এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সাঁতার

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ এপ্রিল ২০২৪ | ৩৮৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • চারিদিকে শুধু জল আর জল। দোতলা বাড়ি জলের তলায়। বাড়ি তেতলা হলে শুধু গলাটুকু বাইরে। দোতলা তেতলা এখানে আর কোথায়। যা দেখা যাচ্ছে তা অনেক দূরে দূরে। ও..ই দূর গঞ্জে।

    এ তো নিকষ্য গেরাম। কুঁড়েঘরে খড়ের ছাউনি। দু চারটে ইঁটের গাঁথনির কোঠা আছে। মাথায় টিনের বা টালির ছাউনি। সব ডুবে আছে। চারদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ ভেঙেছে। দুরন্ত বেগে উল্টে পাল্টে বইছে মাটিধোয়া ঘোলাটে জল।আজু রহমান দুটো গরুকে নিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে বিডিও অফিসের দিকে। ওদিকে যেতে পারলে একটু উঁচু ডাঙা পাবে।পাশেই হাই ইস্কুল। তিনটে ছেলেমেয়ে বৃষ্টি নামতেই ওখানে গিয়ে উঠেছে কদিন আগে। তখনও জল বাড়েনি এখানে। বরপেটা থেকে তাদের গাঁ প্রায় দশ কিলোমিটার ভেতরে। আজু সাঁতারে ভীষণ পটু ছোটবেলা থেকেই। ওরা আগে থাকত ধুবড়িতে, তার আগে অনেকদিন ছিল গোয়ালপাড়ায়।

    হে..ই বাপ.... কলকলে জলের টান গরুগুলোকে হড়কে নিয়ে যাচ্ছে পেছন পানে ড্যামের দিকে। নাকানি চোবানি খাচ্ছে। ড্যামে গিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না। কোথায় তলিয়ে যাবে কে জানে। আজু সাঁতারে খুব দড়। একহাতে গরুদুটোর গলার দড়ি ধরা আছে। আর এক হাতে সাঁতার কেটে চলেছে। ডাঙা পাবে অন্তত তিন কিলোমিটার গেলে। একে তো নাগাড়ে বৃষ্টি, তায় লেগেছে হড়পার বান। কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি ! যেন কোটি কোটি সৈন্য জলের তীর ছুঁড়ছে মাটির দিকে।

    আজুর একহাতে দুটো গরুরই গলার দড়ি ধরা। সে গরু দুটোর মুখ ঘুরিয়ে দিল দক্ষিণমুখ করে। হ্যাঁ.... এবার দক্ষিণ বরাবর জলের টানে ভেসে যাবে আপনা আপনি। ভেসে থাকার জন্য ওদের কসরত করতে হয় না। এমনিই ভেসে যায়। আজুর হাতে ধরা আছে দড়ি।

    আজুদের গোটা পরিবার সীমানা পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল সেই কবে। সাল তারিখ কিছু জানা নেই। তার তখন জন্মই হয় নি। এখানে কিসব কাগজপত্র তৈরি হয়েছিল নাগরিক প্রমাণপত্র হিসেবে তা আজুর ভালভাবে জানা নেই। বাপ মা আর ওপরের দুই ভাই পরপর মরল তিন বছরের মধ্যে। মা যখন মারা গেল কি একটা জ্বরে ভুগে ভুগে তার একমাস আগে আজুর সাদি হয়েছে। বাবার একটুকরো জমি ছিল। ধান জমি। তিন ভাই সেখানেই চাষ করত। কোন ঝামেলা হয়নি কোনদিন। দুই ভাই মরে যাবার পর আজু একা হয়ে গেল। তারপর পরপর তিনটে ছেলেমেয়ে হল তার। তাদের পরিচয় পত্র টত্র কিছু নেই। ঘরে একটা টিনের বাক্স আছে। বাবা বলত তাতে নাকি কিসব কাগজপত্র আছে। আজু কোনদিন খুলে দেখেনি। তার দাদারা জানত এসব। তারা তো এখন নেই। তারা নাকি আসলে অন্য দেশের লোক। ওই বর্ডারের ওপারের বাংলাদেশের লোক। সেখানে সে কোনদিন পা দেয় নি। সে দেশ কোনদিন চোখেও দেখে নি। এখন সবার মুখে শুনছে তারা যে আসলে ইন্ডিয়ারই লোক তার প্রমান দিতে হবে। না হলে এদেশে আর থাকতে দেওয়া হবে না তাদের। পঞ্চায়েত থেকে তাদের গাঁয়ের ঘরে ঘরে নোটিস ধরিয়ে দিয়ে গেছে। কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ কর তোমরা এদেশী না ভিনদেশী।

    যদিও আজুর দম প্রচুর তবু একটানা সাঁতরাতে বা শুধু টানের মুখে ভেসে থাকতে থাকতে কেমন হাঁফ ধরে গা সিরসির করে। তাছাড়া গরু দুটোরও খানিক জিরেন দরকার। এই উঁচু উঁচু নারকেল গাছগুলোর বুক পর্যন্ত জল। কোনটা পুকুর কোনটা বাজার কিছু ঠাহর করা যায় না। এই যে জলের একটু ওপরে বেশ খানিকটা ছড়িয়ে জেগে আছে বটগাছের শরীর। আজু চিনতে পারল - এটা কুর্মীতলার বুড়োবট। গরু দুটোকে টেনে এনে বটের ডালে কষে বেঁধে দিল যাতে ওরা একটু জিরেন পায়। নিজে একটা ডালে চেপে বসল।

    এ জায়গাটায় ছড়ানো বটের ডালপালার ঠেকায় জলের টান বেশ কম। জল ঘুরছে গাছের এ পাশে ওপাশে। কিছুক্ষণ অন্তর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ লাগছে গরুদুটোর গায়ে। তাতে কোন কষ্ট নেই ওদের। জলে পা ডুবিয়ে গাছের ডালে বসে আছে আজু। ও..ই দেখ একটা জলঢোঁড়া হিলহিলিয়ে উঠছে বটের ডাল বেয়ে। তা উঠুক, আজু ভাবে।ওদেরও তো বাঁচতে হবে। তবে জাত সাপ হলে বড় ভয় লাগে। যদিও আজু অনেক জাতসাপ ধরেছে তাদের ঘরের আশপাশ থেকে। একটাকেও মারে নি। জঙ্গলে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ওরা তো কারও ক্ষতি করে না। ভীষণ ভীতু। যখন খুব ভয় পায় তখন ছোবল মারে।

    প্রায় পনের মিনিট কেটে গেল। এবার ফের রওয়ানা দিতে হয়। গরুদুটোর দড়ি খুলে হাতে নিল। তারপর জলে ভেসে পড়ল আবার। বটের আওতা ছাড়াতেই ফের স্রোতের টান। ভেসে চলল সরসর করে। পায়ের আঙুলে কি একটা কামড়াল। উ: হু , কামড়ে ধরে আছে। আজু বুঝতে পারল কাঁকড়া দাঁড়া বসিয়েছে। কোনরকমে ছাড়াল একটা হাত নীচের দিকে নিয়ে গিয়ে।

    জলের টানে ভাসতে ভাসতেই আজুর মাথায় অনেক চিন্তা এল। এন আর সি, না কি বলছে সব তার কাগজপত্তর ঠিক ঠাক আছে তো। টিনের বাক্স খুলে তার বৌ বার করেছিল একদিন। সবার জন্ম তারিখের কাগজ আছে। বাবা মার নামও আছে। তার বৌয়েরও আছে। খুব বুদ্ধি তার বৌ আনোয়ারার। বাপের বাড়ি থেকে আনিয়ে রেখেছে মাস ছয়েক আগে থেকে। তবে আর ভয় কিসের। তারা এন আর সি ফর্দে ঢুকবেই। আর এসব কাগজ যদি সরকারের অফিসাররা না মানে ....! তার বাচ্চাদের নামধাম যদি সরকারের খাতায় না মেলে তখন কি হবে ! আজুর মাথা ঘোলা জলে পাক খেতে থাকে।

    এখন বেলা প্রায় একটা হবে। মাথার ওপর গনগনে সূয্যি থাকার কথা। আকাশ একেবারে ধোঁয়াটে মেঘে লেপা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। টিনের দেওয়ালওয়ালা ক্যাম্প হয়েছে দলগোমায়।বাচ্চাগুলোকে যদি ওখানে পাঠিয়ে দেয় ! কেঁদে কেঁদে তো সারা হবে বেচারীরা ....। তার চেয়ে ভাল সবাই মিলে বরাকের জলে ডুবে মরা।

    ওই ওটা বোধহয় কোর্ট বাড়ি। জলে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। থামগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে। দুটো মরা কুকুরের লাশ ভেসে যাচ্ছে.... জলের ঘোর টানে আজুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। পেট ফুলে ঢাক হয়ে আছে। এখনও বোধ হচ্ছে এক কিলোমিটারের মতো জল টানতে হবে।

    আনোয়ারার আগের বর তালাক দিয়েছিল। নিকা হালালা হয়েছিল। তালাকের নতুন আইন কানুন তখন হয়নি। তারপর একদিন করিমগঞ্জের বাজারে আচমকা দেখা হয় আজুর সঙ্গে। দুজনের নিকা হয়ে গেল একদিন হুট করে। আনোয়ারার কোন বিটি ছাওয়াল ছিল না আগের পক্ষের।আনোয়ারাকে আজু একদিনের জন্যেও ছেড়ছাড় করে নি। আজুকে সে নতুন জীবন দিয়েছিল। মুশ্কিল হল, তারা একে মুসলমান তায় আবার একাত্তরের পরের লোক। তার বাবাই তো এখানে একাত্তরের পরে এসেছিল। যদি এন আর সি-তে নাম না ওঠে কি হবে ! গেলে তারা সবাই মিলে ডিটেনশান ক্যাম্পে যাবে। তারপর কি তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ? সেখানেও তো তারা আসলে পরদেশী। সে দেশ নেবে কেন তাদের। জন্মভূমি থেকেই যদি ভাগিয়ে দেওয়া হয় ! কিন্তু টিনের বাক্সে তার বাবা তো কাগজপত্র তোয়ের করে রেখে গেছে। তাদের চলে যেতে হবেই বা কেন ?

    ওই যে শিবমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। শিবঠাকুর এখন প্রায় বারোফুট জলের তলায়। বড়মাঠের গাজনের পরব হয় চোত মাসে। ছেলেপুলে নিয়ে প্রত্যেকবার আজু আনোয়ারা খুব আনন্দ করে এখানে এসে। তারা নাই বা হল হিঁদু, বাঙালী তো বটে। কি আশ্চর্য, মন্দিরের চূড়াটা ছোঁয়া গেল একহাত দিয়ে ! শিবমন্দির পার হয়ে গেল আজু গরুদুটোকে নিয়ে। আর একটু ভেসে থাক বাবারা। এই তো এসে গেল প্রায়। আর আধ কিলোমিটার।

    বর্ষা হোক দুর্যোগ হোক দুষ্ট লোকের দুষ্ট প্রবৃত্তি যায় না কখনও। কাম পরবিত্তি মরে না কারো কারো। এই যেমন নিশীথ।

    নিশীথ দাস। সেও কিন্তু বাঙালী। এখানে আছে পাঁচপুরুষ ধরে। জমি জিরেত করেছে বিস্তর। পয়সার গরম খুব। আনোয়ারার পেছনে লেগে আছে অনেকদিন ধরে। এই যেদিন বানের জল উঠে এসেছে চৌকাঠের ধারে সেদিনও ডাকাডাকি করছিল জানলা দিয়ে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কি প্রবৃত্তি বোঝ। মেয়েমানুষের গায়ের গন্ধ এতই মধুর ! আনোয়ারা আর কতবার শিকার হবে ? নিকা হালালার লোকটাও সুবিধের ছিল না। একমাস ধরে আনোয়ারাকে ছিঁড়ে খেয়েছে।

    এই যা:, সামনে পড়েছে একটা ঘোরা। অনেকটা জায়গা জুড়ে। বনবন করে জল ঘুরছে।বরাক আর ব্রহ্মপুত্র দুদিকের বাঁধের টান লেগেছে এক জায়গায়। দুই টানে দিশাহারা জল ঘুরপাক খাচ্ছে ভীষণ জোরে, এগোবার পথ না পেয়ে। ওর মধ্যে গিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না। কোন পাতালে টেনে নিয়ে যাবে কে জানে। কোন ওস্তাদ সাঁতারুও বাঁচার উপায় পাবে না। এখন আড়াআড়ি সাঁতার টানতে হবে বাঁ হাতে বরাকের দিকে। তারপর আবার সিধে টান। পথটা অনেকটা ঘুর হয়ে গেল। গরু দুটো হাঁফিয়ে পড়ছে। তার নিজেরও দম ফুরিয়ে আসছে। এখন আর একবার একটু জিরেন দিতে পারলে হত। এই যে ... বাঁ পাশে ঘুরতে আট দশটা বাঁশের আগা দেখতে পেল আজু।সে ভাবল এইখানে একটু ঠেকা দিই। জলের মধ্যে হিলহিল করে সাপ যাচ্ছে এদিক এদিক। তার মধ্যে জাতসাপও আছে, আজু বুঝতে পারল। ওরাও একটু ডাঙা খুঁজছে। একনাগাড়ে কাঁহাতক জলে থাকা যায়। আজু আবার গরুর দড়ি বাঁধল জলে বেরিয়ে থাকা বাঁশের আগার দিকে।

    চল্লিশ বছরের ওপর একদেশে থাকার পর তারা কি করে পরদেশী হয়। মাথায় আসে না আজুর।
    ঘূর্ণি এড়িয়ে ঘুরে যেতে গিয়ে আরও আধ কিলোমিটার বেড়ে গেল। রাস্তাটা প্রায় মেরে এনেছিল।এখন আবার বেড়ে গেল। কলজের হাওয়া যে ফুরিয়ে আসছে ....
    হ্যাঁ, ঘোরাটার পাশ কাটানো গেছে কোনরকমে। কাটাবার পর একটু সুবিধে হল। এপাশে জলের টান আরও খর। হুড়মুড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আর মেলা পথ বাকি নেই। আবার বৃষ্টি পড়তে লাগল। কি জ্বালা।এই ভর দুপুরে অন্ধকার করে এসেছে।
    এর মধ্যেও আজুর মনে আসল — জলের তলায় ডোবা ঘরের মধ্যে টিনের তোরঙে তার আর আনোয়ারার ভোটার কার্ড আছে।
    অংলং-এ এস ডি ও অফিসে গিয়ে ফটো তোলা হয়েছিল। জল নামলে ওই বাক্স খুলতে হবে।
    জলের মধ্যে দুটো বড় মাছ ঘাই মারল। বোয়াল মনে হল। এদিকটায় কাছেই নদী। ওখান থেকে প্রচুর মাছ ভেসে আসছে। জলের ধাক্কায় বাস্তুহারা হয়েও মহানন্দে সাঁতরাচ্ছে জলে। ওদের কেউ বিদেশী বলবে না। মাছের মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে আজুর।
    ওই যে .... ওই ওখানে ঘোলাটে আকাশের নিচে আবছা দেখা যাচ্ছে ডাঙা। বর্ষাধোয়া কালচে গাছপালা। জলে ভেজা হলুদ রঙা ইস্কুল বাড়ি। আজুর দুপাশ দিয়ে প্রবল বেগে ভেসে চলেছে গাদা গাদা মোটা মোটা লতাপাতা।

    আরো আধঘন্টার মতো জল টানার পর আজু পায়ের নীচে কাদা পেল। গরু দুটোর এখন বুকের নীচে জল....
    আজু কাদা চপচপে চরে এসে উঠল। উঠে গরুর সারা গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। তাতে যদি একটু তাজা হয়। বড্ড কষ্ট গেছে বেচারিদের। মাখমের মতো নরম এঁটেল মাটির কাদা। এক পা কোন গতিকে তুললে আর এক পা বসে যাচ্ছে। তেমনি হড়হড়ে আঠালো। দড়ি ছেড়ে দিয়ে গরুগুলোকে পেছন দিক থেকে ঠেলা মেরে তুলতে লাগল।এখন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এই রক্ষে। পাড়ের ওপরটায় জনমনিষ্যি নজরে আসছে না। বৃষ্টির ঝাপটায় সব গুটিয়ে গেছে ঘরের কোণে। কাউকে দেখা গেলে দুটো বাঁশের লগা ফেলে দিতে বলত। লগা দুটো কাদায় পুঁতে দিয়ে চাড় মেরে মেরে উঠে আসত।
    আচ্ছা, তারা যদি ডিটেনশান ক্যাম্পে যায় তার গরু দুটোকে নিয়ে যেতে দেবে তো.... আজুকে
    ছেড়ে ওরা কোথায় থাকবে? কেই বা ওদের খাওয়াবে। আজুর মাথায় নানা চিন্তা পাক খেতে থাকে।
    সে যাই হোক আজু প্রানান্তকর চেষ্টায় গরু দুটোকে নিয়ে উঁচু ঘাস জমির নীচে গিয়ে পৌঁছল। এখন ওপরটায় গিয়ে উঠতে পারলে হয়। ওই ওখানটায় মাটির ঢাল আছে।
    ওখান দিয়েই উঠতে হবে। উঠতে গিয়ে হড়হড়িয়ে আবার নীচে না পিছলে যায়। তাহলে এতক্ষণের খাটনি মাটি। কপালজোরে সেটা অবশ্য হল না। আজু গরু সমেত ওপরের ঘাস জমিতে উঠে এল। আর এট্টুখানি হাঁটলেই ওই হলুদরঙা ইস্কুলবাড়ি।
    ওখানে উঠে আবার একটু দাঁড়াল আজু। গরুদুটোর হাঁফ ধরেছে বোধহয়। ওদের বুকের দুপাশে হাল্কা মালিশ করতে লাগল। ওদের গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দাঁডিয়ে। গলা উঁচু করে আদর খাচ্ছে ওরা।

    গরু দুটোকে একটা ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে ইস্কুল বাড়িতে গিয়ে ঢুকল আজু। এখানে প্রচুর ঘাস। গরুদুটো খেতে পারবে। খিদেয় ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ছে শরীর। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। শুধু ডাঙা পাবার চিন্তা ছিল মাথায়। শরীরের চিন্তা উড়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে আনোয়ারা আর তার ছেলেমেয়েরা ছুটে এল। আনোয়ারা একটা গামছা দিল গা মোছার জন্য।এখানে সবাইকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছে। আজুও আর দেরি না করে বসে গেল খেতে ভিজে কাপড়েই।

    পাশেই বি ডি ও অফিস। সেখানে বিরাট লাইন। দুজন অফিসার গম্ভীর মুখে বসে সেই সকাল থেকে কাগজপত্র পরীক্ষা করছে। গেজেটে পেন্সিল বুলিয়ে দেখছে এন আর সি খাতায় কার নাম আছে কার নেই। একটা নিম গাছের আড়ালে অফিসের জানলা। নিমডালের আড়ালে ওই খোলা জানলা দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিটা ধরেছে এখন। একটু আলোও ফুটছে যেন আকাশে। এখানে কোন বসার জায়গা নেই। যে তিনটে বেঞ্চি আছে তাতে লোক ভর্তি।

    আজু গোগ্রাসে খিচুড়ি খেতে লাগল ওসব দিকে মন না দিয়ে। খাবার পরে মেঝেয় বসল ওরা সকলে। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল আজুর দুচোখে। এলিয়ে পড়ল শরীর।

    ঘন্টাখানেক পরে আনোয়ারা ঠেলা মেরে তুলল আজুকে। ‘এই শুনছ.... বিডিও অফিসে ডাকছে এখানকার সবাইকে। কাগজপত্র মেলাতে চাইছে। আজকেই নাকি শেষদিন। রাত দশটা অব্দি কাজ চলবে। সবাই ওখানে গিয়ে লাইন মেরেছে। আমাদের কি হবে গো ! তুমি তো কাগজপত্র আনতে পারনি কিছু.... আমাদের কি তা’লে দলগোমার ক্যাম্পে চালান করবে !

    আজু ঘুম থেকে উঠে থম মেরে বসে থাকল। বেলা প্রায় চারটে বাজে। বৃষ্টি ধরে গেছে। কালো মেঘে আলোর চিড় ধরেছে। আলো উঁকি মারছে একটু একটু। দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল আজু। গরু দুটো বসে বসে জাবর কাটছে নিশ্চিন্তে। অনেকটা ঘাস খেয়ে নিয়েছে নিশ্চই এর মধ্যে। আজু ভাবল তারও যদি এমন জীবন হত...

    জলের তলায় ডুবে আছে ঘর। সেখানে আছে টিনের তোরঙ। খুললে পাওয়া যাবে সাত রাজার ধন এক মানিক.... পরিচয়পত্তর।

    আজুর আবার ঢুলুনি আসে। ভাবে, জলের ছালায় সে সব কি আর আছে? থাকলেও কি আর চেনা যাবে সে সব। তবু ওগুলোকে তুলে আনার জন্য আর একবার ঝাঁপাতে হবে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে বাঁচার জন্য।

    রাত দশটা পর্যন্ত কাজ চলবে বি ডি ও অফিসে। বিবি বাচ্চাদের শুকনো ডাঙায় রেখে আজু বিকেল সাড়ে চারটেয় হড়পার বানের জলে আবার ঝাঁপ মারল ছ কিলোমিটার উজিয়ে তার ডুবে থাকা ঘরের টিনের তোরঙ থেকে গোটা পরিবারের বংশলতিকা ছেঁচে আনবার জন্য।

    দেখে সোয়াস্তি এল, তার গরু দুটো নিশ্চিন্ত মনে জাবর কাটছে।

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:২৪530233
  • এই পরিস্থিতি আরও ছড়াবে হয়ত।
     
    গল্প লেখার মুন্সিয়ানা ভালো লেগেছে।
  • Anjan Banerjee | ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৫৩530236
  • সেটাই ভয়। বুকে ভয় নিয়ে বাঁচা আমাদের। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন