এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দেবানন্দের মেয়ের বিয়ে

    gautam roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৪৪৬ বার পঠিত
  • শীতের শুরুতেই বেশ ভালো ট্যাংড়া মাছ পেলাম ভাইয়ের কাছে। ভাই। নামটা তার পোষাকি, না নিকনেম - জানি না। জানার চেষ্টাও করি নি কখনো। মাছওয়ালা। ভাটপাড়ার ধুনি মুখুজ্জের রোয়াকে বসে মাছ বেচে। ট্যাংড়া মাছ দেখলেই আমি বড্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। শীতের বড়ো তেলালো ট্যাংড়া বড্ড ভালোবাসতেন জ্যোতিবাবু। নৈহাটি বাজারের সুকুমারদার কাছে একটা সময় ছিল, যখন শীতে বড় ট্যাংড়া আসলেই তা থেকে খানকতক যেত ইন্দিরা ভবনে। কিন্তু দুটো থেকে তিনটের বেশি পাঠালেই জয়কৃষ্ণ ঘোষের মৃদু বকুনি খেতে হতো। বলতেন; সাহেব ভালোবাসেন, তাই খেয়ে ফেলেন, সহ্য করতে পারেন না এই বয়সে। একদম বেশি পাঠাবেন না। সেইসব দিন এখন সোনালী অতীত। ম্যারি হফকিনকে গানে গানে অবচেতন মনে স্মরণ করতে করতে ধুনি মুখুজ্জের সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়েই দেবানন্দের সঙ্গে দেখা।

    দেবানন্দ আমাদের পাড়ার নরসুন্দর। বাংলাতে এতো সুন্দর উপহাসের বিশেষণটি সে জানে কি না, জানি না। তবে তার মুলুক, বিহারের ছাপড়া জেলার পিপড়হিয়া গাঁয়ে তাঁর পরিচিতি 'নও ঠাকুর'। জাতপাতের দীর্ণতায় জর্জরিত আমাদের সামাজিক কাঠামোতে, আধুনিক রাজনীতির বেরাদরিতে সে এখন 'পিছড়ে বর্গ'। তবে এই নরসুন্দর পিছড়ে বর্গের হাতের জল, উচ্চবর্ণ এখনো না খেলেও, পালাপার্বণে এই 'নও ঠাকুরে' র মাধ্যমে পান, সুপুরি সহ 'নেওতা' না পেলে, উচ্চবর্ণের সামাজিকতা এখনো ঠিক মতো রক্ষা পায় না।

    এই হেন দেবানন্দকে দেখে প্রথমটায় আমি নিজের প্রয়োজনটা বলতে গিয়েও একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম। কদিন আগেই ওঁদের ছটপুজো গেছে। জাতপাতের বিদীর্ণতায় বিহারের সামাজিক কাঠামো যাই থাক না কেন, 'ছট পুজো' সেখানকার প্রায় সব মানুষ ই করেন। উত্তরপ্রদেশে আবার এই পুজোর প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। 'এক দেশ, এক ভোট' এর শ্লোগান দিয়ে ভারতের ধারাবাহিক সমন্বয়বাদী, বহুমাত্রিক সংস্কৃতিকে নরেন্দ্র মোদি যতই ঢেকে দিতে চান না কেন, বহুত্ববাদের শেকড় গোটা ভারতেই কতোটা গভীর রয়েছে, আমাদের দেশের যে কোনো প্রান্তের, যে কোনো ধর্ম, ভাষাবলম্বী মানুষ কে দেখলে তা মালুম হয়।

    এইসব বৈচিত্র ঘিরে ভাবার আগেই দেবানন্দের মুখোমুখি পড়ে যাওয়াতে আমার শহুরে বেড়াদরির অস্বস্তিটা চাগিয়ে উঠল। কারন, দেবানন্দ ছট পুজোর জন্যে প্রতি বছরের মতোই কিছু টাকা নিতে এসেছিল। যেটুকু পেরেছি, দিয়েছি। তারপর ও সে নাকি কয়েকবার এসেছে, বাড়ির মানুষদের কাছে শুনেছি। তাই ধরেই নিয়েছিলাম, যে কটা টাকা ওঁকে ছট পুজোর দিন দিয়েছিলাম, তাতে ওঁর মন ভরে নি। আরো টাকা সে চায়। আর সেই জন্যেই রোজ রোজ আসছে। একটু বেজার মন নিয়েই একদিন দরজা খুলতেই দেবানন্দ বললে, আপনার নখ কাটার কথা বলেছিল। তাই আসছি।

    আসলে আমি পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ আজকালকার নেইলকাটারে কাটতে পারি না। নরুন ছাড়া কাটা যায় না আমার পায়ের বুড়ো আঙুলের শক্ত নখ। আর দেবানন্দ ছাড়া এই তল্লাটের কোনো নরসুন্দরের কাছে মেলে না নরুন। আমাদের এই একদা চটকলের জৌলুষে ভরা, এখন সব দিক থেকে ঝিমিয়ে পড়া মফস্বল শহরে নখ পরিচর্যার আধুনিক, চোখ ধাঁধানো দোকানপত্তর, যাকে কি না পার্লার বলে, তেমন কিছু হয়েছে কি না, তার সুলুক সন্ধান জানি নে বলেই দেবানন্দের নরুনই আমাদের মতো আধা বুড়োদের ভরসা।

    দেবানন্দ নখ কাটার জন্যে এলেও আমি ধরে নিয়েছিলাম, ছট পুজোর জন্যে যে সামান্য টাকা দিয়েছিলাম, তাতে সে অখুশি। আরো বেশি টাকার দাবি নিয়েই সে বার বার আসছে। আসলে আমরা তথাকথিত মধ্যবিত্তেরা, যাঁদের ভিতরে একটু শহুরে কতদারি মিথ্যে ঠমক আছে, অথচ গমক নেই, সেই রকম মানুষেরা এই দেবানন্দের মতো মানুষদের ঘিরে নিজেদের দর্প দেখাতে সব সময়েই একটু বেশি মাত্রায় মটমট করি না।

    কিন্তু দেবানন্দকে ছাড়া যে আমাদের চলবেও না।পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ বেশ বড়ো হয়েছে। হোঁচোট খেলে যে কোনো সময়ে ভেঙে গিয়ে একদম রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যাবে। মনের হোঁচটের জের বেশি শক্তিশালী, না কি পায়ের বুড়ো আঙুলে হোঁচটের জের বেশি শক্তি ধরে? - এই তৈলাধার পাত্র, না, পাত্রাধার তৈলের বিচার না করে ধুনি মুখুজ্জের রোয়াক থেকে রাস্তায় নেমে দেবানন্দকে দেখেই বলে ফেললাম, পায়ের নখের চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বাড়ন্তের কথা।

    একটু যেন কাচুমাচু মুখ করে দেবানন্দ বললে; দুদিন পরে যদি যাই, খুব অসুবিধা হবে দাদা? অসুবিধা হোক, না হোক, একটু নখ কেটে বিশ, তিরিশ টাকা উপায় করলে সংসারে একটু সুরাহা হয় দেবানন্দের। তাই সকাল থেকে পড়ন্ত দুপুর পর্যন্ত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের পাড়ায় পাড়ায় টহল দেয় দেবানন্দ। আমাদের বাবাদের প্রজন্ম, যাঁরা চুল কাটার বাহার নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতেন না বয়সকালে, তাঁরা ছিলেন দেবানন্দের নিয়মিত খরিদ্দার। সেই প্রজন্ম তো কালের গতিতে প্রায় হারিয়েই গেছে। আজকের প্রজন্ম তো কোন ছাড়, আমাদের মতো মাঝ বুড়ো, এই ঘরকা না ঘাটকা প্রজন্ম ও দেবানন্দের মতো মান্ধাতার ঠাকুর্দার আমলের নরসুন্দর কে দিয়ে চুল ছাঁটাতে চায় না। ফলে দেবানন্দ, দেবানন্দের মতো দু চারজন মানুষ, নরসুন্দরের বৃত্তিকে আঁকড়ে এখনো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, চুল কাটতে কাটতে বেশ এ পাড়া ও পাড়ার খবর দেয়, এই প্রজন্মটি যে কি ভয়ঙ্কর আর্থিক দুরবস্থার ভিতরে দিন গুজরান করছে, তার তত্ত্বতালাশ করার সময় সরকার থেকে রাজনীতির লোকেদের কোথায়? তাই পারলে রাস্তায় ধরে বেঁধেই নখ, দাড়ি, চুল কেটে দিতে চাওয়া দেবানন্দ কেন বললো, দু চার দিন পরে আসব?

    আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে দেবানন্দ নিজেই বলল; মেয়ের বিয়ে। জানতে চাইলাম, জামাই কোথায় থাকে? কি করে? জবাব পেলাম; ধানবাদের দিকে। রাজমিস্ত্রী। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের জাতপাতের দীর্ণতাকে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতে জয় করেছে দেবানন্দ। তাই সাহস করে নিজে নাপিত হয়েও ভুজারের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে মেয়ের।

    বিয়ের দিন, দুপুরে বাজার করে ফিরছি, দেখলাম; দেবানন্দ একজন সাথীকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি মুখো চলেছে। একটা ছোট পলিব্যাগে সরু একটা রজনীগন্ধার মালা আর কিছু ফুল।একঝলক দেখে মনে হল, বাবুদের বাড়ির বে তে যেমন ছাৎনানাড়া ফুল থাকে আর সেটা নাপিতেরই ক্রিয়ার অঙ্গ, তেমনই একটা ছোট্ট ফুলের তোড়া। হয়ত দেবানন্দের পিতৃহৃদয় মেয়ের মঙ্গলকামনায় 'বাবু' দের এই টুকুই অনুকরণ করবে। এর বেশি তার সাধ্য কোথায়?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন