বরং আকাশ থেকে ছিঁড়ে নামানো চাঁদ, পরাভূত ও দ্রোহী, যাকে আতঙ্কিত ঘাসের ওপরে নাচতে বাধ্য করেছিল থেসালিয়ার করালদর্শন ডাইনিরা ! তার সরু ভ্রুর তলায় বাস করে এক একগুঁয়ে ইচ্ছা আর শিকারের প্রতি ভালোবাসা । কিন্তু এই অশান্তিকর মুখাবয়বের তলার দিকে, সর্বদা স্ফূরিত নাসারন্ধ্রের অজানা ও অসম্ভব শ্বাসের কাঁপুনিতে, বিস্তৃত মুখগহ্বরের হাসি অবর্ণনীয় মাধুর্যে ঝলকায় , লাল এবং শ্বেত, এবং স্বাদু, যা দেখে যে কেউই আগ্নেয়গিরির ঢালে ফুটে থাকা অলৌকিক ফুলের স্বপ্ন দেখবে। এমন নারীরা আছেন যাঁরা তাঁদের জয় ও সঙ্গদান করার প্রেরণা যোগান ; কিন্তু এই নারী জাগিয়ে তোলেন মৃত্যুর আকাঙ্খা, ধীরে, তাঁর দৃষ্টির গভীরে ।

    সাঁইত্রিশ
    চাঁদের আনুকূল্য
    তুমি যখন দোলনায় শুয়েছিলে তখন চাঁদ, খামখেয়ালের মূর্ত প্রতিমা, জানালা দিয়ে তোমাকে দেখেছিল, আর বলেছিল : “আমি এই বাচ্চাটাকে পছন্দ করি।”
    এবং ভেড়ার সলোম চামড়ার মতন নরম, মেঘের সিঁড়ি বেয়ে তিনি নেমে এলেন, শব্দ না করে জানালা দিয়ে চলে গেলেন । তারপর মায়ের নমনীয় কোমলতায় তিনি তোমার ওপরে ছড়িয়ে পড়লেন, ওনার রঙগুলো রেখে গেলেন তোমার মুখাবয়বে । এই কারণেই তোমার চোখের তারা সবুজ, আর তোমার গালদুটো অত্যধিক ফ্যাকাশে । আর এই আগন্তুকের কথা মনে করে তোমার চোখদুটো অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে উঠলো ; আর এমন কোমলতায় তিনি তোমার গলা জড়িয়ে ধরলেন, যে তবে থেকে তোমার ফোঁপাতে ইচ্ছে করেছে । তবু, তাঁর ছড়িয়ে পড়া আনন্দে, চাঁদ সারা ঘরকে অনুপ্রভার বাতাবরণে ভরে তুললো, আলোকময় বিষের মতন ; আর এই জীবন্ত আলো ভাবলো, আর বললো : “তুমি চিরকাল আমার চুমুর প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। তোমার সৌন্দর্য হবে আমার । যা আমি ভালোবাসি তুমিও তাই ভালোবাসবে, আর যা-কিছু আমাকে ভালোবাসবে : জল, মেঘ, স্তব্ধতা, এবং রাত্রি ; বিশাল সবুজ সমুদ্র ; আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল ; যে জায়গায় তুমি নেই ; যে প্রেমিককে তুমি জানো না ; দানবিক ফুলদল ; বিভ্রম সৃষ্টিকারী সুগন্ধ ; পিয়ানোর ওপর শুয়ে থাকা বিড়ালের নারীসুলভ খসখসে গলায়, মিষ্টি সুরের কাতরানি, সমস্তকিছু !
    “আর আমার প্রেমিকরা তোমাকে ভালোবাসবে, যারা আমার সঙ্গ দেয় তারা তোমায় সঙ্গ দেবে। তুমি হবে সবুজ-চোখ পুরুষদের রানি যাদের কন্ঠকে আমি নিশির আদরে জড়িয়ে ধরেছি ; যারা সমুদ্রকে ভালোবেসেছে, বিশাল, প্রাণবন্ত এবং সবুজ সমুদ্রকে, আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল, যে প্রাসাদ নেই, যে নারীদের তারা চেনে না, অজানা ধর্মের ধুপধুনোর মতন ভয়ানক ফুলদল, যে সুরভি ইচ্ছাশক্তিকে বিরক্ত করে, এবং আরণ্যক, কামনাময় পশুরা যারা উন্মাদনার প্রতিনিধি ।”
    আর সেই কারণেই, অভিশপ্ত, প্রিয়, নষ্ট আমার শিশু, এখন আমি তোমার পায়ের কাছে শুয়ে আছি, তোমার প্রতিটি অঙ্গে ভয়াবহ ঐশ্বরিকতার প্রতিফলন চাইছি, মারাত্মক ধর্মমাতা, সমস্ত উন্মাদদের বিষাক্ত সেবিকা ।

    আটত্রিশ
    কোনটা আসল ?
    আমি একজন বেনেডিক্টাকে জানতুম, যার থেকে আদর্শময়তার ছটা বিস্ফারিত হতো, যার চোখ মহৎ হবার সদিচ্ছার বীজ বপন করতো, সৌন্দর্ষের জন্য, খ্যাতির জন্য, আর সমস্তকিছু যা আমাদের অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস জন্মায় তার জন্য। কিন্তু এই ঐন্দ্রজালিক মেয়েটি বেশিদিন বাঁচার তুলনায় বড়ো বেশি সুন্দরী ছিল ; তার সঙ্গে আমার দেখা হবার কয়েকদিন পরেই সে মারা গেল, আর আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, তা ছিল বসন্তকাল, গোরস্তানেও তার ধুপধুনো উড়িয়েছিল । আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, সুগন্ধী ও নিষ্পাপ কাঠের কফিনে বন্ধ করে, ভারত থেকে আসা সিন্দুকের মতন ।
    আর আমার ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল, যখন সেদিকে তাকিয়ে ছিলুম, আমি হঠাৎ দেখলুম একজন ছোটোখাটো তরুণী যাকে দেখতে হুবহু মৃতার মতন, আর যে, টাটকা মাটিকে পাগলের মতন অদ্ভুত হিংস্রতায় খুঁড়ছিল, হাসিতে ফেটে পড়ে বলে উঠলো : “আমিই, বাস্তবের বেনেডিক্টা! আমিই, একজন বিখ্যাত বারবণিতা ! আর তোমার পাগলামির আর তোমার অন্ধত্বের শাস্তি হিসাবে আমি যেমন তেমনই তুমি আমাকে ভালোবাসবে !”
    কিন্তু আমি, ভয়ানক রেগে গিয়ে, জবাবে বললুম, “না ! না ! না !” এবং আমার প্রত্যাখ্যানকে গুরুত্ব দেবার জন্য, মাটিতে আমার পা এতো জোরে ঠুকলুম যে নতুন কবরের ভেতরে আমার পা হাঁটু পর্যন্ত সেঁদিয়ে গেল, আর ফাঁদে পড়া নেকড়ের মতন, আমি টিকে আছি, বোধহয় চিরকালের জন্য, পরমাদর্শের কবরে বাঁধা অবস্হায় ।

    উনচল্লিশ
    বিশুদ্ধ বংশজাত
    মেয়েটি নিঃসন্দেহে কুৎসিত । তা সত্বেও সে উপাদেয় !
    সময় ও প্রেম তাদের নখ দিয়ে তার গায়ে আঁচড় দিয়েছে আর তাকে নিষ্ঠুরভাবে শিখিয়েছে যে প্রতিটি মিনিট ও প্রতিটি চুমু তার যৌবন আর তার নতুনত্বকে ফুরিয়ে দিয়েছে ।
    মেয়েটি সত্যিই কুৎসিত ; পিঁপড়ের মতন, মাকড়সার মতন, এমনকি কঙ্কালের মতন, যদি তুমি ওকে চাও ; কিন্তু একই সঙ্গে মেয়েটি একরকম মলম, ইন্দ্রজাল, ডাকিনিবিদ্যা ! সংক্ষেপে, মেয়েটি নিখুঁত চমৎকারীত্বপূর্ণ । সময় ওর চলনভঙ্গীমার ঐকতান ভাঙতে পারেনি বা ওর দেহবল্লরীর অভঙ্গুর সৌষ্ঠব নষ্ট করতে পারেনি । প্রেম ওর শিশুসূলভ শ্বাসের মিষ্টতাকে নষ্ট করতে পারেনি ; এবং ওর কেশরের প্রাচুর্য হ্রাস করতে পারেনি সময়, যা এখনও নিঃশ্বাস ফেলে, কস্তুরি সুগন্ধে, দক্ষিণ ফ্রান্সের আরণ্যক প্রাণবন্ততা : নাইম, একস, আর্লে, অ্যাভিনিও, নাবোন, তুউল, সূর্যের আশীর্বাদপ্রাপ্ত শহর, প্রণয়লীলার ও পুলকের !
    সময় ও প্রেম মেয়েটির অস্তিত্বে তীব্র ক্ষয় ঘটাতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ; ওর বালকসূলভ বুকের অস্পষ্ট ও শাশ্বত জাদুকে তারা একটুও কমাতে পারেনি ।
    হয়তো জীর্ণতাপ্রাপ্ত কিন্তু অব্যবহার্য হয়নি, আর চিরকালের জন্য বীরাঙ্গনা, মেয়েটি তোমাকে সেইসব অভিজাত-বংশজাতদের কথা মনে পড়ায় যা প্রকৃত রসপণ্ডিতেরা সবসময় চিহ্ণিত করতে পারেন, এমনকি কোনো ভাড়াকরা ঘোড়ার গাড়িতে হোক বা ফালতু ঠেলায় সে বসে থাকুক।
    আর তাছাড়া মেয়েটি বেশ মিষ্ট প্রকৃতির আর কতো ঐকান্তিক ! লোকে যেমন হেমন্তকালকে ভালোবাসে মেয়েটি সেইভাবেই ভালোবাসা জানায় ; যেন আগত শীত তার হৃদয়ে নতুন আগুন জ্বেলেছে, আর তার কোমলতায় যে বশ্যতা তা কখনও ক্লান্তিকর নয় ।

    চল্লিশ
    আয়না
    একজন বীভৎস লোক ভেতরে ঢুকে এসে আয়নায় নিজের দিকে তাকালো ।
    “তুমি কেনই বা নিজেকে আয়নায় দ্যাখো, যখন কিনা তুমি সম্ভবত নিজেকে অপছন্দ করা ছাড়া অন্য কিছু দেখবে না ?’
    বীভৎস লোকটি জবাবে আমাকে বলল : “স্যার, ১৭৮৯ সালের অপরিবর্তনীয় আইন অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের আছে সমান অধিকার ; অতএব, আমারও অধিকার আছে আয়নার দিকে তাকানোর : তা পছন্দের হোক বা অপছন্দের তা অন্য কারোর মাথা ঘামাবার ব্যাপার নয়, কেবল আমার ব্যাপার।”
    শুভবুদ্ধির তর্কে আমি নিশ্চয়ই ঠিক ছিলুম ; কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে, লোকটাও ভুল ছিল না।

    একচল্লিশ
    বন্দর
    জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত আত্মার বিশ্রামের জন্যে একটা বন্দর খুবই ভালো জায়গা। আকাশের বিস্তার, মেঘেদের ভ্রাম্যমান স্হাপত্য, বদলাতে থাকা সমুদ্রের রঙ, লাইটহাউসগুলোর ঝিলমিলে আলো চোখদুটোকে ক্লান্তি না দিয়ে তাদের আনন্দ দেবার চমৎকার ত্রিপার্শ্বকাচ । জাহাজগুলোর এগিয়ে চলা আকার, তাদের জটিল দড়িদড়া-মাস্তুলসহ, যা সমুদ্রের ঐকান্তিক ঢেউগুলোর সন্ধান পায়, আত্মার সৌন্দর্য ও ছন্দের স্বাদ বজায় রাখতে সাহায্য করে । আর তাছাড়া, রয়েছে একধরনের রহস্যময়, অভিজাত আনন্দ, বিশেষ করে সেই লোকগুলোর জন্যে মনঃসংযোগ করার জন্য যাদের কৌতূহল বা উচ্চাকাঙ্খা নেই, আচ্ছাদিত জায়গায় শুয়ে কিংবা জেটির খুঁটিতে হেলান দিয়ে, যারা চলে যাচ্ছে আর যারা ফিরে আসছে তাদের চলাফেরা দেখা, যাদের এখনও যা ইচ্ছে চাইবার কর্মশক্তি বজায় আছে, পর্যটনে বেরোবার বা ধনী হবার আকাঙ্খা রয়েছে।

    বিয়াল্লিশ
    রক্ষিতাদের প্রতিকৃতি
    খাসকামরার পুরুষ রূপান্তরণে -- অর্থাৎ, জমকালো এক জুয়াখানার লাগোয়া তামাক ফোঁকার ঘরে -- চারজন লোক বসে ফুঁকছিল আর কথা বলছিল । তারা ঠিক যুবক নয় আবার বুড়োও নয়, সৌম্যকান্তি নয় কুৎসিতও নয় ; কিন্তু যুবক হোক বা বুড়ো, তাদের চোখেমুখে ছিল মজায় জীবন কাটাবার ঝানুদের নির্ভুল ছাপ, সেই অবর্ণনীয় কিছু-একটা, সেই শীত আর ব্যঙ্গমাখা বিষাদ যা ব্যথায় ঘোষণা করে : “আমরা আশ মিটিয়ে বেঁচে নিয়েছি, আর এখন আমরা খুঁজছি এমনকিছু যা আমরা ভালোবাসতে আর সমাদর করতে পারি ।”
    ওদের একজন আলোচনার বিষয়বস্তু নারীদের দিকে নিয়ে গেল । তাদের সম্পর্কে কথা না বলাই দার্শনিকভাবে ভালো ছিল ; কিন্তু কিছু চালাক মানুষ আছে যারা, যৎসামান্য মদ টানার পর, ফালতু আলোচনাকেও বাতিল করবে না । তেমন অবস্হায়, যে কথা বলছে তার দিকে কান দিতে হয়, যেমনভাবে লোকে নৃত্যসঙ্গীত শোনে ।
    “প্রতিটি মানুষ”, সে বলছিল, “তার দেবদূতের মতন কালখণ্ড কখনও নিশ্চয়ই কাটিয়েছে ; তা হলো সেই সময় যখন, বনপরীর অভাবে, লোকে জেনেশুনে ওকগাছের গুঁড়িকে জড়িয়ে ধরে । এটা হলো প্রেমের প্রথম ধাপ । দ্বিতীয় ধাপে লোকে বাছবিচার করে । ধীর ও সতর্ক হওয়ার স্তরে ইতোমধ্যে সে সৃজনীশক্তিচ্যুত হয়ে গেছে । এইটাই হল সেই সময় যখন একজন মনঃস্হির করে নিয়ে সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ব্যপৃত হয় । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, বন্ধুগণ, আমি গর্বিত যে শেষ পর্যন্ত যৌবনান্তকালীন পর্বে পৌঁছেচি, তৃতীয় ধাপে, যেখানে সৌন্দর্যই সবকিছু নয় যদি না তা সুগন্ধ, সুশ্রী পোশাক ইত্যাদির দ্বারা পরিপক্ক হয় । এবং আমি স্বীকার করছি যে অনেকসময়ে আমি চেয়েছি, অজানা আশীর্বাদের স্তরে, চতুর্থ ধাপে পৌঁছোতে, যা কিনা পরম শান্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত। কিন্তু আমার সমগ্র জীবনে, বনপরীদের পর্ব ছাড়া, আমি মেয়েদের বিরক্তিকর বোকামি আর অস্বস্তিকর মধ্যমেধা সম্পর্কে অন্য লোকেদের চেয়ে বেশি জানতুম । পশুদের যে ব্যাপারটা আমি বেশি পছন্দ করি তা হলো তাদের সারল্য । তাহলে ভেবে দ্যাখো, আমার শেষ রক্ষিতা আমাকে কতো কষ্ট দিয়েছে । “সে ছিল এক রাজপুত্রের জারজ মেয়ে । সুন্দরী, নিঃসন্দেহে; নয়তো কেনই বা তাকে আমি নিয়ে আসতুম ? কিন্তু মেয়েটা সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে ফেললো এক কুরুচিপূর্ণ এবং বিকৃত উচ্চাকাঙ্খার ফলে । সে ছিল এমন নারী যে সবসময় পুরুষের ভূমিকাটা নিতে চাইতো : ‘তুমি তো পুরুষ নও ! আহ, যদি আমি পুরুষ হতে পারতুম ! আমাদের দুজনের মধ্যে, আমিই পুরুষ!’ অমনধারা অসহ্য কথাবার্তা ওর গলা থেকে বেরোতো যে কন্ঠ থেকে আমি চেয়েছিলুম গানের উড়াল । এবং যদি আমার মুখ ফসকে কোনো বই, কবিতা, কিংবা অপেরার সমাদরের কথা বেরোতো, ও তক্ষুনি বলে উঠতো : তুমি কি সত্যিই মনে করো ওটা ভালো ? অবশ্য, তুমি কীই বা জানো কাকে ভালো বলে ?’ আর তারপর তর্কাতর্কি আরম্ভ করে দিতো ।
    “একদিন, ও রসায়নের বিষয় আলোচনা করতে চাইলো : আর তারপর থেকে, ওর আর আমার ঠোটের মাঝে কাচের মুখোশ গড়ে উঠলো । তার সঙ্গে শালীনতার ভান । যদি আমি যখন তখন ওর প্রতি সামান্য প্রণয় প্রকাশ করার জন্যে এগোতুম, ও ছিঁড়ে নেয়া ফুলের মতন ঝিমিয়ে পড়তো….”
    “ব্যাপারটা কেমন করে শেষ হলো ?” ওদের মধ্যে একজন জানতে চাইলো। “আমি তো তোমার ধৈর্যশীলতা কখনও দেখিনি ।”
    “ঈশ্বর,” ও বলল, “রোগের সঙ্গে উপশমও পাঠান । একদিন আমি আমার মিনার্ভাকে দেখতে পেলুম, নিজের জোরালো আদর্শে বুভুক্ষু, আমার চাকরের সঙ্গে দৈহিকভাবে লিপ্ত, যে দৃশ্য দেখে আমি বাধিত হলুম চুপচাপ সরে যেতে যাতে তারা লজ্জায় না ভোগে । সেই সন্ধ্যায় আমি দুজনকেই বরখাস্ত করলুম, তাদের পাওনা টাকাকড়ি মিটিয়ে দিয়ে ।”
    “যদি আমার কথা বলি,” যে লোকটা মাঝখানে কথা বলেছিল সে বলল, “আমার তো নিজেকে ছাড়া আর কারোর বিরুদ্ধে নালিশ ছিল না । আনন্দ আমার সঙ্গে বসবাস করতে এলো, অথচ আমি তা বুঝতে পারিনি । বেশিদিন আগের কথা নয়, ভাগ্য আমাকে এক নারীসঙ্গের আনন্দ দান করেছিল যে ছিল খুবই মধুর, অত্যন্ত বশ্য, আর একান্ত অনুরক্ত জীব, আর সবসময় তৈরি ! আর কোনো রকম উৎসাহ ছাড়াই! ‘তোমাকে আনন্দ দেয় বলে আমি একাজ করে খুশি ।’ তা ছিল ওর গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া । তুমি ওই দেয়ালে ঠেলে বা এই সোফায় ফেলে ঠুকতে পারো, আর আমার রক্ষিতার ঠোঁট থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বেরোতো তার চেয়ে দেয়াল আর সোফা থেকে পাওয়া যেতো একই শ্বাস, এমনকি সঙ্গমের বুনো আস্ফালনের সময়েও । দুজনে এক বছর একসঙ্গে বসবাসের পর, ও স্বীকার করল যে কখনও আনন্দ পায়নি । আমি সেই একতরফা দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়লুম, আর অতুলনীয় মেয়েটি বিয়ে করে ফেললো । পরে, ওকে আবার দেখার রোখ চেপে বসল, আর ও আমাকে ওর ছয়টা সুন্দর বাচ্চা দেখিয়ে বলল, ‘প্রিয় বন্ধু ! স্ত্রী সেরকমই অক্ষতযোনি হয় যেমনটি তোমার রক্ষিতা ছিল।’ ওর কোনো কিছুই বদলায়নি । অনেকসময় আমি আফশোষ করি ; আমার উচিত ছিল মেয়েটিকে বিয়ে করা ।”
    অন্য সকলে হেসে উঠলো, আর তৃতীয়জন তার কথা বলা আরম্ভ করলো :
    “বন্ধুগণ, আমি কিছু আনন্দ পেয়েছি যা তোমরা হয়তো অবহেলা করেছ । আমি প্রণয়লীলায় হাসিঠাট্টার কথা বলতে চাই, এমন হাসিঠাট্টা যা সমাদর করতে উৎসাহ জাগায় । আমি আমার শেষ রক্ষিতাকে সবচেয়ে বেশি সমাদর করতুম, মনে হয়, যতোটা তোমরা নিজেদের রক্ষিতাকে ঘৃণা করতে বা ভালোবাসতে পারতে । যখনই আমরা কোনো রেস্তরাঁয় ঢুকতুম, কিছুক্ষণ পরে সবাই খাওয়া-দাওয়া ভুলে কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতো । এমনকি বেয়ারারা আর কাউন্টারের মহিলারা ওর ছোঁয়াচে আহ্লাদে প্রভাবিত হতো আর নিজেদের কাজ অবহেলা করতো। সংক্ষেপে, কিছুদিনের জন্য আমি প্রকৃতির একজন জীবন্ত উদ্ভট সৃষ্টির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছি । মেয়েটি খেতো, চিবোতো, কামড়াতো, গোগ্রাসে গিলতো, আর হজম করতো, কিন্তু হালকাভাবে, জগতের সবচেয়ে বেপরোয়া চালে । ও আমাকে অনেককাল যাবত ভাবাবেশে উচ্ছ্বসিত রেখেছিল । ও বলত, মধুর, স্বপ্নালু, ইংরেজি, রোমান্টিক কন্ঠস্বরে ‘আমার খিদে পেয়েছে’ । আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দাঁত মেলে, কথাটা দিনের আর রাতের বেলা বারবার বলতো-- তোমরা একই সঙ্গে বিচলিত আর আনন্দিত হতে -- আমি ওকে মেলায় নিয়ে গিয়ে সর্বগ্রাসী দানবী হিসাবে প্রদর্শনী করে অনেক রোজগার করতে পারতুম । আমি খাইয়ে-দাইয়ে ভালোই রেখেছিলুম ; তবু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল….”
    “নির্ঘাৎ কোনো মুদিখানার মালিকের কাছে, নাকি ?”
    “সেইরকমই একজন, সৈন্যবাহিনীর মাল সরবরাহকারী কেরানি, কোনো ঐন্দ্রজালিক ছড়ি প্রয়োগ করে লোকটা, বেচারী মেয়েটাকে কয়েকজন সেনার বরাদ্দ খাবারের ব্যবস্হা করে দিতো। আমার তো তাই মনে হয়।”
    “আমার কথা যদি বলো”, চতুর্থজন বলল, নারীর অহঙ্কার বলতে সচরাচর যা বোঝায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারের নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে । আমার মনে হয়, তোমরা বড্ডো ভুল করছ, তোমরা যারা অতিভাগ্যবান নশ্বর মানুষ, তোমাদের রক্ষিতাদের ত্রুটির বয়ান করে-করে !”
    এই কথাগুলো বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিল, যে লোকটাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল শান্তস্বভাব এবং আত্মসংবরণশীল, হাবভাব কেরানিদের মতন, ওর মুখাবয়ব ধূসর চোখের পরিষ্কার উজ্বলতায় বলতে চাইছিল : “আমি এটা চাই !” কিংবা, “তোমার ওটা করা উচিত!” কিংবা এমনকি, “আমি কখনও ক্ষমা করি না !”
    “যদি, আমি তোমাকে যতোটা উত্তজক বলে জানি, জি, কিংবা ঢিলেঢালা আর দুর্বল তোমাদের দুজনের মতন, কে আর জে, তোমাদের যদি আমার পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে জুটি বেঁধে দেয়া হতো, হয় তোমরা পালিয়ে যেতে কিংবা মারা পড়তে । আমি, আমি টিকে গেলুম, দেখতেই পাচ্ছ। একজন মহিলার কথা ভেবে দ্যাখো যে অনুভব বা বিচারে ভুল করতে অসমর্ধ ; একজন মহিলা যার চরিত্র ভয়ঙ্কর রকম শান্ত, ঠাট্টাইয়ার্কি বা জাঁকজমক ছাড়াই আত্মসমর্পিত, দুর্বলতা ছাড়াই মধুর, উগ্রতা ছাড়াই তেজোময় । আমার প্রেমের কাহিনি আয়নার মতন পালিশকরা পবিত্র পৃষ্ঠতলের ওপর দিয়ে অন্তহীন যাত্রার মতন, মাথাখারাপ-করা একঘেয়েমির, যে আয়নায় আমার নিজের বিবেকের হাস্যকর স্পষ্টতায় প্রতিফলিত হতো আমার যাবতীয় অনুভব আর অঙ্গভঙ্গী, যাতে না আমি আমার অবিচ্ছেদ্য অপচ্ছায়ার তাৎক্ষণিক ভর্ৎসনার যোগ্য কোনো অযৌক্তিক আবেগ বা কাজে জড়িয়ে পড়ি । প্রেমকে মনে হতো শিক্ষার বৈঠক । কতো যে বোকামির কাজ থেকে ও আমাকে বিরত করেছে, যে কাজ না করার দরুন আফশোষ হয় ! আমি রাজি না হওয়া সত্বেও কতো যে ধারদেনা শোধ করিয়েছে ! আমার ব্যক্তিগত মূর্খতা থেকে যে লাভ আমি পেতুম তা থেকে বঞ্চিত করেছে । ভাঙা চলবে না এমন শীতল নিয়মকানুনে বেঁধে সে আমার সমস্ত খামখেয়াল রুদ্ধ করেছে । আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো যে ও কখনও চায়নি যে বিপদ কেটে যাবার পর ওকে ধন্যবাদ জানাই! কতোবার যে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি ওর গলা ধরে চেঁচিয়ে বলি : ‘ওগো দুর্দশাময় নারী, একটু ত্রুটিপূর্ণ হও ! যাতে অসুস্হ আর ক্রুদ্ধ অনুভব না করে তোমাকে ভালোবাসতে পারি !’ অনেক বছর যাবত আমি ওকে সমাদর করেছিলুম, আমার হৃদয়ে ঘৃণা নিয়ে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আমি সেই ব্যক্তি নই যে মারা পড়ল !”
    “হায়”, সবাই বলল, “মেয়েটি মারা গেছে ?”
    “হ্যাঁ ! আমি অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারছিলুম না । প্রেম আমার কাছে সর্বভূক দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল । বিজয় অথবা মৃত্যু, রাজনীতিকরা যেমন বলে থাকেন, এইটিই ছিল বেছে নেবার পথ যা নিয়তি আমাকে দিয়েছিল । একদিন রাতে, ঝিলের পাশের জঙ্গলে….মনখারাপ করা পায়চারির পর, যে সময়ে ওর দুই চোখে স্বর্গের মাধুর্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর আমার স্নায়ু ছিঁড়ে যাবার অবস্হায়…”
    “কী !”
    “ কি বলতে চাইছ !”
    “তোমার বক্তব্য কি ?
    “ব্যাপারটা ছিল অবশ্যম্ভাবী । অমন ত্রুটিহীন সেবিকাকে পেটানো, অপমান করা, কিংবা ছাঁটাই করা আমার বিবেকের উর্ধ্বে ছিল । কিন্তু সেই বোধের সঙ্গে আমাকে ভারসাম্য রাখতে হলো আমার মধ্যে প্রাণীটার দেয়া আতঙ্কের সঙ্গে ; অশ্রদ্ধা না করে প্রাণীটা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার ছিল। তাছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারতুম, যখন কিনা মেয়েটা ছিল নিখুঁত ?”
    অস্পষ্ট হতচেতন চাউনি মেলে ওর তিন বন্ধু ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন না বোঝার ভান করছে এবং যেন অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধার করতে পারছে যে, তাদের কথা যদি বলা হয়, তারা অমন কঠোর কাজ করার যোগ্য নিজেদের মনে করে না, তা যতো বিশ্বাসযোগ্য কথায় ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকুক না কেন ।
    তারপর ওরা আরেক প্রস্হ মদ আনতে বলল, সময় নষ্ট করার জন্য, যা জীবনকে নির্দয়ভাবে আঁকড়ে ধরে, আর একঘেয়েমিকে দ্রুতি দিতে পারে ।

    তেতাল্লিশ
    প্রণায়াভিলাষী লক্ষ্যবেধী
    জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা যাবার সময়ে, ও চালককে বলল গুলি-চালানো অভ্যাস করার মাঠের কাছে থামতে, বলল যে স্রেফ সময় কাটানোর জন্য কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাবার সুযোগের আনন্দ নিতে পারবে । আর দানবটাকে মেরে ফেলা -- এটা কি প্রত্যেকের একেবারে মামুলি ও বৈধ পেশা নয় ? --- আর ও নিজের প্রণয়াভিলাষী হাত এগিয়ে দিলো ওর প্রিয়, সমধুর, এবং বিরক্তিকর নারীর দিকে, ওর রহস্যময় স্ত্রী যার প্রতি ওর বহু আনন্দদানের দেনা রয়েছে, বহু দুঃখ, এবং ওর প্রতিভার অনেকাংশ ।
    লক্ষ্যবিন্দু থেকে দূরে-দূরে কয়েকটা গুলি গিয়ে বিঁধলো, একটা গুলি তো গিয়ে ছাদে আটকে গেলো; আর যখন সুন্দরী প্রাণীটি আপ্রাণ হাসতে আরম্ভ করলো, নিজের স্বামীর অক্ষমতাকে ঠাট্টা করে, লোকটা হঠাৎ নারীটির দিকে ফিরে বলল, “ওখানে ডানদিকে ওই পুতুলটাকে দ্যাখো, বাতাসে নাক উঁচু করে উদ্ধত গোমর দেখাচ্ছে । ওগো ! আমার প্রিয় প্রতিমা, আমি কল্পনা করছি যে ওটা তুমি।” লোকটা চোখ বন্ধ করে ট্রিগার টিপলো । পুতুলটার মাথা সুস্পষ্টভাবে ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল । তারপর নিজের প্রিয়, সমধুর, বিরক্তিকর স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে, যে ওর অপরিহার্য এবং নির্দয় অনুপ্রেরণা, হাতে আনত চুমু খেয়ে বলল, “আহ, আমার প্রিয় প্রতিমা, আমার দক্ষতার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই !”

    চুয়াল্লিশ
    সুপ এবং মেঘ
    আমার ছোটোখাটো প্রেয়সী ক্ষেপি আমার জন্যে রাতের খাবার রাঁধছিল, আর খাবার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলুম যে বাষ্প থেকে ঈশ্বর কেমন ভাসমান স্হাপত্য গড়ে তোলেন, স্পর্শাতীতের চমৎকার কারুকার্য । আর আমার ভাবনায়, আমি নিজেকে বলছিলুম : “এই সমস্ত মায়ামেঘ ঠিক আমার সুন্দরী প্রেয়সীর সুন্দর চোখের মতন, আমার ক্ষেপির দানবী সবুজ-চোখ যেন ।”
    এবং হঠাৎ আমার পিঠে একটা সজোর ঘুষি অনুভব করলুম, আর শুনতে পেলুম এক খসখসে, চমৎকার কন্ঠস্বর, ব্র্যাণ্ডিটানার দরুন গলাভাঙা পাগলি কন্ঠস্বর, আমার ছোটোখাটো প্রেয়সীর কন্ঠস্বর, যে বলছিল, “তাহলে, তুমি তোমার সুপ খেতে চলেছ, মেঘের কারবারী কুত্তির বাচ্চা কোথাকার ?”

    পঁয়তাল্লিশ
    গুলি চালানো শেখার মাঠ আর গোরস্তান
    “এক অসাধারণ সাইনবোর্ড” -- গোরস্তান দেখার হোটেল, আমাদের ফেরিঅলা নিজের মনে বলল, “কিন্তু যে কাউকে তৃষ্ণার্ত করে তোলার জন্যে ভালোভাবে তৈরি করা ! নিঃসন্দেহে, হোটেল মালিক হোরেস এবং এপিকিউরাসের কবিশিষ্যদের মর্ম উপলব্ধি করেন । হয়তো প্রাচীন মিশরীয়দের নিগূঢ় বিশোধনের সঙ্গে উনি পরিচিত, যাদের কাছে একটা কঙ্কালের উপস্হিতি ছাড়া কোনো ভোজসভা পূর্ণাঙ্গ হতো না, কিংবা জীবনের স্বল্পস্হায়িতার অন্য কোনো চিহ্ণ।”
    আর লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল, কবরগুলোর দিকে মুখ করে এক গ্লাস বিয়ার খেলো, এবং ধীরেসুস্হে একটা চুরুট ফুঁকলো । হঠাৎ কোনো খামখেয়ালে আক্রান্ত হয়ে ও গোরস্তানে যাওয়া মনস্হ করল, ঘাসগুলো ছিল উঁচু আর্ আ্‌হ্বায়ক, আর এক ঝকমকে সূর্য সবার ওপর রাজত্ব করছিল ।
    সত্যি বলতে কি, মনে হচ্ছিল তীব্র আলো আর তাপ মাতাল সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, যা চমৎকার ফুলগুলোর ওপরে, যে ফুলগুলোর স্বাস্হ তলাকার পচনের কারণে বেশ পুরুষ্টু, তাদের ওপরে আগাপাশতলা জাজিম বিছিয়ে দিয়েছে । বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে জীবনের বিস্তৃত মর্মরধ্বনি -- সবচেয়ে ক্ষুদ্রের জীবন --- যা মাঝেমাঝে কাছাকাছি কোনো গুলিচালানো শেখার মাঠ থেকে রাইফেলের আওয়াজে বিঘ্নিত হচ্ছিল, শ্যাম্পেনের ছিপিখোলার মতন মৃদু নিচুস্বর ঐকতানের মাঝে ।
    তারপর, সূর্যের তলায়, যা ওর মস্তিষ্ককে পোড়াচ্ছিল, এবং মৃত্যুর উষ্ণ সুগন্ধের বাতাবরণে, যে গোরের ওপরে ও বসেছিল তা থেকে ফিসফিসে গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। আর কন্ঠস্বর বলল, “তোমার লক্ষ্যবস্তু আর গুলিগোলা অভিশপ্ত হোক, তোমরা অস্হির জীবন্ত প্রানী কোথাকার, মৃতের আর তাদের বিশ্রামের পবিত্র জায়গা সম্পর্কে তোমাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই ! অভিশপ্ত হোক তোমাদের উচ্চাকাঙ্খা, তোমাদের পরিকল্পনা অভিশপ্ত হোক, তোমরা ধৈর্যহীন নশ্বর কোথাকার, মৃত্যুর নিভৃত আবাসের কাছে আসো হত্যার শিল্প শেখার জন্য !
    হায়, যদি তোমরা জানতে এই পুরস্কার জয় করা কতো সহজ, এই লক্ষ্যবিন্দুকে ভেদ করা কতো সহজ, আর মৃত্যু ছাড়া সবকিছুই শূন্য, তোমরা নিজেদের ওভাবে ফুরিয়ে ফেলতে না, তোমরা শ্রমশীল জীবন্ত প্রাণী কোথাকার, আর যারা বহুকাল আগে লক্ষ্যভেদ করেছে, যা কিনা এই বিরক্তিকর জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যবস্তু, তাদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য তোমরা কম উৎপাত করতে !”

    ছেচল্লিশ
    মাথার পেছনের হারানো জ্যোতি
    “কী ? তুমি এখানে, আমার প্রিয় দোস্ত ? তুমি, এই রকম একটা নোংরা জায়গায় ! তুমি, যে সবচেয়ে অপরিহার্য পানীয় পান করো, দেবতাদের খাবার খাও ! সত্যি, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ।”
    “বন্ধুবর, তুমি ঘোড়া আর ঘোড়ারগাড়ি সম্পর্কে আমার আতঙ্কের কথা জানো। ঠিক এক্ষুনি, তাড়াতাড়ি বাগানের রাস্তা পার হবার সময়ে, কাদার ওপরে লাফ মেরে ওই ভ্রাম্যমান বিশৃঙ্খলায়, যেখানে মৃত্যু টগবগিয়ে তোমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফ্যালে, আমি আচমকা রূঢ়ভাবে হাঁটছিলুম আর আমার মাথা থেকে জ্যোতিটা খসে গেল, পড়ল গিয়ে রাস্তার কাদায় । ফিরে যাওয়ার ঝঞ্ঝাটের কোনো মানে হয় না । আমার মনে হলো নিজের হাড় ভাঙার চেয়ে নিজের তকমা হারানোটা কম অপ্রীতিকর । আর তারপর মনেমনে বললুম, প্রতিটি খারাপ ব্যাপারের একটা ভালো দিক থাকে । এখন আমি আত্মপরিচয় গোপন করে ঘুরে বেড়াতে পারি, বজ্জাতি করতে পারি, লাম্পট্যে নিজেকে সঁপে দিতে পারি, সাধারণ নশ্বর মানুষদের মতন । আর এখন এই আমি, অবিকল তোমার মতন, দেখতেই পাচ্ছ !”
    “তোমার উচিত জ্যোতিটার জন্যে একটা বিজ্ঞাপন দেয়া, কিংবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে ফিরে পাবার চেষ্টা করা ।”
    “হায় ভগবান, না ! আমার এই ভাবেই ভালো লাগছে । কেবল একমাত্র তুমিই আমাকে চিনতে পেরেছ । আর তাছাড়া, মর্যাদা আমাকে বিরক্ত করে । আর আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে কোনো মূর্খ কবি ওটা তুলে নিয়ে নির্লজ্জের মতন নিজের মাথায় পরে নেবে । কাউকে খুশি করা --- কতো যে আনন্দের ! আর তার চেয়েও উৎকৃষ্ট, যদি সে এমন কেউ হয় যাকে দেখে তুমি হাসাহাসি করতে পারবে ! ভেবে দ্যাখো, এক্স-এর মাথায়, কিংবা জেড-এর ! ওহ কতো মজার হবে।

    সাতচল্লিশ
    কুমারী বিসতৌরি
    শহরের শেষ প্রান্তে গ্যাসবাতির তলা দিয়ে হাঁটার সময়ে, অনুভব করলুম একটা হাত আস্তে আমার বাহু আঁকড়ে ধরল, আর আমার কানে একটা কন্ঠস্বর বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, স্যার ?” আমি চেয়ে দেখলুম ; বেশ দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্হ্যবতী বড়ো-বড়ো চোখের যুবতী, মুখে যৎসামান্য সাজগোজ, শিরাবরণের ফিতের সঙ্গে বাতাসে তার চুল উড়ছে ।
    “না, আমি ডাক্তার নই । হতে চাই ।”
    “হ্যাঁ ! আপনি একজন ডাক্তার । আমি দেখে বলতে পারি । আমার বাসায় আসুন । আমার সঙ্গ আপনার ভালো লাগবে ; আসুন !!”
    “হতে পারে, আমি তোমার বাসায় যাবো, কিন্তু ডাক্তার হবার পরে, ধ্যাৎ !”
    “আহা, আহা”, মেয়েটি বলল, আমার বাহু আঁকড়ে থেকে, আর হাসতে লাগলো, “আপনি একজন মজার ডাক্তার । আপনার মতন কয়েকজনকে আমি জানি ! আসুন দিকিনি ।”
    আমি রহস্য বেশ পছন্দ করি, কারণ আমার সব সময়ে মনে হয় তার সমাধান করতে পারবো । তাই আমি এই নতুন সঙ্গিনীর টানের সঙ্গে চললুম, কিংবা বলা যায়, এই অপ্রত্যাশিত হেঁয়ালির সঙ্গে ।
    আমি ওর বাসার বর্ণনা বাদ দিচ্ছি ; তা বহু নাম-করা পুরোনো কবিদের রচনায় পাওয়া যাবে । যাই হোক, যে বিস্তারিত বর্ণনা অঁরি দ্য রেনিউ দেননি, দেয়ালে দুই বা তিনজন বিখ্যাত ডাক্তারের ছবি ঝুলছিল ।
    কতো যে প্রশ্রয় আমাকে দেয়া হলো ! জ্বলজ্বলে তাপ পোয়াবার আগুন, মশলা মেশানো মদ, চুরুট ; আর আমাকে এই জিনিসগুলো দেবার সময়ে এবং নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে, মজার মেয়েটি আমাকে বলল: আরাম করে বসুন, বন্ধুবর, আয়েশ করে বসুন । এটা আপনাকে হাসপাতালের আর যৌবনের ভালো দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেবে -- আরে ! আপনার চুল অমন শাদা হয়ে গেছে কেমন করে ? সেসময়ে তো এরকম ছিল না, সেই কতোকাল আগে, যখন আপনি এল-এর শিক্ষানবীশ ছিলেন । আমার মনে আছে জটিল শল্যচিকিৎসায় আপনিই ওনাকে সাহায্য করতেন । তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি কাটাছেঁড়া করতে, কাঁচি চালাতে আর অংশ বাদ দিতে ভালোবাসতেন !
    আপনি ওনার হাতে সরঞ্জাম তুলে দিতেন, ক্ষতস্হান সেলাইয়ের সুতো আর স্পঞ্জ দিতেন -- আর আমার মনে আছে কেমন করে, যখন শল্যচিকিৎসা শেষ হয়ে যেতো, তিনি নিজের ঘড়ি দেখতেন আর গর্বভরে ঘোষণা করতেন, ‘পাঁচ মিনিট, ভদ্রমহোদয়গণ !’ ---ওহ, আমি, মনে পড়ছে । আমি সেই ভদ্রমহোদয়দের ভালোভাবে চিনি ।”
    কয়েক সেকেণ্ড পরে, এবার ঘরোয়া ঢঙে, মেয়েটি গল্পের সূত্র এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, নয়কি, আমার প্রিয় বাঘ ?”
    মেয়েটির এই পাগলামির ধুয়া আমাকে বাধ্য করল চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে ।
    “না !” আমি চেঁচিয়ে বললুম ।
    “তাহলে একজন শল্যচিকিৎসক ?”
    “না, না ! যদি না আমি তোমার মাথা কেটে ফেলার জন্য শল্যচিকিৎসক হই ! পূতচরিত্র ম্যাকেরেল মাছ ঢোকানোর গর্ত কোথাকার !”
    “দাঁড়ান, “ মেয়েটি বলল । “আপনি নিজেই জানতে পারবেন ।”
    আর মেয়েটি আলমারি থেকে একতাড়া কাগজ বের করল, যেগুলো নামকরা ডাক্তারদের ছবির সংগ্রহ, মরাঁর লিথোগ্রাফ করা, যা কয়েক বছর কোয়ায় ভোলতেয়ারে প্রদর্শিত হয়েছিল ।
    “দেখুন ! এনাকে চিনতে পারছেন ?
    “হ্যাঁ ! ইনি এক্স । ছবির তলায় ওনার নাম ছাপা রয়েছে ; কিন্তু আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ।”
    “হ্যাঁ আপনি তো চিনবেনই ! এটা, দেখুন ইনি জেড, যে লোকটি এক বক্তৃতায় এক্স সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন দানব যে নিজের আত্মার কালিমা মুখাবয়বে প্রকাশ করে !’ আর তা কেবল এই জন্যে যে বিশেষ এক রোগির ক্ষেত্রে দুজনের মতের মিল হয়নি ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কতো হাসাহাসি করেছিল তখন, আপনার মনে আছে ? -- এবার এই যে, কে-এর দিকে দেখুন, যে খবর দিয়েছিল যে তার হাসাপাতালে বিপ্লবীদের সে চিকিৎসা করছে । তা ছিল দাঙ্গার সময়ে । অমন ভদ্রলোকের কেন অতো কম সাহস ছিল?--- আর এই যে ডাবলিউ, বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার; উনি যখন প্যারিসে এসেছিলেন তখন ওনাকে পাকড়াও করেছিলুম । ওনাকে অনেকটা মেয়েদের মতন দেখতে, তাই না ?”
    এবং যখন আমি টেবিলের ওপরে রাখা সুতো বাঁধা একটা তাড়ায় হাত দিলুম, মেয়েটি বলল, “একটু দাঁড়ান ; ওগুলো শিক্ষানবীশদের, আর এই তাড়াটা যারা আবাসিক ছিল না তাদের।”
    তারপর মেয়েটি ফোটোগ্রাফের গোছা বের করল, সেগুলোতে মুখগুলো তরুণতরদের।
    “আমাদের যখন আবার দেখা হবে, আপনি আপনার ছবি আমাকে দেবেন, বলুন, দেবেন তো, হে প্রিয় ?”
    “কিন্তু”, আমি মেয়েটিকে বললুম, আমার ব্যক্তিগত আচ্ছন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে অপারগ, “তুমি কেন মনে করো যে আমি একজন ডাক্তার ?”
    “কারণ আপনি কতো ভালো, নারীদের কতো সন্মান জানান !”
    “অদ্ভুত যুক্তি !” মনে মনে বললুম ।
    “ওহ, আমি তেমন ভুল করি না ; আমি ওনাদের অনেককে চিনি । আমি এই ভদ্রলোকদের এতো ভালোবাসি যে অসুস্হ না হলেও, আমি অনেকসময়ে তাঁদের কাছে যাই কেবল তাঁদের দেখবো বলে । ওনাদের কেউ কেউ শীতল কন্ঠে বলেন : ‘তুমি মোটেই অসুস্হ নও !’ কিন্তু কেউ কেউ আমাকে বুঝতে পারেন, যখন ওনারা দেখেন আমি কেমনভাবে তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসছি ।”
    “আর যখন ওনারা তোমাকে বুঝতে পারেন না ?”
    “হায় ভগবান ! আমি তো তাঁদের কোনোভাবে বিরক্ত করিনি, আমি দশ ফ্রাঁ তাকের ওপরে রেখে দিই ! --- ওনারা এতো ভালো আর এতো ভদ্র, ওই লোকজন ! ---আমি একজন ছোটো শিক্ষানবীশকে পিটি-তে খুঁজে পেয়েছিলুম, দেবদূতের মতন সৌম্যকান্তি আর কতো নম্র ! কতো পরিশ্রম করতো, বেচারা ! ওর বন্ধুরা আমায় বলেছিল ওর অবস্হা ভালো নয়, কারণ ওর বাবা-মা গরিব আর ওকে টাকাকড়ি পাঠাতে পারেন না । শুনে আত্মবিশ্বাস হলো । আমি তো দেখতে যথেষ্ট ভালো, যদিও ততো কম বয়স নয় । আমি ওকে বললুম : ‘এসো, আমার সঙ্গে দেখা করো, আমার সঙ্গে প্রায়ই তুমি দেখা করবে । আর আমাকে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না : আমার টাকাকড়ি চাই না !” কিন্তু আপনি বুঝবেন যে সেসব কথা আমায় নানা উপায়ে বলতে হয়েছিল ; আমি অমার্জিত ঢঙে বলতে চাইনি । ওকে অপমান করে ফেলার ভয় ছিল আমার, আমার খোকাবাবু !”
    “আচ্ছা ! তুমি কি বিশ্বাস করবে যে আমার এক ধরণের মজার উদ্দীপনা চাগিয়ে উঠেছিল যা ওকে বলার সাহস আমার হয়নি ?--- আমি চেয়েছিলুম ও আমাকে দেখতে আসুক ওর ডাক্তারি ব্যাগ আর শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি নিয়ে, এমনকি তাতে লেগে থাকা রক্তসুদ্দু আসুক !”
    মেয়েটি এই কথাগুলো বেশ অকপটে বলল, যেমনভাবে সংসারি লোক তার অভিনেত্রী প্রেমিকাকে বলবে, “আমি তোমাকে তোমার বিখ্যাত ভূমিকায় পরা পোশাকে দেখতে চাই।”
    আমি জেদাজেদি করে জিগ্যেস করলুম : “তুমি কি আমাকে বলতে পারো কোথায় তোমার এই অদ্ভুত চাহিদার সূত্রপাত ঘটেছিল ?”
    আমার কথা বোঝানো বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সফল হলুম । কিন্তু মেয়েটি বড়ো দুঃখি কন্ঠে জবাব দিল, যতোদূর আমার মনে পড়ে, আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে : “আমি জানি না….আমার মনে নেই ।”
    বিশাল একটা শহরে কতো অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যদি লোকে জানে যে কেমন করে চলাফেরা করতে হয় আর তাদের খুঁজতে হয় ! জীবনে ভেসে বেড়ায় নিষ্পাপ দানবেরা । --- হায় ভগবান, হে ঈশ্বর ! তুমি স্রষ্টা, তুমি মালিক ; তুমি আইন ও মুক্তি দুটিই গড়েছ ; তুমি সর্বভৌম যে অনুমতি দেয়, তুমি বিচারক যে ক্ষমা করে, তুমি উদ্দেশ্য ও কারণে সম্পূর্ণ, আর যে সম্ভবত ভয়ঙ্করের স্বাদ আমার আত্মায় দিয়েছে আমার হৃদয়ে পরিবর্তন ঘটানোর জন্য, ছুরির ডগা থেকে যেমন সুশ্রূষা আসে ; ভগবান, দয়া করো, পাগল ও পাগলিনীদের দয়া করো ! হে সৃষ্টিকর্তা ! তোমার দৃষ্টিতে তাদের কি রাক্ষস বলে মনে হয় কেননা কেবল তুমিই জানো কেন তাদের অস্তিত্ব, কেমন করে তাদের তৈরি করা হয়েছে এবং কেমন করে তাদের অন্যরকম তৈরি করা যেতে পারতো ?

    আটচল্লিশ
    এই জগতের বাইরে যেখানে হোক
    এই জীবন একটা হাসপাতাল যেখানে প্রতিটি রোগী বিছানা বদল করার জন্য হন্যে হয়ে থাকে। এই লোকটা আগুনের দিকে মুখ করে ভুগতে চায়, আর অন্যজন ভাবে জানালার পাশে থাকলে ভালো হয়ে উঠবে । আমার সব সময় মনে হয়েছে আমি যেখানে আছি তার চেয়ে অন্য যে-কোনো জায়গায় ভালো থাকবো, এবং এই অন্যত্র যাওয়ার প্রশ্ন আমি আমার আত্মার সঙ্গে অবিরাম আলোচনা করি ।
    “আমাকে বলো, আমার আত্মা, আমার বেচারা শীতল আত্মা, লিসবনে গিয়ে থাকার বিষয়ে কী ভাবো ? সে-জায়গাটা নিশ্চয়ই উষ্ণ, আর তুমি গিরগিটির মতন উদ্দীপিত হয়ে উঠবে । শহরটা জলের কিনারায় ; লোকে বলে শ্বেতপাথরের তৈরি, আর সেখানকার জনগণের উদ্ভিদ সম্পর্কে এমন ঘৃণা যে সব গাছপালা কেটে ফ্যালে । ন তোমার পছন্দ মতো একটা দেশ : আলো এবং আকরিক পদার্থে গড়া ভূদৃশ্য, আর তাদের প্রতিফলিত করার জন্য তরল !”
    সাড়া দেয় না আমার আত্মা ।
    “যেহেতু তুমি নীরবতা আর বহমানতার প্রদর্শনী ভালোবাসো, তুমি কি হল্যাণ্ডে গিয়ে বসবাস করতে চাইবে, মোহময় দেশে ? হয়তো ওই দেশে তোমার চিত্তবিনোদন করা হবে যার ছবি তুমি প্রায়ই মিউজিয়ামগুলোয় দেখে মুগ্ধ হয়েছ । তুমি রোটারডম সম্পর্কে কী ভাবো, তুমি তো জঙ্গল আর মাস্তুলশ্রেনি ভালোবাসো, আর বাড়ির বাইরে নোঙরবাঁধা নৌকো ?”
    আমার আত্মা বোবা হয়ে থাকে ।
    “ব্লাটভিয়া কি তোমার মুখে বেশি হাসি ফোটাবে ? সেখানে আমরা ক্রান্তিমন্ডলের সৌন্দর্যের সঙ্গে ইউরোপীয় কর্মশক্তির মেলবন্ধন খুঁজে পাবো ।”
    একটি শব্দ নয় -- আমার আত্মা কি মৃত ?
    “তাহলে, তুমি কি এতোই অনড় যে নিজের রোগ থেকেই কেবল আনন্দ পেতে চাও ? যদি তাইই হয়, তাহলে চলো সেইসব দেশে পালাই যারা মৃত্যুর সদৃশ । --- আমি জানি তুমি কী চাও, বেচারা আত্মা ! আমরা তোর্নিও যাবার জন্য বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নেবো । আমরা আরও দূরে চলে যাবো, বালটিকের একেবারে শেষ পর্যন্ত ; এমনকি জীবন থেকে বহুদূরে, যদি তা সম্ভব হয় ; আমরা মেরুঅঞ্চলে বাসা বাঁধবো । সেখানে সূর্য পৃথিবীর কাছে তীর্যকভাবে আসে, এবং আলো ও রাত্রির ধীর পরিবর্তন বৈভিন্ন্যকে দমন করে একঘেয়েমিকে প্রশ্রয় দেয়, তা আরেক ধরনের শূন্যতা । সেখানে আমরা বহুক্ষণ ছায়ায় স্নান করতে পারবো, কেবল সেই সময়ে, যখন, ক্ষণে-ক্ষণে, উত্তরের আলো তাদের গোলাপি পিচকারি দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করবে, তা দেখে নরকের আতশবাজির প্রতিফলন মনে হবে !”
    শেষ পর্যন্ত আমার জ্ঞানী আত্মা কান্নায় ভেঙে পড়ে : “যেখানে হোক ! যেখানে হোক ! এই জগতের বাইরে যেখানে হোক !”

    উনপঞ্চাশ
    চলো গরিবদের ধরে পেটাই !
    সপ্তাহ দুয়েক আমি ঘরবন্দি ছিলুম, আর সেই সময়ের ফ্যাশান অনুযায়ী আমি নিজের চতুর্দিক বই দিয়ে ঘিরে রেখেছিলুম ( ঘটনাটা ষোলো বা সতেরো বছর আগের ); মানে সেই ধরনের বই যা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জনগণকে সুখি, জ্ঞানী আর ধনী করে তোলার শিল্প প্রতিপাদন করে।
    ফলে আমি হজম করলুম -- কিংবা গিললুম, আমি বলতে চাই -- জনগণের আনন্দের সকল ঠিকাদারদের লেখা দীপালোকের গন্ধ-মাখানো যাবতীয় পণ্ডিতি রচনা --- তাঁরা যাঁরা উপদেশ দিলেন যে গরিবদের সবায়ের উচিত কেনা গোলাম হয়ে যাওয়া, আর তাদের যাঁরা বোঝাতে লাগলেন যে তারা আসলে রাজপরিবারের সিংহাসনচ্যুত মানুষ । তাহলে অবাক হবার কথা নয় যে, আমি মূর্খতার কিনার বরাবর মাথা-ঝিমঝিমে অবস্হায় বিরাজ করছিলুম।
    তবু আমার মনে হলো যে আমি টের পাচ্ছি, আমার বোধের গভীরে কোথাও চাপা পড়ে আছে, এমন একটা ধারণার অজ্ঞাত বীজানু, যা বুড়ি বউদের ফরমুলার অভিধানের তুলনায়, যা এক্ষুনি পড়লুম, তার চেয়ে উচ্চতর । কিন্তু তা ছিল ধারণার অন্তর্গত ধারণা, এমনকিছু যা সীমাহীনভাবে অস্পষ্ট । আর আমি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্হায় বাইরে বেরিয়ে পড়লুম । কেননা বাজে কিছু পড়ার আবেগান্বিত রুচি সমান্তরালভাবে খোলা হাওয়া আর ঠাণ্ডা পানীয়ের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্রয় দেয় ।
    আমি একটা মদের ঠেকে ঢুকতেই যাচ্ছিলুম, একজন ভিখারি তার টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, ভুলতে পারা যাবে না এমন এক চাউনি মেলে যা সিংহাসন ওলোটপালোট করে দিতে পারে --- মন যদি বস্তুকে সক্রিয় করে তুলতে পারে, কিংবা সন্মোহনকারীর দৃষ্টি যদি আঙুরফলে পাক ধরাতে পারে তেমন ।
    একই সঙ্গে, আমার কানে একটা গলার আওয়াজের ফিসফিসানি শুনতে পেলুম, একটা কন্ঠস্বর যা আমি তক্ষুনি ভালোভাবে চিনতে পারলুম ; ওটা ছিল ভালো দেবদূতের কন্ঠস্বর, কিংবা ভালো দানবের, যে সদাসর্বদা আমার সঙ্গে থাকে । যেহেতু সক্রেটিসের ছিল ভালো দানব, আমার কেন ভালো দেবদূত থাকবে না, আর কেনই বা আমি, সক্রেটিসের মতন, আমার নিজের পাগলামির প্রমাণপত্র পাবার গৌরবে অভিষিক্ত হবো না, কৌশলী লেলুট এবং বিচক্ষণ বেইলারজারের সই করা ?
    সক্রেটিসের আর আমার রাক্ষসের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে : ওনারটা ওনাকে দেখা দিয়েছিল বারন করার জন্য, হুশিয়ার করার জন্য, প্রতিরোধ করার জন্য, যখন কিনা আমারটা অভীষ্টপূরণের জন্য এসেছিলেন উপদেশ দিতে, স্মরণ করাতে, যুক্তি-পরামর্শ দিতে । বেচারা সক্রেটিসের ছিল এক নেতিবাচক রাক্ষস ; আমার অত্যন্ত ইতিবাচক, কর্মশক্তি প্রয়োগের রাক্ষস, লড়ে যাবার রাক্ষস ।
    এখন, আমার রাক্ষস কানে-কানে বলল : “অন্যের সমান সে-ই একমাত্র মানুষ যে তা প্রমাণ করতে পারে, আর একমাত্র সেই মানুষই মুক্তির হকদার যে জানে তা কেমন করে হাসিল করতে হবে ।”
    তক্ষুনি, আমি ভিখারিটার ওপরে ঝাঁপালুম । একটা ঘুষিতে ওর একটা চোখ কালো করে দিলুম, যা ক্ষণেকেই বলের মতন ফুলে উঠলো । ওর দুটো দাঁত ভাঙতে গিয়ে আমার একটা নখে চোট লাগল, এবং যেহেতু আমার কখনও মনে হয়নি যে গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, অত্যন্ত রুগ্ন জন্মের কারণে আর বক্সিঙের বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না বলে, বুড়ো লোকটাকে তাড়াতাড়ি কাবু করার জন্যে আমি এক হাতে ওর কলার চেপে ধরলুম আর অন্য হাতে ওর গলা টিপে ধরলুম, আর জোরে-জোরে ওর মাথা দেয়ালে ঠুকতে আরম্ভ করলুম । আমি স্বীকার করছি যে এই সব করার আগে আমি চারিপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলুম, আর দেখে নিয়েছিলুম যে ফাঁকা শহরতলিতে যেখানে আমি রয়েছি তা পুলিশের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিরাপদ জায়গায় ।
    তারপর, ষাট বছরের দুর্বল বুড়োটাকে মাটিতে ফেলে, আমি ওর পেছনে একটা দ্রুত লাথি মারলুম, ওর শিরদাঁড়া ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট, কাছাকাছি গাছের যে ডাল ঝুলছিল তা হাতে নিয়ে, বিফস্টিক রাঁধুনি একগুঁয়ে মেজাজে যেমন মাংস নরম করে, ওকে তেমন পেটালুম ।
    হঠাৎই --- আরে, অলৌকিক ঘটনা ! আহা , তত্বের গুরুত্ব প্রমাণ করার কি আনন্দ দার্শনিকের !---আমি দেখলুম প্রাচীন লাশ নড়েচড়ে উঠল, আর আমাকে এতো জোরে আক্রমণ করল যে আমি ভাবতেই পারিনি ভেঙে-পড়া যন্ত্রে অমন ক্ষমতা আছে ; আর, ঘৃণার চাউনি মেলে, যা আমার মনে হলো ভবিষ্যৎসূচক লক্ষণ, জরাজীর্ণ বুড়ো বজ্জাতটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার দুটো চোখকেই কালো করে দিলো, ঘুষি মেরে আমার চারটে দাঁত উপড়ে ফেললো, আর সেই একই গাছের ডালটা নিয়ে আমাকে মার দিয়ে প্লাস্টারের চেয়ে চ্যাপ্টা করে দিলো । --- আমার ঝাঁঝালো ওষুধ পেয়ে, আমি ওকে ওর গর্ব আর জীবন ফেরত দিলুম।
    তারপর, নানা ইশারার মাধ্যমে আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে, আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পোরটিকোর কুতার্কিকদের পরিতৃপ্তিসহ, আমি ওকে বললুম : “স্যার, আপনি আমার সমকক্ষ ! আমার টাকাকড়ি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করার সুযোগ দিন ; আর মনে রাখুন, আপনি যদি প্রকৃত লোকহিতৈষী হন, যখনই আপনার কোনো সহযোগী ভিক্ষা চাইবেন, আপনি তাদের ক্ষেত্রে একই তত্ব প্রয়োগ করবেন যা আমি আপনার ক্ষেত্রে পয়োগ করার জন্য এতো কষ্ট করলুম ।”
    ও আমাকে আশ্বস্ত করল যে আমার তত্ব বুঝেছে, আর ও আমার উপদেশ মেনে চলবে ।

    পঞ্চাশ
    ভালো কুকুরেরা
    জোসেফ স্টেভেন্সের জন্য
    বুফোঁ ( যিনি পশুদের জীবন নিয়ে লিখেছেন ) সম্পর্কে আমার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে আমি কখনও কুন্ঠিত হইনি, এমনকি আমার শতকের তরুণ লেখকদের কাছেও ; কিন্তু বর্তমানে, প্রকৃতির তাবৎ সৌন্দর্যকে যে চিত্রকর উপস্হাপন করেন, আমাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর আত্মাকে আর জাগিয়ে তুলবো না । উহুঁ।
    আমি বরং যেচে স্টার্নকে ডাক দেবো, আর তাঁকে বলব : “স্বর্গ থেকে নেমে আসুন, কিংবা এলিসিয় মাঠ থেকে আমার দিকে উঠে আসুন যাতে আমি ভালো কুকুরদের, খারাপ কুকুরদের, গুণগান করতে পারি, আপনার উপযোগী গান, হে ভাবপ্রবণ সিক, হে অতুলনীয় সঙ ! যে গাধাটা সব সময় আপনার সঙ্গে থাকে, ভবিষ্যতের স্মৃতির জন্য তার পিঠে চেপে ফিরে আসুন ; এবং সর্বোপরি, গাধাটাকে ভুলতে দেবেন না, তার ঠোঁটের মাঝে পরিচ্ছন্নভাবে ঝুলিয়ে আনতে, বাদামে তৈরি তার অমর বিস্কুট ! বিদ্যায়তনিক সৃষ্টিপ্রতিমার নাগালের বাইরে ! শালীনতার ভানকারী ওই বুড়ির আমার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি পরিচিত সৃষ্টিপ্রতিমাকে আহ্বান জানাই, শহরের যুবতী, জীবন্ত, যাতে সে আমায় ভালো কুকুর, খারাপ কুকুর, বাজে গন্ধের কুকুর, গায়ে পোকাধরা ক্ষতিকর কুকুর যেগুলোকে সবাই হ্যাট-হ্যাট করে তাড়ায়, তাদের নিয়ে গান গাইতে সাহায্য করে, তারা গরিবদের সহচর, আর কবিরা তাদের ভাইয়ের দৃষ্টিতে সম্ভ্রম করে ।
    ফুলবাবু কুকুরদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, চারপেয়ে জড়বুদ্ধিগুলো, গ্রেট ডেন, কিঙ চার্লস, খ্যাঁদানাকি, কিংবা স্প্যানিয়েল, নিজেকে এতোই ভালোবাসে যে কেউ বেড়াতে আসলে তার পায়ের মাঝে বা কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন তাকে নিশ্চয়ই আদর করা হবে, বাচ্চার মতন চেঁচামেচি করে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো লোকের মতন বোকা, চাকরের মতন বদমেজাজি আর উদ্ধত ! এবং চার-থাবার সাপগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, দুলুনিখোর ও অলস, যার নাম গ্রেহাউণ্ড, যার প্রলম্বিত চোয়ালে গন্ধ শোঁকার যৎসামান্যও বোধ নেই যে কোনো বন্ধুর গমনপথ অনুসরণ করবে, যার চ্যাপ্টা মাথায় ডমিনো খেলার মতন বুদ্ধিটুকুও নেই !
    এই সমস্ত ক্লান্তিকর পরগাছা নিয়ে ফেরা যাক কুকুরের কাঠঘরে ! ফেরা যাক তাদের রেশমের গদি-বসানো কুকুরবাসায় !
    আমি নোংরা কুকুরের গান গাই, দরিদ্র কুকুরের, গৃহহীন কুকুরের, অবাঞ্ছিত কুকুরের, ডিগবাজিখোর কুকুরের, যে কুকুরের সহজপ্রবৃত্তি, গরিবের মতন, জিপসির মতন, এবং অভিনেতার মতন, প্রয়োজনের দ্বারা চমৎকারভাবে তীক্ষ্ণ, সেই ভালো মা, বোধবুদ্ধির প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক নারী !
    আমি অভাগা কুকুরদের গান গাই, তারা একা ঘুরে বেড়াক, বিশাল শহরের ঘুরপাক গর্তগুলোয়, কিংবা সেইগুলো যারা তাদের কানা আধ্যাত্মিক চোখে পরিত্যক্ত লোকেদের বলে : “আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো, এবং আমাদের দুজনের দুর্দশা থেকে আমরা একরকম আনন্দ সৃষ্টি করতে পারবো !”
    “কুকুরগুলো কোথায় যায় ?” নেসতর রোকেপ্লাঁ একবার এক চিরস্হায়ী প্রবন্ধ লিখেছিলেন যে লেখাটা তিনি নিজেই হয়তো ভুলে গেছেন, আর যা কেবল আমি, এবং সম্ভবত স্যঁৎ বভ, আজ পর্যন্ত মনে রেখেছি ।
    কুকুরগুলো কোথায় যায়, আপনি জিগ্যেস করুন, হে অনাগ্রহী লোকজন ? তারা নিজের কাজে যায় ।
    কাজের সমাবেশ, প্রণয়লীলার সমাবেশ । কুয়াশার ভেতর দিয়ে, তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে, কাদার ওপর দিয়ে, জ্বলন্ত কুকুরদিবসের রোদে, তুমুল বৃষ্টিতে তারা যায়, তারা আসে, তারা হাঁটে, তারা ঘোড়ারগাড়ির তলা দিয়ে বেরোয়, পোকা কিংবা আবেগে চালিত হয়ে, কর্তব্যকর্মের দিকে যায় । আমাদের মতোই তারা ভোরবেলা ওঠে আর রোজগারের চেষ্টা করে কিংবা নিজেদের আনন্দের পেছনে দৌড়োয় ।
    অনেকে শহরতলির ভাঙাচোরা বাড়ির তলায় শোয় আর প্রতিদিন একই সময়ে র‌য়াল প্যালেসের
    রান্নাঘরের দরোজার সামনে টুকরো-টাকরা ভিক্ষা চায় ; অন্যেরা দলবেঁধে পাঁচ মাইল দৌড়োয় কোনো অবিবাহিতা ষাট বছরের বুড়িদের রাঁধা দাতব্য খাবার ভাগাভাগির জন্য, যে বুড়িরা তাদের দাবিদারহীন হৃদয়কে পশুদের বিলিয়ে দেন কেননা মূর্খ লোকেরা আর তাঁদের চায় না ।
    অন্যেরা, পলাতক কেনা-গোলামের মতন প্রেমে পাগল, নিজের এলাকা ছেড়ে নির্দিষ্ট দিনে শহরে এসে কোনো সুন্দরী কুকুরীর চারিপাশে ঘণ্টাখানেকের জন্য ক্রীড়াচঞ্চল হয়ে ওঠে, যে কুকুরী নিজের চেহারাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, গর্বিত ও কৃতজ্ঞ হয় ।
    এবং তারা সকলেই বেশ আচারনিষ্ঠ ও সময়নিষ্ঠ, কোনোরকম রোজনামচা, খাতা বা পকেটবই ছাড়াই ।
    আপনি কি শ্রমবিমুখ বেলজিয়ামে গেছেন, এবং মুগ্ধ হয়েছেন, আমার মতন, কসাইয়ের গাড়ির পেছনে বাঁধা প্রাণবন্ত কুকুরগুলোকে দেখে, কিংবা গয়লানির গাড়ি, বা পাঁউরুটিঅলার ঠেলার পেছনে বাঁধা, যাদের জয়ধ্বনির ঘেউঘেউ ঘোড়াদের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গর্ববোধ ও আনন্দ অনুভবের প্রমাণ ? যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দুটি কুকুরের বিষয়ে ভেবে দেখুন যারা সভ্য সমাজস্তরের সদস্য । অনুমতি দিন আপনাকে একজন রাস্তার ক্রীড়া-প্রদর্শনকারীর ঘরটা দেখাই যে অনুপস্হিত । একটা রঙকরা কাঠের খাট, কোনও পর্দা নেই, ছারপোকাভর্তি কোঁচকানো চাদর, খড়ের গদিতে ঠেসান দেবার দুটো চেয়ার, একটা লোহার উনোন, একটা বা দুটো সঙ্গীতযন্ত্র । হায়, দুঃখি আসবাবপত্র ! কিন্তু চেয়ে দেখুন্, যদি দেখতে চান, ওই দুটি মেধাবী চরিত্র, মামুলি ও বিলাসী, সৈনিক বা প্রেমের গীতিকবিতা রচয়িতার মতন শোভন, উনোন থেকে আসা রহস্যময় পাঁচমিশালি রান্নার দিকে খেয়াল রেখেছে, যা থেকে উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে বড়োসড়ো হাতা, এমনভাবে রাখা যেন কোনো অট্টলিকার ছাদে বাঁশের মতু উঁচু যাতে সংকেত দেয়া যায় যে রাজমিস্ত্রির কাজ এখনও শেষ হয়নি ।
    নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, নয় কি, যে অমন একান্ত অনুরত অভিনেতারা কাজে বেরোবার আগে পেটভরে কড়া, সারবান সুপ খেয়ে বেরোবেন না ? আর আপনার কি হিংসে হবে যদি এই বেচারা গরিবরা একটু আনন্দ করেন, কেননা তাঁদের তো প্রতিদিন জনগণের উদাসীনতা এবং ম্যানেজারের অসাধুতার মুখোমুখি হতে হয় --- যে লোকটা রোজগারের অধিকাংশ হাতিয়ে নেয়, যে চারজন অভিনেতার খাবার সুপ একাই খেয়ে নেয় ?
    আমি অনেকসময়ে লক্ষ্য করেছি, তাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আর তাদের সমব্যথার অংশীদার হয়ে, ওই চারপেয়ে দার্শনিকরা, ওই অনুগত, বশ্য, আত্মসমর্পণকারী কেনা-গোলামেরা, যাদের প্রজাতান্ত্রিক অভিধান বেসরকারি কেনা-গোলাম বলে সংজ্ঞায়িত করবে, যদি সেই প্রজাতন্ত্র, মানুষের সুখ সম্পর্কে অত্যধিক উদ্বিগ্ন হতো, কুকুরদের প্রাপ্য সন্মান নিয়ে চিন্তা করার সময় থাকতো ।
    এবং আমি অনেকসময়ে চিন্তা করেছি, ( যদিও, কে-ই বা তা জানে ? ) অমন সাহসকে পুরস্কৃত করার জন্য, অমন ধৈর্য ও পরিশ্রম, ভালো কুকুরদের জন্যে, গরিব কুকুরদের জন্যে , দুর্গন্ধিত ও অত্যাচারিত কুকুরদের জন্য একটা বিশেষ স্বর্গোদ্যান কোথাও তো হবে । কেননা সুইডেনবোর্গ তো জোর দিয়ে বলেছেন যে তুর্কিদের জন্য অমন বিশেষ জায়গা আছে, এবং আরেকটা আছে ওলন্দাজদের জন্যে !
    ভার্জিল এবং থিওক্রিটাসের মেষপালকরা, গানের প্রতিযোগীতায়, পুরস্কারের আশা করেছিল, সুস্বাদু পনির, সবচেয়ে ভালো কারিগরের তৈরি একটা বাঁশি, কিংবা থনে দুধভরা একটা ছাগলি । যে কবি বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন গাঢ় আর ফ্যাকাশে রঙের ফতুয়াকোট, হেমন্তের সূর্যের স্মারকের মতন, স্বাস্হ্যবতী রমণীর সৌন্দর্যের মতন, এবং ভারতীয় গ্রীষ্মের মতন ।
    যারা রু ভিলা হেরমোসা শুঁড়িখানায় উপস্হিত ছিল তারা কখনই ভুলবে না কতো উৎসাহে চিত্রকর তাঁর ফতুয়াকোট খুলে ফেলে কবিকে দিয়েছিলেন, কেননা তিনি ভালোভাবেই জানতেন বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শোনানো কতো ভালো এবং সৎ ।
    তাই তো প্রাচীন কালে একজন চমৎকার ইতালীয় স্বৈরাচারী তাঁর মণিরত্নখচিত দৈব আরেতিনো ছোরা অথবা দরবারি পোশাক একটি অসাধারণ সনেট অথবা কৌতূহলোদ্দীপক বিদ্রূপাত্মক কবিতা রচয়িতার সঙ্গে অদল-বদল করে নিয়েছিলেন ।
    এবং যখনই চিত্রকরের ফতুয়াকোট কবি পরে নেন, তিনি ভালো কুকুর, দার্শনিক কুকুর, ভারতীয় গ্রীষ্মকাল, আর যৌবনশেষের নারীদের সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারেন না ।
    [ রচনাকাল : ১৮৫৫ - ১৮৬৭ ]
    [ প্রকাশকাল : ১৮৬৯ ]
    [ অনুবাদ : ২০১৯ ]
  • Roberto Padilla ( Cuba ) | ***:*** | ০৩ জুলাই ২০১৯ ১২:০২383615
  • কিউবার কবি হার্বাতো পাডিলা-র কবিতা ( ১৯৩২ - ২০০০ )। [ এই কবিতাগুলো লেখার জন্য তাঁকে নয় বছর জেলে পোরা হয়েছিল] অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "খেলার বাইরে"
    বেটা কবি ! লাথি মেরে বের করে দাও।
    এখানে ওর কোনি কাজ নেই ।
    ও খেলতে জানে না । ও কখনও উত্তেজিত হয় না
    কিংবা স্পষ্ট করে কথা বলে ।
    ও এমনকি অলৌকিক ব্যাপার দেখতে পায় না ।

    "বৃদ্ধ কবি যা বলছেন"
    ভুলে যেও না কবি ।
    স্হান আর কাল যাইই হোক না কেন
    যার মধ্যে তুমি ইতিহাস গড়ো বা যন্ত্রণা পাও,
    একটা বিপজ্জনক কবিতা সব সময়ে ওৎ পেতে থাকবে
    তোমাকে আক্রমণ করার জন্য ।

    "প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য"
    তুমি ওদের কিউবার সর্বত্র দেখতে পাবে
    সবুজ বা হলুদ, জল থেকে আঁশের মতন উঠছে
    আর সূর্য, এই সময়ের যুদ্ধের সত্যকার ভূদৃশ্য।
    বাতাস কোকাকোলার পোস্টার ধরে টান মারে।
    ঘড়িগুলো ক্যানাডা ড্রাইয়ের দৌলতে পাওয়া, থেমে গেছে
    পুরোনো সময়ে ।
    নিয়নের বাতিগুলো, ভাঙা, বৃষ্টিতে ঝরে পড়ে ।
    এসসো বলতে অনেকটা এরকম বোঝায়: এস ও এস
    আর ওপরে কয়েকটা ঘষা অক্ষর, লেখা আছে
    স্বদেশ বা মৃত্যু ।

    "প্রতিশ্রুতি"
    কিছুকাল আগে
    আমি তোমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলুম অনেক প্রেমের কবিতার
    আর -- এখন দেখতেই পাচ্ছো -- আমি সেগুলো লিখতে পারছি না ।
    তুমি আমার পাশে বসেছিলে
    আর কাছেই যা রয়েছে তা সম্পর্কে লেখা অসম্ভব ।
    যা কারোর কাছে থাকা তা সব সময়ে কবিতা ।
    কিন্তু কয়েকটা সুস্পষ্ট ব্যাপার
    আমাদের একসঙ্গে নিয়ে আসা আরম্ভ করেছে--
    আমরা একই নিঃসঙ্গতা ভাগাভাগি করেছি
    আলাদা ঘরে
    নিজেদের সম্পর্কে কোনোকিছু না জেনেই।
    চেষ্টা করেছি, যে যার জায়গায়
    আমাদের মুখের চাউনিগুলো,
    যা হঠাৎই ওদের মেলাতে চেয়েছে

    কিছুকাল আগে
    আমি তোমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলুম অনেক প্রামের কবিতার
    আর -- এখন দেখতেই পাচ্ছো -- আমি সেগুলো লিখতে পারছি না
    তুমি আমার পাশে বসেছিলে
    আমরা ভেবেছিলুম হারিয়ে গেছি, মুছে গেছি
    আমাদের প্রথম বছরগুলো থেকে ।
    দরোজার টোকাগুলো আমার মনে আছে
    আর তোমার আতঙ্কিত কন্ঠস্বর,
    আর তুমি, আমার চোখ তখনও ঘুমে ভরা ।
    অনেক কাল যাবত
    তুমি প্রশ্ন করতে ইতিহাস আসলে কী ?
    আমি উত্তর দিতে পারতুম না, আমি ভাসা-ভাসা সংজ্ঞা বলতুম।
    তোমাকে সত্য কথা বলার সাহস আমার হয়নি ।

    "বাজিকরের গান"
    জেনারাল, যুদ্ধ চলছে
    আপনার আদেশ আর আমার গানের মাঝে ।
    এটা সব সময়ে চলতে থাকে
    রাত, দিন
    এটা ক্লান্তি বা ঘুমের কথা জানে না--
    এমন যুদ্ধ যা অনেক বছর ধরে চলছে,
    এতো বেশি যে আমার চোখ কখনও সূর্যোদয় দ্যাখেনি
    যার মধ্যে আপনি, আপনার আদেশ, আপনার অস্ত্র, আপনার পরিখা
    কোনো স্হান পায়নি ।
    এক ঘনঘোর যুদ্ধ, নান্দনিকভাবে বলতে হয়, আমার ছেঁড়া পোশাক
    আর আপনার সামরিক পোশাক মুখোমুখি হয় ।
    একটা নাটুকে লড়াই--
    শুধু ঝলমলে মঞ্চের অভাব
    যেখানে কৌতূকাভিনেতারা যেকোনও জায়গা থেকে আসতে পারে
    হুল্লোড় শুরু করতে পারে যেমনটা কার্নিভালে করে,
    প্রত্যেকেই নিজের আনুগত্য আর সাহস দেখাতে ব্যস্ত। জেনারাল, আমি আপনার ট্যাঙ্কবাহিনী ধ্বংস করে দিতে পারি
    আর জানি না কতোকাল এই যুদ্ধ চলবে
    কিন্তু প্রতিরাতে আপনার আদেশগুলো একটা মারা যায়
    তাকে মান্যতা না দিয়েই,
    আর অপরাজিত, আমার গানের কোনও একটা টিকে থাকে ।

    "কঠিন সময়ে"
    ওরা লোকটাকে জিগ্যেস করল ওরা কি
    ওর খানিকটা সময়ে নিয়ে ইতিহাসে জুড়ে দিতে পারে।
    ওরা ওর হাত দুটো চাইলো
    কেননা কঠিন সময়ে
    আক জোড়া হাতের চেয়ে ভালো কিছু হয় না ।
    ওরা ওর চোখ দুটো চাইলো
    যাতে এককালে অশ্রুফোঁটা ছিল
    যাতে ও আলোকিত দিকটা সম্পর্কে ভাবতে পারে
    ( বিশেষ করে জীবনের আলোকিত দিক )
    কেননা আতঙ্কের জন্য একটা চোখই যথেষ্ট ।
    ওরা ওর ঠোঁট দুটো চাইলো
    শুকনো আর ফাটা, সমর্থনের জন্য,
    দৃঢ়, প্রতিটি ইতিবাচকতার সঙ্গে, এক স্বপ্ন
    ( উচ্চতর জীবনের স্বপ্ন );
    ওরা ওর পা দুটো চাইলো,
    শক্ত আর শিরা বেরোনো,
    ( ওর উঁচু পা-ফেলার পা দুটো )
    কেননা কঢিন সময়ে
    একজোড়া পায়ের চেয়ে ভালো কিছু আছে
    ইঁট সাজাবার বা পরিখা খোঁড়ার জন্য ?
    ওরা ওর কাছে সেই ক্ষেতটা চাইলো যা ওকে শৈশবে খাবার যুগিয়েছে
    তার অনুগত গাছসুদ্ধ ।
    ওরা ওর বুক, ওর হৃদয়, ওর কাঁধ চাইলো ।
    ওরা ওকে বলল
    যে ওগুলো অত্যন্ত জরুরি।
    পরে ওরা ব্যাখ্যা করল
    যে এই দানগুলো অর্থহীন হয়ে যাবে
    যদি ও নিজের জিভটা না দেয়,
    কেননা কঠিন সময়ে
    ঘৃণা আর মিথ্যা থামাবার জন্য এতো উপকারী জিনিস আর নেই।
    আর শেষ পর্যন্ত ওরা ওকে অনুরোধ করল
    দয়া করে হাঁটতে আরম্ভ করুন
    কেননা কঠিন সময়ে
    নিঃসন্দেহে সেটাই নির্নায়ক পরীক্ষা ।
  • Arthur Rimbaud - A Season in H | ***:*** | ০৫ জুলাই ২০১৯ ১৭:৩৭383616
  • আর্তুর র‌্যাঁবো : নরকে এক ঋতু

    আগে কোনো এক সময়ে, যদি ঠিকমতম মনে থাকে, আমার জীবন ছিল ভুরিভোজের উৎসব যেখানে প্রতিটি হৃদয় নিজেকে মেলে ধরত, সেখানে অবাধে বয়ে যেতো সব ধরণের মদ ।

    একদিন সন্ধ্যায় আমি সৌন্দর্য্যকে জড়িয়ে ধরলুম — আর তাকে আমার তিতকুটে মনে হলো — আর আমি ওকে অপমান করলুম ।

    বিচারের বিরুদ্ধে নিজেকে করে তুললুম ইস্পাতকঠিন ।

    আমি পালালুম । ওহ ডাইনিরা, ওহ দুর্দশা, ওহ ঘৃণা, আমার ঐশ্বর্য্য ছিল তোমাদের হেফাজতে।

    যাবতীয় মানবিক আশা আমি নিজের মধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি । বিরূপ জানোয়ারের নিঃশব্দ লাফ নিয়ে আমি গলা টিপে মেরে ফেলে দিয়েছি প্রতিটি আনন্দ ।

    আমি জল্লাদদের আসতে বলেছি ; আমি তাদের বন্দুকের নল চিবিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে চাই। আমি বালি আর রক্তে রুদ্ধশ্বাস হবার জন্য নিম্নত্রণ করেছি মহামারী রোগদের । দুর্ভাগ্য ছিল আমার ঈশ্বর । আমাকে পাঁকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে, আর নিজেকে শুকিয়ে নিয়েছি অপরাধাত্মক হাওয়ায়। আমি উন্মাদনার সীমায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে মূর্খের খেলা খেলেছি ।

    আর বসন্তঋতুর দিনগুলো আমাকে এনে দিয়েছে বোকার আতঙ্কিত হাসি ।

    এখন কিছুদিন হলো, যখন আমি নিজেকে ভবিষ্যত অমঙ্গলের বার্তাবাহক হিসাবে আবিষ্কার করলুম, আমি ভাবতে লাগলুম পুরোনো দিনকালের ভোজনোৎসবের উৎসসূত্রের কথা, যেখানে আমি খুঁজে পাবো আবার নিজের বাসনার আকাঙ্খা ।

    সেই উৎসসূত্র হলো সর্বজনে প্রীতি — এই ধারণা প্রমাণ করে যে আমি স্বপ্ন দেখছিলুম !

    যে দানব একসময়ে আমাকে অমন সুন্দর আফিমফুলের মুকুট পরিয়েছিল, চিৎকার করে বলে ওঠে: “তুমি হায়েনা ইত্যাদি জানোয়ার হয়েই বেঁচে থাকবে”…। “মৃত্যুকে খুঁজবে তোমার আকাঙ্খাপুর্তির মাধ্যমে, আর যাবতীয় স্বার্থপরতা দিয়ে, আর সাতটি মারাত্মক পাপ দিয়ে।”

    আহ ! আমি সেসব অনেক সহ্য করেছি : তবু, হে প্রিয় শয়তান, অমন বিরক্তমুখে তাকিও না, আমি তোমার কাছে আবেদন করছি ! আর যতোক্ষণ অপেক্ষা করছি কয়েকটা পুরোনো কাপুরুষতার খাতিরে, কেননা তুমি একজন কবির মধ্যে সমস্ত রকমের চিত্রানুগ কিংবা নীতিমূলক স্বাভাবিকতার অভাবকে গুরুত্ব দাও, আমি তোমাকে এক অভিশপ্ত আত্মার রোজনামচা থেকে এই কয়েকটা অপবিত্র পৃষ্ঠা পাঠিয়ে দিচ্ছি ।

    বদ রক্ত

    ফরাসি দেশের প্রাচীন অধিবাসী গলদের থেকে আমি পেয়েছি আমার ফিকে নীল চোখ, একখানা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক, আর প্রতিযোগীতায় আনাড়িপনা । আমার মনে হয় আমার জামাকাপড় তাদের মতনই অমার্জিত ।

    কিন্তু আমি চুলে তেল লাগাই না ।

    সেই প্রাচীন অধিবাসী গলরা ছিল তাদের সময়ের অত্যন্ত মূর্খ চামার আর খড় পোড়ানোর দল। তাদের কাছ থেকে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি : প্রতিমা-উপাসনা, আর যা-কিছু পবিত্র তাকে নোংরা করে দেবার প্রতি টান ; ওহ ! যতোরকমের কদভ্যাস হতে পারে, ক্রোধ, লাম্পট্য, — ভয়ানক ব্যাপার, এই লাম্পট্য ; — তাছাড়া মিথ্যে কথা বলা, আর সবার ওপরে আলস্য ।

    যাবতীয় ব্যবসাপাতি আর কাজকারবার সম্পর্কে আমি বেশ আত্ঙ্কে ভুগি । কর্তাব্যক্তিদের আর খেটে-খাওয়া লোকেদের সম্পর্কে, ওরা সব্বাই চাষাড়ে আর মামুলি । যে হাত কলম ধরে থাকে তা লাঙল ধরে থাকা হাতের মতনই শুভ। — হাতের ব্যাপারে একটা শতাব্দী বলা যায় ! — আমি কোনোদিনও আমার হাত ব্যবহার করতে শিখবো না । আর হ্যাঁ, পারিবারিক ঝুঠঝামেলা তো আরও এক কাঠি বাড়া । ভিক্ষা চাওয়ার মালিকানা আমাকে লজ্জা দেয় । অপরাধীরা অণ্ডকোষহীন পুরুষদের মতোই নিদারুণ বিরক্তিকর : আমি আছি বহাল তবিয়তে, আর আমি কাউকে পরোয়া করি না ।

    কিন্তু ! কে আমার জিভকে এতো বেশি মিথ্যা-সুদর্শনে ভরে তুলেছে, যা কিনা আমাকে এতোদিন পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছে আর অলস করে রেখেছে ? আমি তো আমার জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে শরীরকেও ব্যবহার করিনি । ঘুমন্ত কোলাব্যাঙের আলস্যকে ছাপিয়ে, আমি সব রকমের জায়গায় বসবাস করেছি । ইউরোপে এমন কোনো পরিবার নেই যাদের আমি চিনি না। — পরিবার বলতে, আমি বোঝাতে চাইছি, যেমন আমার, যারা মানুষের অধিকারের ফতোয়ার জোরে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । — আমি প্রতিটি পরিবারের সবচেয়ে বড়ো ছেলেকে চিনি!

    ——————————-

    যদি ফ্রান্সের ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকতো !

    কিন্তু তার বদলে, কিছুই নেই ।

    আমি ভালো করেই জানি যে আমি চিরটাকাল এক নিকৃষ্টতর জাতির মানুষ । আমি দ্রোহ ব্যাপারটা বুঝতে পারি না । নেকড়ের পালের মতন কোনো জানোয়ারকে ছিঁড়ে খাবার জন্য, যা তারা নিজেরা মারেনি, আর লুঠপাচার বাদ দিলে, আমার জাতি কখনও উঠে দাঁড়ায়নি ।

    খ্রিস্টধর্মের বাড়ির বড়ো মেয়ে ফ্রান্সের ইতিহাস আমার মনে আছে । পবিত্র ভূমির জন্যে ক্রুসেডে লড়তে, আমিও চলে যেতে পারতুম, একজন গ্রাম্য চাকর হিসাবে ; আমার মগজের ভেতরে ব্যাভেরিয়ার বনানীর ভেতর দিয়ে অজস্র পথ রয়েছে, বসফরাসের বাইজেনটিয়াম সাম্রাজ্যের ছবি, জেরুজালেমের কেল্লা ; মেরির পুজোপদ্ধতি, ক্রুশকাঠে ঝোলানো যিশুর সম্পর্কে দুঃখদায়ক চিন্তা, আমার মগজের ভেতরে হাজার অবজ্ঞায় পুলকিত হতে থাকে। — রোদ্দুরের কামড়ে ধ্বসে পড়া দেয়ালের কিনারায়, ভাঙাচোরা মাটির বাসনকোসন আর বিছুটিবনের মাঝে আমি একজন কুষ্ঠরোগির মতন বসে থাকি । — আর তাছাড়া, আমি একজন উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে ভাড়াটে সৈনিক, জার্মান রাত্রির আকাশের তলায় সময় কাটাতুম ।

    আহ ! আরেকটা ব্যাপার : বুড়ি আর বাচ্চাদের দলের সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল লালচে ফাঁকা মাঠে আমি স্যাবাথছুটির নাচ নেচে চলেছি ।

    আমি এই দেশ আর খ্রিস্টধর্মের বিষয়ে বিশেষ কিছুই মনে রাখতে পারিনি । আমি নিজেকে চিরটাকাল অতীতে দেখতে পাবো । কিন্তু সবসময়ে একা ; পরিবারহীন ; প্রকৃতপক্ষে, কোন সেই ভাষা, যাতে আমি কথা বলতুম ? আমি কখনও নিজেকে যিশুখ্রিস্টের পারিষদবর্গের সদস্য হিসেবে দেখি না ; সন্তদের সভাতেও নয়, — যারা যিশুখ্রিস্টের প্রতিনিধি ।

    এক শতক আগে আমি ঠিক কী ছিলুম : আজকে আমি কেবল নিজেকে খুঁজে পাই । টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো সেইসব লোকগুলো, ধূসর যুদ্ধগুলো উধাও হয়ে গেছে । নিকৃষ্ট জাতি চেপে বসেছে সবার ওপরে — যাকে লোকে বলে জনসাধারণ, যুক্তিপূর্ণতা ; রাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ।

    আহ ! বিজ্ঞান ! সমস্তকিছু অতীত থেকে নিয়ে আসা হয় । শরীর আর আত্মার জন্যে, — শেষ আধ্যাত্মিক সংস্কার, — আমাদের রয়েছে ওষুধ আর দর্শনতত্ব, বাড়িতে সারিয়ে তোলার টোটকা আর নতুনভাবে বাঁধা লোকগান । এবং রাজকীয় আমোদপ্রমোদ, আর যে সমস্ত খেলাধুলা রাজারা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ! ভূগোল, আকাশবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যা, রসায়ন !…

    বিজ্ঞান, নবতর আভিজাত্য ! প্রগতি । জগতসংসার এগিয়ে চলেছে !…. আর কেনই বা তা করবে না ?

    আমাদের রয়েছে গণিতের দৃষ্টিপ্রতিভা । আমরা এগিয়ে চলেছি প্রাণচাঞ্চল্যের দিকে । আমি যা বলছি তা অমোঘ রহস্যপূর্ণ এবং ধ্রুবসত্য । আমি বুঝতে পারি, আর যেহেতু আমি পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট শব্দাবলী ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না, আমি বরং চুপ করে থাকবো ।

    পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট রক্ত ফিরে বইতে থাকে শরীরে ! প্রাণচাঞ্চল্য এখন আয়ত্বে, যিশু কেন আমাকে সাহায্য করেন না, কেন আমার আত্মাকে আভিজাত্য আর স্বাধীনতা দেন না । আহ ! কিন্তু যিশুর উপদেশাবলী তো অতীতের ব্যাপার ! খ্রিস্টের উপদেশাবলী ! খ্রিস্টের উপদাশাবলী !

    আমি হাঘরের মতন ঈশ্বরের জন্যে অপেক্ষা করি । আমি চিরকালের জন্যে, চিরকালের জন্যে, এক নিকৃষ্ট জাতের মানুষ ।

    আর এখন আমি উত্তরপশ্চিম ফ্রান্সের ব্রিট্যানির সমুদ্রতীরে । শহরগুলো সন্ধ্যায় তাদের আলোকমালা জ্বালিয়ে দিক । আমার দিনকাল ফুরিয়ে গেছে ; আমি ইউরোপ ছেড়ে চলে যাচ্ছি । সমুদ্রের হাওয়া আমার ফুসফুসকে গরম করে তুলবে ; হারিয়ে-যাওয়া আবহাওয়া আমার ত্বককে পালটে ফেলবে চামড়ায় । সাঁতার কাটার জন্যে, ঘাসভূমি মাড়িয়ে চলার জন্যে, শিকার করার জন্যে, সবচেয়ে প্রিয় ধোঁয়াফোঁকার জন্যে ; কড়া মদ খাবার জন্যে, সে মদ গলিয়ে ফেলা লোহার মতন কড়া, — আগুনের চারপাশে আমার প্রণম্য পূর্বপুরুষরা যেমন ভাবে বসে থাকতেন ।

    আমি লোহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ফিরে আসবো, কালো ত্বক, আর রাগি দুটো চোখ : এই মুখোশে, ওরা সবাই মনে করবে আমি উৎকৃষ্ট জাতির মানুষ । আমার কাছে থাকবে স্বর্ণভাঁড়ার : আমি হয়ে উঠবো নৃশংস আর শ্রমবিমুখ । যে দুর্ধষ্য পঙ্গুরা গ্রীষ্মমণ্ডলের দেশ থেকে ফিরে আসে, তরুণীরা তাদের সেবা করে । আমি রাষ্ট্রনীতিতে জড়িয়ে পড়বো । বেঁচে যাবো ।

    এখন আমি অভিশপ্ত, আমি আমার নিজের দেশকে অপছন্দ করি । সবচেয়ে ভালো হলো মাতাল অবস্হায় ঘুমোনো, চিলতেখানেক কোনো সমুদ্রতীরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া ।

    ————————–

    কিন্তু কেউই ছেড়ে চলে যায় না । — আরেকবার বেরিয়ে পড়া যাক আমাদের এলাকার পথে-পথে, আমার অধার্মিকতার ভার সঙ্গে নিয়ে, সেই অধার্মিকতা যা যুক্তিপূর্ণতার যুগ থেকে আমার অস্তিত্বে দুঃখকষ্টের শিকড় পুঁতে দিয়েছে — স্বর্গ পর্যন্ত উঠে যাওয়া, আমাকে বিদ্ধস্ত করে, ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায়, আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায় ।

    চরম পাপহীনতা, শেষ মায়া । সবকিছু বলা হয়ে গেছে । পৃথিবীতে আমার জঘন্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার নয় ।

    চলে এসো ! কুচকাওয়াজ করে, ভার কাঁধে তুলে, মরুভূমি, একঘেয়েমির বিরক্তি এবং ক্রোধ নিয়ে।

    কার কাছে গিয়ে ভাড়া করা মজুর হবো ? কোন সে জানোয়ারদের আদর করি ? কোন পবিত্র মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করি ? কেমনতর হৃদয়কে ভাঙি ? কোন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিই ? — কোন সে রক্তের নদী হেঁটে পার হই ? বরং বিচার থেকে দূরত্ব রাখা ভালো । — এক কঠিন জীবন, সুস্পষ্ট বিস্ময়, — কফিনের ঢাকা তোলার জন্যে একটা শুকনো মুঠো, শুয়ে থাকো, আর দম বন্ধ হয়ে যাক । এইভাবে বার্ধক্যে পৌঁছোবার কথা নয়, কোনো বিপদ নেই : সন্ত্রাস ব্যাপারটা অ-ফরাসী।

    –আহ ! আমি এমন পরিত্যক্ত যে নিজেকে কোনও না কোনও স্মৃতিমন্দিরে গিয়ে নিখুঁত হবার আবেগ উৎসর্গ করব ।

    ওহ আমার আত্ম-অস্বীকৃতি, আমার মনোমুগ্ধকর বিশ্বপ্রেম ! আমার নিঃস্বার্থপর ভালোবাসা ! অথচ তবু আমি এই তলানিতে !

    গভীর অতল থেকে কেঁদে উঠি, আমি আসলে একটা গাধা !

    ———————————-

    যখন আমি এক ছোট্ট শিশু ছিলুম, আমি সেই দণ্ডিত অপরাধীকে শ্রদ্ধা করতুম যার মুখের ওপর কারাগারের দরোজা সদাসর্বদা বন্ধ থাকবে ; আমি সেই সমস্ত মদের আসর আর ভাড়াদেয়া ঘরগুলোয় যেতুম যেগুলোকে তার উপস্হিতি পবিত্রতায় উন্নীত করেছে ; আমি তার চোখ দিয়ে নীলাকাশ আর ফুলে ছাওয়া মাঠের কর্মোন্মাদনা দেখতুম ; শহরের রাস্তায় আমি তার সর্বনাশা সুগন্ধকে অনুসরণ করেছি । তার ছিল সন্তদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা, যেকোনো অনুসন্ধানকারীর চেয়েও বেশি বোধশক্তি — আর সে, কেবল সে-ই ! নিজের মহিমা এবং নিজের ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষী ছিল ।

    শীতের রাতের ফাঁকা রাস্তা-বরাবর, ঘরছাড়া, ঠাণ্ডায় কাতর, আর ক্ষুধার্ত, একটা কন্ঠস্বর আমার হিমায়িত হৃদয়কে আঁকড়ে ধরল : “দুর্বলতা হোক বা শক্তিমত্তা : তুমি টিকে আছো, তাইই হলো শক্তিমত্তা । তুমি জানো না তুমি কোথায় চলেছো কিংবা কেন তুমি কোথাও যাচ্ছো, যেদিকে চাও যাও, সবাইকে জবাব দাও । কেউই তোমাকে মেরে ফেলবে না, তুমি শবদেহ হলে যেরকম করতো তার চেয়ে বেশি কিছু নয় ।” সকালবেলায় আমার চোখদুটো এতো বেশি ফ্যালফ্যালে হয়ে উঠেছিল আর মুখ শবের মতন ফ্যাকাশে, যে যাদের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছিল তারা যেন আমায় দেখতে পাচ্ছিল না ।

    শহরগুলোয়, কাদার রঙ আচমকা বদলে গিয়ে লাল আর কালো হয়ে উঠল, পাশের ঘরে আলোর শিখা কাঁপলে আয়নায় যেমন হয়, জঙ্গলে গুপ্তধনের মতন ! আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, গুড লাক, আর আমি দেখতে পেলুম আগুনশিখার সমুদ্র আর ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে ; এবং বাঁদিকে আর ডানদিকে, কোটি-কোটি বজ্রবিদ্যুতের মতন সমস্ত ঐশ্বর্য্য বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছিল।

    কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল পানোমত্ততা এবং নারীসঙ্গ ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব । এমনকি কোনো বন্ধুসঙ্গও নয় । আমি দেখলুম আমি একদল রাগি মানুষদের সামনে পড়ে গেছি, ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি, তারা যে দুঃখে কাঁদছিল তা তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছিল না, আর ক্ষমা করে দিচ্ছিল ! ঠিক যেন জোয়ান অব আর্ক ! — “যাজকরা, অধ্যাপকরা আর ডাক্তাররা, আপনারা আমাকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে ভুল করছেন । আমি কখনও আপনাদের একজন ছিলুম না; আমি কখনও খ্রিস্টধর্মী ছিলুম না ; আমি সেই জাতির মানুষ যারা ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গায়; আমি তোমাদের আইনকানুন বুঝি না ; আমার নৈতিক জ্ঞানগম্যি আছে ; আমি ভালোমন্দজ্ঞানশূন্য ; তোমরা একটা বড়ো ভুল করে ফেলছো…”

    হ্যাঁ, তোমাদের ঝলমলে আলোয় আমার চোখ বন্ধ । আমি একটি পশু, একজন কৃষ্ণাঙ্গ । কিন্তু আমার পরিত্রাণ সম্ভব । তোমরা সব নকল কৃষ্ণাঙ্গ ; বাতিকগ্রস্ত, বুনো, কৃপণ, তোমরা সবাই । ব্যবসাদার, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; জজসাহেব, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সেনাপতি, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সম্রাট, বুড়ো চুলকানো-মাথা, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; তুমি শয়তানের হেফাজত থেকে যে মদ খেয়েছো তাতে কেউ কর বসায় না । — এই দেশকে উৎসাহিত করে জ্বরের তাপ আর কর্কটরোগ । পঙ্গু আর বুড়ো মানুষেরা এতো বেশি শ্রদ্ধার পাত্র যে তারা চায় তাদের উষ্ণতাপে সেদ্ধ করা হোক । — সবচেয়ে ভালো হবে এই মহাদেশ ছেড়ে বিদায় নেয়া, যেখানে এই হতভাগাগুলোকে প্রতিভূ সরবরাহ করার জন্যে পাগলামি জিনিশটা ঘুরঘুর করে বেড়ায় । আমি প্রবেশ করবো ক্যাম্বোডিয়ার সত্যকার চাম রাজার সন্তানদের দেশে ।

    আমি কি প্রকৃতিকে বুঝতে পারি ? আমি কি নিজেকে বুঝতে পারি ? কোনও বাক্য আর আয়ত্বে নেই । আমি মৃত মানুষদের নিজের পাকস্হলিতে পুরে রাখি…হইহট্টোগোল, ঢোলঢোলোক, নাচো, নাচো, নাচো ! আমি সেই মুহূর্তের কথা চিন্তাও করতে পারি না যখন শ্বেতাঙ্গ মানুষরা পোঁছেচে, আর আমি শুন্যতায় তলিয়ে যাবো ।

    পিপাসা আর ক্ষুধা, হইহট্টোগোল, নাচো, নাচো নাচো !

    —————————–

    শ্বেতাঙ্গরা তীরে নামছে । কামানের গোলার আওয়াজ ! এখন আমাদের নির্ঘাত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হবে, পোশাক পরে তৈরি হও, আর কাজে বেরোও ।

    আমার হৃৎপিণ্ডকে ঈশ্বরিক করুণায় বিদ্ধ করা হয়েছে । আহ ! আমি কখনও ভাবিনি যে আমার জীবনে এই ঘটনা ঘটবে !

    কিন্তু আমি কোনও অন্যায় তো করিনি । আমার দিনগুলো হয়ে উঠবে স্বস্তিময়, এবং পশ্চাত্তাপ থেকে আমাকে মুক্তি দেয়া হবে । যেখানে আনাড়ম্বর আলোকমালা শোকসভার মোমবাতির মতন আরেকবার জ্বলে ওঠে, আমাকে আধমরা আত্মার শুভত্বে পীড়ন করা হবে না । প্রথম সন্তানের অদৃষ্ট, সময়ের আগেই জন্মানো কফিন যা ঝিলমিলে কান্নাফোঁটায় ঢাকা । কোনও সন্দেহ নেই, ন্যায়ভ্রষ্টতা হলো বোকামি, কদভ্যাস হলো বোকামি ; পচনবিকারকে সদাসর্বদা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে । কিন্তু দেয়ালঘড়িকেও শিখতে হবে বিশুদ্ধ যন্ত্রণার সময়নির্দেশের চেয়ে বেশিবার কাঁসরঘণ্টা কেমন করে বাজাতে হয় ! এই সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে, আমাকে কি শিশুর মতন তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, যাতে স্বর্গোদ্যানে গিয়ে খেলা করতে পারি ! তাড়াতাড়ি করো ! সেখানে কি অন্যান্য জীবনও আছে ? — বৈভবশালীদের পক্ষে শান্তিতে ঘুমোনো অসম্ভব । ঈশ্বর্য্য চিরকাল সবায়ের সামনে খোলামেলা থাকে । কেবল জ্ঞানের চাবিকাঠি দিতে পারে দেবোপম প্রেম। আমি তো দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতি একধরণের দয়ামায়ার প্রদর্শনী । বিদায় বিশপের আঙরাখায় ঢাকা আগুনের নিঃশ্বাস-ওড়ানো দানব, আদর্শবোধ আর ভুলভ্রান্তি ।

    উদ্ধারকারী জাহাজ থেকে ভেসে আসছে দেবদূতদের উদ্দেশ্যময় গান : এ হলো দেবোপম ভালোবাসা। — দুটি ভালোবাসা ! আমি জাগতিক প্রেমে মরে যেতে পারি, আনুগত্যের কারণে মরে যেতে পারি । আমি পেছনে ফেলে যাচ্ছি সেই সমস্ত প্রাণীদের, আমি চলে যাবার পর যাদের যাতনা ক্রমশ বাড়তে থাকবে ! বাতিলদের মধ্যে থেকে তুমি আমাকে বেছে নিয়েছো, যারা রয়ে গেলো তারা কি আমার বন্ধু নয় ?

    তাদের অমঙ্গল থেকে বাঁচাও !

    আমি নিমিত্তসিদ্ধির খাতিরে দ্বিতীয়বার জন্মেছি । জগৎসংসার বেশ শুভময় । আমি জীবনকে আশীর্বাদ করবো । আমি আমার ভাইবেরাদরদের ভালোবাসবো । বাল্যকালীন প্রতিজ্ঞার ব্যাপার আর নেই। বার্ধক্য আর মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার আশা নেই । ঈশ্বর আমার শক্তি, এবং আমি ঈশ্বরের বন্দনা করি ।

    —————————-

    একঘেয়েমি-জনিত বিরক্তিকে আমি আর পছন্দ করি না । দুর্বার-ক্রোধ, বিকৃতকাম, উন্মাদনা, যাদের সব কয়টি স্পন্দনাঘাত আর দুর্বিপাকের সঙ্গে আমি পরিচিত, — আমার সম্পূর্ণ ভার লাঘব হয়েছে । এবার আমার অপরাধশূন্যতার সীমাকে ঠাণ্ডা মাথায় মূল্যায়ন করা যাক।

    প্রহারের সন্তুষ্টি চাইবার মতন অবস্হায় আমি আর নেই । আমি কল্পনা করি না যে আমার শ্বশুর যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে আমি মধুচন্দ্রিমায় বেরিয়েছি ।

    আমি আমার নিজের যুক্তিজালে আটক জেলবন্দি নই । আমি তো বলেছি । হে ঈশ্বর । আমি উত্তরণের মাধ্যমে স্বাধীনতা চাই : আমি কেমন করে সেই দিকে যাবো ? ছেলেমানুষির সেই স্বাদ আর নেই । আর দরকার নেই দেবোপম ভালোবাসার কিংবা কর্তব্যের প্রতি উৎসর্জন। আমি ছেলেবেলার আবেগ ও অনুভবের ত্রুটিকে দোষ বলে মনে করিনা । যে যার নিজের যুক্তিপূর্ণতায়, অবজ্ঞায়, সর্বজনপ্রীতিতে রয়েছে : শুভবুদ্ধির দেবদূতোপম সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে নিজেকে রেখেছি আমি ।

    আর যদি সুস্হিত আনন্দের কথা বলতে হয়, গার্হস্হ হোক বা না হোক…। না, আমি পারবো না। আমি বড়ো বেশি তুচ্ছ, অত্যন্ত দুর্বল । কর্মকাণ্ড জীবনকে কুসুমিত করে তোলে, ওটা পুরোনো ধ্যানধারণা, আমার নয় ; আমার জীবন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা কর্মকাণ্ডের থেকে দূরে লক্ষ্যহীন ভেসে চলে যায়, পৃথিবীর সেই তৃতীয় মেরুঅঞ্চলে ।

    বুড়ি চাকরানি হয়ে যাচ্ছি আমি, মৃত্যকে ভালোবাসার সাহস হারিয়ে ফেলেছি !

    ঈশ্বর যদি আমাকে সেই দিব্যশান্তি দিতেন, নির্মল প্রশান্তি, এবং প্রার্থনা, — প্রাচীনকালের সন্তদের মতন — সেই সন্তরা ! তাঁরা ছিলেন শক্তিমন্ত ! নোঙোর, এমনই এক ধরণের শিল্পী যাঁদের প্রয়োজন আর আমাদের নেই !

    এই প্রহসনের কি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন ? আমাকে কাঁদাবার জন্যে আমার শুদ্ধতা যথেষ্ট। জীবন নামের প্রহসনে সবাইকে খেলতে হবে ।

    ————————–

    এবার থামাও ! এটা তোমার শাস্তি । — কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাও !

    আহ ! আমার ফুসফুস জ্বলছে, কপাল দপদপ করছে ! রাত্রি ঘনিয়ে আসছে আমার চোখে, এই সূর্যের তলায় ! আমার হৃদয়….আমার দুই হাত আর পাদুটো….

    আমরা কোথায় চলেছি ? যুদ্ধ করতে ? আমি বেশ দুর্বল ! অন্যেরা এগিয়ে চলেছে । যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র…আমাকে সময় দাও !

    গুলি চালাও ! আমাকে তাক করে গুলি চালাও ! নয়তো আমি তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো নিজেকে । — ভিতুর দল ! — আমি নিজেকে খুন করবো ! আমি নিজেকে ঘোড়ার খুরের তলায় নিক্ষেপ করবো !

    আহ !

    –আমি এ-সবে অভ্যস্ত হয়ে যাবো ।

    সেটাই হবে ফরাসি উপায়, শৌর্যের পথ ।

    নরকে এক রাত

    আমি এক্ষুনি মুখভরা ভয়ানক বিষ গিলে ফেলেছি । — আমাকে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল তাতে আমি মহিমান্বিত, মহিমান্বিত, মহিমান্বিত ! — আমার নাড়িভূঁড়িতে আগুন ধরে গেছে । বিষের ক্রিয়াক্ষমতায় আমার দুই হাত আর পাদুটো মুচড়ে উঠছে, পঙ্গু করে দিচ্ছে, মাটিতে থুবড়ে ফেলে দিয়েছে । তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, আমি কাঁদতে পারছি না । এ হলো নরক, অনাদি-অনন্ত যন্ত্রণাভোগ ! দ্যাখো আগুনের শিখা কেমনভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে ! আমার যাওয়া উচিত, আমি জ্বলেপুড়ে মরছি । চালিয়ে যাও, হে শয়তান !

    আমি একবার শুভের সঙ্গে আর প্রকাশসৌষ্ঠভের সঙ্গে কথা কইবার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলুম, পাপের শাস্তি হিসাবে নরকভোগ থেকে মুক্ত । কেমন করেই বা আমি নিজের দৃষ্টিপ্রতিভা বর্ণনা করবো, নরকের বাতাস বন্দনাগান গাইবার পক্ষে বড্ডো গাঢ় ! সুসংবদ্ধ আত্মিক ঐকতান, বলিষ্ঠতা এবং শান্তি, অভিজাত উচ্চাশা, তাছাড়া জানি না আরও কি ছিল সেখানকার লক্ষ-লক্ষ পরমানন্দিত প্রাণীদের ?

    পরমানন্দের উচ্চাশা !

    কিন্তু তবু আমি বেঁচে আছি ! — মনে করো নরকযন্ত্রণা হলো শাশ্বত ! একজন মানুষ যে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছে সে নিশ্চয়ই অভিশপ্ত, নয়কি ? আমার বিশ্বাস আমি নরকে রয়েছি, তার মানে আমি বেঁচে আছি । এই প্রশ্নোত্তরপর্বই কাজ করে চলেছে । আমি আমার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত কেনা-গোলাম । তোমরা, আমার বাপ-মা, আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছো, আর নিজেদের জীবনও । বেচারা খোকা ! — পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে নরক ক্ষমতাহীন । — আমি তবু বেঁচে আছি! পরে, নরকযন্ত্রণার মহানন্দ হয়ে উঠবে আরও নিগূঢ় । একটা অপরাধ, দ্রুত, আর মানুষের আইনে দণ্ডাদেশ পাওয়া আমাকে শূন্যতায় তলিয়ে যেতে দাও ।

    চুপ করো, তুমি কি চুপ করবে !…এখানে সবকিছুই লজ্জাকর আর কলঙ্কিত ; শয়তান বলছে যে আগুনটার কোনও মানে হয় না, বলছে যে আমার ক্রোধ হলো হাস্যকর এবং নির্বোধ। — আহ, থামো দিকিনি !…কেউ ফিসফিস করে ওই ভুলগুলোর কথা বলেছে, ইন্দ্রজালের সন্মোহন, বোকা-বানানো গন্ধ, শিশুতোষ সঙ্গীত । — আর এই কথা ভাবা যে আমিই সত্যের অধিকারী, যে আমার আয়ত্বে চলে আসতে পারে বিচারের দৃষ্টিপ্রতিভা : আমার নির্ণয় বিচক্ষণ আর দৃঢ়, নিখুঁত হয়ে ওঠার জন্যে আমি শ্রেষ্ঠগুণসম্পন্ন… গর্ববোধ । — আমার করোটি চেপে বসছে । দয়া করো ! হে নাথ, আমি সন্ত্রস্ত ! জল দাও, আমার তেষ্টা পাচ্ছে, আমার তেষ্টা পাচ্ছে ! আহ, শৈশব, ঘাসভূমি আর বৃষ্টি, পথের পাথরে জমা জল, যখন রাত বারোটা বাজে তখনকার চাঁদের আলো….শয়তান দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘড়িমিনারের ছাদে, ঠিক এখনই ! মেরি । পবিত্র অক্ষতযোনি !…ভয়ংকর মূর্খতা।

    ওই দিকে তাকাও, ওরা কি মাননীয় মানুষ নয়, যারা আমার ভালো চেয়েছে ?…এসো…মুখের ওপরে বালিশ, ওরা আমাকে শুনতে পাবে না, ওরা তো কেবল প্রেত।

    যাই হোক, কেউ আর অন্য কারোর কথা ভাবে না । ওদের কাছে আসতে দিও না । আমার গা থেকে নিশ্চয়ই পোড়া মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে ।

    আমার অলীকদৃশ্যগুলো অসংখ্য । এগুলোই আমাকে সব সময় সহ্য করতে হয়েছে : ইতিহাস সম্পর্কে আমার বিশ্বাসহীনতা, আদর্শগুলোকে উপেক্ষা । আমি এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলব না : কবিরা এবং দ্রষ্টারা ঈর্ষা করবে । আমি সকলের চেয়ে ধনী, কয়েক হাজার গুণ, আর আমি তা সমুদ্রের মতন আগলে রাখবো ।

    হে ঈশ্বর — এক মুহূর্ত আগে জীবনের ঘড়ি থেমে গেছে । আমি আর পৃথিবীর অন্তর্গত নই। — ব্রহ্মবিদ্যা সঠিক ; নরক নিশ্চয়ই নিচের দিকে — এবং স্বর্গ ওপরদিকে । — ভাবাবেশ, দুঃস্বপ্ন, ঘুম, আগুনের নীড়ের ভেতরে ।

    দেশের মধ্যে কেমন করে অলস ঘুরে বেড়ায় মন…শয়তান, ফার্দিনান্দ, বুনো বীজের সঙ্গে উড়ে যায়…যিশুখ্রিস্ট ময়ূরপঙ্খী রঙের কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে যান কিন্তু তাদের নত করেন না…যিশু হেঁটে যেতেন চঞ্চল সমুদ্রের ওপর দিয়ে । লন্ঠনের আলোয় আমরা ওনাকে সেখানে দেখেছি, শ্বেতবসনে, দীর্ঘ বাদামি চুল, পান্নারঙা এক ঢেউয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন ।

    যাবতীয় রহস্যের চাদর আমি ছিঁড়ে ফেলবো : ধর্মের রহস্য হোক কিংবা প্রকৃতি, মৃত্যু, জন্ম, ভবিষ্যৎ, অতীত, সৃষ্টির উৎপত্তিতত্ব, এবং শূন্যতার রহস্য । আমি হলুম মোহাবিষ্ট চোখে-দেখা অলীক ছায়ামূর্তিদের মালিক ।

    শোনো !…

    প্রতিটি কর্মদক্ষতাই আমার ! — এখানে কেউ নেই, ওখানে কেউ রয়েছে : আমি আমার ঐশ্বর্য নষ্ট করতে চাইবো না । — আমি কি তোমাকে আফরিকার বাঁশি শোনাবো, তলপেট-নাচিয়েদের ? আমি কি উধাও হয়ে যাবো, আমি কি চেষ্টা করবো গসপেল-কথিত আঙটি খুঁজে আনার । যাবো? আমি তৈরি করব সোনা আর ওষুধ ।

    তাহলে, আমাকে বিশ্বাস করো । বিশ্বাস আরাম দ্যায়, তা পথনির্দেশ করে এবং সারিয়ে তোলে। তোমরা সবাই আমার কাছে এসো, — ছোটো বাচ্চারাও — এসো তোমাদের সান্তনা দিই, তোমাদের সামনে আমার হৃদয়ের কথা মেলে ধরি — আমার অলৌকিক হৃদয় ! — হে দরিদ্রগণ, হে দরিদ্র শ্রমিকবৃন্দ ! আমি বন্দনাগান চাইছি না : তোমরা কেবল আমাকে বিশ্বাস করো, আর তাহলেই আমি আনন্দিত হবো ।

    — এবার, আমার কথা ভাবো । এই সবকিছু পৃথিবীকে হারানোর ব্যাপারে আমাকে তাড়িত করে না । আমি ভাগ্যবান যে আমাকে আর যন্ত্রণা পেতে হবে না । আমার জীবন, দুর্ভাগ্যবশত, মিষ্টি বোকামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।

    বাহ ! যতো রকমের কুৎসিত মুখভঙ্গী হতে পারে আমি তা করবো ।

    আমরা জগৎসংসারের বাইরে, নিঃসন্দেহে । কোনও শব্দ নেই । স্পর্শের বোধশক্তি আমার চলে গেছে । আহ, আমার দুর্গভবন, আমার স্যাক্সনি, আমার উইলোবনানী ! সন্ধ্যা ও সকাল, রাত আর দিন…আমি কতো ক্লান্ত !

    আমার ক্রোধের জন্যে একটা বিশেষ নরক থাকা উচিত ছিল, একটা নরক গর্ববোধের জন্যে, — এবং একটা নরক যৌনতার জন্যে ; নরকের এক পরিপূর্ণ ঐকতান-সঙ্গীত !

    আমি পরিশ্রান্ত, আমি মরে যাচ্ছি । এটাই কবর আর আমি কীটে পরিণত হয়ে চলেছি, আতঙ্ক ছাপিয়ে গেছে আতঙ্ককে ! শয়তান, ভাঁড় কোথাকার, তুই নিজের চমৎকারিত্ব দিয়ে আমাকে গলিয়ে ফেলতে চাইছিস । ঠিক আছে, আমি তাইই চাই । আমি তাই চাই । কোদালকাঁটা দিয়ে আমাকে গিঁথে ফ্যালো, আমার ওপরে আগুনের ফোঁটা ঝরাও ।

    আহ ! জীবনে ফিরে যাওয়া ! আমাদের বিকলাঙ্গতার দিকে তাকিয়ে দ্যাখা । আর এই বিষ, এই শাশ্বত অভিশপ্ত আলিঙ্গন ! আমার দুর্বলতা, এবং জগতসংসারের নির্দয়তা ! হে ঈশ্বর, দয়া করো, আমাকে লুকিয়ে ফ্যালো, আমি নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না — আমি আড়ালে রয়েছি, আর আমি নেইও ।

    আর যেমন-যেমন অভিশপ্ত আত্মা জেগে উঠতে থাকে, ঠিক তেমনই আগুনও ।

    প্রথম ডিলিরিয়াম : সেই বোকা অক্ষতযোনি মেয়ে

    নরকবাসী একজন পুরোনো বন্ধুর আত্মস্বীকৃতি শোনা যাক, “হে প্রভু, হে দিব্য বিবাহের বর, তোমার সবচেয়ে সমব্যথী পরিচারিকাদের আত্মস্বীকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না । আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি । আমি মাতাল । আমি অশুদ্ধ।

    এই কি জীবন !

    “ক্ষমা করো, স্বর্গের নিবাসী হে প্রভু, ক্ষমা করে দাও ! আহ ! ক্ষমা করো । এই কান্নার জল। এবং আরও যে অশ্রু পরে ঝরতে থাকবে, অনুমান করি !

    “পরে, আমি দিব্য বিবাহের বরের সঙ্গে দেখা করবো ! আমি তো জন্মেছিলুম তাঁর কেনা-গোলাম হবার জন্যে । — ওরা এবার আমাকে পিটুনি দিতে পারে !

    “ঠিক এখনই, জগতসংসারের শেষ ! ওহ, মেয়েরা…আমার বন্ধুনিরা !…না, আমার বন্ধুনিরা নয়…আমি কখনও এমনতর অবস্হা সহ্য করিনি, ডিলিরিয়াম, পীড়নসমূহ, সমস্তকিছু…এটা এমন অর্থহীন ।

    “ওহ ! আমি কাঁদছি, আমি কষ্ট পাচ্ছি । আমি সত্যিই যন্ত্রণাভোগ করছি । তবু আমার যা ইচ্ছা করার অধিকার রয়েছে, যখন কিনা আমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে সবচেয়ে অবজ্ঞেয় হৃদয়গুলোর অবজ্ঞা দিয়ে ।

    “ঠিক আছে, আমাকে আত্মস্বীকৃতি করতে দেয়া তো হোক, যদিও আমাকে হয়তো তা কুড়িবার নতুন করে আওড়াতে হবে, — এমনই নীরস, এবং এমনই গুরুত্বহীন !

    “আমি নারকীয় বিয়ের বরের একজন কেনা-গোলাম, সেই লোকটা যে বোকা অক্ষতযোনি মেয়েদের ফুসলিয়ে সতীত্বহানি করেছিল । ও একেবারে সেই রকমেরই শয়তান । ও মোটেই মায়াপুরুষ নয়, ও প্রেতও নয় । কিন্তু আমি, যে কিনা নিজের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, জগতসংসারের কাছে অভিশপ্ত আর মৃত ,– কেউই আমাকে খুন করতে পারবে না ! কেমন করে তোমার কাছে তার বর্ণনা করি ! এমনকি আমি কথাও বলতে পারছি না । আমি পরে আছি শোকের পোশাক, আমি কাঁদছি, আমি বেশ ভয়ার্ত । দয়া করো, হে প্রভু, একটু টাটকা বাতাস, যদি তোমার খারাপ না লাগে, দয়া করো !

    “আমি এক বিধবা…– আমি এক সময় বিধবা ছিলুম…–ওহ, হ্যাঁ, তখনকার সময়ে আমি ভীষণ গম্ভীর থাকতুম, আমি কংকাল হয়ে ওঠার জন্য জন্মাইনি !…ও ছিল কচিখোকা কিংবা বলা যায় প্রায়…ওর কোমল, রহস্যময় চালচলন আমাকে পুলকিত করেছিল । ওকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমি আমার সব কর্তব্য ভুলে গেলুম । কি যে এক জীবন আমরা কাটাই ! সত্যকার জীবনের অভাব রয়েছে । আমরা এই জগতসংসার থেকে নির্বাসিত, সত্যি — ও যেদিকে যায় আমিও সেই দিকে যাই, আমাকে যেতেই হয় । আর বেশির ভাগ সময়ে ও আমার ওপর ক্ষেপে যায়, আমার প্রতি, বেচারা পাপিষ্ঠ । সেই শয়তানটা ! ও সত্যিই একটা শয়তান, তুমি জানো, এবং মোটেই মানুষ নয় ।

    “ও বলে : “আমি মেয়েদের ভালোবাসি না । ভালোবাসাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে, আমরা তা জানি । মেয়েরা যা শেষপর্যন্ত চায় তা হল সুরক্ষা । একবার ওরা তা পেয়ে গেলে, প্রেম, সৌন্দর্য্য, সবই জানালার বাইরে কেটে পড়ে : যা তাদের কাছে রয়ে যায় তা হলো তাচ্ছল্য, আজকাল বিবাহ তার ওপরই টিকে থাকে । অনেক সময়ে আমি এমন তরুণীদেরও দেখেছি যাদের খুশি থাকার কথা, যাদের সাথে আমি সঙ্গলাভ করতে পারতুম, কিন্তু তাদের তো আগে থেকেই মাস্তানরা এমন গিলে খেয়েছে যেন কাঠের গুঁড়ি ছাড়া তারা আর কিছুই নয়…”

    “আমি ওকে শুনি, বদনামকে শৌর্যে পালটে ফেলছে, নিষ্ঠুরতাকে মায়ায় । “আমি প্রাচীন এক জাতির সদস্য : আমার পুর্বপুরুষরা ছিল ভাইকিং যোদ্ধা : তারা নিজেদের দেহ ফালাফালা করে ফেলতো, নিজেদের রক্ত পান করতো ।—আমি আমার সমস্ত শরীর ফালাফালা করে ফেলবো, উল্কি দেগে দেবো সারা শরীরে , আমি মোঙ্গোলদের মতন কুৎসিত হয়ে উঠতে চাই : তুমি দেখো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করতে চাই । আমি সত্যিই রাগে ফুঁসিয়ে উঠতে চাই । আমাকে হীরে-জওহরত দেখিও না ; আমি চার হাতেপায়ে জাজিমের ওপরে হামাগুড়ি দিয়ে দুমড়ে উঠবো । আমি চাই আমার ধনসম্পত্তি রক্তে জবজবে হয়ে উঠুক । আমি কখনও কোনো কাজ করবো না… “বহুবার, রাতের বেলায়, ওর দানব আমাকে কাবু করেছে, আর আমরা কুস্তির দাঁওপ্যাঁচে গড়াগড়ি খেয়েছি ! — অনেক সময়ে রাতের বেলায় যখন ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যায় তখন ও রাস্তার আনাচে-কানাচে কিংবা দরোজার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, যাতে আমাকে ভয়ে আধমরা করে দিতে পারে ।– আমি নির্ঘাৎ আমার গলা কেটে ফেলবো ; তা কি বিরক্তিকর হবে।” আর, ওহ ! সেই দিনগুলো যখন ও খুনি হবার ভান করে !

    “অনেক সময়ে ও ওর দেশোয়ালি বুলিতে কথা বলে, তা একেবারে আবেগে ঠাশা, মৃত্যু সম্পর্কে, আর তা কেমন করে আমাদের অনুতপ্ত করে, এবং জগতসংসারে নিশ্চয়ই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আছে, শ্রমে পরিশ্রান্ত, আর বিদায় জানাবার প্রসঙ্গ তোলে এবং তা কেমন করে তোমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে ফ্যালে । যে নোংরা পানশালাগুলোতে ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যেতো, তখন আমাদের চারিপাশের লোকজনদের দেখে কাঁদতো — যেন বস্তি-অঞ্চলের গোরুমোষ । অন্ধকার রাস্তায় মাতালদের তুলে নিতো । ছোট্ট খোকাদের জন্য নির্দয় মায়ের দয়ামায়া ছিল ওর । রবিবারের স্কুলের পথে এক ছোট্ট খুকির মতন মধুরস্বভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো । ও ভান করতো যেন সবকিছুই জানে, ব্যবসাপাতি, শিল্প, ওষুধ । — আর আমি সবসময় ওর সমর্থন করতুম, আমাকে করতে হতো !

    “ও নিজের কল্পনাজগতে যেসব ঝালর ঝুলিয়ে রাখতো তা আমি সুস্পষ্ট দেখতে পেতুম ; পোশাক-পরিচ্ছদ, কারিগরি, আসবাবপত্র….আমিই ওকে অস্ত্র ধার দিয়েছিলুম, আর মুখভঙ্গীতে রদবদল । ওকে যাকিছু প্রভাবিত করতো তা আমি টের পেতুম, ঠিক যেমনভাবে ও নিজেকে কল্পনা করে নিতো । যখনই ওকে মনে হয়েছে হতোদ্যম, আমি ওকে অদ্ভুত দুর্বোধ্য অভিযানে অনুসরণ করতুম, চলেছি তো চলেইছি, শুভ হোক বা অশুভ : কিন্তু আমি সবসময়ে জানতুম যে আমি ওর জগতের অংশীদার হতে পারবো না । ওর প্রিয় দেহের পাশে, শুয়ে থাকার সময়ে, জেগে থাকতুম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত, ভাবতে চেষ্টা করতুম যে কেন ও বাস্তব থেকে পালিয়ে যেতে চায় । এর আগে আর কোনো লোকের এই রকম ইচ্ছে হয়নি । আমি বুঝতে পেরেছিলুম, ওর সম্পর্কে বিনা ভয়ে — যে, সমাজের পক্ষে ও ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে । ওর কি, হয়তো, এমন কিছু গোপন ব্যাপার ছিল যা ওর জীবনের নবীকরন ঘটাবে ? না, আমি নিজেকে বলেছি, ও কেবল সেগুলোকে অনুসন্ধান করছিল । কিন্তু তবু, ওর বদান্যতা এক সন্মোহনে আবৃত, এবং আমি তাতে বন্দী । আর কারোর অমন শক্তিক্ষমতা থাকতে পারে না — হতাশার শক্তিক্ষমতা — তা সহ্য করবার, ওর ভালোবাসা আর শুশ্রুষা সহ্য করার ক্ষমতা । তাছাড়া, অন্য কারো সাথে আমি ওকে কল্পনাও করতে পারি না : আমাদের সকলের রয়েছে নিজস্ব কালো-দেবদূতের চোখ, অন্য লোকেদের দেবদূতদের নয়, — অন্তত আমি তাইই মনে করি। আমি ওর আত্মার ভেতরে বাসা বেঁধেছিলুম, যেন তা ছিল এক ফাঁকা প্রাসাদ যাতে সবচেয়ে অযোগ্য লোক হিসাবে তুমিই তাতে থাকো : ব্যাস এইটুকুই । আহ! সত্যি বলতে কি আমি ওর ওপর শোচনীয়ভাবে নির্ভর করতুম । কিন্তু আমার নিষ্প্রভ, আমার ভিতু অস্তিত্ব থেকে ও কিই বা চাইতো ? ও তো আমার উৎকর্ষসাধন করতে পারতো না, যদিও ও কখনও আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্হা করতে পারেনি ! আমি এমন ভেঙে পড়ি আর হতাশ হই : অনেকসময়ে আমি ওকে বলি: “আমি তোমাকে বুঝতে পারি।” ও তাতে কেবল কাঁধ নাচায় ।

    “আর তাই আমার হৃদয়ের বেদনা বাড়তেই থাকলো, আর আমি দেখলুম যে বেশি করে ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছি — আর সবাই তা হয়তো দেখতে পেয়েছে, নিশ্চয়ই, আমি যদি এতোটা অবজ্ঞেয় না হতুম তাহলে কেউই আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখতো না ! আর তবু আমি ওর অনুরাগের জন্যে আকুল কামনা করেছি…ওর চুমুগুলো আর ওর বন্ধুত্বের আলিঙ্গন ছিল স্বর্গীয়– অন্ধকার স্বর্গ, যার মধ্যে আমি প্রবেশ করতে পারতুম, আর যেখানে আমি চাইতুম আমাকে রেখে দেয়া হোক — গরিব, বধির, বোবা, এবং অন্ধ । আমি ইতিমধ্যে ওর ওপর নির্ভর করা আরম্ভ করেছিলুম । এবং আমি কল্পনা করতুম যে আমরা দুজন সুখী বালক দুঃখের স্বর্গোদ্যানে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি । আমাদের মধ্যে ছিল চরম সামঞ্জস্য । গভীর সমবেদনায়, আমরা পাশাপাশি খেটেছি । কিন্তু তারপর, এক ছিঁড়েফেলা আলিঙ্গনের শেষে, ও বলে উঠবে : “কতো মজার মনে হবে এই সমস্ত কাণ্ড, যা তুমি সহ্য করেছো, যখন আমি আর এখানে থাকবো না । যখন তুমি তোমার কাঁধ ঘিরে আমার বাহু অনুভব করবে না, তোমার তলায় আমার হৃদয়কেও পাবে না, তোমার চোখের ওপর আমার এই মুখ । কেননা একদিন আমাকে চলে যেতে হবে, অনেক দূরে । তাছাড়া, অন্যদেরও তো আমার সহচর্যের প্রয়োজন : সেই জন্যেই আমি এখানে রয়েছি, যদিও আমি সত্যিই তা চাই না…প্রিয় হৃদয়…”আর সেই মুহূর্তে আমি নিজেকে অনুভব করতে পারি, ও চলে যাবার পর, ভয়ে বিহ্বল, ভয়ঙ্কর কালোগহ্বরে তলিয়ে যাওয়া : মৃত্যুর দিকে । আমি ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালুম যে ও আমাকে কখনও ছেড়ে চলে যাবে না । এবং ও প্রতিজ্ঞা করলো, কুড়িবার ; প্রেমিকের মতন প্রতিজ্ঞা করলো । ব্যাপারটা যেন ওকে বলা আমার এই কথার মতন অর্থহীন “আমি তোমায় বুঝতে পারছি”।

    “ওহ, আমি কখনও ওর সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হইনি । ও আমাকে কখনও ছেড়ে চলে যাবে না, আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত । কিই বা ও করবে ? কোনো লোককেই ও চেনে না ; ও কোনও কাজও করতে পারবে না । ও ঘুমে-হাঁটা মানুষের মতন বাঁচতে চায় । ওর দয়া আর বদান্যতা কি বাস্তব জগতে ওকে ঠাঁই দেবে ? এমন মুহূর্তও আসে যখন আমি ভুলে যাই যে কোনও জঘন্য নোংরামিতে আমি জড়িয়ে পড়েছি : ও আমাকে শক্তি যোগাবে, আমরা দেশান্তরে যাবো, মরুভূমিতে শিকার করতে যাবো, অচেনা শহরের পথের ধারে ঘুমোবো, পিছুটানহীন আর মজায় । কিংবা হয়তো কোনোদিন জেগে উঠলুম আর — ওর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা যাবতীয় আইনকানুন ও নীতি-নৈতিকতায় বদল ঘটিয়ে ফেলেছে, — কিন্তু জগতসংসার ঠিক আগেকার মতনই রয়ে যাবে আর আমাকে রেখে যাবে আমার আকাঙ্খা আর আমার আনন্দ আর আমার উদ্বেগহীনতায়।

    ওহ! অভিযানের সেই বিস্ময়কর জগৎ যা আমরা বাচ্চাদের বইতে পেতুম — তুমি কি সেই জগৎ আমাকে দেবে না ? আমি অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি, আমি একখানা পুরস্কারের যোগ্যতা রাখি। ওর তা নেই । আমি সত্যিই জানি না ও ঠিক কী চায় । ও বলে যে ওর রয়েছে নানাবিধ আশা এবং পশ্চাত্তাপ : কিন্তু সেসব ব্যাপার নিয়ে আমার কিছুই করার নেই । ও কি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা কয় ? আমারও উচিত ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা । আমি অতলের তলানিতে, আর আমি ভুলে গেছি কেমন করে প্রার্থনা করতে হয় ।

    “মনে করো ও আমাকে নিজের দঃখকষ্ট ব্যাখ্যা করলো, আমি কি তা ওর ঠাট্টা-ইয়ার্কি এবং অপমানের চেয়ে ভালো করে বুঝতে পারবো ? ও আমাকে আক্রমণ করে, ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য সেইসব ব্যাপার যা আমার কাছে কখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা নিয়ে বকে যায়, আর তারপর আমি যখন কাঁদি তখন ক্ষেপে যায়।

    “– তুমি কি ওই সৌম্যকাক্তি যুবকটিকে দেখতে পাচ্ছো সুন্দর, শান্তিপূর্ণ বাড়িটায় ঢুকছে? ওর নাম দুভাল, দুফো, আরমান্দ, মরিস, যা তুমি মনে করো। ওখানে এক মহিলা আছেন যিনি ওই অশুভ প্রাণীটাকে ভালোবেসে সারাজীবন কাটিয়েছেন : উনি মারা গেলেন। আমি নিশ্চিত উনি এখন স্বর্গবাসী একজন সন্ত । তুমি আমাকে সেইভাবেই খুন করবে যেভাবে ও ওই মহিলাকে খুন করেছে । যাদের রয়েছে পরার্থবাদী হৃদয় তাদের এটাই ভবিতব্য…”। হে প্রিয় ! এমনও দিনকাল ছিল যখন ওর মনে হতো উদ্যমী মানুষেরা ওর গ্রটেস্ক উন্মাদনার খেলনা : ও তারপর ভয়ানকভাবে হাসতেই থাকবে, হাসতেই থাকবে ।—তারপর ও কমবয়সী মায়ের মতন বা বয়স্কা বোনের মতন অভিনয় করায় ফিরে যাবে । ও যদি অমন বুনো জিনিস না হতো, তাহলে আমরা বেঁচে যেতুম । কিন্তু ওর মধুরস্বভাবও সাঙ্ঘাতিক । আমি একজন কেনা-গোলাম। — ওহ, আমি আমার চিন্তাক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি !

    “কোনও দিন হয়তো ও অলৌকিকভাবে লোপাট হয়ে যাবে, কিন্তু আমাকে তা নিশ্চিত করে বলে যাওয়া দরকার, মানে আমি বলতে চাইছি ও যদি স্বর্গে বা অন্য কোথাও ফিরে যেতে চায়, যাতে আমি গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পারি অক্ষতযোনি মেরির ঢঙে আমার সোহাগের খোকাটার স্বর্গারোহন ।

    একটা নারকীয় গৃহস্হালী বটে !

    দ্বিতীয় ডিলিরিয়াম : শব্দের অপরসায়ন

    এবার আমার পালা । আমার উন্মাদনাগুলোর এক কাহিনি ।

    অনেককাল যাবত আমি এই ভেবে দম্ভোক্তি করতুম যে সমস্ত সম্ভাব্য ভূদৃশ্যের আমি গুরু এবং আমি মনে করতুম যে আধুনিক তৈলচিত্র আর কবিতার মহান ব্যক্তিদের কাজগুলো হাস্যকর।

    যা আমি পছন্দ করতুম তা হলো : কিম্ভুতকিমাকার তৈলচিত্র, চৌকাঠের মাথার ওপরের ছবি, মঞ্চের সজ্জা, কার্নিভালের পশ্চাতপট, সাইনবোর্ড, রঙচঙে ছাপা ; পুরোনোদিনের সাহিত্য, গির্জার লাতিন, ভুল বানানে ভরা যৌনপুস্তক, যে ধরণের উপন্যাস আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা পড়েন, পরিদের গল্প, বাচ্চাদের বই, পুরোনো অপেরা, ফালতু পুরোনো গান, দেশোয়ালি গানের ঠুনকো তাল ।

    আমি ক্রুসেডের স্বপ্ন দেখতুম, এমন আবিষ্কারযাত্রায় বেরিয়েছি যা কেউ কখনও শোনেনি, ইতিহাসহীন গণরাজ্য, মুছে-ফেলা ধর্মযুদ্ধ, নৈতিকতায় বিপ্লব, মহাদেশ ও জনজাতির প্রসারণ : আমি সমস্ত রকমের ইন্দ্রজালে বিশ্বাস করতুম ।

    আমি প্রতিটি স্বরবর্ণের রঙ আবিষ্কার করেছি ! –A কালো, E শাদা, I লাল,O নীল, U সবুজ।

    —আমি আঙ্গিকের নিয়ম তেরি করেছি এবং প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের বিচলন, এবং আমি নিজের অন্তরজগত থেকে ছন্দ আবিষ্কারের দম্ভোক্তি করতুম, এমনই এক ধরণের কবিতা যাকে প্রতিটি ইন্দ্রিয়, এখন হোক বা পরে, স্বীকৃতি দেবে । এবং কেবল আমিই হবো তার অনুবাদক।

    এটা আমি অনুসন্ধান হিসাবে আরম্ভ করেছিলুম । আমি নৈঃশব্দ আর রাতকে শব্দে পরিবর্তিত করে দিয়েছিলুম । যা উচ্চারণ করা যায় না, আমি তা লিখে ফেলতুম । আমি ঘুরন্ত পৃথিবীকে এক জায়গায় স্হির করে দিয়েছিলুম ।

    —————-

    ঝাঁকের থেকে দূরে, পাখিদের আর গ্রামের খুকিদের,

    ওই পাতা-সবুজের ভেতরে আমি কী পান করেছিলুম

    কচি বাদামগাছে ঘেরা

    দুপুরের উষ্ণসবুজ কুয়াশায় ?

    এই নতুন ওয়াজ নদী থেকে আমি কী পান করতে পারি

    –জিভহীন গাছেরা, ফুলহীন ঘাসভূমি, অন্ধকার আকাশ !–

    এই হলুদ কুমড়োখোসা থেকে পান করব, সেই কুটির থেকে দূরে

    যা আমি ভালোবাসতুম ? একটু সোনালি চুমুক যার দরুন আমি ঘামছি।

    আমাকে দেখে কোনো সরাইখানার সন্দিগ্ধ প্রতিনিধি মনে হতে পারতো ।

    — পরে, সন্ধ্যার দিকে, আকাশ মেঘেয় ভরা…

    বনের ভেতর থেকে জলধারা ছুটে চলেছে বিশুদ্ধ বালিয়াড়িতে,

    আর পুকুরের ওপরে স্বর্গীয় বাতাসে বরফের পুরু সর ;

    তারপর আমি দেখতে পেলুম স্বর্ণ, আর ফোঁপালুম, কিন্তু পান করা হলো না।

    গ্রীষ্মকালে, সকাল চারটের সময়ে

    ভালোবাসার খোঁয়ারি তখনও থেকে গেছে…

    ঝোপঝাড় ছড়িয়ে দিচ্ছে সুগন্ধ

    রাতের পানভোজনোৎসবের

    উজ্জ্বল নদীকন্যাদের ওইদিকে

    সূর্যের পশ্চিমা কারখানার মধ্যে,

    ছুতোরেরা তাড়াহুড়ো করছে — শার্টের হাত গুটিয়ে —

    এবার কাজ আরম্ভ হবে ।

    কাজ শুরু হয়ে গেছে ।

    আর ফাঁকা, শেওলা-ওপচানো পাথুরে জমিতে

    তারা তাদের দামি জিনকাপড় মেলে ধরছে

    যেখানে শহর

    এঁকে দেবে এক ফোঁপরা আকাশ

    ছবি আঁকা নিয়ে সেইসব মনোরম শখের চর্চাকারীদের জন্যে

    যারা ব্যাবিলনের কোনো রাজার জন্যে পরিশ্রম করছে,

    ভিনাস ! একটু সময়ের জন্য ছেড়ে চলে যাও

    প্রেম-করিয়েদের উজ্বল হৃদয় ।

    হে মেষপালকদের রানি !

    শ্রমিকরা যেখানে জিরোচ্ছে

    আর দুপুরের সমুদ্রে স্নান করছে

    সেখানে নিয়ে যাও ফলের বিশুদ্ধতম মদ ।

    ————————–

    আমার শব্দের অপরসায়নে পুরোনো দিনের কবিতার ক্ষয়ে-যাওয়া ধারণাগুলো গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ।

    আমি প্রাথমিক সন্মোহনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলুম : কারখানা দেখার বদলে আমি সুস্পষ্ট দেখতে পেতুম মসজিদ, দেবদূতদের ড্রামবাদকদল, আকাশের রাজপথে ঘোড়ার গাড়ি, ঝিলের জলের তলায় বৈঠকখানা ; দানবদের, আর রহস্যগুলো ; এক প্রমোদানুষ্ঠানের নামপত্র আমাকে শ্রদ্ধায় ভীত করেছিল ।

    আর তাই আমি শব্দগুলোকে দৃষ্টিপ্রতিভায় বদলে দিয়ে আমার ঐন্দ্রজালিক কুতর্কগুলোকে ব্যাখ্যা করলুম !

    শেষ পর্যন্ত আমার মগজের বিশৃঙ্খলাকে আমি পবিত্র বলে মনে করতে লাগলুম । গা এলিয়ে শুয়ে থাকতুম, জ্বরে গিলে খেয়ে ফেলছে শরীর : আমি জানোয়ারদের শান্তিময়তাকে হিংসে করতে লাগলুম — গুটিপোকা, যারা দ্বিতীয় শৈশবের পাপহীনতাকে সুস্পষ্ট করে তোলে , গন্ধমুষিক, অক্ষতযোনি মেয়েদের তন্দ্রাভাব !

    আমার মন বিষিয়ে উঠলো । আমি জগতসংসারকে গাথাসঙ্গীতের মতন কবিতায় বিদায় জানালুম :

    সবচেয়ে উঁচু মিনার থেকে গাওয়া একটি গান

    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,

    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি

    আমি বহুকাল অপেক্ষা করেছি

    যা আমি ভুলে যেতে পারি ;

    আর স্বর্গে রেখে দিতে পারি

    আমার ভয় ও পশ্চাত্তাপ ।

    এক অসুস্হ তৃষ্ণা

    আমার শিরাগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে ।

    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,

    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি

    তাই সবুজ মাঠ,

    অনেক ছড়িয়ে পড়েছে, ফুলে ছেয়ে গেছে,

    সুগন্ধ আর বুনোঝোপে

    আর নোংরা পোকাদের

    নিষ্ঠুর আওয়াজে ।

    তাকে আসতে দাও, তাকে আসতে দাও,

    যে ঋতুকে আমরা ভালোবাসতে পারি

    আমি মরুভূমিকে ভালোবাসতুম, পোড়া ফলবাগানকে, ক্লান্ত পুরোনো দোকান, গরম পানীয়। আমি নিজেকে দুর্গন্ধ গলির ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলুম, আর দুই চোখ বন্ধ করে আমি সূর্যের কাছে, যিনি আগুনের দেবতা, নিজেকে উৎসর্গ করলুম ।

    “সেনাধিপতি, যদি তোমার বিদ্ধস্ত পাটাতনের ওপরে একটা কামানও টিকে থাকে, আমাদের ওপরে শুকনো মাটি দিয়ে গড়া গোলা চালাও । দামি দোকানগুলোর আয়নাগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দাও ! এবং বৈঠকঘরগুলো ! শহরের মুখে তারই ধ্বংসধুলো ঢুকিয়ে দাও । মরচে পড়ে যেতে দাও ছাদের সিংহমুখো নালিগোলোয় । পদ্মরাগমণির আগুনগুঁড়ো দিয়ে বন্ধ করে দাও মহিলাদের গোঁসাঘরগুলো….”

    ওহ ! গ্রামের সরাইখানার পেচ্ছাপঘরের ছোট্ট মাছিটা, পচা আগাছার প্রেমে মশগুল, আলোর একটা রশ্মিতে ঝিমিয়ে পড়ে !

    ক্ষুধা

    আমি আমার হাড়ের ভেতরে কেবল খুঁজে পাই

    পৃথিবীর মাটি আর পাথর খাবার স্বাদ ।

    যখন আমি খাই, আমি বাতাস খেয়ে টিকে থাকি,

    নুড়ি আর কয়লা আর আকরিক লোহা ।

    পরিবর্তে, আমার ক্ষুধা । ক্ষুধা, খাওয়াও

    খেতভরা ভূষি ।

    যতো পারো যোগাড় করো সেই উজ্বল

    বিষের আগাছা ।

    একজন ভিখারির হাত দিয়ে ভাঙা পাথর খাও,

    পুরোনো গির্জার দেয়ালের পাথর ;

    নুড়িশিলা, বানভাসির শিশুরা,

    কাদায় পড়ে থাকা রুটি ।

    ———————————-

    ঝোপের পেছনে ডেকে উঠবে এক নেকড়ে

    মোরগের মাংসখাবার উৎসবে

    ঝলমলে পালকগুলো ছিঁড়ে :

    ওরই মতন, আমি নিজেকে গিলে ফেলি ।

    জড়ো করার জন্যে অপেক্ষা করে

    ফল আর ঘাস তাদের সময় কাটায় ;

    বেড়ায় যে মাকড়সা জাল বোনে

    শুধু ফুল খায় ।

    আমাকে ঘুমোতে দাও ! আমাকে সেদ্ধ হতে দাও

    সলোমনের পূজাবেদির ওপরে ;

    আমাকে শুষে নিতে দাও ছাতাপড়া মাটি,

    আর বয়ে যেতে দাও কেন্দ্রনে ।

    সব শেষে, হে যৌক্তিকতা, হে মহানন্দ, আমি আকাশ থেকে তার নীল সরিয়ে ফেলেছি যা আসলে অন্ধকার, আর আলোর প্রকৃতির সোনালি স্ফূলিঙ্গে বসবাস করেছি । আমার আনন্দের আতিশয্যে, আমি আমার মুখকে যতোটা পারি মজাদার আর আদিম করে তুলতে চেয়েছি:

    ওটা খুঁজে পাওয়া গেছে ।

    কী ? — অনন্তকাল ।

    ঘুরন্ত আলোয়

    সমুদ্রের সূর্যে ।

    হে আমার চিরকালীন আত্মা,

    আকাঙ্খা আঁকড়ে ধরে থাকো

    রাত হওয়া সত্ত্বেও

    এবং আগুনের দিন ।

    তোমাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে

    মানবের কঠোর সংগ্রাম থেকে

    আর জগতসংসারের সকলরব প্রশংসা থেকে

    তোমাকে উড়ে যেতে হবে যতোটা তুমি পারো….

    –চিরকালের আশা নেই

    নেই উথ্থানের অবকাশ ।

    বিজ্ঞান আর ধৈর্য,

    যাতনা অবশ্যম্ভাবী ।

    তোমার অন্তরের আগুন,

    মোলায়েম রেশম-অঙ্গার,

    আমাদের সমস্ত কর্তব্য

    কিন্তু কেউই তা মনে রাখে না ।

    তা খুঁজে পাওয়া গেছে ।

    কী ? অনন্তকাল ।

    ঘুরন্ত আলোয়

    সমুদ্রের সূর্যে ।

    ——————-

    আমি হয়ে উঠলুম নীতিকাহিনির অপেরা : আমি দেখলুম জগতসংসারে সকলেই আনন্দে দণ্ডপ্রাপ্ত। কর্মশক্তি প্রয়োগই জীবন নয় : তা কেবল ক্ষমতাকে বরবাদ করার একটা উপায়, স্নায়ুকে ধ্বংস করার নিমিত্তমাত্র । নৈতিকতা হলো মস্তিষ্কে ভরা জল।

    আমার মনে হয়েছে যে প্রত্যেকেরই আরও বেশ কয়েকটা জীবন থাকা উচিত ছিল। ওই লোকটা জানে না ও কি করছে : ও একজন দেবদূত । ওই পরিবারটা কুকুর-বাচ্চাদের গাদাঘর । কয়েকজনের ক্ষেত্রে, আমি অনেকসময়ে তাদের কোনো এক অপরজীবন থেকে চেঁচিয়ে কথা বলেছি। — ওই সূত্রেই আমি একটা শুয়োরকে পছন্দ করেছিলুম ।

    উন্মাদনার একটিও মেধাবী যুক্তিতর্ক নয়, — যে উন্মাদনাকে তালাচাবি দিয়ে আটক করা হয়, — আমি কি ভুলে গেছি : আমি আবার তার কোটর দিয়ে যেতে পারি, পুরো প্রণালীটা আমার হৃদয়ে খোদাই করা আছে ।

    তা আমার স্বাস্হ্যে প্রভাব ফেলেছিল । সামনেই যেন সন্ত্রাস । আমি বারবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তুম, যা এক লপ্তে অনেকদিন স্হায়ী হতো, আর যখন আমি জেগে উঠতুম, আমার দুঃখি স্বপ্নগুলো বজায় থাকতো । মারাত্মক ফসল তোলার জন্যে আমি ছিলুম তৈরি, আর আমার দুর্বলতা আমাকে জগতসংসারের বিপজ্জনক রাস্তার কিনার পর্যন্ত নিয়ে যেতো, সিমেরিয়ার সমুদ্রতীর পর্যন্ত, ঘুর্নিঝড় আর অন্ধকারের স্বর্গে ।

    আমাকে ভ্রমণ করতে হতো, যাতে মগজে জড়ো হওয়া জাদুগুলো উবে যেতে পারে । সমুদ্রের ওপরে, যা আমি এমন ভালোবাসতুম যে তা যেন আমার অশুদ্ধতা ধুয়ে দেবে, আমি দেখলুম দয়াময় ক্রুশকাঠ ওপরে উঠে এলো । আমি ছিলুম রামধনু দ্বারা শাপিত । প্রকাশসৌষ্ঠব ছিল আমার শাস্তি, আমার কুরে-খাওয়া মনস্তাপ, আমার কীট : তারপর আমার জীবন শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যের তুলনায় অনেকটাই বড়ো হয়ে উঠবে ।

    আনন্দধারা ! তার মারাত্মক মিষ্টতার হুল আমাকে কাকডাকা ভোরে জাগিয়ে তুলবে, –রাত বারোটায়, যিশুর পুনরুথ্থানের মুহূর্তে, — বিষণ্ণতম শহরে :

    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !

    কোথায় আছে সেই নিখুঁত আত্মা ?

    আমি শিখলুম ইন্দ্রজাল

    আনন্দধারা, আমাদের সবাইকে সন্মোহিত করে।

    আনন্দধারা তোমাকে, জীবনের জয়গান করো

    যখনই ফরাসিদেশের কাক ডেকে উঠবে ।

    এখন সমস্ত আকাঙ্খা বিদায় নিয়েছে :

    আমার জীবনকে তা নিজের করে নিয়েছে ।

    সেই সন্মোহন প্রভাবিত করেছে আমার হৃদয় ও আত্মা

    আর প্রতিটি যোগ্যতাবিচারকে লণ্ডভণ্ড করেছে ।

    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !

    আর, ওহ ! যেদিন তা মিলিয়ে যাবে

    সেইদিনই হবে আমার মৃত্যুর দিন ।

    হে ঋতুসকল, হে পল্লীদুর্গেরা !

    ———————-

    তা সবই শেষ হয়ে গেছে । আজকে, আমি জানি সৌন্দর্যকে কেমন করে উদযাপন করতে হয় ।

    সেই অসাধ্যসাধন

    আহ ! বালক হিসাবে আমার জীবন, প্রতিটি আবহাওয়ায় খোলা রাস্তার মতন ; আমি ছিলুম অস্বাভাবিকভাবে মিতাচারী, সবচেয়ে ভালো ভিখারির চেয়েও উদাসীন, কোনো দেশ না থাকার চেতনায় গর্বিত, বন্ধুহীন, তা যে কি বোকামি ছিল । — আর আমি এখন তা উপলব্ধি করছি!

    — বুড়ো লোকগুলো যারা আদর করার সুযোগ ছাড়ে না তাদের অবিশ্বাস করার ব্যাপারে আমি সঠিক ছিলুম, আমাদের নারীদের স্বাস্হের গায়ে আর নির্মলতায় পরগাছা, যখন কিনা আজকে নারীরা আমাদের থেকে আলাদা এক জাতি ।

    যা কিছু আমি অবিশ্বাস করতুম সে ব্যাপারে আমি সঠিক ছিলুম : কেননা আমি পালিয়ে যাচ্ছি!

    আমি পালিয়ে যাচ্ছি !

    বলছি বিশদে ।

    এমনকি কালকেও, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি : “ঈশ্বর ! এখানে এই তলানিতে আমাদের মতন প্রচুর অভিশপ্ত রয়েছে ! তাদের সারিতে আমি ইতিমধ্যে যথেষ্ট দুর্দশায় ভুগেছি ! আমি ওদের সবাইকে চিনি । আমরা পরস্পরকে চিনতে পারি ; আমরা পরস্পরকে বিরক্ত করি । আমাদের কেউই পরার্থবাদীতার কথা শোনেনি । তবুও, আমরা মার্জিত ; জগতসংসারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ নিয়মানুগ ।” তা কি অপ্রত্যাশিত ? এই জগতসংসার ! ব্যবসাদারের দল, আর মূর্খেরা ! — এখানে থাকায় কোনো অসন্মান নেই । — কিন্তু নির্বাচিত লোকজন, তারা আমাদের কীভাবে আপ্যায়ন করবে ? কেননা তেমন লোকজনও তো আছে, খুশমেজাজ লোকজন, নকলভাবে নির্বাচিত, কেননা তাদের সান্নিধ্যে যাবার জন্যে আমাদের সাহসী ও বিনয়ী হতে হবে। ওরাই প্রকৃত নির্বাচিত । মোটেই কপটাচারী সন্ত নয়, ওরা !

    যেহেতু দুই পয়সা দামের যুক্তিপূর্ণতা ফিরে পেয়েছি — কেমন তাড়াতাড়ি তা চলে যায়! — আমি দেখতে পাই যে আমার ঝঞ্ঝাটের উৎস হলো আগেই টের না পাওয়া যে এটা পাশ্চাত্য জগৎ । এগুলো পাশ্চাত্য জলাভূমি ! এমন নয় যে আলো ফিকে হয়ে গেছে, আঙ্গিক ক্ষয়াটে, কিংবা অগ্রগমন বিপথে চালিত…। ঠিক আছে ! প্রাচ্যের পতনের পর থেকে আমার মনের মধ্যে যে রদবদল ঘটেছে আমার মন এখন নিশ্চিতভাবে সেই সব নিষ্ঠুর ঘটনার মোকাবিলা করতে চায়…। আমার মনের সেটাই চাহিদা !

    …আর সেখানেই আমার দুই পয়সা দামের যুক্তিবোধের সমাপ্তি ! নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মন, তা দাবি করছে যে আমি পাশ্চাত্যজগতেই থাকি । যেমনটা আমি চিরকাল চেয়েছি, আমি যদি এটা শেষ করে ফেলতে চাই তাহলে একে চুপ করিয়ে দিতে হবে ।

    আমি আগে বলতুম, চুলোয় যাক শহিদদের করতল, শিল্পের যাবতীয় আলোকসঙ্কেত, আবিষ্কারকের গর্ববোধ, লুন্ঠনকারীর উত্তেজনা ; প্রাচ্যদেশে এবং মৌলিক, শাশ্বত জ্ঞানে আমার ফিরে যাবার কথা । কিন্তু এসবই নিঃসন্দেহে কলুষিত আলস্যের স্বপ্ন !

    আর তবুও আধুনিক যন্ত্রণাবোধ থেকে পালাবার ইচ্ছে আমার ছিল না । কোরানের মিশ্রিত পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আমার গভীর কৌতূহল নেই। — কিন্তু এই জ্ঞানে কি প্রকৃত পীড়ন নেই যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রদোষ থেকে, খ্রিস্টধর্ম, মানুষ নিজেকে মূর্খ প্রতিপন্ন করে চলেছে, যা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান তাকে প্রমাণ করতে চাইছে, বারবার প্রমাণ দেখিয়ে গর্বে বুক ফোলাচ্ছে, আর কেবল তা নিয়েই বেঁচে আছে ! এটা একরকমের সূক্ষ্ম, বোকা পীড়ন ; আর এটাই আমার আত্মিক অসংলগ্নতার উৎস । প্রকৃতি হয়তো এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত ! যিশুর সঙ্গেই জন্মেছিলেন প্রুধোম ।

    তা কি এই জন্যে নয় যে আমরা কুহেলিকার চর্চা করি ! জোলো শাকসবজির সঙ্গে জ্বরকে গিলে ফেলি । এবং মাতলামি ! আর তামাক । আর অজ্ঞানতা ! আর অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ! — এই সমস্তকিছুই কি প্রাচ্যের জ্ঞান, আমাদের আসল পিতৃভূমি, তার দর্শন থেকে দূরে নয় ? আধুনিক জগতসংসার নিয়ে কিই বা করার আছে, যদি অমন বিষ আবিষ্কার হয় !

    যাজকরা আর ধর্মোপদেশকরা বলবেন : নিশ্চয়ই । কিন্তু তুমি তো আদম আর ইভের নন্দনকাননের প্রসঙ্গ তুলছো । প্রাচ্য জাতিদের অতীত ইতিহাসে তোমার জন্য কিচ্ছু নেই…। সে কথা সত্যি । আমি নন্দনকাননের কথাই বলতে চাইছি ! প্রাচীন জাতিদের বিশুদ্ধতা কেমন করেই বা আমার স্বপ্নকে প্রভাবিত করবে ?

    দার্শনিকরা বলবেন : জগতসংসারের কোনো বয়স নেই । মানবতা স্হান থেকে স্হানান্তরে যায়, ব্যাস । তুমি একজন পাশ্চাত্য মানুষ, কিন্তু তুমি তোমার নিজস্ব প্রাচ্যে বসবাসের জন্য স্বাধীন, যতো পুরোনো তুমি চাও ততোই, — আর সেখানে তুমি যেমন ইচ্ছে থাকতে চাও । হেরো হয়ে যেও না । দার্শনিকগণ, আপনারা পাশ্চাত্য জগতের পাকাপাকি অংশ !

    মন, সাবধান হও । উত্তরণের পেছনে পাগলের মতন ছুটো না । নিজেকে শিক্ষিত করো! –আহ!

    বিজ্ঞান আমাদের থেকে কখনও এগিয়ে থাকে না !

    –কিন্তু আমি দেখি আমার মন ঘুমিয়ে পড়েছে ।

    এই মুহূর্ত থেকে যদি তা পূর্ণসতর্ক থাকে, আমরা দ্রুত সত্যকে পাবো, যা হয়তো এখনই ফোঁপাতে থাকা দেবদূতদের দিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে !….– যদি তা এই মুহূর্ত পর্যন্ত পূর্ণসতর্ক ছিল, তাহলে, অনেককাল আগেই, আমি তা নীচ প্রবৃত্তির কাছে সোপর্দ করতুম না !…–যদি তা চিরটাকাল পূর্ণসতর্ক থাকতো, আমি প্রজ্ঞায় ভাসতুম!…

    হে বিশুদ্ধতা ! বিশুদ্ধতা !

    এই জাগরণের মুহুর্তে, আমার ঘটে গেল বিশুদ্ধতার দৃষ্টিপ্রতিভা ! মনের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোই !

    কী যে এক ঠুঁটো দুর্ভাগ্য !

    সৌদামিনী

    —————-

    মানুষের শ্রম ! সেই বিস্ফোরণ আমার অতলকে সময়ে-সময়ে আলোকিত করে।

    “জ্ঞান আহরনের পথে : কোনো ব্যাপারই আত্মশ্লাঘা নয়!” চেঁচিয়ে বলে ওঠেন আধুনিক ধর্মপ্রচারকদল, যার অর্থ সব্বাই । আর তবুও বজ্জাত ও অলসদের চাপ গিয়ে পড়ে বাদবাকিদের হৃদয়ের ওপরে….। আহ ! তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি ওইখানে চলুন ; রাতের ওই পারে…ভবিষ্যতের সেই পুরস্কার, সেই শাশ্বত পুরস্কার…আমরা কি তা থেকে নিষ্কৃতি পাবো?

    —এর থেকে বেশি আমি কিই বা করতে পারি ? শ্রমের কথা জানি ; এবং বিজ্ঞান বড়োই মন্হর। প্রার্থনা দ্রুতগামী আর আলোকমালার গর্জন…আমি তা ভালো করে জানি। ব্যাপারটা খুবই সহজ, আর আবহাওয়া বেশ তপ্ত ; আমাকে ছাড়াই তোমাদের চলে যাবে । আমার রয়েছে কর্তব্য ; একে একপাশে সরিয়ে রাখতে, আমি গর্ববোধ করবো. যেমন অন্যেরা করেছে ।

    আমার জীবন নিঃশেষিত । ঠিকই, চলো ভান করা যাক, আমরা কোনো কাজই করবো না ! ওহ ! দুঃখদায়ক ! আর আমরা বেঁচে থাকবো, আর নিজেদের মনোরঞ্জন করবো, দানবিক প্রেম আর খেয়ালি জগতের স্বপ্ন দেখবো, পৃথিবীর আদল-আদরা নিয়ে অভিযোগ আর ঝগড়া করবো, দড়াবাজিকর, ভিখারি, শিল্পী, ডাকাত, — যাজক ! আমার হাসপাতালের বিছানায়, ধুপকাঠির সুগন্ধ তীব্রভাবে আমার কাছে ফিরে এলো ; পবিত্র সৌরভের অভিভাবক, আত্মস্বীকৃতিকারী, শহিদ…।

    শৈশবের মলিন শিক্ষা সেখানে আমি চিনতে পারি । তারপর কী !…কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছোও: আমি কুড়িবছর পালন করবো, অন্য সকলে যদি তা করে…।

    না ! না ! এখন আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াচ্ছি ! আমার গর্ববোধের তুলনায় শ্রমকে মামুলি মনে হয় : জগতসংসারের কাছে আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়াটা আমার শাস্তির পক্ষে যৎসামান্য হবে। শেষ মুহূর্তে আমি আক্রমণ করব, একবার ডানদিকে, আরেকবার বাঁদিকে….।

    —ওহ ! — বেচারা প্রিয় আত্মা, তাহলে অমরত্ব হয়তো হাতছাড়া হবে না !

    সকাল

    আমার কি একসময় তেমন যৌবন ছিল না যা মনোরম, বীরোচিত, কিংবদন্তিপ্রতিম, যা সোনার কাগজে লিখে ফেলা যায় ? — আমি ছিলুম খুবই ভাগ্যবান ! কোন সে অপরাধ, কোন ভুলের কারণে আমার ওপর বর্তেছে বর্তমান দুর্বলতা ? তোমরা যারা মনে করো যে জানোয়াররাও দুঃখে ফোঁপায়, অসুস্হরা বিষাদগ্রস্ত হয়, মৃতেরা খারাপ স্বপ্ন দ্যাখে, এবার আমার পতনের সঙ্গে আমার ঘুমের সম্পর্ক খোঁজো । যে ভিখারিটা পাখির মতন এবং প্রভুর বন্দনাগান গায়, আমি নিজেকে তার চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না । কীভাবে কথা কইতে হয় তা আমি আর জানি না !

    অথচ তবু, আজকে, আমার মনে হয় এই নরকের হিসাব আমি শেষ করে ফেলেছি । আর তা নরকই ছিল : সেই পুরোনোটা, যার সিংহদরোজা খুলে দিয়েছিল মানবপুত্র ।

    সেই একই মরুভূমি থেকে, সেই একই আকাশপানে, আমার ক্লান্ত চোখ রূপালি নক্ষত্রের দিকে সবসময় চেয়ে থাকে, সব সময়ের জন্যে ; কিন্তু সেই তিন জ্ঞানী মানুষ একেবারও নিজেদের জায়গা থেকে নড়াচড়া করেন না, জীবনের মহারাজারা, হৃদয়, আত্মা, মন । আমরা যখন যাবো, পাহাড়ের ওপর আর সমুদ্রের তীরে, নতুন শ্রমের, নতুন জ্ঞানের জন্মের গুণগান করার জন্যে, অত্যাচারী এবং দানবরা পালাবে , কুসংস্কারের সমাপ্তি ঘটবে, — আমরাই হবো প্রথম ভক্ত ! — পৃথিবীর মাটিতে খ্রিস্টের জন্মোৎসব !

    স্বর্গসমূহের গান, রাষ্ট্রদের অগ্রগমন ! আমরা কেনা-গোলাম , জীবনকে অভিশাপ দেয়া আমাদের উচিত নয় !

    বিদায়

    হেমন্ত এসে গেছে ! — আমরা যদি দৈব উজ্বলতা অনুসন্ধানের জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাহলে চিরকালীন সূর্যের জন্যে কেনই বা দুঃখপ্রকাশ করা , — ঋতুবদলের সঙ্গে যাদের মৃত্যু হয় তাদের থেকে বহু দূরে ।

    হেমন্ত । আমাদের নৌকা, ঝুলন্ত কুয়াশা থেকে উঠে এসেছে, বাঁক নেয় দারিদ্রের বন্দরের দিকে, দানবিক শহর, তার আকাশ আগুন আর কাদায় নোংরা । আহ ! সেইসব কটুগন্ধ কাঁথা, বৃষ্টিতে ভেজা রুটি, মাতলামি, আর হাজার প্রেম যা আমাকে ক্রুশকাঠে বিঁধেছে ! লক্ষকোটি মৃত আত্মা আর দেহের পিশাচিনী রানির দিন কি কখনও ফুরোবে না, আর কবেই বা তাদের সবায়ের বিচার হবে ! আমি নিজেকে আবার দেখতে পাই, নোংরায় আর রোগে আমার গায়ের চামড়া ক্ষয়ে গিয়েছে, মাথার চুলে আর বগলে পোকারা কিলবিল করছে, আর তাদের চেয়েও বড়ো-বড়ো পোকা চরে বেড়াচ্ছে আমার হৃদয়ে, আয়ূহীন, হৃদয়হীন, অচেনা আকারে ছেয়ে ফেলেছে…। আমি সেখানে অনায়াসে মরে যেতে পারতুম…। কি ভয়ানক স্মৃতি ! দারিদ্র্যকে আমি খুবই ঘেন্না করি।

    আর শীতকালকে আমি ভীষণ ভয় পাই কেননা তা বড়োই আরামদায়ক !

    —অনেকসময়ে আমি আকাশে দেখতে পাই বালিছড়ানো সীমাহীন তীর শাদা উদ্দীপনাময় রাষ্ট্রে ছেয়ে গেছে । একটা সোনালি জাহাজ, আমার ওপরদিকে, সকালের হাওয়ায় নানা রঙের নিশান ওড়াচ্ছে । প্রতিটি ভোজনোৎসব, প্রতিটি বিজয়, প্রতিটি দৃশ্যকাব্যের আমি ছিলুম স্রষ্টা । নতুন ফুল, নতুন গাছপালা, নতুন মাংস, নতুন ভাষা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলুম আমি । আমি ভেবেছিলুম আমি অর্জন করেছি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ।

    হাঃ ! আমাকে আমার কল্পনা আর আমার স্মৃতিকে গোর দিতে হবে ! শিল্পী আর গল্পকার হিসাবে জমকালো কর্মজীবনের কেমনতর সমাপ্তি!

    আমি ! নিজেকে ম্যাজিশিয়ান, দেবদূত, নৈতিকতার বাঁধন থেকে মুক্ত বলে মনে করেছিলুম ।

    আমাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে যাতে চাষের জমির প্রতি কৃতজ্ঞতা শোধ করতে পারি, বাহুতে মুড়ে নিতে পারি গ্রন্হিল বাস্তবতা ! একজন চাষি !

    আমি কি প্রতারিত ? পরার্থবাদিতা কি হয়ে উঠবে মৃত্যুর বোন, আমার জন্যে ?

    ঠিক আছে, মিথ্যা আশ্রয় করে বেঁচে থাকার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নেবো। আর তাইই শেষ ।

    কিন্তু বন্ধুত্বের একটাও হাত নেই ! আর কোথায়ই বা আমি সাহায্য খুঁজবো ?

    ¯¯¯¯¯¯¯¯

    সত্যি, নতুন যুগ রূঢ় ছাড়া আর কিছুই নয় ।

    কেননা আমি বলতে পারি যে আমি একটা বিজয় পেয়েছি ; দাঁতের ওপর দাঁত চেপে, নরকের আগুনের ফোঁসফোঁসানি, দুর্গন্ধিত দীর্ঘশ্বাস ফুরিয়ে এসেছে । আমার রাক্ষুসে স্মৃতি মিলিয়ে যাচ্ছে।

    বিদায় নিচ্ছে আমার শেষ আকাঙ্খাগুলো, — ভিখারিদের, ডাকাতদের, মৃত্যুর বন্ধুদের, যে জগত পাশ দিয়ে চলে গেছে, তার সম্পর্কে ঈর্ষা । — অভিশপ্ত আত্মারা, যদি আমি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারতুম !

    চরম আধুনিক হওয়া দরকার ।

    ধন্যবাদোৎসবের স্তবগানকে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই : একবার যে ধাপে পা রেখেছো তা ধরে রাখো । এক দুঃসহ রাত ! আমার মুখের ওপরে শুকনো রক্তের ধোঁয়া, আর আমার পেছনদিকে ওই ছোট্ট বীভৎস গাছ ছাড়া আর কিছু নেই !…মানুষের সংগ্রামের মতনই আত্মার জন্য সংগ্রামও পাশবিক ; কিন্তু বিচারের আনন্দদর্শন কেবল ঈশ্বরের একার ।

    তবু এটাই রাত্রিকালের জাগ্রদবস্হা । চলো আমরা নতুন শক্তিক্ষমতাকে, আর প্রকৃত প্রেমপরায়ণতাকে মেনে নিই । এবং সকালে, দীপ্তমান ধৈর্যকে বর্ম করে, আমরা মহিমান্বয়ের শহরগুলোয় প্রবেশ করবো ।

    আমি কেন বন্ধুত্বের হাতের কথা বলেছিলুম ! আমার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো যে মিথ্যায় ভরা পুরোনো ভালোবাসা আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, আর অমন প্রতারণাভরা যুগলকে কলঙ্কে দেগে দিতে পারি, — সেখানে আমি নারীদের নরকের অভিজ্ঞতাও পেয়েছি ; — আর এবার আমি একই দেহ ও একই আত্মায় সত্যকে ধারণ করতে সক্ষম হবো ।

    [ রচনাকাল : এপ্রিল-আগস্ট, ১৮৭৩ ]

    [ অনুবাদ : ২০১৯ ]
  • Georges Bataille | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৯ ১১:২১383617
  • জজ ব্যাতাইয়ের কবিতা - Georges Bataille ( ১৮৯৭ - ১৯৬২ ) ।
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    অতিদেবদূতীয় কবিতা
    আমার পাগলামি আর আমার ভয়
    ওদের আছে বড়ো-বড়ো মরা চোক
    আর জ্বরের অবিচলিত চাউনি

    এই চোখগুলোয় যা দেখা যায়
    তা ব্রহ্মাণ্ডের অসারতা
    আমার চোখ দুটো অন্ধ আকাশ

    আমার দুর্ভেদ্য রাতে
    অসম্ভাব্যতা কেঁদে ওঠে
    সবকিছু চুরমার হয়ে যায়

    কালি-চোখের পঞ্জিকা
    চুলবহুল কবির অমরত্ব
    কবিতা মেদবহুলতার গোরস্হান
    বিদায় ঢেমনি ধোপানি
    বিদায় মিষ্টি-মরা নগ্ন তরুণীর মতন সাজগোজ
    বিদায় মিথ্যা বলে মিথ্যা ঘুমোচ্ছে

    পিঁপড়েদের অগণন চুলকানি
    ধুলোয় কাগজের গোঁফ খোঁজার বাছাই
    গাড়িভরা জ্বর

    পাগল বৃষ্টির সারি
    মলিন চাদরকে হাততালি দিচ্ছে
    মানুষের হাড়ের শোকপূর্ণ বেহায়াপনা

    ওখেনে ভিড় জড়ো করছে টিনক্যান কিসের হয়তো
    এক পুলিশ ছাদের ওপরে শার্টের ভেতরে
    রাক্ষস কাস্তে নাচায়

    আমি তোমাকে হাওয়ায় হারিয়ে ফেলি
    আমি তোমাকে মৃতদের একজন মনে করি
    এক গুরুত্বপূর্ণ শিরা
    হৃদয় আর বাতাসের মাঝে

    এই জগতে আমার কিছুই করার নেই
    পুড়তে থাকা ছাড়া
    আমি তোমাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালোবাসি

    তোমার অস্হিরতা
    তোমার মগজে এক পাগল বাতাস সিটি বাজায়
    তুমি হাসার দরুন অসুখে ভুগছ
    তুমি আমার কাছ থেকে পালাও তেতো শূন্যতার জন্য
    নিজের হৃদয়কে ছিঁড়ে আলাদা করো
    আমাকে ছিঁড়ে আলাদা করো যদি চাও
    আমার জ্বরগ্রস্ত চোখ
    তোমাকে রাতে খুঁজে পায়
    আমি কাঁপছি আমার হৃদয়ের শীতে
    আমার যন্ত্রণার গভীরতা থেকে তোমাকে ডাক দিই
    অমানুষের কান্নায়
    যেন আমি সন্তান প্রসব করছি

    তুমি আমার গলা টিপে ধরো মৃত্যুর মতন
    আমি তা বড়ো দুঃখে জেনেছি
    আমি তোমাকে কেবল মৃত্যুর মুখেই খুঁজে পাই
    তুমি ততোই সুন্দরী যতোটা মৃত্যু

    সব শব্দ আমার গলা টিপে ধরে

    নক্ষত্ররা আকাশে ছ্যাঁদা করে
    মৃত্যুর মতন আর্তনাদ করে
    কন্ঠরোধ করে

    আমি জীবন চাই না
    কন্ঠরুদ্ধ হওয়া বেশ মিষ্টি
    উদীয়মান নক্ষত্র
    মৃত নারীর মতনই শীতল

    আমার চোখ দুটো বেঁধে দাও
    আমি রাতকে ভালোবাসি
    আমার হৃদয় কালো

    আমাকে রাতের ভেতরে ঠেলে দাও
    সবকিছুই নকল
    আমি যন্ত্রণায় ভুগি

    জগত থেকে মৃত্যুর গন্ধ বেরোয়
    পাখিরা অন্ধ হয়ে ওড়ে
    তুমি তেমনই ময়লা যেমন কালো আকাশ

    এক উৎসব আরম্ভ হবে
    কাদায় আর ভয়ে

    নক্ষত্ররা ঝরে পড়বে
    যখন মৃত্যু কাছে এসে পড়ে

    তুমি রাতের আতঙ্ক
    তোমার জন্য আমার ভালোবাসা যেন মৃত্যুর কান্না
    তুমি মৃত্যুর মতন দুর্বল

    তোমার জন্য আমার ভালোবাসা বিভ্রমের মতন
    তুমি জানো আমার মাথা মারা যায়
    তুমিই বিশালতা তুমিই ভয়

    তুমি খুন করার মতন সুন্দরী
    আমার হৃদয় ফুলে ওঠে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে
    তোমার তলপেট রাতের মতন উলঙ্গ

    তুমি আমাকে সরাসরি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাও
    মৃত্যুর কামড় আরম্ভ হয়েছে
    তোমাকে বলার আর কিছু নেই
    আমি মৃতের কাছ থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলছি
    আর মৃতরা চিরকাল মৌন ।
  • Jean Genet | ***:*** | ১০ জুলাই ২০১৯ ১১:২৫383618
  • জাঁ জেনে’র কবিতা ( ১৯১০ - ১৯৮৬ ) ‘শবযাত্রার কুচকাওয়াজ’
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


    এক কোনে আবদ্ধ, একটুখানি রাত রয়ে গেছে।
    আমাদের ভিতু আকাশে নির্মম আঘাতে স্ফূলিঙ্গ উগরে
    ( নৈশব্দের গাছেরা কিছু দীর্ঘশ্বাস ঝুলিয়ে রেখেছে )
    এই শূন্যতার শীর্ষে গরিমার এক গোলাপ জেগে।
    ঘুম বড়োই বিশ্বাসঘাতক যেখানে জেলখানা আমায় নিয়ে এসেছে
    যদিও আমার গোপন দালানে বেশ আস্পষ্টভাবে
    ওই অহংকারী ছোঁড়া গভীরভাবে নিজের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে
    নাবিকদের আলোয় ঝলমলিয়ে যারা শব-সুন্দরী গড়ে তোলে ।


    ও আমাকে নিজের ভেতরে শেকল পরিয়ে রাখে
    জেলখানার এই কুড়ি বছর বয়সী পরিদর্শক
    আর ও আমায় চিরকালের জন্য শেকল পরিয়ে রাখে !
    একটিমাত্র ইঙ্গিত, ওর চোখ, দাঁতে চুল চিবোয় :
    আমার হৃদয় খুলে যায়, আর পরিদর্শক, উৎসবময় উল্লাসে
    আমাকে নিজের অন্তরে জেলবন্দী করে ।
    এই অসূ্য়াভরা দরোজা আবার বন্ধ হবার সুযোগ পায় না
    অনেক বেশি দয়ায়
    আর তুমি তো ইতোমধ্যেই ফিরেছো । তোমার পরিপূর্ণতা আমাকে আতঙ্কিত করে
    আর আমি আজকে শুনতে পাই আমাদের ভালোবাসা বর্ণিত হচ্ছে
    তোমার মুখে যা গান গায় ।
    এই ছোরামারা ট্যাঙ্গো যা জেলখুপরি শুনতে পায়
    বিদায়বেলার এই ট্যাঙ্গোনাচ ।
    তাহলে কি তুমি, হে প্রভূ, এই উজ্বল বাতাসে ?
    তোমার আত্মা গোপন পথে এগিয়েছে
    দেবতাদের থেকে পার পাবার জন্য ।


    যখন তুমি ঘুমোও রাতের আস্তাবল ভেঙে ঘোড়ারা
    তোমার চ্যাটালো বুকে নামে, আর জানোয়ারগুলোর টগবগ
    অন্ধকারকে ছত্রভঙ্গ করে তোলা যেখানে ঘুম নিজের
    ক্ষমতার যন্ত্র চালায়, আমার মগজ থেকে ছিঁড়ে
    একটুও শব্দ না করেই ।
    ঘুম অনেক শাখা তৈরি করে
    তোমার পা থেকে ফুল
    তাদের কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে আমি ভয় পাই ।
    তোমার মোলায়ের পাছার বাঁকের ওপরে, মিলিয়ে যাবার আগে
    তোমার শাদা ত্বকে তা নীলাভ।
    কিন্তু একজন জেল পরিদর্শক কি তোমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, আমার কচি চোর
    যখন তুমি তোমার হাত ধুয়ে নাও ( ওই পাখিগুলো তোমার দস্তানায়
    ডানা ঝাপটায়, একশো দুঃখের ভারে )
    তারপর তুমি নির্দয়ভাবে নক্ষত্রদের আলোকরশ্মিকে ছারখার করে দাও
    তোমার কাঁদতে-থাকা মুখের ওপরে ।
    তোমার শোকেভরা অবশিষ্টাংশে
    মহিমাময় অঙ্গভঙ্গী ধরে রাখা হয়
    তোমার হাত যেটা একে ছুঁড়ে দিয়েছিল, রশ্মি দিয়ে বীজ পুঁতেছিল।
    তোমার গেঞ্জি, তোমার শার্ট, আর তোমার কালো বেল্ট
    আমার জেলখুপরিকে অবাক করে আর আমাকে হতবুদ্ধি করে তোলে
    তোমার সুন্দর হস্তিদন্তের সামনে ।


    সারাদিনের সুন্দর রাতগুলো
    পিলর-এর অন্ধকার
    তোমার কালো পাকের ভেতরে
    আমার ছুরি জাল করা হয় ।
    ঈশ্বর, এখানে আমি উলঙ্গ
    আমার ভয়ঙ্কর লুভরেতে ।
    কেউ চিনতে পারে না
    তোমার বন্ধ মুঠো আমায় খুলে দ্যায় ।
    আমি ভালোবাসা ছাড়া কিছু নই
    আমার সমস্ত শাখা জ্বলে
    যদি আমি দিনটাকে অন্ধকার করে দিই
    তারপর আমার ভেতরের ছায়া নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।
    বিশুদ্ধ হাওয়ায় এটা সম্ভব
    আমার শুকনো দেহ গুঁড়িয়ে ধুলোয় মেশার জন্য
    দেয়ালে পিঠ দিয়ে
    আমি বিদ্যুতের চমকের দখল নিই ।
    হৃদয় আমার সূর্য
    মোরগের ডাকে চৌচির হয়ে যায়
    ঘুম কখনও সাহস দেখায় না
    এখানে তার স্বপ্নগুলোকে উথলে দিতে।
    আমার আকাঙ্খায় শুকিয়ে যাওয়া
    আমি স্তব্ধতাকে মেরামত করে দিই
    পাখিদের আগুন দিয়ে
    যা আমার গাছ থেকে জেগেছে ।


    নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হয় এমন মহিলাদের থেকে
    তাদের খবরিয়ারা গয়না পরে থাকে ।
    গলির এই ছিঁচকে চোরগুলো রাতের বেলায় জেগে ওঠে
    আর তাদের ইশারা পেয়ে তুমি সাহসে বেরিয়ে পড়ো।
    অমন এক কচিখোকা, নিজের মায়াময় পোশাকে কাঁপে
    ও ছিল আমার কাছে পাঠানো দেবদূত, যার আলোময় দিশা
    আমি অনুসরণ করি বিভ্রান্ত হয়ে, যাত্রায় পাগল হয়ে
    এই জেলখুপরি পর্যন্ত যেখানে তার প্রত্যাখ্যান ছিল জ্যোতির্ময়।

    যখন আমি অন্য সুরে গাইতে চাইলুম
    আমার পালক আলোকরশ্মিতে জড়িয়ে পড়লো
    এক ঝিমধরা শব্দে, মাথা নিচু করে
    আমি বোকার মতন পড়ে গেলুম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে
    এই খাদের তলায় ।


    আর কিছুই গোলমাল
    বাধাবে না অনন্তকালীন ঋতুতে
    যেখানে আমি নিজেকে আটক আবিষ্কার করছি ।
    একাকীত্বের স্হির জলাশয়
    আমাকে পাহারা দেয় আর জেলখানা ভরে রাখে ।
    আমি চিরকালের জন্য কুড়ি বছর বয়সী
    তোমাদের নিরীক্ষণ সত্বেও ।
    তোমাদের মন রাখতে, ওহ বধির সৌন্দর্যের অনাথ
    মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি পোশাক পরে থাকবো
    আর তোমার আত্মা তোমার মুণ্ডকাটা ধড়কে ছেড়ে গিয়ে
    আমার ভেতরে খুঁজে পাবে এক শাদা আশ্রয় ।
    ওহ একথা জানতে পারা যে তুমি আমার মামুলি ছাদের তলায় শোও!
    তুমি আমার মুখ দিয়ে কথা বলো
    আমার চোখ দিয়ে দ্যাখো
    এই ঘর তোমার আর আমার কবিতা তোমার।
    যা ভালো লাগে তার জন্য আরেকবার বেঁচে নাও
    আমি নজর রাখছি ।


    হয়তো তুমিই ছিলে সেই দানব যে কেঁদেছিল
    আমার উঁচু দেয়ালের পেছনে ?
    রেশমি ফিতের চেয়েও মোলায়েম তুমি ফিরে এসেছো
    আমার দৈব দুর্বৃত্ত
    এক নতুন মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়তি আবার তছনছ করে
    আমাদের নিরানন্দ ভালোবাসাগুলো
    কেননা তুমিই তো ছিলে আবার, পিলর, মিথ্যা বোলো না
    এই চুরিকরা ছায়াগুলো !


    যে খোকাটাকে আমি খুঁজছিলুম
    বাচ্চাদের মধ্যে খেলছে
    নিজের বিছানায় মরে পড়ে আছে, একা
    এক রাজকুমারের মতন ।
    নিজের আলতো পায়ে ইতস্তত করে
    এক মহিমা ওর পায়ে জুতো পরায়
    আর দেহ ঢেকে দ্যায়
    রাজকীয় পতাকায় ।
    হাতে গোলাপ ধরে-থাকা মিষ্টি ভঙ্গীতে
    শবগুলো কে যে হাত লুটপাট করছিল তা চিনতে পারলুম।
    একজন সেনা অমন কাজ করবে না
    যা তুমি, একা, করেছিলে
    আর তুমি তাদের মধ্যে নেমে গেলে
    ভয়ও পেলে না
    পশ্চাত্তাপও নয় ।
    তোমার দেহের মতন
    একটা কালো গেঞ্জি তোমার আত্মাকে দস্তানায় ঢুকিয়ে রাখলো
    আর যখন তুমি নির্দিষ্ট সমাধিকে অপবিত্র করলে
    তুমি ছুরির ডগা দিয়ে খোদাই করে দিলে
    শব্দ আন্দাজ করার ধাঁধা
    বিদ্যুৎ দিয়ে নকশাকাটা ।
    আমরা তোমার উথ্থান দেখেছি, উন্মাদনায় বয়ে যাওয়া
    নিজের চুলে ঝুলছ
    লোহার মুকুটে
    মুক্ত-বসানো ফিতেয় আর বাসি গোলাপে
    জীবন্ত ধরবার জন্যে মোচড়ানো হাত ।
    তোমার মৃদু হাসি আমাদের দেখাবার জন্য সবেই ফিরেছ
    তুমি দ্রুত উধাও হয়ে গেলে আমার মনে হয়
    আমাদের কিছু না জানিয়ে, তোমার ঘুমন্ত গরিমা
    আরেক মুখের সন্ধানে অন্যান্য আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে।
    পথচলতি এক বালককে লক্ষ করি
    তোমার সুগঠিত দেহের ঝলক
    আমি তার মাধ্যমে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি
    কিন্তু তার এক সামান্য ইশারা
    তার কাছ থেকে তোমাকে উধাও করে দিলো
    আর তোমাকে আমার কবিতায় ছুঁড়ে ফেললো
    যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না ।
    কোন দেবদূত তাহলে
    তোমাকে পাশ দিয়ে যাবার অনুমতি দিলো
    অকাতরে বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে
    হাত দিয়ে বাতাসকে দুফাঁক করে
    ক্ষেপণাস্ত্রের ডগার সূক্ষ্ম ঘূর্ণনের মতো
    যা নিজের দামি পথ খুঁজে নিজেই তাকে নষ্ট করে ?
    তোমার পালাবার সংকীর্ণতা আমাদের নিরানন্দ করেছিল ।
    এক দ্যুতিময় পিছুটান তোমাকে আমাদের আলিঙ্গনে এনে দিয়েছিল।
    তুমি আমাদের গলায় টোকা মেরে আমাদের মন ভরাতে চাইলে
    আর তোমার হাত ছিল ক্ষমাময়
    কামানো চুলের দরুণ ।
    কিন্তু তুমি আর দেখা দাও না, ফর্সা খোকা যাকে আমি খুঁজি।
    আমি কোনো শব্দে হুঁচোট খাই আর তোমাকে তার বিপরীতে দেখি।
    তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও, কবিতা আমাকে রক্ষা করে।
    কান্নার কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে আমি বিপথগামী হই ।
    তোমাকে ধরার জন্য আকাশ নানা ফাঁদ পেতেছিল
    করাল আর নতুন, মৃত্যুর সঙ্গে ষড় করে
    এক অদৃশ্য সিংহাসন থেকে নজর রাখছিল
    সুতোগুলো আর গিঁটগুলো
    সোনার ববিনে পরানো ।
    আকাশ এমনকি মৌমাছিদের যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিল
    কতোরকমের রশ্মি আর কতোরকমের সুতোর পাক খুলে
    যে সেষ পর্যন্ত ওকে গোলাপের সৌন্দর্য ধরে ফেললো :
    ছবিতে দেখানো এক শিশুর মুখ ।
    এই খেলা যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি নালিশ করব না
    তোমার সুন্দর চোখ খুলে ফেলার জন্য
    দুঃখের এক গান তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল
    অতো সন্ত্রাসকে আয়ত্ত করে
    আর এই গান, হাজার বছরের জন্য
    তোমার কফিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।
    দেবতাদের ফাঁদে আটক, তাদের রেশমিসুতোয় কন্ঠরুদ্ধ
    কেন আর কেমন করে না জেনেই তুমি মারা গেলে ।
    তুমি আমাকে ছাপিয়ে জিতে গেছ
    কিন্তু সাপসিঁড়ি লুডোখেলায় হেরে গেছ
    যেখানে আমি তোমাকে ধর্ষণ করার সাহস দেখাই
    ওগো আমার পলাতক প্রেমিকা ।
    কালো সেনারা তাদের বন্দুক নত করলেও
    তুমি ওই বিছানা ছেড়ে পালাতে পারো না যেখানে লোহার মুখোশ
    তোমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে -- কিন্তু হঠাৎ তুমি উঠে দাঁড়াও
    নড়াচড়া না করেই পেছনে পড়ে যাও
    আর নরকে ফেরো ।

    ১০
    আমার ভালোবাসার কালকুঠুরি
    তোমার স্পন্দিত ছায়ায়
    আমার চোখ, আচমকা, এক গোপনকথা আবিষ্কার করেছে ।
    আমি কতো রকম শোয়া শুয়েছি তা জগত জানে না
    যেখানে সন্ত্রাস নিজেই গিঁট পাকায় ।
    তোমার অন্ধকার হৃদয়ের দর-দালানগুলো আঁকাবাঁকা পথ
    আর তাদের জড়োকরা স্বপ্নগুলো স্তব্ধতাকে সঙ্গঠিত করে
    কবিতার সঙ্গে মিল আছে এমন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া
    আর তার হুবহু তীব্রতা ।
    আমার চোখ আর আমার কপাল থেকে
    তোমার রাত কালির বন্যা বয়ে যেতে দ্যায়
    এমন ঘন পালক যার ওপরে আমি এখানে শুই
    নিয়ে আসবে কুসুমিত নক্ষত্রদের
    যেমন কেউ গোলাগুলির বেড়াজালে দেখতে পায় ।
    আমি তরল অন্ধকারের দিকে এগোই
    যেখানে অবয়বহীন ষড়যন্ত্রেরা
    ধীরে ধীরে আকার পাওয়া আরম্ভ করে ।
    কেনই বা আমি সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করব ?
    আমার সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ ভেঙে টুকরো হয়
    আমার আমার কান্নাগুলো
    খুবই সুন্দর ।
    আমার চাপা দুর্দশা থেকে শুধু তুমিই জানতে পারবে
    দিনের মেলে দেয়া অদ্ভুত সৌন্দর্যগুলো ।
    ওদের হাজার রকমের ভেলকিবাজির পর
    যে বজ্জাতদের কথা আমি শুনি
    খোলা বাতাসে ভিড় জমায় ।
    পৃথিবীতে তারা একজন কোমল প্রতিনিধি পাঠায়
    এক শিশু যে কারোর পরোয়া করে না, আর নিজের যাত্রাপথ চিহ্ণিত করে
    অনেকরকমের চামড়া ফাটিয়ে
    আর ওর খোশমেজাজি বার্তা
    এখানে পায় নিজের জাঁকজমক ।
    কবিতাটা পযে তুমি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাও
    অপরাধী অঙ্গভঙ্গী দিয়ে একজন বয়ঃসন্ধির লেখা
    কিন্তু তুমি কখনও জানতে পারবে না
    মৌলিক গিঁটগুলোর কোনও ব্যাপার
    যা আমার মলিন ক্রোধের ফসল
    কেননা ওর রাতে যে গন্ধগুলো গড়াচ্ছে তা খুবই তীব্র।
    ও সই করবে পিলর আর ওর মহিমান্বয়ন হবে
    গোলাপ-স্রোতের উজ্বল ফাঁসিমঞ্চ
    মৃত্যুর সুন্দর কর্মফল ।

    ১১
    সম্ভাবনা -- সবচেয়ে মহার্ঘ সম্ভাবনা !
    প্রায়ই আমার পালককে তৈরি করতে বাধ্য করেছে
    আমার সমস্ত কবিতার হৃদয়কেন্দ্র
    সেই গোলাপ যার ওপরে শাদা শব্দে লেখা মৃত্যু
    বাহুর ফেট্টিতে নকশা করা
    যে কালো যুদ্ধাদের আমি ভালোবাসি তাদের নাম।
    আমার রাতের ভেতর দিয়ে কোন বাগানই বা ফুল ফোটাতে পারে
    কোন যন্ত্রণাময় খেলা এখানে হয় যে
    এই কেটে নেয়া গোলাপ থেকে পাপড়ি ছেঁড়া হয়
    আর কে তাকে নিঃশব্দে ফাঁকা কাগজে নিয়ে যায়
    যেখানে তোমার হাসি তাকে অভিবাদন করে ?
    কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষকিছু আমি জানি না
    মেয়েটির বিষয়ে এতো কথা বলার পরও
    আর গুরুতর উপায়ে
    তাহলে মেয়েটি আমার ভেতরেই বাস করে
    যাতে সহজে জেগে উঠতে পারে
    আমার আমার আবোলতাবোল থেকে বইতে পারে
    অন্তত আমার শব্দগুলো ।
    মেয়েটির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না
    বলা হয় যে ওর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল
    অনন্তকালকে খেয়ে ফ্যালে
    কিন্তু এই বিশুদ্ধ বিচরণ পরাজয়ে বিদীর্ণ হয়
    আর এক বিয়োগান্তক বিশৃঙ্খলার গোপনীয়তাকে ফাঁস করে ।
    অশ্রুবিন্দুর আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যাকাশে
    মেয়েটি খালি পায়ে আসে ফুৎকারে আত্মপ্রকাশিত হয়ে
    আমার উপরিতলে যেখানে ফুলের এই তোড়াগুলো
    আমাকে শেখায় মৃত্যুর
    কন্ঠরোধী কোমলতা।
    আমি নিজেকে তোমার আলিঙ্গনে ছেড়ে দেবো, হে বর্ণোজ্বল মৃত্যু
    কেননা আমি জানি কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়
    আমার উন্মুক্ত শৈশবের চলমান চারণভূমি
    যেখানে তুমি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যাবে
    অপরিচিত লোকটার ফুলেফুলে সাজানো লিঙ্গের কাছে ।
    আর এই শক্তিতে বলবান, হে রানি, আমি হবো
    তোমার ছায়াদের নাটকের গোপন মন্ত্রী ।
    মিষ্টি মৃত্যু, আমাকে নাও, আমি তৈরি
    এই যে আমি এখানে, আমি যাচ্ছি
    তোমার নিরানন্দ শহরে ।

    ১২
    একটা শব্দে আমার কন্ঠস্বর হুঁচোট খায়
    আর অভিঘাত থেকে তুমি উৎসারিত হও
    এই অলৌকিকতার জন্য ততোটা উৎসাহী
    যতোটা তুমি তোমার অপরাধগুলোর জন্য !
    কেই বা তাহলে অবাক হবে
    যখন আমি আমার নথিগুলো খুলে ধরব
    যাতে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অন্বেষণ করা যাব
    শব্দের ঝোপঝাড়গুলো ?
    আমার হাতে আরও দড়ি ধরিয়ে দেবার জন্য বন্ধুরা লক্ষ রাখে
    জেলখানার ছড়ানো ঘাসে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ।
    তোমার জন্য, এমনকি তোমার বন্ধুত্বের জন্য
    আমি পরোয়া করি না ।
    আমি এই সৌভাগ্যকে আগলে রাখি
    যা বিচারকরা আমাকে দেন ।
    এটাকি তুমি, অন্য আমি, তোমার রুপোর চটি ছাড়াই
    সালোম, যে আমাকে একটা গোলাপ কেটে এনে দ্যায় ?
    এই রক্তাক্ত গোলাপ, শেষ পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ থেকে খোলা
    তা কি মেয়েটির, নাকি এটা জাঁ জেনের মাথা ?
    উত্তর দাও পিলর ! তোমার চোখের পাতাকে পিটপিট করতে দাও
    আমার সঙ্গে তির্যক কথা বলো, তোমার গলায় গান গাও
    তোমার চুলের কাছে কাটা আর গোলাপঝাড় থেকে পড়ে যাওয়া
    হুবহু শব্দে, হে আমার গোলাপ
    আমার প্রার্থনাকে মেনে নাও ।

    ১৩
    হে আমার কারাগার যেখানে আমার বয়স না বাড়লেই আমি মারা পড়ি
    আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
    জীবন, মৃত্যু দিয়ে সাজানো, আমাকে শুষে নেয় ।
    তাদের ধীর কঠিন ওয়ালৎজ উল্টোদিকে নাচা হয়
    প্রত্যেকে নিজের মহিমান্বিত কার্যকারণের পাক খোলে
    অন্যের বিরোধীতায় ।
    তবু, আমার অনেকটা জায়গা আছে, এটা আমার সমাধি নয়
    আমার জেলখুপরি বেশ বড়ো আর আমার জানালা অতিবিশুদ্ধ ।
    আবার জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করছি জন্মের আগের রাতে
    আমি নিজেকে তেমনভাবে বাঁচার অনুমতি দিয়েছি যাতে আমাকে
    মৃত্যু চিনতে পারে
    উচ্চতর ইশারার মাধ্যমে ।
    আকাশ ছাড়া আর সকলের জন্য আমি আমার দরোজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি
    আর আমি কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অনুমতি দিই
    খোকা চোরগুলোকে যাদের ফিসফিসানিতে আমার কান গুপ্তচরগিরি করে
    নিষ্ঠুর আশায়, আমার সাহায্যের ডাকের জন্য
    তাদের সমাপ্ত গানের মাধ্যমে ।
    যদি আমি ইতস্তত করি আমার গান নকল নয়
    কেননা আমি আমার গভীর মাটির তলায় খোঁজ করি
    আর আমি প্রতিবার একই ধ্বনন নিয়ে উঠে আসি
    জীবন্ত কবর দেয়া ঐশ্বর্যের টুকরো-টাকরা
    যা জগতের আরম্ভ থেকে ছিল ।
    যদি তুমি দ্যাখো আমার টেবিলের ওপরে ঝুঁকে আছি
    সাহিত্যে বরবাদ আমার মুখাবয়ব
    তাহলে বুঝবে যে এটা আমাকেও পীড়িত করে
    এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ
    আবিষ্কার করার স্পর্ধা
    সেই লুকোনো সোনার
    এই প্রচুর
    পচনের তলায় ।
    এক আনন্দময় জ্যোতি আমার চোখে উদ্ভাসিত হয়
    যেন উজ্বল ভোরবেলায় এক জাজিম
    পাথরের ওপরে বেছানো
    তোমার চলাফেরায় বাধা দেবার জন্য
    গোলোকধাঁধা জুড়ে
    কন্ঠরুদ্ধ দর-দালানগুলোতে
    তোমার চৌকাঠ থেকে
    ভোরের
    সিংহদ্বার পর্যন্ত ।

    ( কবিতাটি মরিস পিলর [ Maurice Pilogre ] নামে একজন নামকরা অপরাধীকে উদ্দেশ্য করে। জেলে তার সঙ্গে জাঁ জেনের পরিচয় । ১৯৩৯ সালে গিলোটিনে তার মাথা কাটা হয়েছিল । মরিস পিলর হাসিমুখে গিলোটিনে মাথা দিয়েছিল ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চায়নি । )
  • Gertrude Stien | ***:*** | ১২ জুলাই ২০১৯ ১২:৫৩383619
  • 'তিনটি অঙ্কে চারজন সন্ত'

    ঘাসের ওপরে পায়রা হায় ।

    ঘাসের ওপরে পায়রা হায় ।

    ছোটো বেশি বড়ো ছোটো বেশি বড়ো বেশি বড়ো বেশি ছোটো হলুদ ঘাস। পায়রারা

    বড়ো পায়রারা ছোটো বড়ো হলুদ ঘাসে হায় পায়রারা ঘাসের ওপরে ।

    ওরা যদি পায়রা না হয় তাহলে ওরা কি ছিল ।

    ওরা যদি ঘাসের ওপরে পায়রা ছিল না হায় তা্লে কি ছিল । লোকটা শুনেছিল

    একটা তৃতীয় আর ও জিগ্যেস করেছিল ওটা কি আকাশে কিচিরমিচির পাখি।

    যদি আকাশে কিচিরমিচির পাখি আকাশের ওপরে তাহলে কাঁদতে পারবে না যদি

    ঘাসের ওপরে পায়রা হায় আর পায়রাটাকে এড়িয়ে ঘাসের ওপরে হায়

    আর কিচিরমিচির পাখি আকাশে আকাশের ওপরে চেষ্টা করবে চেষ্টা করবে চেষ্টা হায়

    ঘাসের ওপরে হায় পায়রাটা ঘাসের ওপরে পায়রা ঘাসের ওপরে আর হায়।

    ওরা হহয়তো ভালো ওরা হয়তো ভালোই অনেক ভালো অনেক ভালো হয়তো হতে পারে।

    লুসিকে দাও লিলি লিলি লুসি লুসি দাও লুসি লুসি লিলি লিলি লিলি লিলি

    লিলিকে দাও লিলি লুসি লুসি দাও লিলি । দাও লুসি লিলি।

    'মেয়ে'

    পৃথিবী কেন শান্তিতে রয়েছে

    এটা তোমাকে একটু অবাক করতে পারে কিন্তু তুমি যখন বুঝতে পারবে

    কতো সহজে শ্রীমতি চার্লস বোনাকো মার্কিন চিত্রকরদের তৈলচিত্র মার্কিন

    ধনপতিদের বিক্রি করেন আপনি জানতে পারবেন যে কর্তৃপক্ষের হাত পা বাঁধা

    এই ব্যাপারে । দাঁড়াও তোমাকে একটা গল্প বলি । একজন চিত্রকর এক নারীকে

    ভালোবাসতো । একজন গাইয়ে গান গাইতো না । একজন দক্ষিণ আফ্রিকার লোক

    বই ভালোবাসতো । একজন আমেরিকান ছিল মহিলা আর তার সাহায্যের দরকার ছিল।

    আমেরিকানরা কি ইনকিউবেটরের মতন । কিন্তু এটাই গল্পের বাকি অংশ ।

    সে হয়ে উঠলো পণ্ডিত ।

    'লাল পতাকা'

    লাল পতাকা সুন্দর পতাকার কারন ।

    আর রিবন ।

    পতাকার রিবন

    আর পরবার জিনিস

    পরবার জিনিসের কারন ।

    আনন্দ দাও ।

    তুমি কি আমাকে এলাকাগুলো দিতে পারো ।

    এলাকাগুলো আর জমি ।

    এলাকাগুলো আর চাকাগুলো ।

    সব চাকাই নিখুঁত ।

    উৎসাহ ।

    বাড়িটা চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছিল

    বাড়িটা চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছিল ।

    আর তার মধ্যে ঝিলমিল করছিল আহ্লাদ,

    আমার খুকি উজ্বল ।

    আহ্লাদে ঝিলমিল বাড়ির ভেতরে ঝিলমিল

    চাঁদের আলোর সঙ্গে,

    আমার খুকিকে আশীর্বাদ করো আমার খুকিকে আশীর্বাদ করো উজ্বল,

    আ্‌লাদে ঝিলমিল আমার খুকিকে আশীর্বাদ করো

    বাড়ির মধ্যে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল।

    ওর প্রিয় বর উল্লসিত হতে ভালোবাসে যখন ভাবে

    আর সে সব সময়েই ভাবে যখন জানতে পারে আর সে সব সময়

    জানে যে ওর আশীর্বাদপুত বউই এখানে যাকিছু আর ও পুরোটাই

    ওর বউয়ের, আর তার সঙ্গে সেঁটে থাকে আশীর্বাদপূত খুকির মতন ।

    যদি আমি ওকে বলতুম, পিকাসোর একটা সম্পন্ন প্রতিকৃতি

    আমি যদি ওকে বলতুম ও কি পছন্দ করত । ও কি পছন্দ করত যদি আমি ওকে বলতুম।

    ও কি পছন্দ করত যদি নেপোলিয়ান হতেন নেপোলিয়ান হতেন হতেন ও পচন্দ করত।

    যদি নেপোলিয়ান যদি ওকে বলতুম যদি বলতুম যদি নেপোলিয়ান । ও কি পছন্দ করত যদি আমি ওকে বলতুম যদি বলতুম যদি নেপোলিয়ান । ও কি পছন্দ করত যদি নেপোলিয়ান যদি নেপোলিয়ান যদি আমি ওকে বলতুম । যদি আমি ওকে বলতুম যদি নেপোলিয়ান যদি নেপোলিয়ান যদি ওকে বলতুম । যদি ওকে বলতুম ও কি পছন্দ করত ও কি পচন্দ করত যদি আমি ওকে বলতুম ।

    এখন ।

    এখন নয় ।

    আর এখন ।

    এখন ।

    ঠিক যেমন যেমন রাজারা ।

    পুরোটা অনুভব করতে পারে ।

    রাজাদের মতন হুবহু ।

    তাই তোমাকে খোঁজা এরজন্য পুরোটা এর জন্য।

    অবিকল কিংবা রাজাদের মতন ।

    আবদ্ধ বন্ধ আর খোলা যেমন রানিরা । আবদ্ধ বন্ধ আর আবদ্ধ আর তাই আবদ্ধ বন্ধ আর আবদ্ধ আর তাই আর তাই আবদ্ধ আর তাই আবদ্ধ বন্ধ আর তাই আবদ্ধ বন্ধ আর আবদ্ধ আর

    তাই । আর তাই আবদ্ধ বন্ধ আর তাই আর সেই সঙ্গে । আর সেইসঙ্গে আর তাই আর তাই আর সেই সঙ্গে ।

    হুবহু মিল হুবহু মিলের সঙ্গে হুবহু মিল হুবহু মিলের মতন ঠিক হুবহু মিলের মতন, হুবহু ঠিক তেমনিই মিল, হুবহু মিলে যায়, হুবহু তেমনই দেখতে হুবহুর হুবহু । কারন এটা তাইই। কেননা ।

    এখন সক্রিয়ভাবে একে বারবার করো, সক্রিয়ভাবে সবকিছু বারবার করো, সক্রিয়ভাবে বারবার করো ।

    বলেছি আর শুনেছি, সক্রিয়ভাবে বারবার ।

    আমি বিচারকের বিচার করি ।

    যেন তার মতন দেখতে ।

    কে প্রথমে আসে । প্রথম নেপোলিয়ান ।

    কে আরও আসে আসে আরও, কে ওখানে যায়, যেমন যেমন যায় তেমন ভাগাভাগি করে, কে সবকিছু ভাগাভাগি করে, সবই হয় সবই হয় এখনও এখনও ।
  • Kajal Ahmad | ***:*** | ১২ জুলাই ২০১৯ ১২:৫৭383621
  • কুর্দিস্তানের কবি কাজল আহমদ-এর কবিতা ( ১৯৬৭ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "যদি শহিদ হতুম"

    আমি ফুল চাই না,

    মিলনের উৎসব চাই না,

    সম্পর্কভাঙার ভোর চাই না।

    আমি ফুল চাই না

    কেননা আমিই সবচেয়ে প্রিয় ফুল।

    আমি চুমু চাই না

    সত্যিকার কবজির জন্য

    আমি কোনও যোদ্ধাকে পেতে চাইবো–

    কোনো বিয়ের ঘটনা নয়

    কোনো ডিভোর্সের ভোর নয়,

    কোনো বিধবার জ্বর নয় ।

    আমি কোনো চুমু চাই না

    যদি, প্রেমের সঙ্গে আমি শহিদ হয়ে যাই।

    আমি কান্না চাই না

    কফিন বা আমাকে নিয়ে, এক শব ।

    আমি সহানুভুতির চেরিগাছ চাই না

    আমার কবর পর্যন্ত যা টেনে নিয়ে যাবে,

    কোনো ফুল কিংবা চুমু নয়,

    কোনো কান্না বা দুর্দশা নয় ।

    কিচ্ছু এনো না ।

    কিচ্ছু ধরে থেকো না ।

    আমি পতাকাহীন এক স্বদেশের জন্য মরি, কন্ঠস্বরহীন ।

    আমি কৃতজ্ঞ ।

    আমি কিছুই চাই না ।

    আমি কিচ্ছু নেবো না ।

    "বোতাম"

    নির্দোষ চুমুগুলোর মধ্যে

    আমার গোলাপি শার্টের প্রথম বোতাম

    খসে পড়ল ।

    পরে, সেলাই করার সময়ে

    মেয়েটির চশমা লেজার-রশ্মির মতন ওর চোখে আটকে রইলো

    মেয়েটির হাতে ছুঁচ, ওর আঙুলের মতন,

    হুমকি দিয়ে, মেয়েটি বলে উঠল,

    “এই ঘটনা কবিতায় আনবেনা কক্ষনো!”

    "সন্ত্রাসের দেশে পুরুষের চেয়ে পথগুলোকে বেশি ভালোবাসি:

    পথগুলো জানতে চায় না, তুমি এখন কোথায় ? আর কোথায় যাচ্ছ

    পাগল মেয়ে ?

    পথ তো কখনও অন্যায় করে না আর হুমকিও দেয় না ।

    সন্ত্রাস জানে না ।

    পথের কোনো-কিছুই পুরুষের মতন দেখতে নয় আর

    পুরুষদের কোনো-কিছুই পথের মতন দেখতে নয় ।

    তা আমাকে বলে:

    যাও, আমাকে পেরিয়ে চলে যাও।

    বড়ো হও:

    ভালোবাসো

    সামান্যতম ভার বইতে হবে না তোমাকে।

    যে মেয়েরা ওড়ে তাদের ডানা আর তাজা থাকে না

    সেই সময়ে যখন তারা ভালোবাসার পাড়ার ভেতর দিয়ে যায়

    অন্ধকারে গড়া এক অহংকারী পুরুষ, এক অশিক্ষিত বালক

    জীবনের কাচের বাসন ভেঙে যায়

    নিঃসন্দেহে নিজের হৃদয়ের হাতে।

    ওই পথ–

    তাকে পার হতে বেশ ভালো লেগেছিল একজনের সঙ্গে।

    পরস্পরকে ভালোবাসতে নিষিদ্ধ করল অদৃষ্ট ।

    আমার হৃদয়ে উড়াল উঠেছিল যখন তার সঙ্গে হেঁটেছিলুম।

    পুরুষ ইচ্ছে করে পিছিয়ে পড়তে চাইলো

    যাতে ও আমাকে পেরিয়ে যেতে না পারে, যাতে আমি ওর চেয়ে আগে দৌড়োতে পারি।

    একটা পথই যথেষ্ট

    স্বাধীনতা উদযাপন করার জন্য আর পেরিয়ে যাবার জন্য,

    শিশুদের জন্য যাতে পেরিয়ে স্কুলে যেতে পারে,

    ছেলেদের জন্য যাতে মেয়েদের দিকে চেয়ে দেখতে পারে আর

    মেয়েদের জন্য যাতে হাসাহাসি করতে পারে।

    একটা পথ যা আমার নামে

    তাতে কোনো বিখ্যাত পুরুষের মূর্তি কোথাও থাকবে না ।

    তাকে প্রশস্ত হতে হবে, তাকে প্রশস্ত হতে হবে, প্রশস্ত

    আমার হৃদয়ের মতন।

    সকাল আর সন্ধ্যায় তাকে ফাঁকা থাকতে দাও

    কবিতার বাড়ির মতন শান্ত আর

    অন্য সময়ে তা থাকুক হইচই-ভরা

    আমার অন্তরজগতের মতন । ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট।

    আমার একটা পথ দরকার

    রক্তের দাগ যেখানে নেই,

    এমন এক পথ যা কখনও দ্যাখেনি

    বা জানেনি সন্ত্রাস কাকে বলে ।

    তা হোক খুঁতহীন, তা হোক খুঁতহীন, খুঁতহীন

    এই মেয়েগুলোর যৌনতার মতন যাদের অন্যায়ভাবে খুন করা হয় ।

    তা হোক অনেক দীর্ঘ, তা হোক অনেক দীর্ঘ, দীর্ঘ

    ওদের অন্তর্বেদনার মতন ।

    ওই পথে

    আমরা সবাই পর্যটক

    কিন্তু আমি একজন পর্যটক থেকে যাবো।

    নিশাপুরের চতুষ্পদী শ্লোক

    হঠাৎই নিজেদের বিশ্বাস করবে না

    আর ভালোবাসায় মাতাল

    আমার বাহুতে বাহু দিয়ে হাঁটবে ।

    "আয়না"

    আমার সময়ের অস্পষ্ট আয়না

    ভেঙে গেছে কারন

    যা ছোটো তাকে বড়ো করতে চাইছিল

    আর যা বড়ো তাকে ছোটো করতে চাইছিল।

    স্বৈরাচারী আর রাক্ষসরা তার মুখতল দখল করে নিয়েছিল।

    এমনকি এখনও যখন আমি শ্বাস নিচ্ছি

    এর ছুঁচোলো টুকরোগুলো আমার হৃদয়ে বিঁথছে

    আর ঘামের বদলে

    আমি কাচ গলিয়ে বের করছি ।

    Kajal Ahmad was born in 1967 in Kirkuk, a disputed city in Iraq with a strong Kurdish population. A poet, journalist and social critic, she has published four books: Benderî Bermoda (1999), Wutekanî Wutin (1999), Qaweyek le gel ev da (2001), and Awênem şikand (2004). Ahmad worked for over a decade as the Editor-in-Chief of Kurdistani Nwe and at times has worked as a TV host for KurdSat.
  • Anna Akhmatova | ***:*** | ১৫ জুলাই ২০১৯ ১১:৩২383622
  • রাশিয়ার কবি আনা আখমাতোভা-র কবিতা ( ১৮৮৯ - ১৯৬৬ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    ------------------------------------------------------------------------------------------------
    "ক্লিওপেট্রা"
    ( আমি বাতাস ও আগুন - শেকসপিয়ার )
    অ্যান্টনির মরা ঠোঁটে আগেই ও খেয়েছিল চুমো
    সিজারের পায়ে পড়ে হাঁটু গেঁযে নিয়েছিল কেঁদে
    চাকরেরা বিশ্বাসঘাতক । মিইয়ে আসা গাঢ় অন্ধকারে
    ওকে হেরে যেতে দেখে রোমের ইগলপাখি উল্লাসে বাজাচ্ছে ভেঁপুভেরি ।

    ওর কমনীয় রূপে বাঁধা শেষতম লোকটি ঘরে ঢোকে
    ঋজু ও রাজকীয় । নিজেরি রানির সামনে তোতলায় :
    “দাসি-গোলামের মতো হাঁটাবে তোমাকে রাজপথে, কেননা বিজয়ী !”
    শুনেও ও শুয়ে থাকে, হাঁসের মতন গ্রীবা, শান্ত গরিমায় !

    ভোর হলে শেকলে বাঁধবে ওর ছেলেমেয়েদের । সামান্য প্রেম
    পৃথিবীতে রয়ে গেছে ওর : এও লোকটির সাথে রসিকতা ।
    তারপর ছেড়ে দেবে শেষ করুণার মতো বিষধর
    শ্যামল বুকের মাঝে আলতো হাতে কালো জীবটাকে ।
    ----------------------------------------------------------------------------------------------
    "মৃত্যুকে"
    জানি তুমি আসবেই । তাহলে এ প্রতীক্ষা কেন ?
    তোমার জন্য আমি পথ চেয়ে : ফুরিয়ে গিয়েছে সব কাজ।
    আশার দীপ্র আলো কবে নিভে গেছে । দরোজা রেখেছি খুলে
    তোমার নামের এক সরল বিস্ময় আসবে তেমন আশায় ।
    অতএব যা-আদল নিতে চাও, নাও : ছুঁড়ে মারো
    তোমার বিষাক্ত বোমা আমার বাসাকে লক্ষ্য করে,
    কিংবা পেশাদার খুনি-গুণ্ডার লাঠির ঘায়ে মেরে ফ্যালো,
    কিংবা কন্ঠে ঠেশে দাও তান্ত্রিক-জ্বরের বিষ-ধোঁয়া,
    যদি তুমি তাই চাও, ঘুম পাড়াবার গল্প হয়ে
    অসংখ্য নিরপরাধ যেভাবে তোমায় চেনে, এসো :
    গুপ্ত পুলিশের নীল টুপিখানা দেখাও আমাকে । ভয়ে কাঠ
    মুখে রক্ত উবে-যাওয়া কাজের লোকের হাত কাঁপে ;
    আমার পরোয়া নেই । এনিস নদীর স্রোত বয়ে যায়,
    মাথার ওপরে জ্বলে উত্তরের তারা
    আর প্রিয় চোখ জুড়ে পুরোনো নীলাভ আলো
    শেষতম আতঙ্কের জন্য যশোহীন ।
    ------------------------------------------------------------------------------
    "আমার কেউ নয় ওরা যারা দেশ ছেড়ে চলে যায়"
    আমার কেউ নয় ওরা যারা দেশ ছেড়ে চলে যায়
    শত্রু আর লুটেরার হাতে যায় দেশটাকে ছেড়ে ।
    ওদের প্রথাগত প্রশংসায় আমি কান দিই না খকনও ।
    ওরা সব গাইবে বলে আমার কোনো গান নেই ।

    দেশত্যাগীদের জন্য আমি কষ্ট পাবো চিরকাল।
    কয়েদির মতো কিংবা যেন আধমরা,
    যে পথে তোমরা ঘোরো অন্ধকারে, ভবঘুরে দল,
    তোমার বিদেশি অন্নে তেতোপাতা ভরা।

    এখানে স্বদেশে রোজ অগ্নিকাণ্ড ঘটেই চলেছে
    খেয়ে ফেলছে বাকি যৌবন, আমরা এগোই
    আমাদের থ্যাঁতলানো দেহ কোনো পরোয়া করেনি
    একটি আঘাতকেও দেয়নি থামিয়ে ।

    জানি পরে কোনোদিন চেতনার আগমন হবে
    প্রতিটি মুহূর্তের ব্যথাকে তা ন্যায্যতা দেবে।
    আমরা সবাই এ-জগতের কান্নাহীন লোক ।
    গর্বে বুক ভরে যায় আমাদের । আমরা সাধারণ ।
    --------------------------------------------------------------------------------
    "আমি স্বপ্ন দেখি'
    কালো আর স্হায়ী বিচ্ছেদ
    তোমার সঙ্গে সমানভাবে ভাগাভাগি করে নিই
    কেনই বা কাঁদা ? আমাকে তোমার হাত ধরতে দাও,
    কথা দাও তুমি আবার আসবে ।
    তুমি আর আমি যেন উঁচু
    পর্বতমালা আর পরস্পরের কাছাকাছি যেতে পারি না ।
    কেবল বার্তা পাঠিও
    মাঝরাতে কোনো সময়ে নক্ষত্রদের দিয়ে ।
  • Natali Scenters-Zapico | ***:*** | ১৫ জুলাই ২০১৯ ১১:৩৭383623
  • মেহিকো-মার্কিন কবি নাটালি সেন্টার্স-জাপিকো-র কবিতা
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    -------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "যুবকটার হাঁ-মুখের বাতিক আছে"
    ও নিজেকে সামলাতে পারে না, মরা
    ফুলগুলোকে, ছেঁটেফেলা নখ, বাসি
    আটার বস্তা নিজের মুখে ঢোকায় । ও থামতে পারে না
    নিজের মুখের বিষয়ে লেখালিখি করে । যেমনভাবে

    ও ঘুম থেকে উঠলো মুখভরা মৌমাছি নিয়ে,
    তাদের মরা হুলগুলো তখনও ফোটাচ্ছে
    ওর মাড়িকে । ও লিখেছে : কিছু তো আছে
    মুখ ভেঙে ফেলার সুন্দর উপায় হিসেবে

    লালা আর শীতল বাতাসে । যুবতী যুবকের
    মুখ চাড় দিয়ে খুলে ফেললো আর তাতে
    ভরে দিলো সিসারঙা মাটি । মেয়েটি ওকে
    মুখ দিয়ে ব্রেনডেড করে ফেলতে পারল ;
    যুবতী মধু চেটে বের করে আনল
    যুবকের শ্বদাঁত থেকে, গাছের প্রাণরসের মতন ।
    যুবকের হাঁ-মুখ, তাতে টানা দাগ
    গাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে -- যুবতী কখনও দ্যাখেনি

    অমনতর কিছু । যুবকের মুখ একটা ক্ষত
    ওর খিদের, একটা ক্ষত ওর খিদের পরের
    পেটুকেপনার । লেখালিখি বন্ধ করো
    মুখ সম্পর্কে : দাঁত, মাড়ি সম্পর্কে,

    বেঁকা দাঁত আর তার রঙচঙে নীল আর সবুজ ।
    লেখা থামাও কেমন করে যুবতী কামড়ে ধরল
    তোমার মুখ আর টর্চ জ্বেলে ঝালাই করল
    মুখের খোলা-বন্ধ । লেখালিখি থামাও

    মুখ সম্পর্কে : জিভ, পবিত্র কশের দাঁত, নিজেকে
    চিবিয়ে হাড় করার ক্ষয় । মুখ নিয়ে লেখা থামাও
    যুবকের মুখ, তোমার মুখ, যুবতীর মুখ ।
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "একজনের বেশি পুরুষ আমার স্কার্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে"
    আমি জিগ্যেস করা বন্ধ করলুম:
    কেন ?
    আমি একজন লোককে সিটি মারার অনুমতি দিয়েছি
    টেবিলে বসে আরও বিয়ার অর্ডার করার জন্য,
    আর তার কাছে এনে দিয়েছি
    এক গাল হেসে । আমি থাপ্পড় মেরেছি
    একজন লোককে আর ছুটেছি
    লোকটা ততক্ষণ হেসেছে--
    বেশ সাহসী খুকি ।
    আমার একবার গর্ভপাত হয়েছিল । আমি একটা লোককে
    আমায় চুমু খাবার অনুমতি দিয়েছিলুম
    গর্ভপাতের পর
    লোকটার গরম চোখের জলকে সান্ত্বনা দিয়েছি।
    আমি এসব কাণ্ড করেছি,
    যখন অন্য যুবতীরা
    চাকরি করেছে
    জুড়েছে নানা অংশ
    ডেল কমপিউটার বোর্ডে,
    যখন কিনা অন্য যুবতীরা
    বেশ্যালয়া কাজ করেছে,
    আর চোটজখম খাওয়া বাহুতে
    ফাউন্ডেশান ক্রিম মেখেছে
    যখন কিনা অন্য মেয়েরা
    বাসে চেপে একা বাসায় ফিরেছে
    রাতের বেলায়, প্রতি রাতে,
    যখন কিনা অন্য যুবতীদের পাওয়া যাবে
    পোশাক পরে আছে
    যা তাদের নিজেদের নয়, কিংবা
    কোনো পোশাকই পরে নেই । আমি এসব কিছুই করেছি
    যখন কিনা অন্য যুবতীদের পাওয়া যাবে
    দুশ্চরিত্রদের সঙ্গে
    রক্ত দিয়ে লেখা
    তাদের ভাঙা তলপেটে ।
    আমার মা আমার চোখ ঢেকে দিতেন
    যখন মেয়েদের পাশ দিয়ে যেতুম
    কোনে দাঁড়িয়ে,
    আর বলত:
    দ্যাখো তোমাদের ভাগ্য কতো ভালো
    কোনো কাজকর্ম নেই
    কিই বা করে ওরা ? আমিও কাজ করেছি
    কারখানায়
    বলা হতো কর্মী
    হ্যা, আমি বলতুম, খুব ভালো ভাগ্য ।
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "একটি দেহ"
    ইদ
    দুটো ইদ হাঁটতে হাঁটতে একটা দেহে ঢুকে পড়ে আর লড়তে থাকে রান্নাঘরের টেবিলে তরমুজ কাটা হবে আর মুঠোয় করে খাওয়া হবে নাকি তরমুজটাকে বন্ধ জানালা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে আর দেখা হবে ফুটপাতে পড়ে কেমন করে ফাটল, কাঁচের টুকরোয় খুন হয়ে ।

    ইগো
    দুঃখিত, ম্যাকডোনাল্ডের গাড়ি যাবার গলিতে স্পিকারে চেঁচাবার জন্য । দুঃখিত, দরোজা দিয়ে তোমাকে প্রথমে ঢুকতে না দেবার জন্য । দুঃখিত, কলতলায় পনেরো মিনিটে এক ডজন ডোনাট খেয়ে ফেলার জন্য । দুঃখিত, আমার গলার আওয়াজ কর্কশ, মনে হয় বোকা, মনে হয় মাথা ঝিমঝিমে, মনে হয়ে হাঁক পাড়ছি । দুঃখিত, মম । আমি বলতে চাই, মামা । আমি বলতে চাই, মিস । আমি বলতে চাই, কিছু মনে করবেন না ।

    সুপারইগো
    প্রিয় শরীর : ধারালো ছুরি যেটা খুঁজে পাবে তাই দিয়ে তরমুজটা ফালি করে কেটে ফ্যালো আর তরমুজটাকে যে যন্ত্রণা দিচ্ছ তার আনন্দ উপভোগ করো । বলা বন্ধ করো যে তুমি দুঃখিত, বরং অপরাধবোধে ভোগো কর্কশ হবার জনয়, বোকা হবার জন্য, মাথা ঝিমঝিমের জন্য, হাঁক পাড়ার জন্য। অপরাধবোধে ভোগো কেননা তোমার মম তোমার মাম্মা তোমার মিসই সেই মানুষ যে আসলে অপরাধী তোমাকে এই শরীর দেবার জন্য যাতে রয়েছে দুটো ইদ, আর একটা ইগো আর একটা সুপারইগো যে তোমার সম্পূর্ণতায় ফিসফিস করে ।
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "তুমি এক অন্ধকার দেহ"
    জলের যাতে তলদেশের পাথর দেখা যাচ্ছে না
    তোমার ওপর থেকে । তুমি কেবল জলের একমাত্র অন্ধকার দেহ
    মরুভূমিতে যেখানে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে রক্তাক্ত ক্যাকটাস ।
    তোমার কন্ঠের হাড়ের কাছে তুমি বইছ একটা সংকীর্ণ গিরিখাত
    একটা চুলে বাঁধা । তুমি দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াও নিজের থেকে জল খেয়ে,
    কেননা তুমি এই জমির একমাত্র অন্ধকার দেহ
    জলের । দিগন্তরেখায় তুমি এক নারীকে খুঁজে পাও
    বিছানায়, তার বুক লালায় ভিজে, তুমি লাথিয়ে তাকে বিছানা থেকে
    ফেলে দাও, আর চাদরের তলায় তার জায়গা নাও । একজন লোক
    তোমার পাশে শুয়ে আছে । সে তোমার অন্ধকার দেহ গিলে ফ্যালে
    জলের আর তোমাকে নারীর দেহ দ্যায়, যে দেহের সঙ্গে তুমি
    কখনও পরিচিত হওনি । নারী হিসাবে পুরুষ তোমাকে খোসপাঁচড়া দ্যায়
    আর সেই খোস দিয়ে তুমি শ্বাস নাও, আর খোস সত্ত্বেও তুমি এক মৃত
    শিশুর জন্ম দাও জলের অভাবে । তুমি শিশুটাকে লাথিয়ে
    বিছানা থেকে ফেলে দাও, কিন্তু শিশুটি সেই নারীর কোলে ফিরে আসে
    যার বিছানা তুমি চুরি করেছিলে। তুমি কাঁদো যাতে তোমাকে আবার
    জলের অন্ধকার দেহ দেয়া হয় । লোকটা তোমাকে লাথিয়ে বিছানা থেকে
    ফেলে দ্যায়, তোমাকে জঞ্জালে ঢেকে দ্যায়, আর তোমাকে মরুভূমিতে
    পালটে দ্যায় । তুমি একটা বিছানার জন্যে কাঁদো যাতে লোকটা তোমাকে
    আর কখনও শুতে দেবে না । তুমি তোমার দেহের পাথরের বিছানার জন্যে
    কাঁদো যা জলের অভাবে মরুভূমি হয়ে গেছে ।
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "আমার মুখের ভেতরে একটা পাখি আছে"
    আমি ওটা তোমার পেটে খুঁজে পেলুম, আর ধরলুম
    দুই আঙুল দিয়ে । পাখিটাকে রাখলুম
    আমার কানের পেছনে ছোটো দাঁড়ে ।
    পালকগুলো ছিঁড়ে নিলুম, তাদের পুরলুম
    আমার ঠোঁটের তলায় তামাকের মতন,
    আর কালু সুতোগুলো থুতুর সঙ্গে ফেললুম
    একটা পলিথিন কাপে । এক রাতে
    পাখিটা মরে গেল । পেষা ঠোঁট, চেরা
    হাড় -- আমরাই করেছিলুম । তোমার হৃদয়
    ঈর্ষায় ভরা , আমার দেহ বীজ আর
    বাকলের স্বাদে উত্যক্ত
    আমরা পাখিটাকে চাইনি ।
    রাতের খাবারের সময়ে আমরা করলুম,
    তুমি আমার স্মৃতির ভেতরে ঢুকলে
    একটা আঙুল আমার কানে রাখলে।
    আমি আমার হাত তোমার মুখে
    রাখলুম পাখিটা ধরার জন্য
    আর আমরা পাখিটাকে দুজনে
    থেঁতলে দিলুম । ব্যাপারটা সহজ,
    আমরা করে ফেললুম আর বেশ
    আরামে কথাবার্তা বললুম ।
    স্মৃতি ব্যবহার করে আমরা পাখিটাকে
    মেরে ফেললুম যা কখনও আমাদের ছিল না।
    এখন আমরা হয়ে গেছি
    পাখির কসাই, তুমি বললে
    আর পাখিটার নিস্তেজ দেহ
    আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিলুম । আমি
    তোমার মুখটা দুহাতে নিতে চাইলুম,
    কিন্তু দু’হাতই হারিয়ে ফেলেছি।
    প্রতিটি আঙুল তোমার চোখের মণিতে
    হারিয়ে গেল, আমাদের ছোটো ছোটো
    কালো বিতর্কের মূল বিষয় ।
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "কাগজের টুকরো"
    কাগজের টুকরোয় নদী পার হবার সময়ে,
    আমি আমার নাম ভুলে গেলুম। আমার শরীর,
    একবার ফিরিয়ে দাও । আমি একজন মুরুব্বি
    সন্ত চাই যে খেঁকুরে কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেবে
    রাতের বেলায় গাছের বেড়ার ধারে মনে হল।
    আমি চাই জগতটা ভাষাহীন হোক,
    কিন্তু বলা যায় না তাই চিন্তাধারা লিখে রাখবো।
    সাহায্য পাঠাও, কুকুরটার গোঙানি
    আমাকে ঘুমোতে দেবে না। কতোদিন ঘুমোইনি।
    আমি এক মুরুব্বি সন্তের খোঁজ করছি, কিন্তু কেউই
    আমাকে প্রার্থনা করার পথনির্দেশ দেবে না। আমার ডান কানে
    গুঞ্জন আটকে আছে যা যেতে চায় না, যতোই আমি
    মাথার ডানদিক থাবড়াই না কেন
    খুচরো পয়সার জন্যে । বেশিরভাগ সকালে অবাক হই
    আমি কার কাছে প্রার্থনা করব যে নিশ্চিত করবে যে
    আমাকে জাগ্রত অবস্হায় বেঁচে থাকতে হবে না ।
    বেশির ভাগ রাতে আমি জপের মালা নিয়ে প্রার্থনা করতে
    ভুলে যাই, যদিও ওটা বিছানার পাশে রেখে ঘুমোতে যাই।
    আমি কখনও টিভি কিনিনি কেননা আমি আমার মগজে
    এই কথাবার্তা বারবার চালিয়ে যাবো । রান্নাঘরে
    আমার মরা প্রেমিকরা ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাই আমি এমন
    খাবার ওদের দিই যা ওরা খেতে পারবে না। আমি
    বাছুরের চামড়ার কাগজে রুটি বানাই, ব্যাণ্ডেজের
    কাপড়ের ডিম ভাজি । আমি শুধু একজন মুরুব্বি
    সন্ত চাই আমাকে যে রক্ষা করবে । আমি চাই
    অন্য কারোর রক্তক্ষরণ হোক ।
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "নব্যপৌরুষ"
    তুমি এখনও বেঁচে আছো কিনা দেখার জন্যে, একটা পাত্রে চিনির রস গরম করো যতক্ষণ না
    তা তোমার বাহুতে গ্রহাণুর থুতু ছিটোয় । তোমার পোড়া চামড়ার খেয়াল রেখো । তোমার দাগগুলো দুই বছরের বেশি থাকা উচিত নয় । যন্ত্রণাকে খেলাবার জন্য একটা পরিষ্কার স্লেট চাই । একটা লাল রঙের পোশাক পরো আর লোকজন তাকে সারারাত টানাটানি করুক। তোমার আকাঙ্খা : তোমার চুল ওপড়ানো হোক, রক্ত বেরোক, কুকুরের মতন গরমে নিজের ক্ষত চাটো । বলো যে রেগে যাবার জন্য তুমি দুঃখিত। বলো যে তুমি দুঃখিত কেননা তুমি রেগে গেছো । ক্রোধ হল পুরুষ মানুষের আবেগ । চিনি, পাতিলেবু আর নুন মিশিয়ে তুমি ক্রোধকে দুঃখে পালটে ফেলতে পারো যেমন ভালো মহিলারা করেন । ফোঁপানি বন্ধ করো, ব্যাপারটা কুৎসিত। তার বদলে, কুমারী মেয়েদের কাচ-অশ্রুর নকল করো যারা পুরুষদের দয়া চায় যে পুরুষরা তাদের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করেছে । তোমার পুরুষকে বলো : তুমি পৌরুষের জীবন্ত মূর্তি । তাকে বলো এই কথা এচটিএমএল-এ তোমায় জানাতে । সিনেমায় যেমন হয়, তাপটা কেটে যাক, যতক্ষণ না ও চিৎকার করে বলছে যে তোমাকে তোমার মায়ের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেবে । পুরুষটা যখন হাসি থামাতে পারছে না, তুমিও হাসো--- বিদেশি হয়ে যাও যে ভাষা বোঝে না : আমি দুঃখিত দুঃখিত ! লোলা ফ্লোরেস শোনো আর ইনটারনেটে তোমার চোখের মাঝে যন্ত্রণা সার্চ করো । মন খারাপ কোরো না যদি তুমি একটা ঘরে বসে ফোঁপাও আর লোকটা পাশের ঘরে বসে ‘অসেতুসম্ভব’ বিষয়ে পড়াশুনা করে। লোলা ফ্লোরেসের মতন, তোমার চুলও খুব সুন্দর ; লোলার কথা বাদ দাও, ভাড়া মেটাবার জন্য চুল বিক্রি করে দাও । হাসতে থাকো যখন লোকটা বলবে : তুমি একটি অকৃতজ্ঞ দুশ্চরিত্রা তবু তুমি আমার । লোকটাকে বুঝিও যে নিজের বাবা হবার চেষ্টা কোরো না । যখন লোকটা বলবে যে তোমার জন্যেই এসব ঘটছে, জবাব দিও না । লোকটার আঙুল নিজের মুখে পুরে নিও আর শ্বাস বন্ধ করে রেখো যখন লোকটা জিগ্যেস করবে : কে তোমায় নিজেকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে ?
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "ভালো কঙ্কাল"
    জীবন অনেক ছোটো, আর আমি তা দেশের মেয়েদের বলি ।
    জীবন অনেক ছোটো, আর আমি ওদের দেখাই কেমন করে কথা বলতে হয়
    দরোজা না খুলে পুলিশের সঙ্গে, কেমন করে
    সোশাল সিকিউরিটি নম্বর ফাঁকা রাখতে হবে
    পরীক্ষার খাতায়, আমি এসব দেশের মেয়েদের শেখাই।
    এই জগত রোজ ওদের বলে আমি তোমাদের ঘৃণা করি
    আর আমি তা দেশের মেয়েদের কাছে লুকোই না
    কেননা বাসের চালক ওদের লাথিয়ে বের করে দ্যায়
    রাস্তায় টিকিট ফাঁকি দেবার জন্য । কেননা আমি ভালোবাসি
    দেশের মেয়েদের, আমি ওদের পুরুষদের থেকে আগলে রাখি
    যারা ওদের পরস্পরের মাথা ঠুকে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে চায়।
    জীবন অনেক ছোটো আর জগতটা ভয়ঙ্কর । আমি জানি
    কোনো দয়ালু আগন্তুক এই দেশে নেই যারা এক মরুভূমি
    দূরত্বের বোন, আর আমি এগুলো দেশের মেয়েদের কাছে
    লুকোই না । জগতকে ওদের কাছে বিক্রি করা আমার
    কাজ নয়, কিন্তু ওদের আগলে রাখা যাতে নিজের দেশে
    ফেরত পাঠিয়ে দেয়া না হয় । আমাদের প্রথম
    বাড়িমালিক একবালতি কাচবার কাপড় এনে বলল
    তোর গায়ের রঙ পরিষ্কার হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি।
    ও দেশের মেয়েকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তোদের হাড়
    খাটুনির জন্য বেশ শক্তপোক্ত । দেশের মেয়ে, আমরা কি
    এই জায়গাটা সুন্দর করে তুলতে পারি ?
    আমি এই জায়গাটা সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করেছি ।
  • Bert Meyers | ***:*** | ১৭ জুলাই ২০১৯ ১৭:৫৭383624
  • বার্ট মেয়ার্স-এর কবিতা (১৯২৮ - ১৯৭৯)
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    -----------------------------------------------------------------------------------------
    "আমার শত্রুদের জন্য"
    আমি এখনও রয়েছি এখানে, এক চামড়ার ভেতরে
    ভুতুড়ে রেইনকোটের চেয়েও রোগা ;
    সেই পাখিদের মতন অদ্ভুত যারা বেহায়াপনায়
    একগুঁয়ে পাম্পগুলো ঠোকরায়
    যা থেকে কিছুই মেলে না…
    তোমার কারবারে পাগল হয়ে
    যার জন্য টাকা-নেবার মেশিন
    তাদের যাজকীয় ঘণ্টাসহ
    এক রাষ্ট্রিয় গির্জা হয়ে দাঁড়ায়;
    তুমিও, যার তাৎক্ষণিক হাসি
    আমার পায়ের কাছের মাটিতে ফাটল ধরায়…
    তোমার বউ যাক স্বর্গোদ্যানে
    জঞ্জালফেলার লোকটার সঙ্গে,
    তোমার লিঙ্গ ঝুলুক জুতোর ফিতের মতন,
    তোমার বিচিদুটো হয়ে যাক শুকনো আঙুর
    চোখে শাদায় গজাক চুল
    আর তোমার চোখের পাতা পালটে যাক
    ঘাস ছাঁটার মেশিনে
    যা নয়টা থেকে পাঁচটা কাটতে থাকে…
    মানুষ হলো চামড়ার অসুখ
    যা পৃথিবীকে ঢেকে রেখেছে ।
    নক্ষত্রগুলো অ্যান্টিবডি
    এসে পড়লো, তোমার রাষ্ট্রপতি
    হলো আফ্রিকার রক্তচোষা মাছি...

    "রসুন"
    মশলার ইহুদি যাজক
    যাঁর শ্বাস এক ক্রিয়াপদ,
    দাড়ি তাঁর বেশ পাতলা
    আর একটা শাদা আলখাল্লা :
    আপনি, যিনি রোগা আর ক্ষুদে
    আর চেহারা মুঠোর মতো,
    এক ইহুদি ধর্মস্হান,
    আমাদের তিক্ততাকে আশীর্বাদ করেন,
    রান্নাঘরকে শ্রেষ্ঠ করে তুলে
    মৃত্যুকে মিষ্টতা দেবার জন্য--
    শিখায় আমাদের মোম
    আর রুটিতে আমাদের বীজ
    আমার দাদু বসে থাকেন
    আমার কাকারা পুরে দ্যান
    আমার মুখে ছাই ।
    ------------------------------------------------------------------------------------
    "আস্তে, আস্তে"
    আমরাও, আরম্ভ করেছিলুম আনন্দে ।
    তারপর, রোগ এলো ;
    তারপর, দারিদ্র্য ।
    আমরা গরিব ছিলুম, বেশ গরিব,
    আমাদের বাচ্চারাই কেবল আমাদের বন্ধু ছিল ।

    আস্তে, আস্তে,
    ক্রোধ আর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে,
    ভালোবাসা নিজেকে ন্যায্য করে তুললো,
    বাড়ির পেরেকগুলোর মতন
    ঝড়ের সময়ে ।

    নানা উপায়ে, আমরা আশার জন্ম দিলুম,
    নির্ভরযোগ্য ঢোল
    ছায়ার কবজিতে
    এক জলতরঙ্গ
    স্বপ্নের পথের দুধারে ।

    রাতের বেলায়, আমিই ছিলুম
    যে হয়ে গেলো চেলো
    আমাদের যাবতীয় পথের তারে বাঁধা
    যেখানে স্মৃতি গুনগুন করে
    নিজের কাছেই একটা চাকার মতন ।

    আর তুমি, সানাইয়ের মতন পাগল
    যেখানে পথগুলো দুভাগ হয় :
    ঝোপঝাড়ে বৃষ্টিফোঁটার মতন এক শহর ;
    আস্তে আস্তে যে মধুর ফোঁটা পড়ে
    আকাশের পুরোনো হাতা থেকে…

    যে কারণে আমি মৃত্যুকে ভয় পাই ।
    আমার ডানার দিব্বি
    ভালোবাসা আমার কোমরে ছড়িয়ে পড়ে,
    আমি তোমার সুর বয়ে বেড়াবো
    আমার ক্লান্ত তারগুলো যতক্ষণ না ছিঁড়ে যাচ্ছে ।
    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "পেনসিল ছুঁচোলো করার কাটার"
    এর হাত নেই কিংবা পা, এই ছোটো নগ্নিকা ; তবু আঁকড়ে ধরো
    ওর কোমর, তারপর পাছাকে উত্তেজিত করো : একটা শুকনো পাতা বহুগুণ হয়,
    জঙ্গলে একটা শীতল চক্রযান চলা আরম্ভ করে ।
    জ্যান্ত করে তোলো, তখনও কাঁপছে, পেনসিলটা নিজেকে মেলে ধরে
    আর এক প্রজাপতি পাবে, দাঁত, একটা রাজমুকুটের টুকরো-টাকরা ।
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------
    "সূর্যমুখী ফুল"
    কেউই সূর্যমুখী ফুলের সঙ্গে কথা কয়নি,
    ওইসব প্রাচীনকালের মাইক্রোফোন
    ফাঁকা জায়গায় ।
    তাহলে, ওরা মাথা ঝুঁকিয়ে থাকে
    আর, আস্তে আস্তে, খসে পড়ে ।
  • Forough Farrokhzad | ***:*** | ১৮ জুলাই ২০১৯ ১৭:৩৩383625
  • ইরানের নারীবাদী কবি ফোরো ফারোখজাদ-এর কবিতা ( ১৯৩৪ - ১৯৬৭ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    -----------------------------------------------------------------------------------------
    "হাতে অস্ত্র তুলে নাও"
    কেবল তোমরা, হে ইরানের নারীরা, রয়ে গেছো
    হীনাবস্হা, দুর্ভাগ্য আর নিষ্ঠুরতার বাঁধনে ;
    তোমরা যদি এই বন্ধনগুলো ভাঙতে চাও,
    একগুঁয়েমির পোশাককে আঁকড়ে ধরো

    মিষ্টি প্রতিশ্রুতিতে কোমল হয়ে পোড়ো না,
    স্বৈরাচারের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ কোরো না ;
    ক্রোধ, ঘৃণা আর যন্ত্রণার বানভাসি হয়ে ওঠো,
    নিষ্ঠুরতার ভারি পাথরটাকে টুকরো করে ফেলে দাও।

    তোমাদের উষ্ণ বুকের আলিঙ্গন
    গর্বিত আর আত্মম্ভরী পুরুষদের প্রতিপালন করে ;
    তোমাদের হাসিমুখই তো যোগায়
    পুরুষের হৃদয়ে উদ্দীপনা আর বলিষ্ঠতা ।

    যে লোকটাকে তোমরা সৃষ্টি করেছো,
    তার অগ্রাধিকার ও শ্রেষ্ঠতা উপভোগ করা লজ্জাজনক ;
    নারী, হস্তক্ষেপ করো কেননা এই জগত
    অপেক্ষা করছে আর তোমার সুরে সুর মিলিয়েছে ।

    অন্ধকার কবরে শোয়া তোমাদের আনন্দের ব্যাপার মনে হয়
    এই শোচনীয় চাকরানিগিরি আর দুর্দশার তুলনায় ;
    কোথায় সেই বীর্যবান পুরুষ…? তাকে বলো
    তোমার চৌকাঠে যেন এবার থেকে মাথা নিচু করে ।

    কোথায় সেই গর্বের কেশর ? তাকে বলো উঠে দাঁড়াতে
    কেননা এখানে একজন নারী জেগে উঠেছে তার সঙ্গে লড়বে বলে ;
    তার কথাগুলো হল সত্য, যে উদ্দেশ্যপূরণের জন্য
    নারী কখনও দুর্বলতার অশ্রূ ঝরাবে না ।
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "বন্দি"
    তোমাকে চাই, তবু আমি জানি যে কখনও
    আমি তোমাকে হৃদয়ের তৃপ্তির জন্য জড়িয়ে ধরতে পারব না ।
    তুমি ওই পরিষ্কার আর উজ্বল আকাশ।
    আমি, খাঁচার এই কোনে, এক বন্দি পাখি ।

    শীতল আর কালো শিকের পেছন থেকে
    আমার বিস্ময়ের ক্রুদ্ধ চাউনি তোমার দিকে লক্ষ্য করে,
    আমি ভাবছি যে হয়তো একটা হাত আসবে
    আর আমি সহসা তোমার উদ্দেশ্যে ডানা মেলতে পারবো ।

    আমি ভাবছি কোনো এক অবহেলার মুহূর্তে
    আমি এই নির্বাক কারাগার ছেড়ে উড়ে যেতে পারবো,
    আমার কারারক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারবো
    আর তোমার পাশে নতুন জীবন আরম্ভ করতে পারবো ।

    আমি এই ব্যাপারগুলো ভাবছি, তবু আমি জানি
    আমি পারব না, এই কারাগার ছেড়ে পালাতে পারবো না ।
    এমনকি কারারক্ষী চাইলেও পারব না,
    আমর উড়ালের জন্য শ্বাস আর বাতাস আর নেই ।

    শিকগুলোর পেছন থেকে, প্রতিটি উজ্বল সকালে
    আমার দিকে তাকিয়ে এক শিশুর হাসি ভেসে ওঠে ;
    যখন আমি আনন্দের গান গাওয়া আরম্ভ করি,
    তার ঠোঁট আমার দিকে চুমুর জন্য এগিয়ে আসে ।

    হে আকাশ, একদিন যদি আমি চাই
    এই নিঃশব্দ কারাগার থেকে উড়ে যেতে
    শিশুটির ফোঁপানো চোখেদের আমি কি বলব :
    বলব কি, আমার কথা ভুলে যাও, আমি একটি বন্দি পাখি ?

    আমি সেই মোমবাতি যা ধ্বংসাবশেষকে আলোকিত করে
    তার নিজের হৃদয়কে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ।
    যদি আমি নিঃশব্দ অন্ধকার বেছে নিই,
    আমি একটি নীড়কে নষ্ট করে ফেলব ।
    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "পাপ"
    আমি একটা পরমানন্দের পাপ করেছি,
    এমন এক আলিঙ্গনে যা ছিল উষ্ণ আর আবেগভরা।
    বাহুর ঘেরাটোপে আমি পাপ করলুম
    তা ছিল তপ্ত আর শক্তিময় আর প্রতিকর্মের ফল ।

    অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে
    আমি ওর নিগূঢ় চোখের দিকে তাকালুম ।
    আমার বুকের মধ্যে হৃদয় অধৈর্যভাবে স্পন্দিত হল
    ওর করণীয় চোখের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ।

    ওই অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে,
    আমি আলুথালু ওর পাশে বসলুম ।
    ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটে কামেচ্ছা উগরে দিলো,
    আমি আমার উত্তেজিত হৃদয়ের দুঃখ কাটিয়ে উঠলুম।

    আমি ওর কানে ভালোবাসার কাহিনি বললুম ফিসফিস করে :
    আমি তোমাকে চাই, হে আমার জীবন,
    আমি তোমাকে চাই, হে জীবনদায়ী আশ্লেষ
    হে আমার উন্মাদ প্রেমিক, তুমি ।
    চাহিদা ওর চোখ থেকে অনুরাগের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিলো ;
    পেয়ালায় নাচতে লাগলো লাল মদ ।
    নরম বিছানায়, আমার শরীর
    ওর বুকে মাতাল স্ফূরণ গড়ে ফেললো ।

    আমি এক পরমানন্দের পাপ করেছি,
    শিহরিত স্তম্ভিত আকারের নৈকট্যে
    হে ঈশ্বর, কেই বা জানে আমি কি করেছি
    ওই অন্ধকার আর নিঃশব্দ আড়ালে ।
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "বিয়ের বেড়ি"
    মেয়েটি হাসল আর বলল : এই সোনার
    আঙটির রহস্য কি,
    এই আঙটির রহস্য যা এমন এঁটে
    বসে গেছে আমার আঙুলে,
    এই আঙটির রহস্য
    যা ঝিলমিল করছে আর এতো দ্যূতিময় ?
    যুবক বেশ অবাক হল আর বলল :
    এই আঙটি সৌভাগ্যের, জীবনের আঙটি ।

    সবাই বলল : অভিনন্দন আর ভালো থেকো !
    মেয়েটি বলল : হায়
    আমার এখনও সন্দেহ আছে আঙটির এই মর্মার্থের ।

    বহু বছর কেটে গেল, আর এক রাতে
    এক হতোদ্যম মহিলা সোনার আঙটিটা দেখল
    আর তার দ্যূতিময় নকশায় দেখতে পেল
    স্বামীর বিশ্বস্ততার আশায় নষ্ট হওয়া দিনগুলো,
    দিনের পর দিন একেবারে বরবাদ ।

    মহিলাটি উত্তেজিত হয়ে কেঁদে বললেন :
    হায়, এই আঙটি যা
    এখনও ঝিলমিল করে আর দ্যূতিময় রয়েছে
    তা ক্রীতদাসত্বের আর বাঁধনের বেড়ি ।

    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    "আমার বোনকে"
    বোন, তোমার স্বাধীনতার জন্য উঠে দাঁড়াও
    এতো চুপচাপ কেন তুমি ?
    উঠে দাঁড়াও কেননা এবার থেকে
    স্বৈরাচারী পুরুষদের রক্তে নিজেকে ভেজাতে হবে ।

    তোমার অধিকার দাবি করো, বোন,
    যারা তোমাকে দুর্বল করে রেখেছে তাদের কাছ থেকে,
    তাদের কাছ থেকে যারা অসংখ্য কৌশল আর ষড়যন্ত্রে
    বাড়ির এক কোনে তোমাকে বসিয়ে রেখেছে।

    আর কতোদিন আনন্দ দেবার জিনিস হয়ে থাকবে
    পুরুষদের কামনার হারেমে ?
    কতোদিন তোমার গর্বিত মাথা নত করবে তাদের পায়ে
    তমসাকবলিত চাকরানির মতন ?

    আর কতোদিন একগাল রুটির জন্য,
    এক বুড়ো হাজির সাময়িক বউ হয়ে থাকবে,
    দেখতে থাকবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বউদের ।
    শোষন আর নিষ্ঠুরতা, বোন আমার, আর কতো কাল ?

    তোমার ক্রুদ্ধ গোঙানি
    নিশ্চিত হয়ে উঠুক এক বিক্ষুব্ধ চিৎকার ।
    এই শক্ত বাঁধন তোমাকে ছিঁড়তেই হবে
    যাতে তোমার জীবন হয়ে ওঠে স্বাধীন ।

    উঠে দাঁড়াও আর অত্যাচারকে মূল থেকে উপড়ে তোলো।
    তোমার রক্তাক্ত হৃদয়কে আরাম দাও ।
    তোমার স্বাধীনতার জন্য, সংগ্রাম করো
    আইন বদলাবার জন্য, উঠে দাঁড়াও ।
  • Yezidi | ***:*** | ২১ জুলাই ২০১৯ ১১:০৯383626
  • ইয়াজিদি ( Yezidi ) কবিদের কবিতা
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------
    আমি ইয়েজিদি
    আজি মেরশাউই
    আমি ৭৪টা গণহত্যার যন্ত্রণা বইছি
    আর কোটি বছরের ফোঁপানি ।
    আমার পার্থক্যের চিহ্ণগুলো হলো
    এক বন্ধ মুখ আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ইচ্ছাশক্তি ।
    সৃষ্টিকর্তা আমার কথা জানে না
    আর কোনো পথ-মানচিত্র আমাকে ধারণ করতে পারে না ।
    সবচেয়ে দয়ালু দেবদূতরা আমাকে ঘৃণায় পরিহার করে ।
    অনুকূল কেউই আমার সমর্থনে কথা বলবে না
    আর কুরআনের আয়াত আমার দেয়ালকে সুরক্ষিত করবে না ।
    আমি অন্যের স্বর্গোদ্যানে যাবার মসৃণ পথ ।
    যারা আমাকে খুন করেছে তাদের সবায়ের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি
    যদি তারা শেষ পর্যন্ত স্বর্গে গিয়ে না পৌঁছে থাকে ।
    যদি পৌঁছে থাকে, আমি আশা করব কৃতজ্ঞতা ।
    মৃত্যুযন্ত্রণা আমার জিনকোষে সহজাত ।
    যন্ত্রণা নিজের শিকড় বিছিয়ে রেখেছে আমার রক্তস্রোতে।
    আমার দেহের কোষগুলোয় বিষাদ বাসা বেঁধে আছে ।
    বেঁচে থাকার জন্য আমি নিয়তি নির্দেশিত
    কেবল অন্যেরা যেমনভাবে চাইবে ;
    মরার জন্য আমি নিয়তি নির্দেশিত
    কেবল যখন অন্যেরা তার হুকুম দ্যায়---
    ঈশ্বরের স্মৃতির ধ্বংসাবশেষে ক্রুশকাঠে ঝোলানো
    জীবনের প্রাণবন্ত এলাকা থেকে একঘরে,
    যন্ত্রণাদায়ক ফাঁসির দড়ির মতন ছুঁড়ে ফেলে দেয়া
    বিস্মৃতির ধারালো ক্ষুরের ওপরে ।
    আমার একমাত্র স্বদেশ রয়েছে আমার অশ্রুর চাকচিক্যে ।
    আমার একমাত্র শোকজ্ঞাপন হলো আমার দুঃখের শঙ্খধ্বনি ।
    আমার অন্তরে, কারারুদ্ধ, মানবিক ফোড়ার পুঁজের বন্যা ।
    কোনো মধ্যস্হতা আমাকে ওই ভুলে যাওয়া
    ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না
    আর তার বদমেজাজি হুকুম থেকে
    আমার পালাবার কোনো পথ নেই ।
    আমি ভয়ের হিমে বন্দি,
    নিরাশার আটার তালে আমি চটকানো
    ফোঁপানিতে মিশে, তিক্ততায়--
    হাহাকারের ঝোপজঙ্গলে
    আমার গলার আওয়াজ এক কন্ঠরুদ্ধ গোঙানি।
    ব্রহ্মাণ্ডের কানে খড় ঢোকানো আছে
    আর প্রভু নিজেকে অন্যান্য অভিরুচিতে ব্যস্ত রেখেছেন ।
    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    যুদ্ধের রঙ
    দুন্যা মিখাইল
    দেয়ালে ডিজিটাল মানচিত্র ঝোলানো
    মার্কিন যুদ্ধ দেখাচ্ছে
    নানা রঙে :
    ইরাক বেগুনি
    সিরিয়া হলুদ
    কুয়েত নীল
    আফগানিস্তান লাল
    ভিয়েতনাম সবুজ।
    যুদ্ধ
    মানচিত্রে
    সুন্দর দেখায়
    রসবোধপূর্ণ
    আর রঙিন ।
    -------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    স্বভূমি
    আমেল হসকান
    কল্পনা করো কেবল কল্পনা, আমি সতেরো বছরের মেয়ে । পরিবারের সঙ্গে আনন্দে সিঞ্জার নামে একটা জায়গায় থাকি, যেখানের পর্বতমালা রাজকীয় আর ক্ষেতগুলো সবুজ, যেখানে এক সময়ে ছিল ভালোবাসা আর শান্তি ।
    আমার মা প্রতঃরাশ তৈরি করছে, বাবা কাজের জন্য তৈরি হচ্ছে, ছাদে ঘুমোচ্ছে ভাই, আমার বোন ফুলের বাগানে প্রজাপতিদের সঙ্গে নাচছে, প্রতিবেশিদের বাচ্চারা পাড়ায় খেলছে, আর তাদের হাসি পৌঁছোচ্ছে আকাশে ।
    ন ইরবতা, শান্তি, সুরক্ষা, ভালোবাসা, হাসি, সৌন্দর্য ।
    তখন আমি ভাবতুম আমি স্বর্গের অংশ, তা ছিল পৃথিবীর স্বর্গ ।
    দাঁড়াও, শব্দ আসছে কোথা থেকে, কিসের !! মাকে ডাকলুম, মা আওয়াজ কিসের ? বাগানে গেলুম, আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে গিয়েছিল, ফুলগুলো মুর্ছিত, আমি সর্বত্র রক্তের গন্ধ পেতে লাগলুম ।
    মাকে ডাকলুম, মা তুমি কোথায় ? বোন এখানে আছে তো, সে কোথায়? তুমি কোথায় ?
    তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন, তুমি কোথায় ?
    ওহ, আমার ভাই ছাদে ঘুমোচ্ছে, ও বলতে পারবে। আমি ভাইয়ের কাছে গেলুম ।
    ভাই, উঠে পড় ; এই আওয়াজে তুই কেমন করে ঘুমোচ্ছিস, উঠে পড়, ভাই,ভাই ।
    গন্ধটা ছিল আমার ভাইয়ের রক্তের, আমার ভাই বিছানায় খুন হয়েছে, আমার ভাইকে বিছানায় খুন করা হয়েছে । কেউ দয়া করে বলুক, এটা কি দুঃস্বপ্ন, বলুক এটা কি দুঃস্বপ্ন তাহলে জেগে যাবো।
    আমি কি করি ? আমি কি করব ?
    আমি পাহাড়ে যাবো । আমি শারফেদেন মন্দিরে যাবো, দুঃস্বপ্ন সেখানে শেষ হবে ।
    বেরোবার জন্য দরোজা খুললুম, দেখলুম কারোর ধড় থেকে মাথা কাটা । না, না, না,না, উনি তো আমার বাবা, ওটা আমার বাবার মাথা, না, না । এমন দুঃস্বপ্ন শেষ হচ্ছে না কেন?
    আমি যন্ত্রণা আর কান্না নিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়োলুম ।
    দাঁড়াও, ওই কালো পতাকাগুলো রাস্তায় কেন দেখা যাচ্ছে ? এরা কারা কুৎসিত বিদেশি নোংরা দাড়ি ঝুলিয়ে ? দৌড়োই, ওরা আমাকে দেখতে পাবে না ।
    দৌড়োচ্ছিলুম, পাথরে হোঁচোট খেয়ে তার ওপরে পড়লুম, দেখলুম তার তলায় একটা শিশু পাশে খালি বোতল, না খেয়ে মারা গেছে ।
    শিশুটাকে দেখার অভিঘাতে আমি যখন বিস্মিত, ওরা আমাকে দেখতে পেলো, আমার সামনে দাঁড়ালো, হায় দেবতা, ওরা তো কাছে আসছে । আমি চিৎকার করতে লাগলুম, বাঁচাও, বাঁচাও, কেউ আমার কথা শুনতে পেলো না, কেউ সাহায্য করতে এলো না । আমাকে ছেড়ে দাও, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে । আমাকে ছেড়ে দাও...আমি কোথায় ? এতো অন্ধকার জায়গা কেন ? মা, তুমি এখানে রয়েছ, মা কথা বলছ না কেন ? মা !
    মা শুধু একটা কথা বারবার বলতে লাগল : তিনটে রাক্ষস তোর বোনকে আমার চোখের সামনে ধর্ষণ করেছে ।
    তিনটে রাক্ষস তোর বোনকে আমার চোখের সামনে ধর্ষণ করেছে, তোর বোনকে ধর্ষণ করেছে, তোর বোনকে ।
    মা ওরা আসছে, মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের বাজারে, ওরা আমাকে দশ ডলারে বেচে দেবে মা । মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে…
    ওটা কি? তরুণীভরা জেল, এই মেয়েটা কে, পরীর মতন ছোট্ট । জিগ্যেস করলুম, তোমার খাবার খাওনি কেন । জবাব দিল, আমি খেতে চাই না, যদি খাই তাহলে বড়ো হয়ে যাও আর ওরা আমাকে নিয়ে গিয়ে বেচে দেবে ।
    তোমরা আমার মা কে ধরে এনেছো
    আমাকে মেরে ফ্যালো, এই মেয়েগুলোকে মেরে ফ্যালো ।
    কিন্তু তোমরা আমার ধর্ম বদলাতে পারবে না, তা আছে আমার হৃদয়ে । তোমরা আমার স্বদেশকে লুকোতে পারবে না, আমরা এমন রাষ্ট্র যারা পরাজয় কাকে বলে জানে না, আমাদের শ্লোগান হলো শান্তি । আমরা ৭৪টা গণহত্যা দেখেছি। আমরা মরিনি, মরব না ।
    আমাকে খুন করো, এই মেয়েগুলোকে খুন করো, কিন্তু আমার স্বদেশকে লুকোতে পারবে না ।
    আমরা শিঞ্জার পাহাড়ে থাকবো শারফেনদেন মন্দিরে ।
    মেয়েটি বুঝতে পারলো সে দুঃস্বপ্ন দেখছে না । তার সামনে রূঢ় বাস্তব ।
    আমরা বেঁচে থাকবো, এই কথা বলে মেয়েটি ধর্ষিত হবার আগে আত্মহত্যা করে নিলো ।
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    ইয়াজিদি বোনেদের
    আইল্লা রুৎ
    আমি বই আর কবিতা লিখি
    দুর্দশা-আক্রান্ত নারীদের জীবন নিয়ে
    আর আমি নামকরা কবি
    আমার কলম আর কবিতার কারণে
    আমার একটা ওয়েবসাইট আছে
    যেখানে আমার কবিতা পড়া হয় আবৃত্তি হয়
    আমি পুরস্কার আর সম্বর্ধনা সংগ্রহ করি।

    তবু ওরা এখনও যন্ত্রণাভোগ করছে
    আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে
    আমাদের মেয়েদের শেকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে
    আমাদের মেয়েরা তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছে
    আমাদের মেয়েদের বোরখায় চাপা দেয়া হয়েছে
    আমাদের মেয়েদের বিক্রি করা হয়
    চিনাবাদামের দামে ।

    কে তাদের মুক্ত করবে ?
    মায়েরা আর বাবারা কাঁদেন
    যতক্ষণ না অশ্রু ফুরিয়ে যাচ্ছে
    তাদের আর অশ্রূবিন্দু নেই
    কে শোনে কন্ঠরুদ্ধ চিৎকার ?
    ওই সুন্দর কালো চোখে
    কে দেখতে পায় সন্ত্রাসের ভয় ?

    একটি মেয়ের অসহায়তা
    যে শুধু নিজের জীবন কাটাতে চেয়েছে
    তার পরিবারের সঙ্গে
    তার বাড়িতে
    তার জনগণের মধ্যে
    আর তার দেশে

    কে তাদের উদ্ধার করবে ?
    স্বাধীন জগতের রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র
    তাদের বাঁচাবার জন্য
    অমন দানবতা থেকে
    তবু পাষাণ নৈঃশব্দ
    জগতের ঠোঁটে

    ছায়ায়
    পেশমেগরা নারীরা
    তাদের জমিজমা অন্ধকার থেকে
    আলোয় আনতে চাইছে

    ছায়ায়
    অনামা কর্মীরা
    ভালোবাসায় ভরা হৃদয়ে
    হাত আর শব্দ দিয়ে
    মুক্ত করতে চাইছে

    তারা কখনও সংবাদ হয় না
    কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়
    অনেক সময়ে তারা মারা যায়
    শহিদের মৃত্যু
    যাদের সন্মানিত করে মরুভূমি
    কিংবা কোনো অলিভ গাছ ।
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    নাদিয়া মুরাদ
    কেন ?
    আমাকে বলো, কেন ?
    ইয়াজিদিদের এতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে ?
    ইতিহাসের মাটিতে পড়েছে চোখের জল ।
    অস্বীকারের দেয়াল-পরদার পেছনে
    না-বলা প্রামাণিক সাক্ষপত্রগুলো উধাও হয়ে গেল, যতক্ষণ না…
    নাদিয়া মুরাদ মুক্ত এলাকায় পালিয়ে এলেন,
    আর নিজের গল্প বললেন ।
    কালো বুটজুতো নেমে এলো
    ইরাকে তাঁর কোচো গ্রামে।
    পুরুষরা এলো ধর্ষণ আর হত্যা করতে-করতে ।
    মেয়েটিকে করা হলো সাবাইয়া,
    যৌন ক্রীতদাসি।
    মেয়েটি বেঁচে রইলো,
    যাতে সবাইকে বলতে পারে ।
    ভুলে যেও না,
    ভুলে যেও না ।
    নাদিয়া মুইরাদ
    হবে শেষতম তরুণী !
    লড়বে আইসিসিসের বিরুদ্ধে ।
    গণহত্যার বিরুদ্ধে।
    অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নয়,
    কিন্তু শব্দ দিয়ে ।
    ন্যায়বিচারের জন্য ।
    আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক ।
    মেয়েটি কতো সাহসী, কতো দৃঢ় ।
    ওর লড়াইকে বৃথা যেতে দিও না।
    আবার সবায়েরর জন্য সকাল আসুক।
    মেয়েটি আমাদের কন্ঠস্বর !
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    আত্মপরিচয়
    হায়মান আলকারসাফি
    ওদের বলো যে আমি মরব না,
    ওরা লাঠি ভেঙে ফেললেও
    যা আমাকে ইতিহাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ।
    আমার শরীর শক্তি সঞ্চয় করে নেবে
    একগুঁয়েমিকে জয় করার জন্য ।
    সঞ্চয় করে নেবে দুর্দশা সহ্য করার ক্ষমতা,
    আর শিশুদের স্বপ্নের কাচের ফলার ওপর দিয়ে
    আমি আমার বাড়ি ফিরব ।
    ওদের বলো, ওরা ইঁদুরের মতন আমার সঙ্গে লড়েছে,
    কিংবা আমাকে কোতল করেছে,
    আমার আত্মপরিচয়কে তাদের চোয়ালের মাঝে আটক করে ।
    এই পর্বতমালা প্রতিবেশির ছেলেকে জড়িয়ে নিয়েছে।

    ওদের বলো
    যে এগুলো কেবল ফিসফিস করে বলা কথা নয়
    কিংবা নকল দেশপ্রেমিকের কান্না -- তা আসলে
    আমার ব্যক্তিগত আত্মপরিচয়,
    আমার ইয়েজিদি অহং,
    আমার ভাষা,
    আমার সিঞ্জারি আত্মা---
    আমি বিভ্রান্ত হবো না ।

    আমি এখনও বেঁচে আছি
    শিশুদের দেহে।
    আমি অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবো,
    আমার হাতে শান্তি আর বিজয়ের পতাকা নিয়ে ।
    ---------------------------------------------------------------------------------------------
    বন্দি
    মুরাদ সুলেইমান আল্লো
    ভালোবাসার মরুযাত্রীদলে যোগ দাও আর আমার যাত্রীদলের চেয়ে এগিয়ে যাও,
    নাওয়াফেল প্রার্থনায় একটা চিঠি দিয়ে দিও।
    মৃত্যুর কালো মুখের সামনে সজোরে চিৎকার করো,
    আজকে পাপিয়াদের গান যথেষ্ট নয় ।
    তুমি কোন প্রার্থনা পছন্দ করো, হে হ্যাজেল-চোখ নারী ?
    সিঞ্জারের শোকের কথা জানাও, প্রশ্ন কোরো না ।
    সবসময় ময়ূরপঙ্খী দেবদূতকে বিশ্বাস করো, তিনি দেবদূতদের প্রধান,
    তাঁর নামে, তাঁর ক্ষমতায় আমি তোমার শেকল আর বন্ধন ছিন্ন করব।
    দয়েশদের বলো জিব্রিল দেবদূতকে নিজেদের সততার প্রশ্ন করতে ।
    কবে থেকে নষ্ট অলসদের দেয়া হয়েছে খলিফাগিরি ?
    তোমরা আমার রক্ত যদি ঝরাও, তা কখনও শুকোবে না ।
    কবে থেকে মরুভূমির বালি ফুরিয়ে গেছে ?
    তোমদের হত্যার ফরমান আমাদের ধ্বংস করতে সফল হবে না ।
    ব্যাবিলনের সভ্যতাকে পুড়িয়ে তোমরা নষ্ট করতে পারোনো পারবেও না।
    প্রতিবেশিদের আপসে লড়িয়ে দেবার মধ্যে গৌরব নেই
    আর পোয়াতি নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো পুরস্কার নেই ।
    তোমরা বলতে পারো যে তোমাদের আক্রমণ একটা ন্যায্য কাজ,
    যেমন একসঙ্গে ডাঁটিকে ঘিরে থাকে কাঁটারা।
    তোমরা অজ্ঞ মূঢ়, তোমাদের পোশাকের মতন হৃদয়ও কালো
    মরুভূমির অপদার্থ বারবনিতাপুত্র তোমরা, জঞ্জালের প্রতিভূ ।
    আমরা দায়ুদ, মির্জা আর বাশার গৌরবকে আবার প্রতিষ্ঠা করব ।
  • Temsula Ao | ***:*** | ২১ জুলাই ২০১৯ ১১:১২383627
  • নাগাল্যাণ্ডের কবি টেমসুলা আও-এর কবিতা
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    --------------------------------------------------------------------------------------------
    সেই বুড়ো গল্পকথক
    আমি জীবন কাটিয়েছি এই ভেবে
    গল্প বলা আমার গর্বের উত্তরাধিকার ।
    যেগুলো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি
    আমার দাদুর কাছ থেকে তা হয়ে উঠল
    আমার প্রথম ঐশ্বর্য
    আর যেগুলো আমি অন্য কথকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি
    তা যোগ হল জাতিগত ঐতিহ্যের সঙ্গে ।
    যখন আমার সময় এলো আমি গল্প বলতুম
    যেন সেগুলো আমার রক্তে বই্ছে
    কেননা প্রতিবার বলার ফলে তা আমার
    জীবনের তেজকে পুনরুজ্জীবিত করে দিতো
    আর প্রতিটি গল্প চাঙ্গা করে তুলতো
    আমার জাতিগত পূর্বস্মৃতি।
    গল্পগুলো সেই মুহূর্তের কথা বলতো
    যখন আমরা ফেটে বেরোলুম
    ছয়টা পাথর থেকে আর
    কেমন করে প্রথমপিতারা প্রতিষ্ঠা করলেন
    আমাদের প্রাচীন গ্রামগুলো আর
    প্রকৃতির শক্তিমত্তাকে পুজো করতে লাগলেন ।

    যোদ্ধারা আর যারা ছিল বাঘ
    গল্পের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠতেন
    যেমন হয়ে উঠতো অন্য প্রাণীরা
    যারা একসময়ে আমাদের ভাই ছিল
    যতোদিন না আমরা মানুষের ভাষা আবিষ্কার করলুম
    আর তাদের বদনাম দিলুম হিংস্র হিসেবে ।
    দাদু অবিরাম সতর্ক করতেন
    যে গল্পগুলো ভুলে যাওয়া হবে
    সবায়ের সর্বনাশ :
    আমরা আমাদের ইতিহাস হারিয়ে ফেলবো,
    এলাকা, আর নিশ্চিতভাবে
    আমাদের অপরিহার্য আত্মপরিচয় ।
    তাই আমি গল্প বলতুম
    যা ছিল আমার জাতিগত দায়িত্ব
    যাতে কমবয়সীদের মনে যোগাতে পারি
    আবহমানকালের শিল্প
    অস্তিত্বের ইতিহাস আর জরুরি ঐতিহ্য
    পরের প্রজন্মে পৌঁছে দেবার জন্য।
    কিন্তু এখন আরম্ভ হয়েছে নতুন যুগ ।
    বুড়োদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কপটতার আশ্রয়ে ।
    আমার নিজের নাতিরা বাতিল করে দ্যায়
    আমাদের গল্পগুলোকে প্রাচীন বকবকানি হিসাবে
    অন্ধকার যুগের, ফালতু হয়ে যাওয়া
    এই বর্তমানকালে আর জিগ্যেস করে
    কেই বা চায় এইসব অসংলগ্ন গল্পগাছা
    যখন বই থেকে বেশি জানা যায় ?
    আমার নিজেদের লোকেদের প্রত্যাখ্যান
    উৎসার নষ্ট করে দিয়েছে
    আর গল্পগুলোকে মনে হয় পশ্চাদগমন
    এমন গর্তে যেখানে পৌঁছোনো যাবে না
    যে মন একসময়ে গল্পে স্পন্দিত ছিল
    এখন পর্যবসিত হয়েছে অকল্পনীয় স্হবিরতায় ।
    তাই যখন আমার স্মৃতি হারিয়ে যায় আর কথায় গোলমাল হয়
    আমি পশুসূলভ এক চাহিদার কাছে পরাস্ত বোধ করি
    মনে হয় ছিঁড়ে বের করে আনি চুরিকরা নাড়িভুঁড়ি
    সেই আদিম কুকুরটা থেকে
    আমার আমার সব গল্প ঢুকিয়ে দিই
    তার প্রাচীন অন্ত্রের মূল দলিলে ।
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    একটি একশিলা-মূর্তির প্রার্থনা
    আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
    আমার আগের অবস্হার ইয়ার্কি হিসাবে ।
    এক সময়ে আমি গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতুম
    গর্বে আর সন্তুষ্ট
    আমার টোলপড়া হাসিমুখ প্রেমিকা
    দাঁড়িয়ে থাকতো আমার পাশে ।
    তারপর একদিন কিছু বাইরের লোক
    খোঁচা দিতে-দিতে আর উঁকিঝুঁকি মেরে
    এখানের টিলাটায় ছোরা ঢোকালো
    আরেক জায়গায় পাথর যাচাই করল ।
    হঠাৎ ওদের বুড়ো লোকটা
    আমাকে দেখতে পেলো আর চেঁচালো,
    ‘আহা, এইটাই চাই
    এতেই কাজ হবে ।’
    অন্যরা আমার প্রেমিকাকে দেখে
    মাথা নাড়িয়ে বলল,
    ‘কিন্তু এটা নয়
    নোংরা ফাটলটা দ্যাখো।’
    আমি প্রতিবাদ করলুম আর অনুরোধ করলুম,
    ‘দয়া করে ওকে ছেড়ে যাবেন না
    ওটা গালের টোল
    এক বিদ্যুৎ যাবার পথে দিয়ে গেছে।’
    কিন্তু তারা আমার অনুরোধকে আমল দিলো না
    আর নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করল ।
    আমাকে বেদি থেকে উপড়ে তুললো
    প্রেমিকার পাশ থেকে কেটে আলাদা করল
    বাটালি দিয়ে চাঁছলো আমাকে
    অন্যরকম চেহারা দিলো।
    ওরা আমাকে গ্রামে টেনে নিওয়ে গেলো
    একটা চলনসই ঠেলাগাড়িতে বেঁধে ফেলল
    আর পুঁতে দিল পালটে-দেয়া আমায়
    তাদের নতুন পাওয়া ট্রফি হিসাবে ।
    দলটা যখন গ্রামে পৌঁছোলো
    বাচ্চারা হইচই করে বেরিয়ে এলো,
    উলু দিল রঙিন-পোশাক মহিলারা
    আর মাতাল পুরুষরা নাচতে লাগল
    আম,আর নতুন পোঁতা
    দুর্দশা ঘিরে ।
    এমনকি গ্রামের কুকুররা
    দৌড়ে এসে নিজেদের ঠ্যাঙ তুলে ধরল
    বাটালি-চাঁছা আমার চেহারায়
    তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য
    সার্বজনিক গর্বে
    আর আমি লজ্জায় দাঁড়িয়ে রইলুম
    অন্য কারো খ্যাতির খাতিরে ।
    এইভাবেই আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
    আমার পুরোনো অবস্হার ইয়ার্কি হিসেবে।
    হে প্রকৃতির শক্তি,
    যখন তুমি জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে
    আর আমার প্রেমিকা জানতে চাইবে
    তাকে বোলো
    আমি আমার গরিমায় অবতীর্ণ হয়েছি
    কিন্তু কখনও, দয়া করে, দয়া করে, বোলো না
    আমার অবমাননার কাহিনি ।
  • Saydee | 43.246.***.*** | ১৭ মার্চ ২০২৪ ১৬:০৫742571
  • দাঁত নখ ওয়ালা প্রেমের দাবি আমি মেটাতে চাইছে, সেটা ভালোবাসা নয়
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন