বুল্লি বাই’ অ্যাপ নিয়ে সাম্প্রতিক হৈচৈ এবং এই কাণ্ডে বেঙ্গালুরু থেকে এক যুবককে মুম্বই পুলিশ আটক করার আগে আমরা কেউই এই কুৎসিৎ বিষয়টি নিয়ে জানতাম না। যারা এখনো বিষয়টি জানেন না তাদের জানিয়ে দিই যে ওই অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে মুসলিম মহিলাদের ‘নিলাম’ করা হত । ভার্চুয়াল নিলাম। এখন ভার্চুয়াল নিলাম কী না বুঝলে আমার কিছু করার নেই।
যাইহোক, অ্যাপটি আপাতত সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। আপাতত বলছি এই কারণে যে গত বছরেরও ৪ জুলাই 'সুল্লি ডিলস' নামে একটি অ্যাপ চালু ছিলো। গিটহাবে অঞ্জাতপরিচয় এক দল এই অ্যাপটি হোস্ট করেছিলো। এই অ্যাপে টার্গেট মুসলিম নারীদের মুখের ছবি ও তার নীচে ট্যাগলাইন থাকত 'আজকের জন্য সুল্লী চুক্তি'। টার্গেট মানে যে সব মুসলিম মহিলারা সিএএ, এনআরসি বিরোধী মন্তব্য করেছেন বা কোনো না কোনো ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বিরুদ্ধে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। এই অ্যাপের বিরুদ্ধে দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কাছে ২টি এফআইআর দায়ের করা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে গিটহাবে কারা এই অ্যাপটি হোষ্ট করেছিল তা জানতে চাওয়া হলে গিটহাব আজও তা জানায়নি। ফলে অ্যাপটি ব্লক করে দেওয়া হলেও অ্যাপ নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোনো নেওয়া হয়নি।
মুসলিম মহিলাদের বিরুদ্ধে বলা আপত্তিজনক এক শব্দ হল 'সুল্লি'। এই শব্দটি মুল্লা (মোল্লা)- এর স্ত্রী লিঙ্গ মুল্লি থেকে উদ্ভূত। ফেসবুকের মতো সামাজিক প্লাটফর্ম গুলো হেটস্পিচের বাড়বাড়ন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগায়। কোথাও বারবার মুসলমান, মোল্লা, হিন্দু ইত্যদি শব্দ বার বার ব্যবহৃত হতে থাকলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেটাকে সন্দেহজনক কার্যকলাপ হিসাবে নোট করে এবং শাস্তি হিসেবে ব্যবহারকারীকে কয়েক দিন ব্লক করে দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ফাঁকি দিতে ঘৃণার চাষ কারীদের পেজে বা গ্রুপে "মুসলমান" না লিখে তার জায়গায় "মুSলমান" বা হিন্দুর জায়গায় 'হি.ন্দু' ইত্যদি লেখার প্রচলন আছে। সেই নিয়মেই ওই অ্যাপের নির্মাতারা "মুল্লি"-এর জায়গায় "সুল্লি" শব্দটি ব্যবহার করে। প্রোগ্রামিং করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা "মুল্লি" শব্দটি চেনে, "সুল্লি" চেনে না।
ঘৃণার প্রবাহের উৎসের সন্ধানে বেশ কিছু দিন ধরে হিন্দুত্ববাদীদের পেজগুলোতে যাতায়াতের সুবাদে আমি এসব রণকৌশল জানি। এই ধরণের পেজের লেখকদের সাধারণ ভাবে আমরা "চাড্ডি" বলে উপেক্ষা করি। কিন্তু এদের মধ্যে কারো কারো যথেষ্ট পড়াশোনা আছে। রীতিমত রেফারেন্স দিয়ে তারা হিন্দুত্ববাদের পক্ষে যুক্তি সাজান। একটা পোষ্টে কমেন্ট করে প্রশ্ন করেছিলাম," এই ঘৃণার চাষ করে আপনার কী লাভ হচ্ছে? 'হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা বিপন্ন' এর বাস্তবতা কী।"
এক মিনিটেরও কম সময়ে উত্তর পেতে শুরু করলাম,"যেদিন মোSলারা আপনার মা-বোনকে তুলে নিয়ে যাবে সেদিন বুঝতে পারবেন।"
আমার মা বেঁচে নেই। দিদি অবশ্য আছে। কিন্তু এখানে শুধু আমার মা-বোনের কথা বলা হচ্ছে না উপলব্ধি করতে করতেই দ্বিতীয় কমেন্ট,
"দাদা সেকু না মাকু?"
'সেকু' ও 'মাকু' যে একধরণের গালাগালি তা আমি জানি। 'সেকু' মানে সেকুলারপন্থী, আর 'মাকু' মানে মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাসী। একটার সঙ্গে অন্যটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলেই জানি। এখানে জানতে চাওয়া হয়েছে ঐই দুটোর মধ্যে আমি কোনটি?
ভালো করে ভেবে উঠতে না উঠতেই একটা কমেন্ট এলো,"গাজোয়াতুল হিন্দ মানে কি জানেন? ইন্ডিয়ায় কত জায়গায় তার ট্রেনিং ক্যাম্প আছে জানেন?"
এটা সত্যিই আমার জানা ছিলো না, গুগল করে জানলাম গাজওয়াতুল হিন্দ হলো নবী মুহাম্মদের একটি ভবিষ্যদ্বাণী, যেখানে উল্লেখ আছে, ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হবে, যাতে মুসলমানদের বিজয় ঘটবে।
এরপর অসংখ্য কমেন্ট, সেগুলোর কয়েকটায় আমার বুদ্ধ্যঙ্কের মানের স্বল্পতা নিয়ে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও বেশিরভাগই ছিল কাঁচা খিস্তি। শালীনতার সীমা রক্ষা করতে সেগুলোর উল্লেখ করছি না।
তবে সব সময় খারাপ মন্তব্য পেয়েছি এমন নয়, যুক্তিপূর্ণ শানিত উত্তরও পেয়েছি। ওদের বিভিন্ন প্রতি মন্তব্য থেকে অনেক কিছু জেনেছি। তারা যা বলতে চায় তার সারমর্ম কোরআনের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না, ইসলামের পথে না এলে তাদের মেরে ফেলতে হবে বা কাফেরদের নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে ইত্যদি। আমি এগুলো আগে থেকেই জানি। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্লগে বেশ উঁচু মানের লেখা থাকে। সেগুলো পড়তে আমি মাঝে মাঝে ওই ব্লগগুলো পরিভ্রমণ করি। ওই ব্লগগুলোতে ধর্মান্ধতাকে আক্রমণ করে অনেক লেখা থাকে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই ব্লগগুলোতে সবথেকে সমালোচিত ধর্মটি ইসলাম। এরকমই একটি ব্লগের একটা লেখা অথেন্টিক কিনা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে আমি হাবিবুর রহমানের ওয়েবসাইটে গিয়ে বাংলা কোরআন পড়েছি। শুধু প্রাসঙ্গিক জায়গাগুলোই পড়েছি। কোরান খুব সুখপাঠ্য গ্রন্থ নয়। অবশ্য কোনো ধর্মগ্রন্থই অনুবাদে সুখপাঠ্য নয়। হয়তো আরবি ভাষায় আয়াতগুলো শুনলে ধ্বণী মাধূর্য উপলব্ধি করা যায়।
কোরানের একাধিক আয়াতে খোলাখুলিভাবে এই ধরণের বর্বর কথা আছে দেখে আমি অবাক হইনি। চোদ্দোশো বছর আগে একটা একেশ্বরবাদী ধর্মের গ্রন্থে এরকমটা না থাকাই আশ্চর্যের। অন্য একেশ্বরবাদী ধর্মগ্রন্থেও এই ধরণের কথা আছে। যদিও হিন্দু ধর্মে বিধর্মীদের প্রতি এরকম ঘৃণা বাক্য নেই। থাকবে কীভাবে? হিন্দু ধর্ম তো একেশ্বরবাদী ধর্ম নয়। কিন্তু হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথায় হিন্দু ধর্মেরই মানুষকে চার ভাগে ভাগ করে শূদ্রদের প্রতি যে বর্বরতার কথা বলেছে তা একেশ্বরবাদী ধর্মের থেকে কোনো অংশে কম? হিন্দু ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ গীতার সকল বাণীর কেন্দ্রে আছে ধর্ম রক্ষার নামে ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধকে সমর্থন।
কিন্তু এই ধর্মগ্রন্থগুলো তো এই সময় লেখা হয়নি, কয়েক হাজার বছর ধরে সেগুলো আছে। ধর্মগ্রন্থের প্রভাবমুক্ত হয়ে আমরা তো ক্রমশঃ সভ্যভব্য ভাবেই বাঁচছিলাম। মানব সভ্যতা ক্রমশঃ ধর্মের প্রভাব মুক্ত হয়ে আসছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকেই ইরাক, ইরান, মিশর সর্বত্র আধুনিক প্রগতিশীল বাম ভাবধারার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলন ছিলো উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন থেকে উদ্ভুত। তারা বুঝেছিলেন উন্নয়নের জন্য চাই আধুনিক রাষ্ট্র। হোসেন মুবারক থেকে বাথ পার্টি, সব এই চিন্তাধারার ফসল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তেলের আবিষ্কারের ফলে একদিকে যেমন এই দেশগুলোর রাতারাতি সম্পদশালী হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তেমনি এই তেলের ভাণ্ডারই মুসলিম বিশ্বের প্রগতির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্ত দেশের বাম ভাবধারার সরকারগুলো চেয়েছিলো তেলের খনির জাতীয়করণ। কিন্তু তেলের খনি লুঠের পথ প্রস্তুত করতে ব্রিটেন এবং অ্যামেরিকা মধ্যপ্রাচের প্রগতিশীল আন্দোলনকে খুন করে। সাদ্দাম হোসেনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল আমরা সবাই দেখেছি।
ইউরোপের উন্নয়ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফসল, ফলে এই দেশগুলোর সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানমনস্কতা থাকতে বাধ্য। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে এক দিকে যেমন প্রগতিশীল আন্দোলনকে খুন করা হয়েছিল, তেমনি ইসলামী ভাবধারার ও শরিয়াপন্থীদের ক্ষমতায় আসতে মদত দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা ও শ্রম ছাড়াই আরাম ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ পেয়ে গেলে যা হয় মধ্যপ্রাচ্যে এই সময় তাই হয়েছিল। হঠাৎ তেলের টাকায় ধনী হয়ে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্য আবার বেশি বেশি করে কোরআন ও হাদিসের চর্চায় মেতে ওঠে। ইউরোপ ও আমেরিকার মদতপুষ্ট ইসলামী ভাবধারার সরকারের এই পরিস্থিতি অপছন্দ হবার কারণ ছিল না, বরং তারা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ইসলাম প্রোমোটিং শুরু করে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের শিরায় ধমনীতে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ভারতবর্ষে এর সুযোগ নেয় এতোদিন পাত্তা না পাওয়া হিন্দুত্ববাদী শক্তি। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে বাম মূল্যবোধ তখন এত শক্তিশালী ছিলো যে একঘরে হয়ে যাবার ভয়ে তেরো দিনের সরকারকে কেউ সমর্থন করেনি। কিন্তু এই সময়ের হিন্দুত্ববাদ কোনো ক্রিয়া নয়, এটা ইসলামের প্রতিক্রিয়া। ইসলামকে প্রোমোট করা চলতে থাকলে হিন্দুত্ববাদ নিশ্চিন্তে টিকে থাকবে। ফলে যে সব সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলতে মানুষ লজ্জা পেতো ক্রমশ সেগুলো বৈধতা পেতে শুরু করলো।
এই সময় আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় কর্পোরেটদের ভারতের সরকার পাল্টানো খুব দরকার হয়ে পড়েছিল, কারণ যে সরকার ছিলো সে অর্থনৈতিক সংস্কারের চাকা জন আন্দোলনের ভয়ে কর্পোরেটদের কাঙ্ক্ষিত গতিতে চালিয়ে যেতে পারছিলো না। তাই কর্পোরেটদের এমন একটি সরকার দরকার ছিলো যে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে দিতে পারবে অথচ মানুষ বাধা তো দূরের কথা বরং খুশি হয়ে বলবে "উনি যখন করেছেন মঙ্গলের জন্যই করেছেন।"
ফলে পরিকল্পিত ভাবে ঘৃণার চাষ শুরু হলো। যতটা সম্ভব আধুনিক প্রযুক্তি ও সোস্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে। সেই চাষের ফল এখন ফলছে। কোনো এক মোবাইল অ্যাপে ভারতবর্ষের শিক্ষিত হিন্দু যুবকেরা মুসলমান মেয়েদের সম্ভ্রম নিলামে তুলছে। আরো কতো কি যে হচ্ছে। কোনো অ্যাপে কোথাও একই রকম শিক্ষিত মুসলমান যুবকেরা হিন্দু মেয়েদের সম্ভ্রম নিলামে তুলছে কিনা জানিনা।