লকডাউনে জনজীবন বিপন্ন হওয়ার ছবি আমরা সবাই দেখেছি, সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টায় মৃত্যুর স্মৃতি এখনো তাজা।
দেখা যাক, রাজনীতি কীভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তার নমুনা। কীভাবে সংক্রামক রোগটিকে (যার মৃত্যুহার ভারতে ১.১৮%, পশ্চিমবঙ্গে ১.৫৯%, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা শ্রেয়) নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে ও হচ্ছে। সূত্র: https://g.co/kgs/T3CrVZ
হঠাৎ কেন করা হলো লকডাউন? ২০১৯ সালের শেষের দিকে CAA, NRC, NPR বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছিল। বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলি দিন রাত এক করে মিছিল, সমাবেশ করে জনমত সংগ্রহ করছিল, সরকার চাপে পরছিল। এই সময়ে সরকারের দরকার ছিল সবকিছু থামিয়ে দেওয়ার মতো ব্রহ্মাস্ত্র, এই ধারাবাহিক আন্দোলনের শৃঙ্খলটাকে ভেঙে দেওয়ার।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে করোনায় আক্রান্তের খবর আসতে থাকে। ২৭ শে জানুয়ারি ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা জানাজানি হয় ( কেরলের ২০ বছর বয়সী একজন মহিলা)। তার আগে থেকেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, বা বলা যায় ছড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রোগ কিছুটা ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করা হয়েছে। তারপর হঠাৎ কোনোরকম পূর্ব অবগতি ছাড়াই ২৫ শে মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
এর ফলে বাইরে বেরোনো সমস্যার হয়ে গেলো। যে মানুষটার 'দিন আনা দিন খাওয়া', যে মানুষটা দৈনিক মজুরী ভিত্তিক কাজ করে, তার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারখানাগুলোয় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় ন্যূনতম ভর্তুকি না দিয়ে। দেশের নানা প্রান্তের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা 'পরিযায়ী শ্রমিক'দের দুর্বিষহ জীবন। বাড়ি ফেরার পথে মৃত্যু, অনাহারে মৃত্যু, পুলিশের লাঠি।
আর এসবের মূল লক্ষ্য, পরোক্ষভাবে NRC, CAA, NPR জাতীয় অপ-আইনের বিরোধীতামূলক আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে দমন করা। আর তা করা হয়েওছে। এই আন্দোলনহীন সময়ে (আন্দোলন হলেও লকডাউনের জন্য যা ডিজিটাল ভাবে হয়েছে, ব্যাপ্তি পায়নি বা আটকে দেওয়া হয়েছে) অনেকগুলো জনস্বার্থ বিরোধী বিল পাস করা হয়।
এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP) ২৯ শে জুলাই, ২০২০ তে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদে পাস হয়। এই আইন চালু হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের পথে এগোবে। এরপর, আনলকে পুনরায় নিয়মমাফিক জীবনে অভ্যস্ত হতে মানুষের সময় লেগেছে। আর সেই সময়েই ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখ লোকসভা ও তার পরের দিন রাজ্যসভায় পাস হয়ে যায় The Industrial Relations Code, 2020. যার ফলে মালিক পক্ষের হাতে সরকার তুলে দেয়, ইচ্ছামত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অধিকার। যার জন্য কাজ হারায় অনেক শ্রমিক।
এই সময় তিনটি কৃষি বিল উপস্থাপনা করা হয়, কর্পোরেট দালালদের সুবিধার্থে, কৃষকদের সাথে আলোচনা না করেই। যাদের গালভরা নাম —
১) The Essential Commodities (Amendment) Bill, 2020 ( চাল, ডাল, আটা, আলু, পিঁয়াজ প্রভৃতি ২০টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ গেল। এছাড়া, কোনো সংস্থার পক্ষে এই সমস্ত পণ্য মজুতির সর্বোচ্চ সীমা রইল না। ফলে যে কেউ অত্যধিকহারে উক্ত পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করতে পারে ও বেশি দামে তা বিক্রয় করতে পারে, এক্ষেত্রে সরকারকে জবাবদিহির বাধ্য থাকলো না সে বা তারা। )
২) The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020 ( নীলকর সাহেবদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া কৃষকদের দুর্গতির কথা আমরা সবাই জানি, এটা তারই আধুনিক রূপ। কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর, চুক্তি অনুযায়ী ফসল উৎপন্ন না হলে বা উৎপন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে না। ),
৩) The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020 ( ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নিজেরা সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল কিনতে পারবে। ফলে, পূর্বের স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকদের জন্য খরচের দেড় গুণ দামে বিক্রয়মূল্য সংক্রান্ত সুনিশ্চিতকরণের দায় সরকারের রইল না। )
এই মারণ বিলের বিরোধিতায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা ৯ই আগস্ট, ২০২০ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের রাস্তা নেন। পরে অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা এতে যোগ দেন। তাঁরা দিল্লির সিংঘু ও টিকরী বর্ডারে বর্তমানে বিক্ষোভরত। কিন্তু লকডাউন ও তৎপরবর্তী আনলকের ফলে বেশিরভাগ অঞ্চলে এই আন্দোলন নৈতিক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি। এরই মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর ও ২০ শে সেপ্টেম্বর যথাক্রমে লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই জনবিরোধী বিল পাস হয়ে যায়। আন্দোলনকে 'অশান্তিকর' দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে ভুয়ো তথ্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের 'আন্দোলনজীবী' আখ্যা দিয়েছে।
লকডাউনের শেষে নতুন খেলা শুরু হলো, আনলক। মানুষের মনে করোনার ভয় কমলেও, স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হলো। কিন্তু সিনেমা হল, শপিং মল সব কিছু খোলা রইল। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কী করোনা আসে? অনলাইনে ক্লাস হওয়াতে ৯১% ছাত্রছাত্রী, যাদের অনলাইনে পড়ার সুযোগ নাই, তারা বঞ্চিত হতে শুরু করলো। প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো ইন্টারনেট সহযোগিতা পৌঁছায়নি। তাছাড়া, সবার আধুনিক মোবাইল কেনার মত অর্থের অবস্থাও নাই। তাহলে তাদের কী হবে? অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা এই অনলাইন পড়াশোনার চাকায় পিষে লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, প্র্যাক্টিক্যাল বা হাতে কলমে শিক্ষা। অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিজে হাতে না শিখলে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাওয়া অসম্ভব। সেসব ক্ষেত্রে, যাদের অর্থ আছে, যারা বিত্তশালী, তারা বিভিন্ন অনলাইন এডুকেশনাল অ্যাপ থেকে শিখতে পারবে, বাড়িতে প্র্যাক্টিক্যালের সামগ্রী কিনে। কিন্তু যারা সেই প্রিভিলেজ পায় না, তারা কি করবে?
১২ই ফেব্রুয়ারি,২০২১ বাংলায় স্কুল খুললেও কলেজের কোনো কথাই নাই। আবার, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছে, ২০ শে এপ্রিল, ২০২১ (আজ) থেকে স্কুল বন্ধ গরমের ছুটি হিসাবে। এদিকে কলেজ তো খোলেইনি। কিন্তু অফলাইনে যেমন ফিজ নিত, ঠিক তেমন হারেই ফিজ নিচ্ছে কলেজগুলো। তার মধ্যেও একটা ক্লাসও হয়তো ঠিকমতো হচ্ছে না। মানে, মোবাইলের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, নেটের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, আবার কলেজের অন্যায্য ফিজও আপনাকে দিতে হবে। এই আর্থিক প্রতিযোগিতায় কতজন পেরে উঠবে? এর মধ্যেই কখন নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়ে যাবে জানতে পারবেন না। শিক্ষা বেসরকারিকরণের সমস্ত ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে।
আনলক-লকডাউন খেলার সুযোগে একের পর এক বিল এভাবেই পাস হয়েছে। বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারিকরণ হয়েছে একাধিক সরকারী সংস্থা ও ব্যাংকের। রেল, বিমান বেসরকারী হয়েছে। BPCL, NEEPCO, শিপিং কর্পোরেশন, Concor ইত্যাদি সংস্থাও বেচে দেবার উদ্যোগ চলছে।
এর বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, মানুষ বুঝতে শুরু করেছে কেন্দ্র সরকারের কর্পোরেট দালালির স্বরূপ। পূর্বোক্ত আইন ও বিলগুলির বিপক্ষে প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, NRC-CAA-NPR এর ইস্যু নিয়ে আবার সবাই কথা বলতে শুরু করেছে। আর তাই শাসক ভয় পাচ্ছে। আবারও করোনা আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে। শীঘ্রই লকডাউন করার কথা ভাবা হচ্ছে। দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের তুলিয়ে দিতে পারে কেন্দ্র কোভিডের জুজু দেখিয়ে — এমনটাই আশঙ্কা করছেন অন্নদাতারা ( সূত্র — বর্তমান-২০/০৪/২০২১)। এটা বলাই যায়, তাঁদের আশঙ্কাই সত্য।
২০২০ সালের সেই ভয়াবহ দিনগুলো ফেরৎ আসতে চলেছে। দিল্লিতে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে, অন্য জায়গায় হতে দেরি নাই। বিভিন্ন জায়গায় থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁরা জানেননা, কীভাবে সংসার চলবে, কী খাবেন, খেতে পাবেন কিনা, তাই অনিশ্চিত।