ভালো করে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গেঞ্জি পাজামা পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে অনি শোনে রুপা ফোনে কাউকে উঁচু গলায় কি একটা বলছে। নির্ঘাত অজয়। অজয় মাঝে মাঝে এসে থাকত এখানে, রুপা প্রথম দিকে তেমন আপত্তি করে নি। অনির আত্মীয়, কলকাতায় আসতো কি একটা কাজে। এক দুদিন তারপর চলে যেত। টাকাও দিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার, বিভিন্ন প্রয়োজনে। একবার গোল টেবিলে রাতের খাওয়ার মাঝপথে অজয়ের প্রবল বমি, সঙ্গে মদের গন্ধ, অনি কোনোরকমে অজয়কে ধরে শুয়িয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখে রুপা গালে হাত দিয়ে বসে আছে অজয়ের ফেলে যাওয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রায় পনেরো মিনিট চুপচাপ বসে থাকার মাঝখানে অনি দুটো সিগারেট শেষ করে এবং শেষমেশ রুপা কোনো কথা না বলে ঘরে চলে যায়।
‘অজয় টাকা চাইছিলো, এখন হবে না বলে দিয়েছি’, রুপা গিয়ে বেসিনে ভালো করে হাত ধোয়। ‘বাথরুমের টিউবটা খারাপ হয়ে গেছে?’, অনি বলে। রুপা কথাটা শুনতে পায়নি এরকম একটা ভাব করে বাড়ি থেকে বেড়োবে বলে দরজার দিকে এগোয়। ‘কি ব্যাপার, কোথায়?’, অনির কথা শেষ হওয়ার আগেই রুপা বলে, ‘ব্লিচিং দিতে হবে বাড়ির চারপাশে! চা খাবে পড়ে, অরুণাচলের মাঠটা একবার দেখে এস আগে’, রুপা সেই জেদ ধরে আছে। অনি বুঝতে পারে ওকেই বাড়ি থেকে বেড়োতেই হবে। হপ্তা খানেক আগে অনেক বুঝিয়েও কোনো কাজ হয়নি, বেড়োতেই হয়েছিল অগত্যা। ফ্রিজটা খুলে দুটো স্লাইস কেক মুখে দেয়, মাস্কটা মুখে বাঁধে, মানিব্যাগ ও মোবাইলটা পকেটে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। ওদের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে যে রাস্তাটা মোড়ের মাথায় চলে গেছে, আগের বারের সন্ধ্যাবেলার মত এখন এই সকালেও পাবলিক টিউবওয়েলটার সামনে বেশ জটলা। এই জিনিস আজকাল আর বেশি দেখা যায় না, কর্পোরেশন থেকে প্রায় অধিকাংশই বন্ধ করে দিয়েছে। অনিদের রাস্তায় এটা কিভাবে যেন এখনও রয়ে গেছে। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। কমিউনিটি হালটার কাছে যে সিগারেটের দোকানটা সেটা আগেরবারের বন্ধ ছিল, এখন অর্ধেক দরজা বন্ধ, এখানে দাড়িয়ে একটা দুটো সিগারেট শেষ করে বাড়ি ফেরা যায়। অনি মাথার চুলে একবার হাত বোলায়। বিশ্বের তাবৎ পণ্ডিত, আগুন-খেকো আঁতেল থেকে শুরু করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব থেকে বড় ডন যে দোকানে গিয়ে নিজের মাথাটা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয় সেই সেলুনগুলো যে কবে খুলবে সেইটে সবচেয়ে অনিশ্চিত। লক্ষ্মীকান্তর সেলুনের দোকানটা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওই বাঁকটা ঘুরলেই। গলির ভেতরের দোকান, অনি অনেক সময় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে বেশ রাতের দিকে ওর সেলুনে যেত দাড়ি কাটানোর জন্য। তিনটে পরপর সিট, সামনেরটার উপর আলো জ্বলছে শুধু, ভিতরের বাকি দুটো সিট অন্ধকারে ঢাকা। ‘দাদা!, বসেন’ বলে লক্ষ্মী অন্ধকার থেকে মাঝেমাঝেই বেড়িয়ে আসত। গ্লাস রাখার শব্দ, ঢেকুর তোলার সঙ্গে মুখে গন্ধ। এসে গামছাটা বুকের উপর বিছিয়ে দেওয়ার আগে গলাটা দুহাতে চেপে ধরত। অনি গোড়ার দিকে দুয়েকবার একটু দোনোমনা করে বুঝেছে, যেকোনো অবস্থাতেই কেনা মাথার উপর লক্ষ্মীর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত। অনি সিগারেট না কিনে মোড়ের মাথার দিকেই এগোয়। ‘কি ব্যাপার এই রাস্তায় তো তোমায় তেমন দেখি না!’, ফ্ল্যাটের মুখার্জীকাকু, চোখে কৌতূহলী চাহনি। অনি কোনো কথা না বলে মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই, উনি নিজেই বলেন, ‘দীপ্তির পাইলসের সমস্যা, সকাল থেকে প্যান জুড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড, তাই ওষুধের দোকানে গিয়েছিলাম প্র্যাক্টসিডল কিনতে, প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেড়োতে হবে তো, সেটা খুঁজে পেতে গলদ ঘর্ম অবস্থা’। অনি এই না জানতে চাওয়া কৈফিয়তের কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় মুচকি হেসে ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। সবগুলো দোকান বন্ধ, লোক প্রায় রাস্তায় নেই বললেই চলে, এক প্যাকেট সিগারেটও কেনা যাবেনা তাহলে! ডানহাতে অরুণাচলের মাঠটা শনিবারের এই সকালে ধুধু ফাঁকা, হপ্তা খানেক আগেও এই মোড়ে পুলিশ ছিল না, আজও নেই। অনি মোড়ের মাথা থেকে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখে, না, আজ গাঙ্গুলিবাগানের মোড়েও পুলিশ পোস্টিং নেই। গতবার ছিল। রাস্তাটা ক্রস করে উল্টোদিকের গলিটার মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। আগেরবার এই গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছিল। সন্ধ্যার আবছায়ায় মনে হয়েছিল জনমানব শূন্য ওই গলিতে কেবল একজন মাত্র মহিলা! মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। দূরে জঞ্জালের মাঠটার ধারে পেছন ফিরে শাড়ী-সায়া সমেত কোমর পর্যন্ত তুলে বসে অনির দিকেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে যেন! বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করে উঠেছিল অনির, কিন্তু এগোনোর ভরসা পায়নি। গাঙ্গুলিবাগানের মোড়ের দিকে এগোতে এগোতে দুচারবার মুখ ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পায়নি। দুটো পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে ফেরার সময় অনেক আগে রাস্তা পার হয়ে উল্টো-ফুটে চলে যায়, গলিটা ক্রস করার সময়ও ভালো করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায়নি। অরুণাচলের মাঠটার কাছে একটা ফুচকাওলা বসত, সকালে ঘুগনি আলুরদম, রাতে ফুচকা। আভরণহীন মধ্যচল্লিশ একজনকে অনি বহুবার দেখেছে এই ফুচকার দোকানটার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে। ইতিহাস জানা নেই। ফুচকাওয়ালা ছেলেটি একদিন অনি সমেত আশেপাশের সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেছিল ‘ও কিছু না, সকালে দেদার দেনা করে আর রাতে ছেলেধরার কাজ করে!’। রূপা দুদিন আগে জানালো ওই ফুচকাওয়ালা ছেলেটা নাকি ঝুড়িতে করে সবজি নিয়ে বিক্রি করতে এসেছিল পাড়ায়। অনি রাস্তা পেরোয়। অরুণাচলের মাঠটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, বাঁ পাটির দাঁতটা আবার ব্যথা করছে, সামনে একটা ফাঁকা রিকশা আসছে, ওঠার কথা ভাবে না, বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়।
কলিং বেল বাজাতে হয়নি। রুপা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ছিল, গেট খুলে দেয়। অনি মানিব্যাগ মোবাইল টেবিলে রেখে সোজা বাথরুমে চলে যায় ভালো করে হাতপা ধুতে। বাথরুমের রডে নতুন জামাকাপড় রেখে গেছে রূপা, সেগুলো পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে একটা ঘর মোছার কাপড় হাতে বাথরুমের দরজার সামনে রূপা দাড়িয়ে রয়েছে। অনি বেড়োতেই বলে, ‘ছাদটা একবার দেখে এসো, সামনের দরজায় এখনও তালা দেইনি‘, চোখে মুখে তীব্র উৎকণ্ঠা। অনি বোঝে এটা রুপার নতুন গন্তব্য, নিজে যাবে না। রুপা ঘর মোছার বালতিটায় জল ঢালছে বাথরুমে ঢুকে, মাস্কটা আবার মুখে পরে ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ায় অনি। আজ থেকে আট বছর আগে অনি এই ফ্ল্যাটটা যখন কিনেছিল তখন অনিরা ছাড়া আরো তিনটে ফ্ল্যাটে লোক ছিল। এখন সব গুলি বিক্রি হয়ে গেছে এবং পুরানো লোকের যায়গায় নতুন লোকও এসেছে। গত এক মাস ধরে কেউ কারো মুখ দেখে না অবশ্য। মুখার্জী কাকুদের ফ্ল্যাটের বাইরের দেওয়ালে টাঙ্গানো এক বৃদ্ধের ছবি দেখে অনি ভেবেছিল বোধহয় মুখার্জীকাকুর কোনো পূর্বপুরুষের ছবি। বাপ ঠাকুরদার ছবি কেউ এইভাবে বাড়ির বাইরে টাঙ্গিয়ে রাখে! ওনার কোনো গুরুটুরুর কথাও তো জানা নেই। একদিন অনির কৌতূহলী দাঁড়িয়ে থাকা কি ভাবে যেন টের পেয়ে কাকু হঠাৎ দরজা খুলে মুখ বার করে বলেন, ‘গিরীন্দ্রশেখর বসু, তোমাদের মতো সেলফ প্রোক্লেইমড ইন্টেলেকচুয়ালদের জানা উচিৎ ইনি ইন্ডিয়ান সাইকোএনালিটিক সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে উনি ইডিপাস কমপ্লেক্স নিয়ে…ভাবো ইডিপাস কমপ্লেক্সের নন-ওয়েস্টার্ন আর্গুমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ কুড়ি বছর পত্রালাপ করেছিলেন! তা গেঁয়ো যোগীদের কথাও একটু জানার চেষ্টা করো’। মারের মুখে অনির মনে পড়েছিল মুখার্জীকাকু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। মানুষ অনেকের বাড়িতে অনেকের ছবি দেখতে পায়, পরিবারের স্বর্গত কারো কিংবা দেবদেবী ইত্যাদি, কিন্তু ইনি এক্কেবারে মৌলিক ! রুপাকে একবার বলেছিলেন, ‘নীল রঙটা তুমি সবসময় এভয়েড করবে।‘ অনি দোতলায় উঠে দেখে বিপুলদের কলাপসিবল গেট খোলা, তার মানে ওরা এখন এখানেই আছে, কবে এলো আবার কে জানে! কাকতালীয় ভাবে অজয়কে একমাত্র এই বিপুলের সঙ্গেই দুয়েকবার কথা বলতে দেখেছে অনি। বিপুলের সঙ্গে যে মেয়েটি থাকে সে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারের সেক্রেটারি। ওদের লেক গার্ডেনসের ওদিকে নাকি আরেকটা আস্তানা আছে। এই ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে আসে, যখন আসে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসে এবং টানা বেশ কিছুদিন থাকে। ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে, শীৎকার? এই সকালে? অনি জিভকাটে। কিংবা বাইরে বেড়োতে না পারা মানুষের হোমওয়ার্ক! পর্ন সাইট গুলোতে ট্রাফিক নব্বই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কদিন আগে মোবাইলে দেখেছে এই স্টেটিস্টিক্স। অনি দ্রুতপায়ে উঠে যেতে থাকে ছাদের দিকে। ছাদের দরজা অল্প খোলা দেখতে পায়, ঠেলে ঢোকে ছাদে। এই সকালে শেষ কবে ছাদে এসেছে মনে পড়ে না। উল্টোদিকের বাড়ির বাগানের নারকেল গাছটা এখনও প্রায় ছাদ ছুঁয়ে রয়েছে। পুরো ছাদটা একবার ঘুরে উকি মেরে নীচে সেফটি ট্যাংকের দিকটা দেখে। চারপাশ থেকে নিচে তাকিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় কোথাও কাউকে দেখতে পায় না। মাথার উপর ওভারহেড জলের ট্যাংক। নীচের কলটা খুলে জল দিয়ে হাতটা ধোয়। জলের মধ্যে পাথর পড়ার মতো একটা শব্দ হচ্ছে না? কোনো মানে হয়না ওভারহেড ট্যাংকটা দেখার। কিন্তু একটা শব্দ হচ্ছে জলের মধ্যে! অনি হাঁটু মুড়ে নিচু হয়ে ট্যাঙ্কের স্ল্যাবের নীচের দিকে তাকায়, কয়েক সেকেন্ড কান পেতে থাকার পর শব্দটা আবার শুনতে পায়, উপর দিকে তাকায়, উঁহু কিছু একটা! অনির উপরের পাটির ডানদিকের শেষের দুটো দাঁতের এক্সরে প্লেটটা চোখে ভেসে ওঠে, যাদবপুর স্টেশনরোডের শেষ মাথার পক্বকেশ সেই ডাক্তার, ‘খুব ব্যথা করছে, করবেই তো, কত দিনের জমা মাল, হঠাৎ ব্যথা শুরু হয়, রুট ক্যানেল করতে হবে অ্যানেস্থেসিয়া করে’। অনি শুনেছে কলকাতায় নাকি একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি চীন থেকে আকুপাংচার শিখে এসেছিলেন, সে অনেককাল আগের কথা। উনি সূচ ফুটিয়ে লোকাল এবং ফুল বডি অ্যানেস্থেসিয়া দুটোই করতে পারতেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সূচ ফোটানোর পরে মোক্ষম সেই নিউরাল পয়েন্টটায় শেষ সূচটা ফোটাতেন যার পরে রোগীর আর কোনো জ্ঞান থাকতো না। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং রিস্কি ছিল জ্ঞান ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি। কিন্তু এখানে যা হয়, কোনো উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি।
ওভারহেড ট্যাংকের শব্দটা, অনি জানে দাঁতের ব্যথাটার মতই সত্যি। উঁচু স্ল্যাবটায় পা দিয়ে উপরে ট্যাংকের দিকে ওঠে, এত উপরে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ আসতে পারে কি? অনি যেন দেখতে পায়, রুপা সারা বাড়ি ধুয়ে বেড়াচ্ছে, হাত ধুচ্ছে মাঝে মাঝে, মুখ থেকে মাস্কটা একবার খুলে রাখছে আবার পরছে, ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে উকি মেরে দেখছে উপরের দিকে। দাঁতের উপরের পাটি, শেষ দুটো দাঁত বেশ ব্যথা করছে, পক্বকেশ অজস্র সূচ হাতে এগিয়ে আসছে, ট্যাংকের শব্দ, অনিমেষ জানে কোনো মানেই হয়না, তবুও একদম মাথায় উঠে পরে, দুহাত দিয়ে ট্যাংকের মুখের ঢাকনাটা আস্তে আস্তে টানতে শুরু করে।
[এই গল্পটি ইতিপূর্বে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে 'তবুও প্রয়াস' ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। অতিমারি নিয়ে ত্রয়ী-গল্পমালা সিরিজের দ্বিতীয় গল্প ছিল এটি।]